আমস্টারডাম থেকে রটারডামে ফিরছি। রেলগাড়ির বাইরে মেঘের কোলে রোদ হেসেছে বাদল গেছে টুটি। মাঠ আর জনপদ পেছনে চলে যাচ্ছে দ্রুত গতিতে। একই দ্রুততায় আমার মন চলে গেছে ছেলেবেলার এক অলস দুপুরে। দুপুরে খাওয়া হয়নি। তাই বোধ হয় মনটা ঘোরাফেরা করছে আমাদের সেই পুরাতন বাড়ির হেসেলে। আপনার মনে আছে সেই দিনগুলোর কথা? যখন প্রায় সব বাড়ীর হেঁসেলেই মিটসেফ বলে একটা আসবাব থাকত। সেই যে, কাঠের তৈরী, তাক-তাক, সামনে মিহি ধাতব জাল। মাটির তৈরী চাকার মত একটা কাঠামোর ওপর খাবার ভরা হাঁড়ি-কড়াই ঢাকা দেয়া থাকতো।
গ্রীষ্মের অলস দুপুরগুলোতে মা ঘুমিয়ে গেলে, খেলার ফাঁকে এই মিটসেফের ভেতর থেকেই টুপটাপ স্ন্যক হিসেবে এক-একটা মাছ তুলে মুখে পুরে দিয়েছি কতবার। ছোট ট্যংরা অথবা খলিসা এমনকি শিংমাছের মাথাও। পরে মা জেগে উঠে কোন এক অজানা বিড়ালের গুষ্টি উদ্ধার করতেন। আমি নিষ্পাপ চেহারা নিয়ে তার পেছন পেছনে হাটতাম। আমি মূলত মাংশাসী, তথাপি সপ্তাহে একদুবার ছোট মাছে না হলে আমার চলেনা। সে ছোট মাছ উত্তর সাগরের হোক, অথবা সিলেটের হাওড়ের হোক, তাতে কিছু এসে যায়না। মিটসেফের মাছগুলো আমার জীহবা ভোলেনি।
কথাটা ঠিক হলনা, মাছগুলো নয়, সেই মাছের গায়ে লেগে থাকা রোদেলা বাসন্তী রঙের ঝোল আমি ভুলতে পারিনি। সেই স্বর্গীয় মেওয়া আঙ্গুল বেয়ে তেল চিকচিকে এত ধীরে নেমে আসে যে সেটা চেটে নিতে পারা যায় একটু একটু করে। গন্ধটায় হলুদ আর পেঁয়াজের রেশ। শীতকালে ধনেপাতার কুঁচি। মাছের রকমফের ঝোল আছে। সানন্দা বা সিদ্দিকার বদৌলতে নতুন নতুন অনেক পদের ঝোল দিনের আলো দেখেছে, দেখছে। কিন্তু আমার মায়ের হাতের সেই মাছের ঝোল একটাই। এতে কোন কপটতা নেই, ভনিতা নেই। এ খুবই সরল, সিধেসাধা, প্রায়োগিক এবং সুস্বাদু। সে জিনিসের অনুকৃতি আমার ক্ষমতার বাইরে। তবে মাঝে মাঝে চেষ্টা করে নিজের একটা মাছের ঝোল দাঁড়িয়ে গেছে। সেটাই আমার সহজ মাছের ঝোল।
তো চলে আসুন রান্নাঘরে। এটা ছোট মাছের ঝোল, ছোট মানে আটপৌরে বাঙালীর একবিঘত দৈর্ঘের মাছ। এর চাইতে বড় মাছও চলবে, কিন্তু সেটা হতে হবে সাদা মাছ। চিংড়ি, কাকড়া, ব্যাঙ-এর ঠ্যাং ও মুরগির ডানাও এতে বেশ জমে। স্যামন বা টুনা এখানে চলবেনা। কৌটোর মাছতো একেবারেই না। মাছা ছাড়া আপনার লাগবে তেল, মিহি ফালি করে কাটা পেঁয়াজ (দেশী পেঁয়াজ বা শ্য়ালট হলে ভাল হয়), রসুনের ফালি, হলুদ গুড়া, শুকনা মরিচের গুড়া, লবন, ফালি করে কাটা কাঁচামরিচ ও ধনেপাতা কুচি। পরিমানগুলো জেনে নিন। মাছ ও পেঁয়াজ লাগবে সমানে সমান, মানে চায়ের কাপের এক এক কাপ করে। তেল লাগবে আধ কাপ। হলুদ ও ধনেপাতা এক টেবিল চামচ করে। মরিচ এক চা চামচ করে। লবন আধা চা চামচ। ৫ টা কাঁচামরিচের ফালিও লাগবে। মাছের পরিমান বাড়লে এই পরিমান গুলো আনুপাতিক হারে বাড়বে।
