আমাদের স্বাধীনতাযুদ্ধ পরিচালনা কৌশলের ক্রমবিকাশ-২

দুর্দান্ত এর ছবি
লিখেছেন দুর্দান্ত (তারিখ: মঙ্গল, ০৬/১২/২০১১ - ৪:০১পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

আগের পর্বে পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলীয় কৌশলের অনুসিদ্ধান্ত ও পরিকল্পনার পটভূমি নিয়ে কথা বলেছিলাম।

আবার একটু ব্রিটিশ আমলে ফিরে যাই। সিপাহীবিদ্রোহের 'ঝামা-ঘষা' এতটাই তীব্র ছিল যে ব্রিটিশ রাজ এর পর থেকে একচেটিয়াভাবে ‘মার্শাল-রেস’ বা 'যুদ্ধবাজ-জাত' থেকে সৈন্য সংগ্রহ শুরু করল। বিভ্রান্ত হবেন না। এই ‘যুদ্ধবাজ-জাত’এর কোন ঐতিহ্যগত পরিমাপ ছিলনা। যেসব অঞ্চলের বা জনগোষ্ঠীর লোকজন সিপাহীবিদ্রোহের সময়ে ব্রিটেনের পক্ষে লড়েছে - ব্রিটিশ বিচারে তারাই ‘যুদ্ধবাজ-জাত’ হিসেবে পরিগণিত হল। এতে ভারতীয় সেনা ও আইন-রক্ষা সংস্থাগুলোতে মারাঠি, মাদ্রাজি ও সর্বোপরি বাঙ্গালীদের সংখ্যা আশঙ্কাজনক ভাবে কমে গেল। অন্যদিকে মনিবের কল্যাণে ভাইয়ের পিঠে ছুরি বসানোর মত সীমাহীন বিশ্বস্ততা প্রদর্শনকারি পাঞ্জাবীদের কপাল গেল খুলে। নিয়মিত ভর্তির পাশাপাশি প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ের পাঞ্জাব, বিশেষ করে ঝিলম নদীর উত্তর পাড়ের আটক (ক্যাম্পবেলপুর), চকওয়াল, রাওয়ালপিন্ডি, এর রুক্ষ ও অভাবী এলাকাগুলো থেকে এলো সবচাইতে বেশী সৈনিক।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে লোকবলের প্রয়োজনীয়তা প্রবল হওয়ায় সেসময়ে কিছু বাঙ্গালী ও অন্য়ান্য় জনগোষ্ঠী থেকে সৈনিক ও তার চাইতেও অল্প সংখ্যক অফিসার নিতে বাধ্য় হল ব্রিটিশ সরকার। এছাড়া প্রায় ষাট হাজার বাঙ্গালী-অহমীয়া মুসলমানকে বার্মা, উত্তর আফ্রিকা ও ইতালিতে পাঠানো হল মূলত সামরিক নির্মাণকাজ ও সেনা ক্যাম্পে গৃহস্থালির কাজে। বার্মায় এই দলটির একটি অংশের কাজ তদারকি করল সদ্য কমিশনপ্রাপ্ত একজন চৌকশ বাঙ্গালী অফিসার। এই অফিসারটির কর্মদক্ষতার কতটুকু উঁচুমানের ছিল, তা তার সমসাময়িক পাঞ্জাবীদের ডিঙ্গিয়ে পদোন্নতির দ্রুততা দেখলে আঁচ করা যায়। ১৯৪০ সালে কমিশন পেয়ে মাত্র দু বছরের মাথায় সে মেজর হয়। আগ্রহীদের জন্য বলে রাখি, এই বাঘের বাচ্চাটির নাম ওসমানী।
Col M A G Osmany wades through water near Lahore at the end of the 1965 war

