জেলার নাম লালকুপি - ১৪

দুর্দান্ত এর ছবি
লিখেছেন দুর্দান্ত (তারিখ: শুক্র, ০১/১০/২০১০ - ২:৫৭অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

সোমবার সকলটায় ভাল রোদ উঠেছে। বাজেটের সময়, সবাই ব্যাস্ত। স্কৃনে অপছন্দের একটা খটমটে হিসাবের দিকে ভ্রূকুটি নিয়ে তাঁকিয়ে আছি। কে যেন আমার স্কৃন আর জানালার আলোর মাঝে এসে দাঁড়াল। ছায়াটা বিরক্তিকর। ভ্রূকুটি নিয়েই সেদিকে মুখ ফিরিয়ে দেখি মেইন্টেনেন্স এর গ্র্যাড তামারা সাথে একজনকে নিয়ে এসেছে। 'হাই, আমি মালয়শিয়ায় চলে যাচ্ছি। এর নাম তানভীর, এ আমার জায়গায় এসেছে'। দেখি হাত বাড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছে হাসিখুশি একটা চেহারা। চকচকে সমান চুলের নিচে বুদ্ধিদীপ্ত দুটো চোখ। তানভীরের চেহারা উপমহাদেশীয়। লন্ডনী ইংরজীতে হ্যালো বলল সে। উত্তরে হ্যালোফ্যালোর তোয়াক্কা না করে আমি ঠাস করেই জিজ্ঞেস করলাম, 'দেশ কই?'।

তানভীর হেসে বলল, বাংলাদেশ। এটুকু শুনেই আমি শিশুর হা হা মত হেসে উঠলাম। ব্যাপারটি ঘটে গেল অনেকটা আমার নিয়ন্ত্রনের বাইরেই। আসলে হল্যান্ড এর এই পান্ডববর্জিত চিপায় আরেকজন বাংলাদেশীকে সহকর্মী হিসাবে পাবো কখনই আশা করিনি।

তামারা আর তানভীর বেশ অস্বস্তিতে পড়েছে বোঝা গেল। ওপেন প্ল্যানের সবাই ঘুরে তাঁকিয়েছে। উঠে এগিয়ে গিয়ে তানভীরের সাথে হাত মেলালাম। বললাম 'অভিনন্দন, আমি গর্বিত'।

কেন এমন হয়? নিজের দেশের মানুষ দেখলে আমরা এমন আত্মহারা হয়ে যাই কেন?

---
আমার নয় বছুরে মেয়েটা আগামি সপ্তাহের তিনটি রাত বাসায় ঘুমোবে না। ওদের ক্লাসের সব ছেলেমেয়েরা চলে যাচ্ছে দুরের একটা জঙ্গলে। ওখানে সবাই হই হল্লা করবে, জঙ্গলের পথে পথে হাঁটতে হাঁটতে গান গাইবে। গাছাপালা আর ব্যাঙের ছাতা চিনবে। ক্যাম্পফায়ারে মার্শমেলো ঝলসিয়ে খাওয়া হবে, তাঁবু খাটিয়ে ঘুমথলিতে ঘুমোনো হবে।

সেপ্টেম্বরের শুরু থেকেই এখানের আবহাওয়া পাল্টে গেছে। ঘষা কাঁচ আকাশ, দমকা হাওয়া আর ঝিরঝির বৃষ্টি। তাপমাত্রা নেমে গেছে অনেক আগেই। এই ভেজা-ঠান্ডার মধ্যে ওরা তিনরাত বাইরে থাকবে। স্কুল থেকে শক্ত ভাষায় বলে দিয়েছে, বাবা মায়েরা যেন শিশুদের সাথে মোবাইল ফোন না দেয়। যেন ক্যাম্পসাইটে গিয়ে বসে না থাকে।

মনকে বোঝানোর চেষ্টা করি। এই কটা দিন নিজের মত থাকাটা যেমন আমার মেয়ের জন্য দরকারি, আবার আমার জন্যও সেটার প্রয়োজন আছে। আর মাত্র ক'টা বছর এরপরই তো সে কলেজে চলে যাবে। তখন তো মাসের পর মাস ওকে ছাড়া আমাদের থাকতে হবে। ওর একা একা থাকার ওপর একটা বিশ্বাস তৈরীর প্রকৃয়াটির এখনই শুরু হওয়ার দরকার।

