যুগলবন্দী

দুর্দান্ত এর ছবি
লিখেছেন দুর্দান্ত (তারিখ: রবি, ০৯/০৯/২০১২ - ৭:৩১পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

(এটি একটি ইউটিউব নির্ভর পোস্ট, ভিনদেশী মিউজিক ভিডিওতে গাত্রদাহ থাকলে এই পোস্ট আপনার ভাল লাগবে না)

আমরা যারা গান ভালবাসি তাদের কারো কারো আমার মত শুধু গান শোনার সাথেই সম্পর্ক। গান বোঝাবুঝি বা গাওয়াগায়ির মত এলেম আমার নেই। গানবাজনা সম্বন্ধে বিস্তর খোঁজখবর রাখার বুদ্ধিশুদ্ধি ও আগ্রহ নেই। কিছু কিছু গান কেন ভাল লাগে টের পাই। কিন্তু সেগুলো কেন ভাল লাগে, জিজ্ঞেস করলে হাবার মত ফ্যালফ্যাল করে তাঁকিয়ে থাকি। এই যেমন ধরেন, একক বা সমবেত সংগীতের চাইতে দ্বৈত সংগীতের একটা আলাদা আবেদন আছে। এই যে একটা জ্ঞানের কথা, এটা কি আমি বুঝে বললাম? জ্বীনা জনাব। এতে বুঝের কিছু নাই। কি সেই আলাদা আবেদন, আমাকে পুঁছবেন না, আমি জানিনা।

কিছু দ্বৈত গান সংলাপের মত। এই গানটার কথাই ধরেন। সতিনাথের আকাশ এতো মেঘলা, যেয়োনাকো একলা'র মতই এই গানের গল্প। একজোড়া কপোতকপোতি, সম্ভবত তাদের পরিচিতি বেশিদিনের নয়, অন্তত মেয়েটির পরিবারে তাদের এই কাছে আসার ঘটনাটা অজানা, এই পরিস্থিতিই গানের কথায় দৃশ্যায়িত। যারা পশ্চিমের বরফাচ্ছন্ন ক্রিসমাস উপভোগ করেছেন, তারা এই গানের রস একটু বিষদে অনুভব করবেন।

কিংবা ধরুন সাউন্ড অব মিউজিকের সেই মিষ্টি গানটা। রজার্স-হ্যামার্স্টিন গান লিখিয়ে জুড়ির হাত গলে বেরিয়েছিল ষোড়শী লিজেল আর সতের বছরের রলফের এই কথোপকথন। এই গানটির চিত্রগ্রহণ হয় সালসবুর্গে একটি প্রাসাদের বাগানের ছাউনি বা গাজিবোর ভেতরে। তারেক অণু যদি কোনদিন সালসবুর্গে যায়, তাহলে আমি নিশ্চিত সে এই গাজিবো'র ছবি তুলে সচলে পোস্ট দেবে। সেদিন পর্যন্ত আসুন আমরা এই গানটি শুনে শান্ত থাকি।

সাউন্ড অব মিউজিকের ঘটনা গত শতাব্দীর। সেখান থেকে সময়কে আরেকটু পিছিয়ে দিয়ে চলুন উনিশ শতকে। আলেক্সান্দর দুমা (জুনিয়র) এর দা লেডি অব দা ক্যামেলিয়া অবলম্বনে ভেরদি রচনা করল লা ট্রিভিয়াটা অপেরা। গল্পের নায়িকা রাজগণিকা ভিওলেটার বাগানবাড়ীতে আজকে বিরাট ভোজ। অনেকদিন রোগে ভুগে ভিওলেটা আজকে সুস্থ। অনেক মান্যগণ্যের সাথে সেখানে এসেছে আলফ্রেডো। ভিওলেটার পুরাতন নাগর গাস্তোন জানায় ভিওলেটার অসুস্থতার প্রতিটি দিন আলফ্রেডো এসেছে বাগানবাড়ীতে, ভিওলেটার খোজ খবর নিতে। বাতাসে ভেসে ওঠে প্রেমের গোলাপি গন্ধ। কিছু পরে আলফ্রেডো গান ধরে, ভিওলেটা এসে যোগ দেয়। সবাই মিলে গাইছে “চল আমরা আজকে মন খুলে পান করি, আর গান গাই, জীবনের আনন্দ উপভোগ করি”। এই গানের পরতে পরতে চলছে আলফ্রেডো আর ভিওলেটা মন দেয়া-নেয়ার সুমধুর দর কষাকষি।

