একটি নিতান্তই নিরীহ নিরানন্দ নিরুপায় বিশ টাকার নোটের কথা ভাবেন। এতে যদি কোন ছাপার ভুলচুক থাকে, বা এর সিরিয়াল নম্বরটি যদি কৌতূহল জাগানিয়া হয় বা এই নোটটি যদি কোন বিশেষ সংস্করনের হয়, অথবা ধরেন এইট যদি আপনার প্রথম কামাইয়ের টাকা হয় - ইত্যাদি নানান বাহ্যিক কারনে এটাকে ফ্রেমে বেঁধে দেয়ালে ঝোলানো যেতে পারে, বা পড়ার টেবিলের কাঁচের নিচেও রাখা যেতে পারে। তবে বিশটাকার নোট কি কেউ আর টিউশানির বেতনে দেয়? কাঁচে ঢাকা সেই পড়ার টেবিলগুলো কি আর পাওয়া যায়?
এসব ইসপিশিয়াল বাহ্যিক কারন ছাড়া একটা বিশ টাকার নোটের একটাই মানে, একটাই প্রয়োগ, একটাই প্রাসঙ্গিকতা। মানিব্যাগের এককোনায় এটা যখন শুয়ে থাকে, তখন আমার ক্রয় ক্ষমতা বিশ টাকার মাত্রায় বেশী থাকে। রাস্তার মোড়ে গিয়ে একটা সিগারেটের দোকানীর হাতে দিলে আমার সেই ক্রয়ক্ষমতাটি দোকানির কাছে টেরান্সপার হয়ে চলে যায়, সেম টু সেম, দোকানীর যদি দিলে রহম থাকে, তাইলে তার, তাই দুই এক শলা দুতলা বিড়ির মালিক আমি হলেউ হতে পারি।
হাল জমানায় শিল্পকারখানায় একইরকম দেখতে হাজারে হাজারে কাতারে কাতারে যেসব জিনিসপত্তর তৈয়ারী হইতেছে, সেসব বেবাগতেই নিজ নিজ একটি সুনির্দিষ্ট প্রয়োগ ও প্রাসঙ্গিকতা নিয়া কারখানা থেইকা বাহির হয়। সবাই বলেন সুবাহানাল্লাহ। কিন্তু এইসব নিয়ামত হইল ভোগের বস্তু, কলা-শিল্প হিসাবে এগুলারে কেউ পুছে না। মানে এই কিছুদিন আগেও পুছতো না আরকি।
প্রথম ও দ্বিতীয় বিশযুদ্ধের মাঝের সময়টিতে গণমাধ্যমের খোল নলচে পাল্টে যায়। রঙীন বিজ্ঞাপন, কমিক্স, মোড়ক। বিলবোর্ডগুলোতে শিল্পরসের গাড়ত্ব বাড়তে থাকে। ভ্রমরের এতটুকু আগ্রহের প্রতিযোগীতায় পদ্মফুলেরা যেমন একে অন্যকে ছাড়িয়ে যেতে চায়, ভোক্তার চোখে পড়বার আগ্রহের এই পণ্যগুলোই সাজতে থাকে নানা সাজে, নানান রঙে, নানান বক্তব্যে। পঞ্চাশের দশকটাও একটা বড়ই মজাদার সময়। যুদ্ধমুদ্ধ শেষ, দুনিয়াজুড়া খালি ঠান্ডা ঠান্ডা শান্তি। পকেটে পকেটে ডলার। সবার মুখে হাসি। উমহু, আমাদের দেশে না, বিদেশের কথা কইতাছি। তো এতসুখের সময়ে, কোনটা যে ভোগের বস্তু আর কোনটা যে শিল্প, এইটার বাউন্ডারি লাইনের চুনা উইঠা যাইবার লাগছিল। জিনিস-শিল্পের পরিস্কার যে বিভাজনটি যুদ্ধের আগে ছিল, সেটি ঘোলা হতে শুরু করল। মুদিদোকানীর দাড়িপাল্লাকে পাশে ঠেলে তার জায়গায় বসে গেল কারখানায় মোড়কবদ্ধ নির্দিষ্ট মানের (standardized) ভোগ্যপণ্য।