যা বলছিলাম, দেশবিভাগের পর ভারত ও পাকিস্তান - দুদিকেই তাদের নিজ নিজ পূর্বাঞ্চলের প্রতি অনীহা অবজ্ঞা দেখাছিল। এই অবজ্ঞাকে উত্তরাধিকারসূত্র হলেও এটাকে চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত তাদের নিজস্ব। উত্তরপশ্চিমের সামরিক ক্ষমতা ও শিল্পউন্নয়নের উত্তাপ এই প্রক্রিয়ার সহায়ক হয়েছে। ৪৭ থেকে অদ্যাবধি ভারতের পূর্বাঞ্চলে এর সামরিক বাহিনীর আমলনামা নাড়াচাড়া করলে বাংলাদেশীরা নিজেদের ভাগ্যবান মনে করবে অনায়াসে। সহজ কথায় দিল্লী তার পূর্বাঞ্চলকে আদরযত্নে রাখেনি। তারপরেও, গত কিস্তিতে যেমনটি বলেছি, ভারতের পূর্বাঞ্চলের সুনির্দিষ্ট কোন সামরিক পরিচালনা কৌশল ছাড়আই সেনাবাহিনীকে ব্য়াবহার করা হয়েছে কেন্দ্রের খুশি মোতাবেক আব্য়্ন্তরীন 'শান্তি' বলবত রাখতে।

আসুন আবার ফিরে যাই পাকিস্তানের সামরিক পরিচালনা কৌশলে। ১৯৭০ এর শরতকালে পিণ্ডির সেনাধ্যক্ষরা পূর্বপাকিস্তানের সামরিক পরিচালনা কৌশল পাশ করল এবং পূর্ব পাকিস্তানের ভূখন্ডকে সেই কৌশল মোতাবেক প্রস্তুত করার পথে দুটি নতুন অপারেশনের সিদ্ধান্ত নেয়া হল। এর প্রথমটির লক্ষ্য হল সামরিক বাহিনীর ভেতরের হুমকি নির্মূল করা। প্রথম অপারেশনের সিংহভাগ বাস্তবায়নের পরে দ্বিতীয়টির বিস্তারিত পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন শুরু করার কথা সাব্যস্ত হল।

(ছবিসুত্রঃ উইকি]

প্রথম অপারেশন 'ব্লিটজ' ৭০ এর নভেম্বরে শুরু হল। সাহেব্জাদা ইয়াকুব খান ও সৈয়দ মোহাম্মদ হাসানকে যথাক্রমে পূর্ব পাকিস্তানের প্রধান সেনাপতি ও গভর্নরের দায়িত্ব থেকে প্রত্যাহার কর হল। পশ্চিম পাকিস্তান (জোন এ) এর সামরিক আইন প্রশাসক টিক্কা খানকে পূররব পাকিস্তানে বদলি করা হল। এমনিতেই পূর্বাঞ্চলে নিযুক্ত বাঙ্গালী অফিসারদের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেবার মত কেউ ছিলনা। যে কজন ছিল, তাদের মধ্যে যারা গর্ভবূহ্যের ভেতরের অবস্থানে ছিল, তাদের সেখান থেকে সরিয়ে সেনানিবাসের দাপ্তরিক কাজে বা গর্ভবুহ্যের বাইরের সামরিক স্থাপনায় বদলি করা হল। গর্ভবূহ্যের ভেতরের বাঙ্গালীদের প্রতি সহানুভূতিশীল হিসাবে পরিচিত পশ্চিমা অফিসারদের ওপর নজরদারি শুরু হল। অপারেশন 'ব্লিটজ' টপ সিক্রেট হওয়ার কথা থাকলেও সামরিক ও বেসামরিক সরকারি মহলে এর কোন গোপনীয়তা রইল না।

অপারেশন ব্লিটজের বেসামরিক ফলো-আপ হিসাবে নির্দিষ্ট দ্বিতীয় অপারেশনটি নিয়ে পিণ্ডিতে একটি উচ্চ-ক্ষমতা সম্পন্ন সভা বসল ১৯৭১ এর ফেব্রুয়ারি মাসের ১২ তারিখে। তার পরে জেনারেল হামিদ পিণ্ডি থেকে ঢাকায় অবস্থানরত রাও ফর্মান আলী ও খাদিম হোসেন রাজাকে সরাসরি টেলিফোনে অপারেশন ব্লিটজ এর ফলো-আপ সেই অপারেশন এর পরিকল্পনার দায়িত্ব দিল। চেইন অফ কমান্ড অনুযায়ী আলী-রাজার কাছে এই কাজের নির্দেশ টিক্কা খানের কাছ থেকে আসার কথা ছিল। কিন্তু মাত্র এই কয়েকদিনেই টিক্কার ওপর পিণ্ডির আস্থা কমে গিয়েছিল বলে প্রতীয়মান হয়। হামিদ সেদিন আলীকে অপারেশন সুন্দরবনের আদলে এই নতুন অপারেশনের সেনা-মোতায়েন ও সফলতার মুখ্য নিয়ামক গুলো চিহ্নিত করতে বলে। আর রাজাকে এইসব নিয়ামকের ভিত্তিতে মাঠ পর্যায়ে, মানে ব্রিগেড ওয়ারি কার্যক্রম বানাতে বলা হল। বেসামরিক ও রাজনৈতিক পরিস্থিতি, বিশেষ করে সেসময়ে পূর্বপাকিস্তানের অসহযোগ আন্দোলন ও সামরিক-বেসরকারি প্রক্রিয়াতে তার প্রতিফলন দেখে পিণ্ডি অধীরতা বাড়ছিল। দ্বিতীয় এই অপারেশনে তাই কার্যকারিতার চাইতে এর গতির প্রাধান্য দেয়া হল।