যারা লা ট্রিভিয়েটা পড়েছেন/শুনেছেন/দেখেছেন তারা জানেন যে এই গানটির পরে আরেকটি দ্বৈত গান আছে, যেখানে আলফ্রেডো সরাসরি নিজেকে নিবেদন করে ভিওলেটার কাছে। কিন্তু সেটা এই গানটার মত জোশিলা হয়নাই।

যা বলছিলাম, দ্বৈত সংগীতের একটা আলাদা আবেদন আছে। ১৯৫১ সালে ন্যাট কিং কোল একটি গান রেকর্ড করেন, নেলসন রিডেলের সংগীত সংযোজনার সাথে। ১৯৬৫ সালে মাত্র ৪৫ বছর বয়েসে এই অসামান্য শিল্পীর জীবনাবসান ঘটে। ১৯৯০ সালে তার সুযোগ্যা কন্যা জীবনের এপারে বসে জীবনের ওপারে চলে যাওয়া পিতার সাথে যুগলবন্দীতে আবারো গাইলো সেই অবিস্মরণীয় গান, জিতে নিলো তিন তিনটা গ্র্যামি পদক।

প্রেমের মত বিরহেও যুগলবন্দী গান হতে পারে। এই ওলন্দাজ গানটা বিবেচনা করুন। সচলে ওলন্দাজ ভাষাভাষী খুব বেশী থাকার কথা না, তাই ইচ্ছা করেই এটাকে এখান যোগ করলাম। দেখেন, কথা না বুঝেই এদের কষ্টটা বোঝা যাচ্ছে কিনা।

ঘর গড়ার মত যুগপৎ কাজে যদি যুগলবন্দী গান যুতসই হয়, তাহলে ঘর ভাঙ্গাও যেহেতু যুগপৎ কাজ, সেখানেও কি যুগলবন্দী গান হতে পারে? পারে। এই কথাটাই কাজে প্রমাণ করতে চেয়েছে বেলজিয়ামে গত্যে আর নিউজিল্যান্ডের কিম্ব্রা। গানের শুরুতে যে সুন্দর বাজনাটি আছে সেটা লুইজ বনফা'র থেকে ধার করা। কিন্তু তাতে কি এসে যায়? ইউটিউবে সামবাডি আই ইউজ টু নো খুজলে বুঝতে পারবেন, এই গানটি কতজনের মনে দোলা দিয়েছে।

প্রেমিক প্রেমিকা, বাবা-মেয়ের দ্বৈত গান শোনা হল। এবার দেখুন শ্বশুর আর হবু পুত্রবধূতেও কত ভাল যুগলবন্দী সম্ভব। ভিক্টোরিয়ান ব্রিটিশদের চোখে জাপানিদের কি চোখে দেখা হত, সেটা কিছুটা আঁচ করতে পারবেন, গিল্বার্ট-সুলেভানের লেখা মিকাডো’র এই গানটিতে। জাপানের সম্রাট মিকাডো তার ছেলের জন্য পাত্রী ঠিক করেছে। ছেলে কিছুটা বখাটে, পাত্রী পছন্দ না হওয়ায় সে রাজধানী ছেড়ে পালিয়েছে। কিন্তু তাতে তো আর পুত্রবধূর রানী হবার স্বপ্ন অবাস্তব থাকতে পারেনা। তিনি ঠিকই গায়ের জোরে বাগদত্তা পুত্রবধূ হিসেবে বেশ সম্রাটের মাথার ওপর লাঠি ঘোরাচ্ছেন।

যুগলবন্দী যে শুধু একটি গানেই সীমাবদ্ধ হতে হবে, তা কিন্তু নয়। যেমন ধরুন জেমস ব্রাউন গাইল, দিস ইজ আ মানস ওয়ার্ল্ড। বেশ শক্তি দিয়ে জেমস বলতে চাইলো যে এই দুনিয়াটা পুরুষের পেশিশক্তিতে গড়া।