আরেকটি বিষয়ও এখানে বলতে হয়, সেইটা হল বিমূর্ত অভিব্যাক্তিবাদ (abstract expressionism) এর বিজলীর গতিতে প্রসার। ক্যানভাসে বিচিত্র রংয়ের ছিটা বা বারান্দার গ্রীলের মত রংচঙে চৌকো এঁকেই লোকে অনেক কথা বলতে শুরু করে বলল এই দেখ সোনামানিকেরা আমি কিছুই না আঁইকা তোমাদের কত গল্প বলি। এই কথাগুলো শুনবার বা বোঝবার তেমন বেশী কেউ ছিলনা। কিন্তু সেই যে যুদ্ধ থেইকা যেই টেক্সান কাউবয় ফেরত গিয়া বাপের রেঞ্চ এ তেলে খনি পাইল সে আর তারমত আরো কিছু লয়া পয়সাদার লাখ লাখ ডলার ফালাইয়া এইসব ছিটকাপড় আর বারান্দার গ্রীল কিনে নিল। তারপরেই যাকে বলে 'পয়সাটা গর্তে পড়ল'। টকাস। যে পারে সে আসল জিনিস কিনে, যার অত হাতে পয়সা নাই সে প্রিন্ট কিনে, আর যে দিন আনে দিন খায়, সে ম্যাগাজিনের পিন আপ সংগ্রহ করে। তখন দেখা গেল সবাই এগুলোকে দেখে, বোঝে, কেউ কেউ আবার এগুলো নিয়ে স্বপ্নও দেখে।
ভোগ্যপন্যের সেই নিদারুন কোনঠাসা প্রাসঙ্গিকতা আর বিমূর্ত অভিব্যাক্তিবাদের দ্রুত উত্থান (কাম সারসে!) , এই দুইটার মাঝখানের মাইনকা চিপায় পড়া আমেরিকা ও ইংল্যান্ডের কিছু তরুন শিল্পী দম নিতে পারতেছিল না। ওরা তড়পায়, পাইলে দুই এক টান 'নওগাঁ' টানে। এরপর একদিন তো ঘটনা ঘটেই গেল। প্রতিবাদ বলেন, প্রসারন বলেন, সংমিশ্রন বলেন, অনুপ্রেরনা বলেন, ভোগবাদ আর বিমূর্ততাকে ভেঙেচুড়ে আর হাতের কাছে যে ভোগ্যপন্য পাওয়া যাচ্ছে তাকেই ব্যাবহার করে বিমূর্ত অভিব্যাক্তি ভরা ছবি/মুর্তি নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা শুরু হয়ে গেল। জন্ম নিল 'পপ আর্ট' - বা পপুলার আর্ট। শুরুটা কে করেছিল, এটা নিয়ে মতভেদ আছে, তবে হ্যামিল্টন আর পাওলোত্সি হাত ধরে ব্লেক, কলফিল্ড, হকনি, জোন্স, ফিলিপ্স এরাই যে একেবারে শুরুর দিকের পপ শিল্পী, তাতে বিতর্ক নেই। তারপর একদশক এরাই পপ নিয়ে নাড়াচারা করেন। ষাট এর দশকে পপ চলে আসে আমেরিকায়। আমেরিকায় গেলে যা হয়। সবকিছুই একটু বদলে যায়। পপ আর্ট ও আমেরিকায় গিয়ে একটু বদলে গেল। হলিউড, রক এন্ড রোল আর রুট ৬৬ মিশে গেল পপ আর্ট এর সাথে।
এক একজন 'পপ' শিপ্লী এক একটি বিষয়, আবেগ, পরিস্থিতি বা ভোগ্যপণ্য নিয়ে কাজ করেন। তবে তাদের প্রকাশভঙ্গীতে একটা জিনিস হরহামেশাই হাজির-নাজির থাকে - কি সেই বস্তু? সে হইল আয়রনি (বাংলা কি?)। শিল্পী যে কথাটা বলতে চায়, কাজে সে করে ঠিক তার উল্টাটা, খালি উল্টা করলেও চলত, কিন্তু আয়রনিতো, তাই সে সেই উল্টা কাজটাই অতিরঞ্জিত ভাবে করে, যাতে প্রথম দেখায় কাজের বিপরীত বক্তব্যকেই চোখে পড়বে। আরেকভাবেও আয়রনি ফলায় কেউ কেউ। কাজে/ছবিতে তাবত দুনিয়ার সবকিছুই থাকবে, কিন্তু সেই বিশেষ বক্তব্যটিই থাকবে না। এখন দর্শকের দায়িত্ব হল, ফিল ইন দ্যা ব্ল্যঙ্কস যোগ এম সি কিউ, অথবা, দর্শক যেটা ভেবে আরাম পায়, সেইটা।
কিউবিজমে যেমন পিকাসো, ইম্প্রশনিসমে যেমন মনে' - পপ আর্টের তেমনি ওয়ারহল। ওয়ারহলের ক্যাম্পবেল স্যুপের ডিব্বা বা মেরলীন মনরোর সেই নানারঙ এর রেশমী-ছাপার মত পপ আর্টের আইকন আর কোনটি আছে নাকি?