আলী-রাজা কে পরিকল্পনা তৈরির জন্য দেয়া হল মাত্র ২৪ ঘণ্টা। এই অপারেশনের নাম দেয়া হল ‘অপারেশন সার্চলাইট’। এর মূল লক্ষ্য ছিল পুরো পূর্ব পাকিস্তান ব্যাপী মূলত আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী সকল সংস্থাকে নিশ্চিহ্ন করে দিয়ে সকল জনপদে সেনাবাহিনীর আধিপত্য নিশ্চিত করা। আলী-রাজা এই অপারেশন সফল করতে কয়েকটি আবশ্যিক নিয়ামক উল্লেখ করল:

১. এই অপারেশন চলাকালে ভারতীয় সেনাবাহিনী কোনভাবে বাগড়া দেবেনা।
২. সারা পূর্বপাকিস্তানে একযোগে এই অপারেশন শুরু হবে।
২. সারা পূর্ব পাকিস্তানের বেসামরিক রেডিও, টেলিভিশন ও টেলিফোনের ব্যাবহার রহিত করা হবে।
৩. রাজনৈতিক ও ছাত্রনেতাদের একটি ফর্দ অনুযায়ী যতজনকে গ্রেফতার ও বন্দী করা সম্ভব, করা হবে।
৪. ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও এর সংলগ্ন রাজনৈতিক গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় সর্বোচ্চ ভীতির সঞ্চার করে সেখানে পূর্ণ সামরিক আধিপত্য নিশ্চিত করতে হবে। এখানে নির্বিচারে গোলাগুলির অনুমতি দিতে হবে।

ধরে নেয়া হল এইসব আবশ্যিক নিয়ামক নিশ্চিত করতে পারলে অপারেশনটি মার্চের শেষ সপ্তাহে শুরু এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে শেষ হবে।
Adm Shariff and Gen Niazi review the position in East Pakistan in 1971

(ছবিসুত্রঃ ফ্লিকার)

মার্চের ১৯ ও ২০তারিখ ইয়াহিয়া-হামিদ-টিক্কা সহ পিণ্ডির সর্বোচ্চ সামরিক নেতৃবৃন্দ এই পরিকল্পনার পর্যালোচনা করল। আলি-রাজার পরিকল্পনায় সেনা, পুলিশ ইত্যাদির বাঙ্গালী সদস্যদের নিরস্ত্র করা অন্তর্ভুক্ত ছিলনা। পরিকল্পনাকারী হয়েও আলী-রাজা ও ইয়াকুব খান সেই সময়ে অপারেশন সার্চলাইট শুরু করার তীব্র বিরোধিতা করল। কারণ তখনকার পরিস্থিতিতে এরকম একটি অপারেশনের সাফল্যলাভের বাস্তবতা নিয়ে তাদের গভীর সন্দেহ ছিল। সভায় ভারত ইস্যুটিও বেশ বিস্তৃতভাবে এলো। ভারতের পূর্বাঞ্চলের সামরিক-সম্পদ, সরবরাহ-ব্যবস্থা , আসন্ন বর্ষা মওসুম ইত্যাদিও আলোচনায় এলো।

