প্রথম কিস্তি
সকাল দশটা নাগাদ আমরা ল্য প্যারিফ ছাড়িয়ে E5 এ এসে পড়লাম।
ফরাসী বলেই বোধহয় হাইওয়ের নাম বিমূর্ত অক্ষর আর সংখায় থেমে থাকেনি। তাই প্যারিস থেকে ম্যাসি অব্দি রাস্তাটির নাম হয়ে গেছে রোদেলা সড়ক (অতোখুত দ’ সোলেই), আবার ম্যাসি থেকে বর্দো পর্যন্ত এলাকার নামের সাথে মিলে রাস্তার নামও হয়ে গেছে লাকিতেন। হাইওয়েওয়ালারা দয়া করে কিছু পর পর যাত্রীদের থেমে জিরিয়ে নেয়ার জায়গা করে দিয়েছেন। ওরলি পেরিয়ে তারই প্রথমটায় এসে থামলাম আমরা। হাইওয়ে থেকে নামার পর পরই অমুক গ্রিল, তমুক বার্গার এর দোকানে জমজমাট, তবে আরেকটু এগিয়ে গেলে নিরালায় গাছতলায় বেঞ্চি-টেবিল পাতা, কাছেপিঠে বাথ্রুমও আছে। ব্রাশ, পেস্ট আর তোয়ালে হাতে সপরিবারে তার সদব্যাবহার করে এলাম।
রোদ উঠেছে। আমরা যেদিকটায় থেমেছি, সেখান থেকে ফসলের ক্ষেত দেখা যাচ্ছে। শহরের কোলাহল আর শোনা যাচ্ছে না। কচকচে সবুজ ঘাস, সাদা-বেগুনী ঘাস্ফুল আর রক্তলাল পপি পেরিয়ে চোখ চলে যায় হলুদ শর্ষে আর নীলচে সবুজ শস্যের দিকে, বার্লি গম বা এ জাতীয় কিছু একটা হবে। মেঘের ছায়া ভেসে যাচ্ছে হলুদ-সবুজ ঢেউ খেলানো মাঠের অপর দিয়ে। ঠান্ডা তখনো আছে, বাতাস উঠলে টের পাওয়া যায়।
কিছু মুখে গোজার পালা। ফ্রান্স বলে কথা, এখানে পেট্রল পাম্পেও দেখি ক্রোয়াযোঁ আছে পাঁচ ধরনের। তার থেকেই দিস্তা খানেক কুচো সাইজের ক্রোয়াযোঁ, আর দুটো ক্যাফে ওলে নিয়ে ফিরলাম।
রোদে পিঠ ঠেকিয়ে মুচমুচে সুড়ুত সুড়ুত।
--
ফ্রান্স দেশটি ২৬ টি জেলা (Région) ও একশতটি থানা (Département)নিয়ে গড়া। প্রশাসনের সুবিধার জন্য নেপোলিয়নের আমলেই এটি গড়া। প্রতিটি থানা আবার কয়েকটি কমিউন নিয়ে। প্রাথমিকে পড়া সেই কয়েকটি মহল্লা লইয়া একটি গ্রাম, কয়েকটি গ্রাম লইয়া একটি ইউনিয়ন – এর মত। ফ্রান্সের হাইওয়েতে এক থানা থেকে আরেক থানায় ঢোকার পথে রাস্তার ডানদিকে বাদামী বোর্ড জানান দেয় এই থানার লোকজন কি নিয়ে গর্ব করে। সাবেকি আমলের প্রাসাদের নামই বেশী দেখি – অমুক শাতো, তমুক পালেই। তবে ব্যাতিক্রম আছে। চলতে চলতে আমরা জেনে গেলাম যে শাখেন্ত্ থানাবাসী কনিয়াক ছাড়াও নাগড়ার মত এক ধরনের নরম পাদুকা বানিয়ে থাকেন। যিখন্দ্ থানার বর্দোকে সবাই চিনি শাতো লাফিত-খত্শিল্ড বা শাতো মার্গোর বেহেশতি লাল মদিরার জন্য, তবে বোর্ডে বোতলের পাশে মিরায ২০০০ এর ছায়া বলে দিল এই জেলাতে ফরসী বিমান বানানেওয়ালা দেসো’ র কারখানাও আছে। তবে ফোয়া গ্রা’ র হাঁস দেখা গেল না কোন বোর্ডে।
--
যিখন্দ্ এর পরের থানাগুলির নামটা কি মনে নেই, তবে এদেরকে একসাথে পেঁয়াজু নামে ডাকা চলে নির্দ্বিধায়।
