ইচিং বিচিং তিচিং চা

দুর্দান্ত এর ছবি
লিখেছেন দুর্দান্ত (তারিখ: সোম, ০৫/০৩/২০১২ - ১১:১৮অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

১৯৭৩ সালের শরৎকালের এক সন্ধ্যায় বৃষ্টি ঝির ঝির ইস্তাম্বুল। ব্রিটিশ সওদাগরি প্রতিষ্ঠান এক্সপোর্ট-ইম্পোর্ট এর টেলেক্স ঘর। টেলেক্স যন্ত্রের পাশে অধীর আগ্রহে বসে আছে রিকি টার। অন্য সন্ধ্যাগুলোতে রিকিকে আমরা দেখতে পেতাম ইস্তাম্বুলের নিষিদ্ধ এলাকার কোন নাইটক্লাবে। নাইটক্লাবের তরুণীদের মধ্যে যারা রিকির নীল চোখ আর চোস্ত তুরকী বোলচালের রহস্য সমাধান করতে গিয়ে আর সুশীল দূরত্ব রাখতে পারেনা, তাদের কেউ হয়তো বলতে পারবে রিকির চৌকো চোয়াল, মসৃণ সোনালী চুল নাকি তার পেশীবহুল দীর্ঘ শরীর এর মধ্যে ঠিক কোনটি তাকে সুপুরুষ বলে পরিচিত করেছে।

ইস্তাম্বুলের তরুণীরা তাকে নিয়ে কি ভাবে বা সেসব অপ্সরীদের কালো চোখ, রেশমি চুল বা তাদের সুললিত শারীরিক কাঠামো নিয়ে সুদীর্ঘ গবেষণায় রিকির কোন আগ্রহ আছে কিনা, সেটা আমাদের জানা হয়না। আজকের এই মায়াবী সন্ধ্যায় রিকির করোটির সবটুকু স্থান অন্যকিছু দখল করে নিয়েছে।

ইস্তাম্বুলে আসার পর থেকে রিকি এক রুশ বাণিজ্যিক প্রতিনিধির ওপর নজর রাখছিল। এই কয়েকদিনে একটা বিষয়ে তার আর কোন সন্দেহ নেই। রুশ প্রতিনিধি ও তার স্ত্রী ইরিনা দুজনেই সোভিয়েত গুপ্তচর।

আরো একটি ঘটনা ঘটেছে।

রিকির মত যেকোনো সু-প্রশিক্ষিত ব্রিটিশ ইন্টেলিজেন্স অফিসারের জন্য সে এক অকল্পনীয় দুঃস্বপ্ন। রিকি ইরিনার প্রেমে পড়ে গেছে। মেয়েমানুষ রিকির কাছে নতুন কিছু নয়। কিন্তু অবাক হয়ে লক্ষ করেছে রিকি। ইরিনার প্রতি তার টান একেবারেই নিখাদ। এ ব্যাপারেও এতটুকু সন্দেহ নেই রিকির মনে। সে ইরিনাকে ভালবাসে। সে ইরিনাকে আপন করে পেতে চায়।

ইরিনাও রিকিকে পছন্দ করেছে। তবে সোভিয়েত ইরিনা বিষয়ী। সে রিকির আহবানে সাড়া দেয়, সেই সাথে জুড়ে দেয় একটি শর্ত। রিকির হতে তার কোন বাধা নেই, তবে সেজন্য তাকে পাকাপাকি ভাবে পশ্চিমে নিয়ে যেতে হবে রিকিকে। সোভিয়েত গুপ্তচর প্রশিক্ষণকেন্দ্র বোকাদের পাঠশালা নয়। ইরিনা জানে লন্ডনের ওপরওয়ালার মদদ ছাড়া রিকির এক চুল নড়ার ক্ষমতা নেই; কিন্তু সেই ওপরওয়ালারা ইরিনাকে সহায্য করবে কেন? লন্ডনের ওপরওয়ালাদের জন্য এক অভাবনীয় উপহারের প্রতিশ্রুতি দেয় সে। ব্রিটিশ গুপ্ত-বাহিনীর একেবারে গভীরে লুকিয়ে থাকা এক বেঈমানের খোঁজ আছে তার কাছে।

এই বৃষ্টি ঝির ঝির মায়াবী সন্ধ্যার অনিশ্চয়তায় শ্বাসরুদ্ধ রিকি ইরিনার সেই প্রস্তাবটিই টেলেক্স করেছিল লন্ডনে। কি জবাব আসবে লন্ডন থেকে? লন্ডন রাজী হলে, তাবেই সে আর ইরিনা গড়তে পারবে সুখের সংসার। আর যদি ঘটে যায় অঘটন? যদি লন্ডন গররাজী হয়, তাহলে সে হারাবে ইরিনাকে। চিরতরে। এমনকি তাকে নিজ হাতেই ইরিনার 'ব্যবস্থা' করতে হতে পারে।