কিন্তু মন মানে না। আমার ছোট্ট প্রজাপতিটা পাখা ঝাপটাতে শুরু করেছে।

---

ওলন্দাজ সিনেমার সুনাম তেমন নেই। এরা তেমন সুখাদ্য কিছু খুব একটা বানায় না। তবে এখানে থাকি বলে চোখের সামনে এদের ফিল্ম দু একটা চলেই আসে।

গতরাতে স্থানীয় টিভিতে আমরা দেখলাম 'লাস্ত দাখেন ফন্‌ এমা ব্লাঙ্ক' বা এমা ব্লাঙ্ক এর শেষ দিনগুলো। জীবন থেকে নেয়ার জাদরেল গৃহকর্তী মত ধনীর দুলালী এমা ব্লাঙ্ক। উত্তর সাগরতীরের বালিয়াড়ীর মাঝে এক বাগানবাড়ীতে একদল চাকরচাকরানি নিয়ে তার একার রাজত্ব। রিমেন্স অব দ্যা ডে'র মিস্টার স্টিভেন্স এর মত হেড চাপরাসি বার্নাফেল্ড, রাঁধুনি বেলা, ঝারপুছ চাকরানি খোনি, আর মালী-চাকর মাইয়ার। আর আছে কুকুর তেও। হিটালারি কায়দায় এমা তার চাকরবাহিনী পরিচালনা করে। এমা খামখেয়ালী কিন্তু তার পোশাক আশাক সর্বদাই টিপটপ ।

এরকম বাড়ীতে যেমন হয়। মালকিন ওপর তলায় চলে গেলে চাকর চাকরানীদের রাজত্ব। ক্রমে আমরা জানতে পারি বার্নাফেল্ড আর বেলার শোবার ঘর আলাদা নয়। খোনি আর মাইয়ার ও একে অন্যের প্রতি আকৃ্ষ্ট।

তেও-ও এরকম সংসারে ঠিক ঠাক মিলে যাওয়া বয়স্ক কুকুর। একটু অবাধ্য, মাঝে মাঝে সোফায় বসে। মালকিনের হাঁটুকে কুকুরি কায়দায় ভালবাসতে চায়। বাইরে থেকে মরা পাখি এনে ফেলে মালকিনের কোলের ওপর। আবার প্রকৃতির ডাকে ঠিক ঠাক বাইরে দৌড়ে যায়। তেও-র চরিত্রটি একটি কুকুরকে দিয়া না করিয়ে পরিচালক নিজেই সেই ভুমিকায় অভিনয় করেছে, অদ্ভূত বিশ্বাযোগ্যতার সাথে ।

তারপর আমাদের চক্ষু চড়কগাছ হবার পালা। একে একে আমরা আবিস্কার করি আদতে বার্নাফেল্ড এমা'র স্বামী আর খোনি তাদের কন্যা। এরকম আরো বেশকিছু চমক অপেক্ষা করে থাকে কালো দেয়াল আর সাদা দরজাজানালার সেই বাগানবাড়ীর আনাচেকানাচে।

সবার ভাল লাগবে না।


মন্তব্য

বাউলিয়ানা এর ছবি

দারুন একটা ব্লগ!

এখানে দেশী ভাইদের সবসময় আশেপাশে দেখি বলে নতুন করে আর চমকিত হইনা। তবে একদম সহকর্মী হিসেবে পাওয়াতো দারুন ব্যাপার।

আপনার ছোট্ট প্রজাপতির জন্য অনেক শুভকামনা রইল। নতুন নতুন ফুলের বাগানে ঘুরে সুন্দর জীবন কাটুক।

দেবোত্তম দাশ এর ছবি

আমার ছোট্ট প্রজাপতিটা পাখা ঝাপটাতে শুরু করেছে।

ভালো লাগলো অতি, ধার নিলাম এটি

------------------------------------------------------
হারিয়ে যাওয়া স্বপ্ন’রা কি কখনো ফিরে আসে !

------------------------------------------------------
হারিয়ে যাওয়া স্বপ্ন’রা কি কখনো ফিরে আসে !

মহাস্থবির জাতক এর ছবি

ওর একা একা থাকার ওপর একটা বিশ্বাস তৈরীর প্রকৃয়াটির এখনই শুরু হওয়ার দরকার।

কিন্তু মন মানে না।

আপনার মতো উদার মানসিকতার এবং আমাদের চাইতে বহুগুণিত পরিমাণে বিশ্ববীক্ষাসম্পন্ন মানুষও যদি এরম ভাবেন, তালে আর আমাদের আমআদমিদের দুষ্ট করি কী প্রকারে?