আলোচনা যাই হোক, শেষপর্যন্ত বাঙ্গালী সৈনিকদের নিরস্ত্র করা ও ভারত কে আপাতত উপেক্ষা করার সিদ্ধান্ত নিয়ে অপারেশন সার্চলাইট পাশ হয়। এর পাশাপাশি পাকিস্তান নৌবাহিনীকে ‘অপারেশন বরিশাল’ নামে আরেকটি স্বতন্ত্র ও অপেক্ষাকৃত ক্ষুদ্র অপারেশনে ঢাকা-বরিশাল-খুলনার নদীপথ, বিশেষ করে চট্টগ্রাম থেকে নারায়ণগঞ্জের জ্বালানী সরবরাহ পথকে নিয়ন্ত্রণে আনাতে বলা হয়। একই সাথে পাকিস্তান বিমানবাহিনীকে বেসামরিক বিমান ব্যাবহারের অনুমতি দিয়ে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে দুই ডিভিশন সৈন্যকে পূর্বাঞ্চলে পরিবহন করে নিয়ে যাবার জন্য ‘অপারেশন গ্রেট ফ্লাই ইন’ পাশ করা হয়।

অপারেশন সার্চলাইটের সফলতা ছিল মিশ্র। ১০ এপ্রিল নাগাদ পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী সম্মুখবুহ্যের একটি অংশ, মানে রংপুর, কুমিল্লা, চট্টগ্রাম আর খুলনার ও প্রদেশের বেতারকেন্দ্র ও বিমানপোত ইত্যাদি দখলে নিতে পারল। কিন্তু রাজশাহী, সিলেট, পাবনা, দিনাজপুর,ময়মনসিংহ আর কুষ্টিয়ার মত সম্মুখবুহ্যের কিছু গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা দখলে আনতে পারলোনা। ২৫ মার্চের অপারেশনের শুরুতেই বাঙ্গালী সৈনিকেরা হাতের কাছে যে যা অস্ত্র পেল, তা নিয়ে সেনানিবাস থেকে বেরিয়ে এল। সুতরাং ঢাকার বাইরের সার্চলাইটে অনিয়মিত ও বেসামরিক সম্পদের ওপর নির্ভরশীলতা বাড়ে। তদুপরি যেখানেই পশ্চিম পাকিস্তানি শক্তি এগুনোর চেষ্টা করেছে, সেখানেই স্থানীয় জনগণের নিরুতসাহিতা তাদের গতি স্তিমিত করে দিয়েছিল। কোথাও কোথাও অনভিপ্রেত গণ-প্রতিরোধের মুখোমুখি হল সামরিক বাহিনী। বাঙ্গালীরা যে একেবারে অপ্রস্তুত ছিল, সেটা নয়। এই প্রস্তুতিতে ভারতের রাজনৈতিক সহায়তা ছিল। কিন্তু সেইসব সহায়তায় ভারতীয় পূর্বাঞ্চলের সামরিক নেতৃত্বের একটি সীমিত অংশ সংশ্লিষ্ট ছিল।

আলী-রাজা যেসব ঝুঁকির কথা বলেছিল, সার্চলাইট নিয়ে মাঠে নেমে পিণ্ডি দেখল ঠিক সেইসব সমস্যাগুলোই বাস্তব হয়ে তাকে নাজেহাল করছে। পিণ্ডির নধর হাঁটুগুলো তাদের দুরারোগ্য অকাল-স্খলনের অভ্যাসবশত এই সুবিশাল সময়-জ্ঞানহীনতা ঢাকতে, আগের মতই, প্রশাসনিক বদলের শরণাপন্ন হল। টিক্কাকে সামরিক দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেয়া হল, আলী রইল তার বেসামরিক উপদেষ্টা হিসেবে। খাদিম রাজাকে পশ্চিমে ফেরত নেয়া হল।

এপ্রিলের ১১ তারিখ পূর্বাঞ্চলের দায়িত্ব দেয়া হল নিয়াজিকে। ইতোমধ্যে পুরো দুই ডিভিশন সৈন্য পশ্চিম পাকিস্তান থেকে পূর্ব পাকিস্তানে এসে পড়ল। স্থানীয় দালালদের সংঘবদ্ধতা বৃদ্ধি পেল। ওদিকে সীমানার ওপারে ইস্টবেংগল রেজিমেন্টের পালিয়ে আসা সৈনিক-অফিসারেরা তাদের অবসরপ্রাপ্ত কর্নেল আতাউল গনি ওসমানীর নেতৃত্বে সংগঠিত হতে শুরু করলেও শিশু মুক্তিবাহিনীর প্রশিক্ষণ, লোকবল, রসদের অভাবসহ আরো নানান দুর্বলতার ভেতরে নিয়াজি ও তার দল সার্চলাইটকে সামনে এগিয়ে নিতে পারল।