অনেকে মাছের আঁশটে গন্ধ পছন্দ করেননা। তাজা মাছের কোন বিশেষ কোন গন্ধ নেই, অদ্ভুত লাগলেও এটাই কিন্তু ঘটনা। মাছে আঁশটে গন্ধ মানেই মাছের পচন প্রক্রিয়া শুরু হয়ে গেছে। মাছে কাঁদার গন্ধ মানেই সেটার পরিপাকতন্ত্র ভাল করে পরিস্কার করা হয়নি। যদি উপায়ন্তর না পান, তাহলে এক কাপ মাছ আধ লিটার পানিতে এক টেবিল চামুচ হলুদ আর এক টেবিল চামুচ লবনে এক ঘন্টা ডুবিয়ে রাখেন, তারপর রান্নার আগে আবার পরিস্কার ভাল করে পানিতে ধুয়ে নেন, মাছের গন্ধ অনেকটা কমে যাবে। গন্ধওয়ালা মাছে লেবুর পাতা একটি বেশ প্রচলিত সংযুক্তি। বিদেশে চীনাদের দোকানে হিমায়িত লেবুপাতা পাবেন।
আমাদের সেই পুরাতন বাসায় একটা কাগজি লেবুর গাছ ছিল। আরো অনেক গাছে মাঝে। একটা রাবার গাছ ওর সমবয়স্ক ও প্রতিবেশী। রাবার গাছ বড় বড় তেলতেলে পাতা নিয়ে তর তর করে বেড়ে উঠে যাওয়ার ফলে বোধ হয় বেচার লেবুগাছটি আলো বাতাস ভাগে কম পেত। লেবু গাছটি বেশি বড় হয়নি অনেদিন। বছর ঘুরে যেত, কিন্তু তাতে না আসতো ফুলনা ধরতো লেবু। কিন্তু গাছটা বেজায় সুন্দর ছিল। তবুও উঠানে বোমব্লাস্ট বা ফ্রিজ্বি নিয়ে খেলার সময়ে লেবুগাছে গায়ে পড়ে গা ছিলেছি বেশ কবার। সেকারনেই লেবু গাছটাকে আমার বিশেষ পছন্দ ছিলনে অনেকদিন।
একদিন লক্ষ্য করলাম সেই গাছে ফুটে আছে এক থোকা ফুল। কি অসাধারন তার রূপ, কি মন মাতানো তার গন্ধ।
কারো কারো ভাজা মাছের ঝোল ভাল লাগে। তারা আগে পরিস্কার মাছগুলোকে কাপড় বা কিচেন টিসু দিয়ে শুকিয়ে নিন। তারপর এক কাপ কাঁচা মাছে এক টেবিল চামুচ তেল মাখান। এবার হালকা বাদামি করে ভেজে, তেল ঝরিয়ে রাখুন। এমনিতে কাচামাছের ঝোলই আমার পছন্দ। কিন্তু যদি মাছটা হয় কই, বা পুটি বা খলিসা - তাহলে সেগুলো আগে ভেজে নিলেই সুবিচার করা হয়। খেয়াল করুন, এখানে মাছে তেল মাখাতে বলছি, ফ্রাইং প্যানে কোন তেল দেবেন না, এতে মাছ লেগে যাবে। খুব ভাল ননস্টিক প্য়ান না হলে এভাবে না ভাজলে ছোট মাছ লেগে যাবার সম্ভাবনা উচ্চ।
রান্না করার জন্য় একটা মুখ খোলা পাত্র লাগবে। কড়াই হলে ভাল হয়। শুকনো পরিস্কার পাত্র চুলায় রেখে গরম হতে দিন। উত্তপ্ত পাত্রে সবটুকু তেল, পেঁয়াজ ও রসুন দিন। কড়াই বেশ শব্দ করে এদের স্বআগত জানাবে। তেলে প্রচুর বুদ্বুদ দেখা যাবার কথা। চার পাঁচ বার নাড়ুন যাতে সবগুলো পেঁয়াজে ও রসুনের গায়ে ঠিক মত তেল লাগে। কড়াই তখন পেয়াজকে অনেকটাই সহ্য় করে নিয়েছে। এসময়ে তেলের বুদবুদগুলো ছোট হয়ে আসার কথা। পেঁয়াজগুলোর ওপর কড়আ নজর রাখুন। কচকচা ভাব কমে কিছুটা নেতিয়ে পড়লে একে একে হলুদ ও মরিচ ঢালুন। আবার নাড়ুন। যাতে সবগুলো পেঁয়াজ ও রসুনের গায়ে মশলাগুলো ঠিক মত লাগে। যদি আপনি পাতলা ঝোল চান, তাহলে এখন আধ কাপ ট্য়াপের পানি যোগ করুন।
এবার আঁচ একেবারে কমিয়ে দিন। মাঝে মাঝে নাড়ুন, যাতে তলায় না লেগে যায়। ৮-১০ মিনিট পরে পেয়াজ সিদ্ধ হয় ঝোলে মিশে যাবার কথা। স্বআদ নিন। আপনার পছ্ন্দ অনুযায়ী লবন মেশান। এবার কাঁচা অথবা ভাজা মাছগুলো ঝোলে ঢেলে দিয়ে সাবধানে নাড়ুন, যাতে সবগুলও মাছের চারিদিক ঝোল ভাল করে লাগে। এবার কাচামরিচ ও ধনেপাতা যোগ করে ঢাকনা দিয়ে পাত্র ঢেকে দিন। ৮-১০ মিনিট পরে চুলা একেবারেই বন্ধ করে দিন।
আপনার মাছের ঝোল রেডি। গরম ভাত আর এক টুকরো লেবুর সাথে উপভোগ করুন। আমিও গুছিয়ে নেই, আর বারো মিনিট পরেই আমার স্টেশান।
মন্তব্য
নতুন মন্তব্য করুন