আসলেই আমরা বাইবেলি সেই শিক্ষা থেকে পুরোটা বেরুতে পারি না।

ভানুসিঙ্গির সে-কতাটা কি ভুলে গেলেন?

"পুণ্যে পাপে দুঃখে সুখে পতনে উত্থানে
মানুষ হইতে দাও তোমার সন্তানে
হে স্নেহার্ত বঙ্গভূমি, তব গৃহক্রোড়ে
চিরশিশু করে আর রাখিয়ো না ধরে।
দেশদেশান্তর-মাঝে যার যেথা স্থান
খুঁজিয়া লইতে দাও করিয়া সন্ধান।
পদে পদে ছোটো ছোটো নিষেধের ডোরে
বেঁধে বেঁধে রাখিয়ো না ভালোছেলে করে।
প্রাণ দিয়ে, দুঃখ স'য়ে, আপনার হাতে
সংগ্রাম করিতে দাও ভালোমন্দ-সাথে।
শীর্ণ শান্ত সাধু তব পুত্রদের ধরে
দাও সবে গৃহছাড়া লক্ষ্মীছাড়া ক’রে।
সাত কোটি সন্তানেরে, হে মুগ্ধ জননী,
রেখেছ বাঙালী করে, মানুষ করনি।"

মায়ের কাছে অনেকবার আবৃত্তি করে শুনিয়েও আমার অনুমতি বা মুক্তি মেলে নি। এখন তাই নিজেকে গৃহবন্দী করেই সুখী থাকি।
_______________________________
খাঁ খাঁ দুপুরে, গোধূলিতে আর রাতে বুড়ি পৃথিবী
কেবলই বলছে : খা, খা, হারামজাদা, ছাই খা!

(ছাই: মণীন্দ্র গুপ্ত)

_______________________________
খাঁ খাঁ দুপুরে, গোধূলিতে আর রাতে বুড়ি পৃথিবী
কেবলই বলছে : খা, খা, হারামজাদা, ছাই খা!

(ছাই: মণীন্দ্র গুপ্ত)

দুর্দান্ত এর ছবি

ছোটবেলায় বাবা মা'কে বলতে শুনতাম, একদিন ছেলেপেলের বাবা হ ঠিক বুঝবি। বুঝলাম আর কই। শুধুই পেট পোড়ায় টের পাই। কেন পোড়ায়, তা কি আর বুঝি?

জুলিয়ান সিদ্দিকী এর ছবি

কেন পেট পোড়ায় সেটা বোঝার দরকার নাই। পেট যে পুড়ে সেটা অনুভব করতে পারলেই হলো।
.
___________________________________________
ভাগ্যিস, আমার মনের ব্যাপারগুলো কেউ দেখতে পায় না!

___________________________
লাইগ্যা থাকিস, ছাড়িস না!

জাহামজেদ এর ছবি

সিনেমায় ডাচরা পিছিয়ে থাকার কারণ কি ?

__________________________________
মরণের পরপারে বড় অন্ধকার
এইসব আলো প্রেম ও নির্জনতার মতো
__________________________________

__________________________________
মরণের পরপারে বড় অন্ধকার
এইসব আলো প্রেম ও নির্জনতার মতো
__________________________________

ধুসর গোধূলি এর ছবি

ফাঁকিবাজী পোস্ট মনে হৈলো!

দুইচার দিন ধরে আমার খালি পালাতে ইচ্ছে করতেছে। কারণ এবং ভেন্যু, উভয়ই অজ্ঞাত। আজকে ইচ্ছে জাগছে পালিয়ে গিয়ে বনফায়ার করার। আগুনের চারপাশে ঘুরে ঘুরে দুর্বোধ্য জিঙ্গেলে খালি গায়ে (হাফপ্যান্ট থাকবে অবশ্য) নাচার। বলাই বাহুল্য, এইটার কারণ এবং ভেন্যুও অজ্ঞাত!

আপনার বড় প্রজাপতির পাখা ঝাপ্টানোর কথা নিজেকে আরেকটু বয়ষ্ক ঘোড়া বানিয়ে দিলো। ছেলেবেলার এক সিনিয়র ফ্রেন্ড যোগাযোগ করেছে ফেসবুকে। শশ্রুমণ্ডিত অবয়ব দেখে প্রথমে ভড়কে গেলেও পরে স্বভাবসিদ্ধ আলাপ চালাতে গিয়ে বুঝলাম, বয়স ছেলেবেলার আমাকেও রেহাই দেয় নি। ওখানেও তাড়া করে ফিরছে!