একটু পর পর সরকারি লোক রাস্তা আটকে নিয়ে সারে সারে স্টিলের আলমিরার ফাঁকে ফাঁকে লাল সাদা তক্তা গেড়ে বসে গেছে। এরা গাড়ী ট্রাক সবার থেকে দেদারসে টাকা তুলে নিচ্ছে। এর নাম এরা দিয়েছেন পেয়ায (Peage)। একশো কিলোমিটার পেরোলাম কি একদল পেঁয়াজু, আবার পঞ্চাশ পেরোলাম কি আরো একদল পেঁয়াজু। আলমিরার ছাদ বরাবর কি কি সব লাল নীল সবুজ এল ই ডি বাতির সঙ্কেত। এই সঙ্কেতের মহত্ব যদি একটু আগে আমি গবেট বুঝতাম।
প্রথম পেয়াজে অত শত না ভেবে গেলাম একটা আল্মিরার পাশে ঢুকে। জানালার কাছাকাছি গিয়ে দেখি সিট খালি, বাক্সের ডিসপ্লেতে লেখা ‘কার্ড ঢুকাও’। কোন কার্ড? ভাবলাম টাকার কার্ডই হবে। বেখেয়ালে যেখানে থেমেছি, সেখান থেকে আলমিরা অব্দি হাত যায় না, আরেকটু না এগোলে গাড়ির দরজা পুরো খোলে যাচ্ছে না, আর এদের তক্তার কারনে গাড়ীও আরেকটু এগুনো যাচ্ছে না। এরই মধ্যে আমার পিছনে এক একে তিন চারটা গাড়ী লাইন নিয়ে থেমে গেল। সিটবেল্টখুলে কিছুটা আলগা হয়েও কাজ হয় না। তাই গাড়ির দরজা খুলে এক পা গাড়ীতে আরেক পা রাস্তায় রেখে আমার আর নাঈমার মিলে গন্ডা চারেক কার্ড বদলে বলদে গুতোগুতি করছি, আর দেখছি আমাদের পিছনে অপেক্ষারত গাড়ীর সঙ্খ্যা বেড়েই চলেছে। মাথা গরম হয়ে যাচ্ছে। ঠান্ডার মধ্যেও ঘেমে উঠছি। আমার মুখ থেকে মাতৃভাষার কিছু কদাকার শব্দ আমার চেষ্টা ব্যাতিরেকেই ছিটকে ছিটকে বেরিয়ে আসছে। পিছনেরি সিট থেকে আমার ছোট মেয়ে ভয় পেয়ে তারস্বরে ভ্যাঁ করে কেঁদে উঠল। আর তক্ষনই ডান পায়ের ধীর সরন আমাকে মনে করিয়ে দিল যে আমি হ্যান্ডব্রেক তুলিনি।
আমার এই লেজেগোবরে দশা বোধহয় কেই দূর-ক্যামেরায় দেখে থাকবেন, তিনিই সহায় হলেন। বাক্স থেকে গলা খাঁকারি দিয়ে কড়া প্রভন্সাল ফরাসী গলায় বলে উঠলেন, জনাব, আমি কি তোমার কোন সেবায় আসতে পারি? একহাতে হ্যান্ডব্রেকে, আরেক হাতে দুটো কার্ড আর মুখে আরেকটা কার্ড কামড়ে ধরা আমি তো পারলে বাক্সটাকেই আব্বা বলে জড়িয়ে ধরি।
তা সেই আব্বা পেঁয়াজুই এলেন নাকি, অন্য কাউকে পাঠালেন জানিনা। নিতান্তই কেতাদুরস্ত টিপটপ পোষাকের একজন এসে কিসব বোতাম টিপেটুপে আমাদেরই কার্ডগুলোর একটায় রফা করলেন। তারপর বুঝিয়ে দিলেন যে এরপর যেন শুধু যে আলমারির চঁদিতে ম্যানুয়াল লেখা তার পাশ দিয়ে ঢুকি।
সুবোধ গাধার মত ঘারগুজে ওরেভোয়া বলে বেরিয়ে এলাম। পেছনের সিটের ভ্যাঁ ভ্যাঁ ভেপু থামলো আরো কিছু পরে।
এদিকে বাইরে পালটে যাচ্ছে ল্যান্ডস্কেপ আর তাপমাত্রা। বাইরে দেখতে পাচ্ছি ২০ ডিগ্রী। রাস্তার দুপাশে পাইনের বনের ঘনত্ব আর উচ্চতা দুইই বাড়ছে। তবে কিছু পর পর আঙ্গুরের বাগান চোখে পড়ছে।