আর সামনে এগুবো না। তবে বলে রাখি গতানুগতিক অনেক রহস্যগল্পের মত রিকি বা ইরিনা আমাদের এই গল্পের মূল চরিত্র নয়। দাবার গুটির সাথে মিলিয়ে বললে, আমাদের এই গল্পে রিকি আর ইরিনা বড় জোর বড়ে হতে পারে। ঠান্ডাযুদ্ধের শেষদিকের পটভূমিতে ফুটে ওঠা এই গল্পের প্রতিটি মোড়ে রহস্য, গোপনীয়তা আর ছলচাতুরীর আলো-আঁধারি। ছবির শুরুতে এর এক মুখ্য চরিত্রকে গম গমে গলায় যখন বলতে শুনি "দেয়ারস এ রটেন অ্যাপল" তখন আমরাও নড়েচড়ে বসি অসাধারন একটি ঘটনার অপেক্ষায়। পরিচালক টমাস আলফ্রেডসন বা মূল উপন্যাসের লেখক জন ল'কারে আমাদের নিরাশ করেননি। গতানুগতিকতা থেকে অনেক দূরে গিয়েই তারা ক্ষান্ত হয়েছেন।

টিঙ্কার টেইলর সোলজার স্পাই একটি রহস্যগল্প, এতে সন্দেহ নেই। তবে এর প্রতিটি দৃশ্য এক একটি আলাদা স্বাদের উৎকণ্ঠায় ঠাসা। সে আতঙ্ক গড়পরতার হলিউডি মোটা দাগের নয়। এ আরো গভীর। এর তাল ও লয় লক্ষ্য করার মত প্রমিত। তদুপরি ভালবাসার রকমফের নিয়ে, আর কত বিচিত্র পরিস্থিতিতে নারী ও পুরুষেরা প্রেমে পড়তে পারে, এই ছবিটি যেন তারই এক চলমান আলোচনা।

দেখুন, ভাল লাগবে।

****

শিরোনামের শান এ নূযুল্ঃ এই উপন্যাস ও ছবির শিরোনাম একটি ইংরেজই নার্সারি রাইম্ অনুসারে:

Tinker, Tailor,
Soldier, Sailor,
Rich Man, Poor Man,
Beggar Man, Thief.

ইংল্যান্ডে পিচ্কিপাচ্কারা এই ছড়া দিয়ে ঠিক করে ছোঁয়াছুঁয়ি জাতীয় খেলায় 'চোর' কে হবে। আমরা ছোটবেলায় যে ছড়া পরে চোর ঠিক করতাম সেটা ছিল্ঃ

ইচিং বিচিং তিচিং চা
প্রজাপতি উড়ে যা !


মন্তব্য

ধূসর জলছবি এর ছবি

ডাউনলোড দিয়ে দিয়েছি হাসি , ধন্যবাদ ।

পাঠক এর ছবি

সিনেমাটা ভালো লাগ্ছে।
মেফিস্টো

প্রৌঢ় ভাবনা এর ছবি

শুরুতে বর্ণনে মনে হয়েছিল, আপনি বোধহয় আপনার জানা কোন ঘটনা শেয়ার করছেন। পরে মনে হলো বুঝিবা আপনার লেখা কোন গল্প। যাহোক, গল্পতো বটেই, তবে কিনা__।

অন্য প্রসঙ্গ : আপনার অফিসের কর্তারা বোধহয় জানে, এই অফিসে বসে লেখালেখির কথা আরকি। তাই আপনার ল্যাপির এই অবস্থা!

দুর্দান্ত এর ছবি

যাচ্চলে। ধরাটা পড়েই গেলাম। ম্যাঁও

প্রৌঢ় ভাবনা এর ছবি

ত্রুটিগুলো তাহলে মেরামত করে ফেলেছেন।
আমার মন্তব্য কলামের দ্বিতীয় অংশটি তাহলে বাতিল।

তাসনীম এর ছবি

অস্কারের পরে একটা তালিকা তৈরি করেছি, এই ছবিটাও আছে তাতে। গতরাতে দেখলাম হুগো।

________________________________________
অন্ধকার শেষ হ'লে যেই স্তর জেগে ওঠে আলোর আবেগে...

তারেক অণু এর ছবি
সবুজ পাহাড়ের রাজা এর ছবি

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।