আবার সেই নিতান্তই নিরীহ নিরানন্দ নিরুপায় বিশ টাকার নোটটারে ডাকি। আপনি যদি সেটাকে ফ্রেমে বেঁধে আপনার বসার ঘরে ঝোলান, তাহলে সেই টাকাটি ক্রয়ক্ষমতা ছাড়াও তার প্রাসঙ্গিকতার ফর্দে আরেকটি মাত্রা যোগ হয়। বেচারা যা না, মানে একটি 'ওয়ার্ক অব আর্ট' আপনি তাকে ঠিক তা হিসাবেই ব্যাবহার করলেন। খিয়াল করেন, এটা নিতান্তই আপনার দৃষ্টিকোন থেইকা। কোন আয়রনির বক্তব্য আছে, সেটা দর্শকের ওপর নির্ভর করে; আপনার নিজস্ব কোন আয়রনির বক্তব্য থাকলেও থাকতে পারে। আপনার শিল্পরসের প্রতি আপনার ভাইবেরাদর ফেরেন্ড ইস্টাফদের কিরকম আস্থা আছে, বা তাদের শিল্পরসগ্রহনের প্রখরতা কোন মার্গের, এইসব গুঢ় রহইস্য কিলিয়ার করতে এই পরীক্ষাটি নিজ দায়িত্ব করে দেখতে পারেন। তয় মাইর ধইর খাইলে কর্তিপক্ষ দায়ী নহে, কইয়া রাখলাম কইলম।
যাউগ্গা, আর আপনাদের মগজ ভুনা করবো না। এবার আসেন কিছু ফুটফুটে পপ আর্ট দেখি। জয় বাবা উইকিনাথ।
প্রথম ছবিটিকেই লোকে প্রথম 'পপ আর্ট' বলে। এটি পাওলোত্ সির করা (১৯৪৭)। ছবিটির নামই গল্পটি বলে দেয় ' I was a richman's plaything'।
দ্বিতীয়টি ওয়ারহলের এলভিস। স্বীকার করি, তার স্যুপের ডিব্বা, মেরিলীনের রংচঙা ছবির মত এটি ততটা পরিচত নয়, তবুও এটা আমার বেশ ভাল লাগে। সাদাকালো প্রিন্টগুলোতে বোঝা যাচ্ছে বলে মনে হয় না, তবে এটি এলভিসের লাল জামা পরা একটা ছবির রেশমী কাপড়ে করা স্কৃনপ্রিন্ট। এই সিরিজে এলভিস ছাড়াও সেসময়ের হলিউডের সব নামকার তারকাদের ছবির প্রিন্টছিল। এ ছবির আয়রনিটি কি? আপনার কি মনে হয়?
এবারে হ্যামিলটনের 'Just What Is It that Makes Today's Homes So Different, So Appealing?'। দেখতেই পাচ্ছেন, বিভিন্ন ভোগ্যপন্যের বিজ্ঞাপন ছিড়ে এনে একসাথে করেছে হ্যামিলটন পাগলাটা। কাজটির নামটিও সে ছিড়ে এনেছে একটি বিজ্ঞাপন থেকে।
সবশেষে আসুন দেখি হকনির A Bigger Splash। আমার সবচাইতে প্রিয় পপ ছবি।
বিশ টাকার নোটটার কথা মনে আছে তো? সেই যে বস্তুর দৈনন্দিন প্রাসঙ্গিকতা থেকে টেনে বের করে আনা শিল্পকর্মটি? বেশ!
