যে বাড়িটিতে আমি বড় হয়েছি, সেই চারতলা বাড়ীটির তলায় একটি আর ছাদে আরেকটি পানির ট্যাঙ্ক ছিল। নিচতলার সিঁড়ির তলায় লোহার খাঁচায় বসে থাকতো এক ময়ূরকণ্ঠী নীল রং এর পেড্রলো পাম্প। সকাল বিকেল সিঁড়িঘরে মৃদু ঝাঁই ঝাঁই শব্দ তুলে সেই পাম্প নিচের ট্যাঙ্ক থেকে পানি ছাদের ট্যাঙ্কে তুলত। ভোরে ঘুম ভেঙে শুনতে পেতাম। আবার আসরের আজান পড়তে পড়তেই। বিকেলেও সিঁড়ি বেয়ে নিচে খেলতে নামার সময় বেখেয়ালে শুনতাম আমি সেই পাম্পটার আওয়াজ।
আশির দশকের শেষে এসে ওয়াসার পানির সাপ্লাই নেতিয়ে আসে। তলার ট্যাঙ্ক আর ভরে না। সে কি হাহাকার। ঝরনা দিয়ে গোসল করার কথা ভুলেই গেছিলাম। প্রতিবেশীদের পথ ধরে বাড়ীওয়ালাও একদিন ওয়াসার লাইন থেকেও একটা ডাইরেক পাইপ এনে পাম্পে লাগিয়ে দিলেন। এতে সমস্যার সমাধান হল না। সকাল বিকেল গলির সব বাড়ীর পাম্প একসাথে ওয়াসার লাইনে চুমুক দেয় ঠিকই, কিন্তু পানি আর আসে না। আসবে কোত্থেকে? রায়েরবাজার গদি-ঘরের কাছের গভীর নলকূপের গোড়াতেই তো পানি নেই। বছর দুয়েক পরে যখন গদিঘরে সুগভীর নলকূপ বসল, তখন গিয়ে পাড়ার লোকেরা ক'মাস নিজের গোসলখানার ঝর্নায় গোসল করেতে পেরেছিল।
মুচাই এর কথা বলে হঠাৎ পানি, পাম্প নিয়ে পড়লাম কেন? আসলে গ্যাসকে পাইপের মধ্যমে মাইলের পর মাইল পাঠানোর মত চাপ সচরাচর প্রাকৃতিক ভাবে পাওয়া যায় না। তাই দূর পাল্লার পাইপলাইনের মুখে একটি কমপ্রেসর বসানো হয়, যেটি পাইপলাইনের ভিতরে উচ্চচাপ সৃষ্টি করে ও তা বজায় রাখে। বেশি দূরের পথ হলে চাপ মিইয়ে আসতে পারে। তাই কয়েক শো' মাইল অন্তর আরও কিছু কমপ্রেসর বসানো হয় চাপকে উস্কে দিতে।
বাংলাদেশের গ্যাসের চাপ নিয়ে নতুন করে কিছু বলার নেই। ক্রমান্বয়ে উৎপাদন হ্রাস ও সঞ্চালন ও বিতরণ নেটওয়ার্কের ক্রমাগত প্রবৃদ্ধির পরিস্থিতিটা অনেকটা শুরুতে বলা আমাদের গলির পানি-সংকটের সাথে তুলনা করা যায়। এই গ্যাস চাপ সমস্যার পাকাপোক্ত প্রতিকার একটাই, গ্যাসের উৎপাদন বাড়াতে হবে, আর তার আগে আমাদের নতুন গ্যাসের মজুদ খুজে বের করতে হবে। তবে হাতের কাছের চাপ সমস্যাটার কিছুটা উপশম করা যায় কমপ্রেসর বসিয়ে। শুরু থেকেই আমাদের জাতীয় সঞ্চালন ও বিতরণ নেটওয়ার্ক এর চাপ ব্যবস্থাপনা দুর্বলও বটে। কোন মহা-পরিকল্পনা না নিয়ে মাঠে নামলে যা হয় আর কি, নানান আমলের নানান চিন্তাভাবনা আর সিদ্ধান্তহীনতার প্রতিফলন পাওয়া যাবে এখানে।
এশিয়ান উন্নয়ন ব্যাঙ্ক বাংলাদেশের গ্যাস সঞ্চালন ও বিতরণ ব্যবস্থার উন্নয়নের জন্য কমপ্রেসর নির্ভর পাইপলাইন বসানোর জন্য টাকা নিয়ে বসে ছিল সেই ২০০৫ সাল থেকেই। এত টাকা খামাখা ফেলে রাখলে নাকি সৃষ্টিকর্তার গজব নাজিল হয়। বোকচন্দর গাই কেনার আগে বালতি কিনেছিল। পেট্রোবাংলা কমপ্রেসের টেন্ডার তৈরি হওয়ার আগেই পাইপলাইনের টেন্ডার করে বসল। কমপ্রেসগুলো কোথায় বসবে, তাদের ধরন বা ক্ষমতা কিরকম হবে এগুলো নির্ধারণ করার আগেই আমাদের পূর্বাঞ্চলে পাইপলাইন বসে গেল। পাইপলাইন আছে, কিন্তু তাতে গ্যাস নেই সেটা কি হতে পারে? কিন্ত উপায়, আমাদের তো গ্যাস সীমিত, এখন বড় পাইপ্লাইন নেটওয়ার্কে সেই গ্যাস ছাড়লে তো চাপ সমস্যা আরো প্রকট হবে।