আপনার ছোট রাজকন্যা কেমন আছে? তাকে তার 'ভালো আঙ্কেল' এর শুভেচ্ছা জানাবেন। পূজাতে আসছেন নাকি? জানিয়েন, রাজকন্যাকে দেখে আসবো এই সুযোগে।

বয়স হইছে। কবে কী হয়ে যায় বলা যায় না! মন খারাপ



বিএসএফ—
ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর কর্মকাণ্ড । বিএসএফ ক্রনিক্যালস ব্লগ

দুর্দান্ত এর ছবি

বয়স হইছে। কবে কী হয়ে যায় বলা যায় না!

ধুগো, এসব কি কথা? বালাই ষাট।

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

এই নামে যে একটা সিরিজ আছে লোকজন সেটা ভুলতে বসেছিলো। অবশ্য তাদের আর কী দোষ, সিরিজটার নতুন কোনো এপিসোড পড়তে পেতে হবে তো!
*****

প্রবাসে কখনো থাকিনি তাই এই অনুভূতিটার সাথে ঠিক পরিচিত নই। তবু অল্প সময়ের জন্য বিদেশে গেলে রাস্তা-ঘাটে বাংলাদেশী বলে মনে হয় এমন কাউকে দেখলে ভালো লাগে।
******

আমার যে বয়সে আমার বাবা আমাকে ছেড়ে গেছেন আমি সেই বয়স থেকে আমার ছেলের বর্তমান বয়স বিয়োগ করি আর মনে মনে ছেলেকে বলি, "বাবান, এইতো আর বারোটা বছর তারপর যদি বেঁচে থাকি সেটুকু বোনাস"। সন্তান বড় হওয়া আনন্দের-গর্বের খবর। সাথে নিজের বিদায় নেবার খবর।
******
জীবনে কোনো ডাচ সিনেমা দেখেছি বলে মনে হয়না। একটু খোঁজ করতে হয় এবার।



তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

তার-ছেড়া-কাউয়া এর ছবি

ভালু লাগে নাই।

দুর্দান্ত এর ছবি

পড়েছেন, মন্তব্য করেছেন, এই অনেক পাওয়া। ধন্যবাদ। আবার আসবেন।

হাসান মোরশেদ এর ছবি

আমার ছেলের বয়স পাঁচ পেরিয়ে গেছে। স্কুলে ইয়ার ওয়ান, অনেক কিছু বুঝে ফেলে, অনেক বিষয়ে প্রায় বন্ধুর মতো আমাদের সাথে শেয়ার করে।
আমি আয়নায় মাঝে মাঝে নিজেকে দেখি। কোন কোন মুহুর্তে বিস্ময় জাগে, এই আমি তো? আমার সন্তান বড় হয়ে যাচ্ছে, আমি বড় হলাম কই?
-------------------------------------
জীবনযাপনে আজ যতো ক্লান্তি থাক,
বেঁচে থাকা শ্লাঘনীয় তবু ।।

-------------------------------------
জীবনযাপনে আজ যতো ক্লান্তি থাক,
বেঁচে থাকা শ্লাঘনীয় তবু ।।

স্নিগ্ধা এর ছবি

এই পর্বটা খুব ভালো লাগলো, দুর্দান্ত! আমার মেয়ের বয়সও নয়। আপনার ছোট্ট প্রজাপতির কথাটা একদম মর্মে মর্মে উপলব্ধি করলাম!

সিনেমাটা দেখার আগ্রহ বোধ করছি। বিশেষ করে কুকুরের ভূমিকায় পরিচালকের অভিনয়ের ব্যাপারটা বেশ অভিনব!

দুর্দান্ত এর ছবি

সহমর্মিতার জন্য অনেক ধন্যবাদ।

ছবিটার ডিভিডি বেরিয়েছে কিনা বলতে পারবো না। টরেন্টে আসক্তি থাকলে একটা খোজ দা সার্চ মেরে দেখতে পারেন।

রানা মেহের এর ছবি

এত ছোট্ট লেখা?
-----------------------------------
আমার মাঝে এক মানবীর ধবল বসবাস
আমার সাথেই সেই মানবীর তুমুল সহবাস

-----------------------------------
আমার মাঝে এক মানবীর ধবল বসবাস
আমার সাথেই সেই মানবীর তুমুল সহবাস

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

আচ্ছা তাই, রানা যেন তার বড় লেখাটা শেষ কবে দিলেন!



তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।