এছবিতে কি আছে? একটি সুইমিং পুল ও ঝপাত!, একটি বাড়ী, তালগাছ ও চেয়ার। এই তো? আবার দেখুনতো এটা ঠিক কোন সময়ের ছবি? দিনের বা ঘটনার? আচ্ছা, যে ঝপাতটি ঘটালো, তার পেশা কি? সে সুইমিংপুলের কোন পাশ থেকে ঝাঁপটি দিল?
এবার আরেকটি বিষয় খেয়াল করুন। এই ছবির বস্তুগুলোর প্রাসঙ্গিকতা ভুলে যান। আকার, রং ও অবস্থান ভাবুন। একটি সমবাহু আয়তাকার চতর্ভুজ, ছাই রং এর জমিনে দুটি সমান আকারের নীল আয়তক্ষেত্র। উলম্ব তালগাছ। আনুভুমিক গোলাপি জমিন। এ পর্যন্ত চৌকোনাকার বিন্যাস ঠিকই ছিল। কিন্তু গোল বাধালো ডানদিকের কোনার হলুদ রম্বাস লাফ-কাঠ আর ঝপাত। লাফকাঠ-ঝপাত-চেয়ারে একটি ত্রিভুজ আকৃতির ভ্রম দিয়ে যাচ্ছে।
মাত্র এক সেকেন্ডের একটি ঘটনা, সেটা প্রকাশ করতে এতকিছু। যাকে নিয়ে এতকিছু সে কিন্তু ডুবে আছে, ছবিতে নেই। জীবনটাও তো এরকমই নাকি?
এইবার একটা বাজনা শোনেন। এটা কি পপ? এতে কি আয়রনি আছে?এতে কী আয়রনি আছে? (কি/কী নয়া শিক্সি)
মন্তব্য
বিষয়বস্তু দারুণ লাগলো, তার চেয়েও ভালো লাগল লেখার ভঙ্গিটা।
এই মুহূর্তে বেশ মাথা ব্যথা, তাই সবটুকু ঠিকমতো বুঝতে পারি নি। আবার পড়বো পুরো লেখাটা।
প্রথম পাঠে চমৎকৃত।
আর লেখায় বেশ কিছু বানান ভুল আছে, সম্ভব হলে ঠিক করে দিতে পারেন।
অলমিতি বিস্তারেণ
অলমিতি বিস্তারেণ
ইন্টারেস্টিং!! চমৎকার লাগল। ‘পপ-আর্ট’ সম্বন্ধে তেমন জানতাম না।
'A Bigger Splash' নিয়ে আরেকটু বিশ্লেষণ করলে ব্যাপারটা আরও ভাল বোঝা যেত।
দারুণ.. দারুণ... পরবর্তী লেখার অপেক্ষায় রইলাম...
______________________________________
বর্ণ অনুচ্ছেদ
দারুণ। নতুন কিছু জানলাম।
_______________
ত্রিমাত্রিক কবি
E-mail:
ভালো লাগলো লেখাটা।
ইচ্ছার আগুনে জ্বলছি...
ইচ্ছার আগুনে জ্বলছি...
বাহ! প্রথমে কিছুই বুঝছিলাম না, কিন্তু পরে দেখি জটিল ব্যাপার। ইন্টারেস্টিং বিষয় তো, এর আগে কিন্তু এই ধরণের পপ আর্ট দেখলেও এইভাবে মাথায় রেজিস্টার করেনি। ধন্যবাদ লেখাটার জন্যে।
ডানদিকের হবে মনে হয়?
___________________
ঘুমের মাঝে স্বপ্ন দেখি না,
স্বপ্নরাই সব জাগিয়ে রাখে।
___________________
ঘুমের মাঝে স্বপ্ন দেখি না,
স্বপ্নরাই সব জাগিয়ে রাখে।
বিস্লেশনটা খুব ভাল লাগলো!
--- থাবা বাবা!
অন্য রকম। আগে একটু আধটু পড়েছিলাম এনিয়ে, আরো বিশদ জানালে ভালো হয়।
পলাশ রঞ্জন সান্যাল
আমজনতার জন্য শিল্পের এমন পাঠই দরকার। এতে বিষয়টা মাথায় এমন ভাবে এনডোর্স করবে যে আর জীবনেও ভুলবেনা।
অধমের একটা অনুরোধ ছিল। সেটা কবে পূরণ করা হইবেক?
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
নতুন মন্তব্য করুন