মাইনকা চিপার একটি নতুন জাতীয় উদাহরন উদ্ভাবিত হল।
বাংলাদেশের পাবলিককে কোনঠাসা করলে সোনার গাভী বনে যায়। কেন খামাখা মজুদ খোজাখুজি করে গা ঘামানো। সরকার চাইছে চাপ বাড়াতে, গ্যাসের সরবরাহ বাড়াতে তো আর কেউ বলছেনা। তো লাগাও কম্প্রেসর। ব্যাস বসে গেল মূচাই কম্প্রেসর। চিচিং। ৫৭ মিলিয়ন ডলার চলে গেল ক্যালিফোর্নিয়ার সান রামোনে, আর বাংলাদেশীরা পেল ইয়াব্বড় এক পেড্রলো পাম্প, যেটা কিনা আগের চাইতেও বড়বড় চুমুকে সেই পুরাতন গ্যাসের মজুদ থেকেই আমাদের গ্যাস গিলিয়ে চলেছে ক্রমবর্ধমান দ্রুততায়।
মহমুদুর ও চৌফিক চৌর্যবৃত্তিতে এতটাই কাছাকাছি যে তাদের মধ্যে কে বেশী সরেস এ নিরূপণ করা কঠিন। তেনারা দুজনেই ঠাকুর ঘর থেকে কলাটা সন্দেশটা সরিয়েছেন, আবার সময়ে এক হাতে কলার ছিলকা, আরেক হাতে সন্দেশের গুড়ো আর মুখ-ভর্তি কলা-সন্দেশ কপ কপ গিলতে গিলতে 'আমি কলা খাই না' ধরনের বক্তিমা দিয়েছেন। এতে তবুও একটি শোয়াস্তি আছে, পাবলিকের কাছে আমলকি আর বিয়েম্পির চুরিডাকাতি নতুন কিছু বৈ তো নয়। কিন্তু যেটা এক দশকের চাইতে বেশী পুরাতন নয় সেটা হল তেলগ্যাস বিষয়ক ইস্যুভিত্তিক পথ আন্দোলন। এটি ক্রমশ আরো দুর্বোধ্য বিষয় হয়ে দাঁড়াচ্ছে।
কনকোর টেন্ডারে জেতা ৫৮ মিলিয়ন ডলারের অনুসন্ধান চুক্তি আমাদের পথে নামিয়েছে, হরতাল ডাকিয়েছে, কিন্তু মুচাই এর ৫৭ মিলিয়নের বিনা টেন্ডারে ও চুক্তিবহির্ভূত ধান্দায় পিন পতন নিরবতা। আগেও এরকম ঘটেছে এশিয়া এনার্জির জন্য মানুষ পথে নেমেছে, কিন্তু আরেকটু উত্তরে আরো বড় খনি ও বিজলীকল নিয়ে কোন উচ্চবাচ্য নেই। সারা দেশে যে টেন্ডারবিহীন একের পর বিজলীকলের চুক্তি দিয়ে দেয়া হল তাতেও বেশী কেউ মাঠে নামেনি। আন্দোলনের এই একচক্ষুতা দেশের মানুষকে আরো বিভ্রান্ত করছে। তবে ভাববেন না আমি দেশরক্ষাকর্তাদের দোষ ধরছি। না-না। আমি দেশের রক্ষাকর্তাদের কোন দোষ ধরছিনা। যত দোষ কনকোর পি-আর লবি ব্যাবস্থাপকের। তার উচিত ছিল আরো কিছু সময় বাংলাদেশের পরিস্থিতি পর্যবেক্ষন করে এগুনো। তাহলেই সে বুঝে যেত যে বারিধারায় এখন একটি নয় দুটো লাল কেল্লা। আরো শিখে যেত সিসমিক আর ড্রিলিং এর সাবকন্ট্রাকটগুলো দেবার সময়ে তাকে অবশ্যই জোর গলায় গাইতে হবে 'পূর্ব দিগন্তে সূর্য উঠেছে রক্তলাল'। তার খাটো যোগ্যতার খসারত দিতে খামখা ঢাকার রাস্তায় কতগুলো ইউয়ান গচ্চা গেল।
নৈষাদের সাম্প্রতিক দুপয়সার (পড়ুন লাখটাকার) আলোচনার জের ধরে অনেকদিন ড্রাফটে পড়ে থাকা এই নিম-প্রাসঙ্গিক লেখাটি চামে চালিয়ে দেয়ার ধৃষ্টতা করলাম। গুস্তাখি মাফ!