---
সন্ধ্যা নাগাদ আমরা পিরেনিজকে হাতের বাঁয়ে ফেলে আর আতলান্তিকের সোনালী সৈকতকে ডানে রেখে প্রবেশ করলাম স্পেনে। স্পেনে ঢুকেই গাড়ি থেকে তোলা এই ছবি দুটো ।
কিন্তু গন্তব্যের কাছে গিয়ে মুখটা শুকিয়ে এল। হাইওয়ে থেকে নেমে পাহাড় জংগল পেরিয়ে চলছি তো চলছিই। নেভিগেশানের আন্টি বলছেন আর আমি ডানে বামে ছোট থেকে ক্রমশ আরো ছোট হয়ে আসা রাস্তায় চলছি। লোকালয় ছেড়ে এসেছি আরো অনেক আগেই। সূর্য অস্ত যাবে এখনি। এমন সময়ূ নেভিগেশানে দেখাচ্ছে আমরা আর ৫০০ মিটার গেলেই গন্তব্যে পৌছে যাব। দেখা গেল আমাদের গন্তব্য হেসুস্কোয়া খামার। কিন্তু এ কোথায় এলাম আমরা?
মন্তব্য
ভাল লাগল, চলুক ...
অনেক দূরে যাব
যেখানে আকাশ লাল, মাটিটা ধূসর নীল ...
অনেক দূরে যাব
যেখানে আকাশ লাল, মাটিটা ধূসর নীল ...
দুর্দান্ত হয়েছে।
জার্মানী, লুক্সেমবুর্গ ও বেলজিয়ামে কোন টোল ছাড়া ভ্রমণ করে ফ্রান্সে এই পিয়াযের ছড়াছড়িতে বেশ বিরক্ত হয়েছিলাম। সাথে জানা সঙ্গী ছিল বলে রক্ষে, এমন ভুল লেনে ঢুকিনি। নর্মান্ডির ডি ডে বীচ দেখে প্যারিসে ফেরত যাবার সময় খায়েস হল পঁ দো নখমান্দি (Bridge of Normandy) দেখার। ওমা দেখি শাঁখের কড়াত। আসতেও কাঁটে যাইতেও কাঁটে - এমনি পিয়াযের দৌরাত্ম।
পৃথিবী কথা বলছে আপনি কি শুনছেন?
পৃথিবী কথা বলছে আপনি কি শুনছেন?
আহা, খুব সুন্দর লেখা।
লেবুগুলো ও খুব সুন্দর।
-----------------------------------------------
কোন দূর নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -
-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -
- খাইছে, জঙলায় গিয়া লেখা থামায়া দিলেন, এখন তো টেনশন হৈতাছে। বস সহি সালামতে আছেন তো!
___________
চাপা মারা চলিবে
কিন্তু চাপায় মারা বিপজ্জনক
ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর কর্মকাণ্ড । বিএসএফ ক্রনিক্যালস ব্লগ
সাসপেন্স।
চলুক।
ফাটাফাটি হইছে বস। ছবি দেইখা, বর্ণনা শুইন্যা আর ঘরে থাকতে মন চাইতেছেনা।
এ গ্রীস্মে ঝড় না আসলেও আমার ঘর ছাড়া লাগব ...
ছবিতো চমৎকার, সাথে বর্ণানাও। পরেরটার অপেক্ষায় থাকলাম।
-----------------------------------------------------------------------------
সোনা কাঠির পাশে রুপো কাঠি
পকেটে নিয়ে আমি পথ হাঁটি
আপনার লেখার তো নামটা পড়েই মন ভালো হয়ে যায়। লেখাও খাসা লাগলো।
দারুণ ! আগের পর্বটা মিস করে ফেলেছি। ্
এখন তাড়াতাড়ি গিয়ে পড়ে আসি
-------------------------------
আকালের স্রোতে ভেসে চলি নিশাচর।
-------------------------------
আকালের স্রোতে ভেসে চলি নিশাচর।
নতুন মন্তব্য করুন