মে মাসের মাঝামাঝি সময়ে এসে পূর্ব পাকিস্তানের সম্পূর্ণ ভূখণ্ড সামরিক বাহিনীর অধীনস্থ হল।

যদিও এপ্রিল মাসে ভারতের রাজনৈতিক-সামরিক নেতৃত্ব অপারেশন সার্চলাইট নিয়ে কথা বলছিল, কিন্তু টিক্কার সীমিত সাফল্য এবং ঘাড়ের ওপরের হোঁৎকা ‘পাণ্ডা’ নিয়ে সরাসরি সেনা মোতায়েন না করার সিদ্ধান্ত নিল ভারত। তবে নিয়াজির সাফল্য দেখে তারা নড়েচড়ে বসল। প্রাথমিক প্রতিক্রিয়া হিসেবে পউররনাংগ সেনা-মোতায়েনের আগপর্যন্ত বাঙ্গালী সামরিক ও বেসামরিক সম্পদকে ব্যাবহার করে গেরিলা যুদ্ধ পরিচালনার জন্য ‘অপারেশন জ্যাকপট’ এর সিদ্ধান্ত নেয়া হয়, সেই সাথে মে মাসের ১৫ তারিখে আনুষ্ঠানিক ভাবে মুক্তিবাহিনীর দায়দায়িত্ব ভারতীয় সেনাবাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় নেতৃত্বের হাতে অর্পিত হয়। শুরুর দুইমাস অপারেশন জ্যাকপটের দায়িত্ব ওঙ্কার সিং কালকাটের হাতে থাকে, সেসময়ে মূলত মুক্তিযোদ্ধা প্রশিক্ষণ ব্যবস্থার গোড়াপত্তন হয়। জুলাই মাসে যখন প্রশিক্ষিত মুক্তিযোদ্ধাদের প্রথম ব্যাচগুলো বেরিয়ে আসতে শুরু করে তখন অপারেশন জ্যাকপটের হাল ধরে জিমি সরকার।

১৮ তারিখে দিল্লী পূর্ব-পাকিস্তান ‘সমস্যা’ কে পুরোপুরি আনুষ্ঠানিকভাবে তার সেনাবাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় নেতৃত্বের হাতে হস্তান্তর করল। ভারতীয় পরিকল্পনাবিদেরা পশ্চিম-পাকিস্তান দখলের পরিচালনা কৌশল নিয়ে কাজে শুরু করল। তাদের তথ্য উপাত্তের উৎসের অভাব ছিলনা। তবুও শুধুমাত্র পাকিস্তানের সম্মুখ বুহ্যগঠন থেকে তারা অনুসিদ্ধান্তে পৌঁছল যে পাকিস্তানি বাহিনী সারা পূর্বপাকিস্তানকেই আঁকড়ে রাখার চেষ্টা করবে। পাকিস্তান যেমন অপারেশন সার্চলাইট পর্যালোচনায় ভারতের আক্রমণের হিসাবনিকাশ করেছিল। ঠিক তেমনি ভারতও তার পূর্বপাকিস্তানের সামরিক পরিচালনা কৌশলে চীনের হস্তক্ষেপের হিসাব নিকাশ করছিল। এটা সত্য যে চীনা পদাতিক ও সোজোঁয়া বাহিনী যত বড়ই হোক না কেন, হিমালয় পেরিয়ে একটি পুরাদস্তুর আক্রমণ বেশ জটিল ও কঠিন একটি কাজ হত। কিন্তু ভারতের পূর্বাঞ্চল যখন পূর্ব পাকিস্তানের ব্যস্ত থাকবে তখন ঠিক সময়ে সঠিক সেনা পরিচালনা করলে চীন সিকিম ও ভুটান দখল করে নিতে পারতো, এবং মুর্গীর গলা চিপে ধরতে পারতো। সুতরাং হিমালয়ের গিরিপথগুলো বরফে অকেজো হয়ে যাওয়ার পরেই আক্রমণ শুরু করলে চীনা হুমকি অনেকটাই অকার্যকর থাকবে।