গানের কথাগুলো খুব মনোযোগ দিয়ে না শুনলে এটাকে বেশ শভিনিস্টিক শোনাতে পারে। মানে দুনিয়ার যাবতীয় উৎপাদনশীল কাজগুলোর কৃতিত্ব দেওয়া হল পুরুষকে। কিন্তু একটু খেয়াল করলেই শোনা যাবে যে নারীর উপস্থিতি ছাড়া পুরুষের বানানো গাড়ি, রেলগাড়ি, জাহাজ সবকিছুই অর্থহীন হয়ে যেত। এই ভারসাম্যের কিছুটা কৃতিত্ব জেমসের সহ-সংগীতকার বেটি-জিন নিউসমকে দিতে হয়। তবে এতে ষাট সালের ছাপ বেশ পরিষ্কার। কিন্তু এখান যুগলবন্দী কোথায়? এলিশা কীস এর এই গানটা শুনুন। জেমস ব্রাউনের গানের কাঠামোকেই ব্যাবহার করে সে গেয়েছে মোটামুটি একই গান, কিন্তু সেখানে এসেছে নারীর দৃষ্টিকোণ, এবং সেটা এসময়ের।

আগেই বলেছি যুগলবন্দী একটি গানেই সীমাবদ্ধ থাকার প্রয়োজন নেই। অনুভূতির গভীরতা যে শুধু গানের কথাতেই সীমাবদ্ধ থাকবে সেটাও জরুরী নয়। গ্রেগ এন্ডারসন আর এলিজাবেথ রো'র কথা ধরুন। এরা দুজনই বেশ মেধাবী পিয়ানোবাদক। মঞ্চের বাইরে এদের সম্পর্ক যাই হোক, পিয়ানোর সামনে এদের পেশাদারি সম্পর্ক যে কতটা গভীর সেটা বোঝা যাবে এই ভিডিওতে তাদের হাত, তাদের আঙ্গুল সঞ্চালনের দিকে দেখলে।

এই প্রায় উন্মাদ যুগলবন্দীর ব্যাকরণ বুঝে আমি কি করবো বলেন? আমার সম্পর্ক শোনার সাথে। বোঝাবুঝির মত এলেম আমার নেই। কিছু কিছু জিনিস ভাল লাগে টের পাই। কিন্তু সেগুলো কেন ভাল লাগে, জিজ্ঞেস করলে হাবার মুখে রা সরে না। এইসব গানের ব্যাকরণ কি, বিজ্ঞান কি, আমি জানিনা। আমি বুঝিনা।


মন্তব্য

সত্যপীর এর ছবি

শেষটা মাথা আউলায় দিল গুল্লি

..................................................................
#Banshibir.

সবুজ পাহাড়ের রাজা এর ছবি
অতিথি লেখক এর ছবি

ইটা রাইখ্যা গেলাম... রাইখা গেলাম, কালকে দেখব। শুধু পিয়ানোর ডুয়েটখান দেখলাম আজকে গুরু গুরু

--বেচারাথেরিয়াম

মোখলেছুর রহমান সজল এর ছবি

চলুক প্রথম বারের মত পড়ে গেলাম। গানগুলো সবকটি শোনা হয়নি। সময় নিয়ে আবারও পড়বো।

অতিথি লেখক এর ছবি

২,৫,৬,৭,৯ এই পাঁচটা ভিডিও জার্মানি থেকে দেখার অনুমতি নাই মন খারাপ

আমারও গানের এতো ব্যাকরণ বোঝার মত এলেম নেই, তবে আপনার লেখাটা বেশ ভাল লেগেছে।
চলুক

--- ঠুটা বাইগা

ধ্রুব বর্ণন এর ছবি

বাহ্। দেখছি।

Somebody That I Used To Know এর ভিডিওটাও যে সেইরকম, জানতাম না।

প্রৌঢ় ভাবনা এর ছবি

এখন এখানে অনেক রাত। সবগুলো দেখা হলোনা। তবে যে কটা দেখেছি ও শুনেছি, ভালই লেগেছে। তবে গানের ব্যাকরণ সম্পর্কে আমার কোন ধারনা নেই।
ধন্যবাদ, ভাল থাকুন।

ফাহিম হাসান এর ছবি

বেশ ইন্টারেস্টিং পোস্ট চলুক

টিউলিপ এর ছবি

সেই রকম পোস্ট। গান সবগুলাই ভালো লাগল, যদিও অনেকগুলোই পুরানো প্রিয়।

___________________

রাতের বাসা হয় নি বাঁধা দিনের কাজে ত্রুটি
বিনা কাজের সেবার মাঝে পাই নে আমি ছুটি

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।