কিছু প্রাসঙ্গক লিঙ্কঃ
১. মুচাই নিয়ে এনার্জি বাংলার প্রতিবেদন।
২. ডেইলি স্টারের দুটো খবর। এখানে আর এখানে।
২. চৌফিকের সাক্ষাতকার
মন্তব্য
দুর্দান্ত,
আমি নৈষাদের পোস্টে আপনার কমেন্ট পড়েছি। এখানেও পুরো পোস্টটা পড়লাম। আপনার আপত্তিটা ঠিক কোন জায়গাটায় এইটা এখনো ধরতে পারি নাই। "এইটা বলে ঐটা বলে না কেনু" নিয়ে আপত্তি দেখলাম। একটা জিনিস নিয়ে কথা বলা হয় নাই মানে এই না যে আরেকটা জিনিস নিয়ে কথা বলার অধিকার কেউ হারাবে। আবার বাংলাদেশের ইস্যুভিত্তিক পথআন্দোলন একটা দুর্বোধ্য বিষয় বলছেন। হতে পারে। কিন্তু গত অনেকগুলো বছর ধরে ক্রমাগত চলতে থাকা একটা আন্দোলনকে এক কনকোর "অনুসন্ধান চুক্তি"র ফ্রেমে বাঁধতে চেষ্টা করছেন দেখে আমার নিজেরই আপনার পোস্টটি দুর্বোধ্য বিষয় মনে হতে শুরু করেছে। এইবারের হরতালের থেকে বড় গোলযোগ এইদেশে জ্বালানী খাতে হয়েছে এবং সেখানে নরহত্যাও ঘটেছে। আশা করি সেইসব ঘটনার বিভিন্ন পক্ষ সম্পর্কে ওয়াকিবহাল আছেন আপনি।
নীড়পাতা.কম ব্লগকুঠি
কনকোর চুক্তি বা তার চাইতেও বড় (ফুলবাড়ী?) আন্দোলনকে খাটো করে দেখার চেষ্টা আমার নয়। তবে দুর্নীতি তো দুর্নীতি? সেটা পশ্চিমা করুক আর পূবালীরা করুক।
আমরা কনকো নিয়ে কথা বলবো কিন্তু মুচাই নিয়ে বলবনা, কনকোর একটি কূপ খনন নিয়ে আমরা পথে নামবো, কিন্তু গাসপ্রম কোন ধরনের টেন্ডারফেন্ডার না করেই পেট্রোবাংলার পাঁচটি কূপ খূড়ে পয়সা নিয়ে যাবে। আমরা ফুলবাড়ী নিয়ে মাঠে নেমে পাবলিক বলি দেব কিন্তু বিনা প্রতিযোগীতায় বড়পুকুরিয়াকে চীনা কোম্পানীর কাছে দেয়া হয়ে যাওয়ার পরে আমরা শুধু শ্রমিকের বেতন ভাতা নিয়ে মিউ মিউ করব। এরকম বেছে শুধু পশ্চিমা দুষ্কৃতিকারীদের পেছনে ধাওয়া করার ফল ভোগ করে পূবদিকের ডাকাতেরা। আমাদের ইস্যুভিত্তিক পথআন্দোলনের নেতারা বিজ্ঞ, কিন্তু তারা ঠিক কি কারনে চীন/রাশিয়ার ইস্যুতে চুপ থাকেন, এটা আমার কাছে দুর্বোধ্য লাগে।
বড়ুপুকুরিয়া ইস্যুতে আপনার ধারণা সীমিত। আরো একটু খোঁজ খবর করেন। পুরনো ফর্মুলায় ফেলে আন্দোলন বিচার করার প্রবণতা থেকে বেরিয়ে আসুন।
নীড়পাতা.কম ব্লগকুঠি
বড়পুকুরিয়া চীনের সাথে চুক্তি ইস্যুতে তেল গ্যাস রক্ষা কমিটির কার্যক্রম নিয়ে আমার ধারনা আসলেই সীমিত। কিছু তথ্যসুত্র দিলে উপকার হত।
"একটা জিনিস নিয়ে কথা বলা হয় নাই মানে এই না যে আরেকটা জিনিস নিয়ে কথা বলার অধিকার কেউ হারাবে। "
ভালো বলেছেন।
কম্প্রেসার বসে গেলেও সেটা নিয়ে কথা বলার সুযোগ শেষ হয়ে যায়নি। কথা আমাদের বলতেই হবে। কথা কানে না ঢুকলে সেটা কানে ঢোকানোর ব্যবস্থাটাও করতে হবে। জটিল কারিগরী ব্যবস্থার ফাঁক-ফোকর নিয়ে আমজনতা হুটহাট কিছু বলতে পারবেনা সত্য, তবে সেখানকার দুর্নীতিটা বোঝানো দুষ্কর নয়। দুর্নীতির প্রতিটি খাত নিয়েই কথা বলা চলুক।
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
নতুন মন্তব্য করুন