এই ভিত্তিতে ভারতীয় পূর্বাঞ্চলের সামরিক নেতৃত্ব পূর্বপাকিস্তানে তার পরিচালনা কৌশল ঠিক করে নিল। আক্রমণ সরাসরি পশ্চিম বা সরাসরি পূর্ব দিক থেকে না করে পাকিস্তানি সম্মুখবূহ্যের সমান্তরালেই ভারতীয় মূল আক্রমণের পরিকল্পনা করা হল। এভাবে মূলত পাকিস্তানি বাহিনীর সম্মুখবুহ্যেকে ছোট ছোট অংশে বিভক্ত করে তাদের শায়েস্তা করা যাবে। তবে এসব ঘটবে শরতকালে। মে মাস থেকে সেপ্টেম্বরের এই সময়টি ভারতীয় গোলন্দাজ বাহিনীর ছত্রছায়ায় মুক্তিবাহিনী গেরিলা কৌশলে পাকিস্তানের সেনাবাহিনীকে যতটা সম্ভব গর্ভবূহ্যের বাইরে ব্যস্ত রাখবে।

পূর্বপাকিস্তানকে মোটামুটি চারটি সেক্টরে ভাগ করে সেনা-মোতায়েনের পরিকল্পনা হয়। যমুনার পশ্চিম ও পদ্মার উত্তরে অংশকে উত্তর-পশ্চিম সেক্টর ধরে সেখানে একটি ডিভিশন মোতায়েন করার কথা থাকে। হিলি-গাইবান্ধা বরাবর এগিয়ে এই ডিভিশনটি বগুড়া দখল করে ঢাকা-মুখী যাত্রার অপেক্ষা করবে। যমুনার পূর্বে আর মেঘনার উত্তরের এলাকাকে উত্তর-পূর্ব সেক্টর ধরে জামালপুর-টাঙ্গাইল বরাবর এসে একটি ডিভিশন ঢাকা-মাওয়া রাস্তার দখল নেবে। মেঘনার পূবে সিলেট-কুমিল্লা-চট্টগ্রামসহ এলাকাকে দক্ষিণপূর্ব সেক্টর ধরে নিয়ে সেখানে মোট তিনটি ডিভিশন আশুগঞ্জ ও চাঁদপুরের মাঝামাঝি এলাকা দিয়ে সীমানা অতিক্রম করে আশুগঞ্জ, দাউদকান্দি ও চাঁদপুর দখলে নেবে। চট্টগ্রামের দায়িত্ব দেয়া হয় ভারতীয় নৌবাহিনীর হাতে। পদ্মার দক্ষিণে আর মেঘনার পশ্চিমের এলাকা নিয়ে পশ্চিম সেক্টর ধরে সেখানে দুটি ডিভিশন মোতায়েন করার কথা থাকে। এই ডিভিশন দুটি দুটি আলাদা কলামে একটি ঝিনাইদহ-যশোর বরাবর ও আরেকটি মুর্শিদাবাদ-কুষ্টিয়া বরাবর এগিয়ে মধুমতীর পাড়ে একত্রিত হয়ে ফরিদপুরে অবস্থান নিয়ে ঢাকা আক্রমণের জন্য প্রস্তুত থাকবে।

(ছবিসুত্রঃ উইকি)

মোট সাতটি পূর্নাংগ ডিভিশন নিয়ে ভারতীয় আক্রমণাত্মক পরিচালনা কৌশল সাজানো হয়।

আগে দেখেছি, পাকিস্তান এসময়ে পূর্বাঞ্চলে মোট দুটি পূর্নাংগ ও একটি আংশিক ডিভিশন মোতায়েন করেছিল। অপারেশন সার্চলাইট সমাপ্ত হবার পরে নিয়াজি তার ডান হাত গোলাম জিলানীকে নিয়ে সার্চলাইটের অভিজ্ঞতা, মুক্তিবাহিনী ও ভারতের কার্যকলাপের আলোকে পূর্বাঞ্চলের পরিচালনা কৌশল পুনর্বিবেচনা শুরু করে। আগের কৌশলে অনুসিদ্ধান্ত ছিল যে ভারতীয় মূল আক্রমণ আসবে পশ্চিম থেকে এবং তা প্রথম ধাক্কায় যমুনার পশ্চিম-পাড় পর্যন্ত দখলে নেবার, এবং পূর্ব দিক থেকে গৌণ আক্রমণ আসবে। জিলানী এই অনুসিদ্ধান্ত পরিবর্তন করল। এবারের অনুসিদ্ধান্ত হল ভারতীয় মূল আক্রমণ আসবে পূর্ব দিক থেকে। এই ভিত্তিতে পরিচালনা কৌশলে কিছু পরিমার্জনা করা হল।

(ছবিসত্বঃ উইকি)

(চলবে)


মন্তব্য

হিমু এর ছবি

পড়ছি। চলুক।

চরম উদাস এর ছবি

চলুক

ত্রিমাত্রিক কবি এর ছবি

আমিও পড়ছি।

_ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _
একজীবনের অপূর্ণ সাধ মেটাতে চাই
আরেক জীবন, চতুর্দিকের সর্বব্যাপী জীবন্ত সুখ
সবকিছুতে আমার একটা হিস্যা তো চাই

কালো কাক এর ছবি

রেফারেন্স ?

অনিন্দ্য রহমান এর ছবি

অ.ট. গুর্খাদের হিস্ট্রি কী?


রাষ্ট্রায়াত্ত শিল্পের পূর্ণ বিকাশ ঘটুক

সৈয়দ নজরুল ইসলাম দেলগীর এর ছবি

চলুক

______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

শোয়েব মাহমুদ সোহাগ এর ছবি

চলুক। চলুক

স্বাধীন এর ছবি

চলুক

পথিক পরাণ এর ছবি

অত্যন্ত উপাদেয় আলোচনা। সাথেই আছি। চলুক।

একটা বিষয়। আলী রাজার পরিকল্পনায় বাঙ্গালী সেনা পুলিশদের নিরস্র করার বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত ছিল না বলে উল্লেখ করেছেন। ২৫ মার্চ রাতেই রাজারবাগ পুলিশ লাইন আর পিলখানায় বাঙ্গালীদের উপর আক্রমণ চালানো হয়েছিল। এই আক্রমণের নতুন কোন পরিকল্পনা ছিল কিনা জানালে খুশি হব।

আরেকটি বিষয়। আপনি অনেক কষ্ট করে এতসব গুরুত্বপূর্ণ তথ্য জোগাড় করে লিখছেন। তথ্যের উৎসগুলোর রেফারেন্স রাখলে লেখাটি আরও সমৃদ্ধ হতো।

-------------------------
পথেই আমার পথ হারিয়ে
চালচুলোহীন ছন্নছাড়া ঘুরছি ভীষণ...

দুর্দান্ত এর ছবি

পড়আর জন্য় ধন্য়বাদ।
১৮ তারিখে পিন্ডিতে পাঠানো আলী-রাজার প্রাথমিক খসড়আয় হুমকি/ঝুঁকি হিসাবে বানংগালী সোঈনিক, ইপিআর ও পুলিশের বিদ্রোহ ও প্রতিরোধের কথা ছিল - এইসব ঝুঁকির সাইয়িক প্রশমনের জন্য় তাদের অপারেশনের প্রারম্ভেই নিরস্ত্র করা হলে তার সুদুরপ্রসারী নেতিবাচল ফল হিসাবে একটি জটিল পরিস্থিতি স্ররিষ্টি হবার কথা উল্লেক ছিল। ১৯ তারিখে হামিদ সেই পরিকল্পনা থেকে সোইনিকদের বাদ দিয়ে শুধু ইপিআর ও পুলিশকে নিরস্ত্র করার সুপারিশ করে। কিন্তু ২০ তারিখে ইয়াহিয়া সহ পিন্ডির অন্য়ান্য় সেনানায়কেরা যখন চুড়আন্ত পরিকল্পনা পাশ করে, তখন সেখানে বাহিনী নিররবিশেষে সকল সকল বানংগালকে নিরস্ত্র করার কথা থাকে।

একটি সম্ভাবনা হতে পারে, পিন্ডি ঢাকার সম্ব্য়াব্য় প্রতিরোধের অনুমাপ করে বুঝেছিল যে শক্তি প্রয়োগ করা হলে রক্ত বইবে, কিন্তু শীঘ্রই পরিস্থিতি পশ্চিমের নিয়ন্ত্রনে আসবে। তবুও বানংগালী অফিসারদের 'বিনীয়োগ' করে ভারতের প্রতিক্রিয়ার গতি ও তীব্রতা সুনিশ্চিত হওয়া যাবে।

মনে রাখতে হবে পরিচালনা কোঊশল আর অপারেশন সাররচলাইটে পিন্ডির প্রতিপক্ষ হল ভারত। বানংগালীরা এখানে ভারতের বিরুদ্ধে ব্য়াবহারযোগ্য় পাকিস্তানের অনেকগুলো হাতিয়ারের একটি।

হিমু এর ছবি

আপনার এই বানান বিপর্যয়ের হেতু কী?

দুর্দান্ত এর ছবি

আমি আর সচলে কি-বোররড দিয়ে বানংলা লেখার অপশান টা দেখি না। তাই যুক্তাক্ষর গুলো ভেজাল লেগে যাচ্ছে। অফিসের মেশিনে অভ্র চালানোর উপায় নাই।

হিমু এর ছবি

এতদিন সচলে থেকে এ-ই শিখলেন? কনট্রোল + অল্ট + পি টিবি দ্যান, ফোনেটিক বাংলা লেআউট সক্রিয় হয়ে যাবে। অভ্র লাগবে কেন?

দুর্দান্ত এর ছবি

কত অজানারে। চোখ টিপি

হিমু এর ছবি

এইবার ফাডায়ালান

দুর্দান্ত এর ছবি

হয়না। যুক্তাক্ষরে গিয়াঞ্জাম কইরা ফেলে।

তারাপ কোয়াস এর ছবি

চলুক


love the life you live. live the life you love.

অন্যকেউ এর ছবি

তথ্যসূত্র উল্লেখ করে দিলে ভালো হয়। আর, সিরিজের আগের পর্বগুলোর লিঙ্ক লেখার শুরুতে যোগ করে দিলে, যারা নতুন করে পড়তে শুরু করবে তাদের সুবিধে হবে।
চমৎকার এগোচ্ছে। চলুক। চলুক

_____________________________________________________________________

বরং দ্বিমত হও, আস্থা রাখো দ্বিতীয় বিদ্যায়।

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

যেহেতু এটা ইতিহাসের বিস্তারিত ও ভিন্ন পাঠ, তাইঃ
১। রেফারেন্সগুলোর তালিকা দরকার
২। গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাগুলোর বিস্তারিত ব্যাখ্যা দরকার
৩। পাঠকের বোঝার সুবিধার্থে মানচিত্র দরকার
৪। ঐতিহাসিক চরিত্রগুলোকে চিনে রাখার জন্য তাদের ছবি দরকার সাথে জীবনীর লিঙ্ক
৫। লেখা শেষে ডেটলাইন ধরে একটা সামারি দরকার
৬। পাকিস্তান, ভারতের পাশাপাশি আমাদের সামরিক নীতি ও কৌশল নিয়ে আলোচনা দরকার (এটা মনে হয় সামনের পর্বগুলোতে থাকবে)

আরো কিছু চাওয়া আছে যা ক্রমে প্রকাশিতব্য।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

দুর্দান্ত এর ছবি

আগে যেভাবে সচলে বোতাম টিপে ছবি, লিন্ক দেবার উপায়গুলো ছিল, এগুলো আর দেখিনা। বিকল্প পথ শিখছি। আমার আলস্য় সেই শেখা ও তার প্রয়োগকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে পারে।

তবে পরের পররবগুলোতে আপনার এই চেকলিস্ট ব্য়াবহার করব - কথা দিলাম।

কাশফুল এর ছবি

দারুণ সিরিজ। চলুক

প্রতিক এর ছবি

নেশায় পেয়ে গেছে। যুদ্ধ কৌশল নিয়ে এমন লেখা আগে পড়ার সুযোগ পাইনি কখনো। তার উপর আমাদের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে লেখা তো আরও উপাদেয়। খুব কৌতূহল হচ্ছে, আপনি কি সামরিক বাহিনীতে আছেন?

বাকিদের মতো আমিও অনুরোধ জানাচ্ছি রেফেরেন্স দেবার জন্যে।

ধ্রুবনীল এর ছবি

যুদ্ধ কৌশল নিয়ে লেখা দারুণ একটা সিরিজ... আগ্রহ নিয়ে পড়ছি, চলুক!

সাফি এর ছবি

পড়ছি। চলুক চলুক

দ্রোহী এর ছবি

পড়লাম। চলুক

পরের পর্বে যাই এবার।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।