স্যাম ও টাইগার

দুর্দান্ত এর ছবি
লিখেছেন দুর্দান্ত (তারিখ: সোম, ১৭/১২/২০১২ - ২:৪৯পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

কোন কোন মর্তবায় এরকম হয় যে পুরাতন কাদিম দোস্তের ফির মোলাকাত হাসিল করতে অনেক পাহাড়, অনেক টিলা পার হতে হয়, অনেক কাঠ ও অনেক খড়কে পুড়তে হয় দুঃসহ প্রতীক্ষার অনলে। ৭১ এর ১৫ ই ডিসেম্বরে স্বাধীনতার চৌকাঠে খাড়া বাংলাদেশের দারুল হুকুমত, বাংলার রাজধানী ঢাকায়, টাইগার নিয়াজি, শের-এ-পাকিস্তান, যখন তার জোয়ানির জানি দোস্ত জেনারেল স্যাম মানেকশ’র কাছে আত্মসমর্পণের, তার আঁতকা কুশকাস্তির বাতচিত করছিলেন, আমি অথবা বুদ্ধ অথবা অন্য কেউ তখন গিরিফতার হয়েছিলাম আমার প্রিয়তমা, আমার বিছড়া দিলরুবা, পার্বতী'র মেহকা মেহকা আগোশে, তার অদ্বিতীয় ও দৃঢ় আলিঙ্গনে। এই দুটি পুনর্মিলন অনায়াসে হাসিল হয়নি, আর যাঁদের খুশ এহসানে, যাদের অশেষ অবদানে, এই মসলা হাল হয়েছিল, তাদের সকলের প্রতি আমার শ্রদ্ধা ও এহতেরাম পেশ এ জাহের করতে আমি আপনাদের সামনে তার শানে নুযূল এরশাদ করছি।

যদি গোস্তাখি না নেন তো বলতে পারি যে ইয়াহিয়া আর ভুট্টো ৭১ এর ২৫শে মার্চের রাতের সেই সুবিশাল গড়বড়টা না করে ফেললে, আমাকে একজন সিভিলিয়ান শহরীর চেহচানি বেশে ঢাকায় আসতে হতনা, আর টাইগার নিয়াজিরও ঐ ডিসেম্বরে ঢাকায় হাজির হুদুদ থাকাতে হতনা। এই ফিতনা ও ফ্যাসাদের পেছনে ছিল বড় কিছু শক্তি, কোন বুলন্দ তাকত এর তোফায়েলি মিথষ্ক্রিয়া।

কারো কারো এরকম মনে হতে পারে যে, কোটি বাঙ্গালী জনতা হিন্দুস্তানের সীমানা পেরিয়ে, দিল্লীকে তার অগণিত মুহাজিরখানা ও শরণার্থী শিবিরগুলোতে প্রতি মাসে দুশো মিলিয়ন ডলার খরচ করতে যদি বাধ্য না করতো - বিবেচনা করুন ১৯৬৫ সালের পুরো যুদ্ধ, যে যুদ্ধে ওরা আমার পুরো পরিবার আর পুরো খানদানকে নিশ্চিহ্ন করেছিল, সেই পুরো যুদ্ধ করতে খরচ হয়েছিল মাত্র সত্তর মিলিয়ন ডলার - তো যদি এইসব শিবিরের এন্তেজামের খরচ এত উঁচা না হত - তাহলে জেনারেল স্যাম ও ভারতীয় সেনাবাহিনীর এই অংশগুলোকে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করতে হত না। দিল্লীর জামে মসজিদ এলাকার কম্যুনিস্ট যাদুকরেরা অবশ্য সেনাবাহিনীর বাংলাদেশে প্রবেশের ভিন্ন আরেকটি কারণ আমাকে জানিয়েছিল। ওরা বলেছিল, বাংলাদেশের ভেতরে ও মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে মুজিব আর আওয়ামী লীগের জনপ্রিয়তা ক্রমশ কমছিল। ভবিতব্য জাতীর জনকের এই ম্রীয়মান জেল্লা আর তার বিপরীতে বিপ্লবী মুক্তিবাহিনীর শণৈ শণৈ বাড়তে থাকা এই জনপ্রিয়তা হুকুমতে দিল্লী, দিল্লীর সরকার আর কংগ্রেস পার্টিকে বহুত পেরেশান রেখেছিল। সেসব পেরেশানির মোকাবেলা করতেই স্যাম আর টাইগারের এই পুনর্মিলন। টাইগার না এলে অবশ্য আমার প্রিয়তমা, মানে সেলিম সিনাই এর প্রিয়তমা, নাকি সে বুদ্ধের প্রিয়তমা? যাই হোক মোটকথা সেই অসামান্য রূপবতী পার্বতীও অবশ্য ভারতীয় বিশেষ বিমানে চড়ে ঢাকায় তশরিফ আনতো না। আরেকটা ওয়াযাহ আপনারাও ইতোমধ্যে অবগত হয়ে গেছেন, মুক্তিযুদ্ধের এই বিশৃঙ্খলা যদি এই ডিসেম্বরেই না মারা যায়, তাহলে এই বিপ্লব সীমানা পেরিয়ে পশ্চিমবঙ্গে সংক্রমিত হতে পারে। এই অবস্থা চলতে দিলে, কে জানে, একটি স্বাধীন সার্বভৌম মুস্তাকিল ও এতেহাদি অখণ্ড বাংলা আখেরে বঙ্গোপসাগর ও পূর্বের পাহাড় জংগল খোয়া যাবার দরজা খুলে দিতে পারে।

আমি ও আমারা যেহেতু নেমকহারাম নই, বেদাতি নাছারা ও কাফের নই, তাই স্যাম আর টাইগার আর সেই সাথে আমার, অথবা সেলিমের, অথবা বুদ্ধের সাথে পার্বতীর এই মধু-মিলনের জন্য কিছুটা হলেও ৭১ এ পশ্চিমবঙ্গের উত্তাল রাজনীতির কাছে শুকর গুজারি করতে ভুলবো না। আপনারা এটাও অবগত হয়ে থাকবেন, যে টাইগারের পরাজয়ের শুভ-লগ্নেই, সেই রোদেলা সকালেই কোলকাতার বাম ঘরানার রাজনীতির ওপরে ঘ্যাঁচ করে নেমে এসেছিল কেয়ামত।

তা যা বলছিলাম, ভারত এসেছিল।

এই আগমনের গতির জন্য - বিবেচনা করুন মাত্র তিন সপ্তাহে পাকিস্তানের আট আনা নৌবাহিনী তাবাহ হয়েছিল, ছয় আনা স্থলবাহিনী সাফ হয়েছিল, চার আনা বিমানবাহিনী ধ্বংস হয়েছিল, আর টাইগারের আত্মসমর্পণের পরে পাকিস্তান তার আট আনা আবাদি হারিয়েছিল – তো স্যামের এই আগমনের অসাধারণ গতি ও এহেন গায়ের মুন্তাজির রফতারের জন্য মুক্তিবাহিনীকে ধন্যবাদ দিতে হয় – কারণ - ওরা ওদের স্বভাবসুলভ সরলতার বশে, ওদের মাসুমিয়াতের বজাহে বুঝে উঠতে পারেনি যে ডিসেম্বরে ভারতের এই অভিযানের লক্ষবস্তু যতটুকু ছিল পাকিস্তান, ঠিক ততটুকুই ছিল মুক্তিযোদ্ধারা নেজেরাও। মুক্তিযুদ্ধকে পূর্ব-পাকিস্তানেই সুনির্দিষ্ট ও সীমিত রাখতে, এই জনপ্রিয় বিপ্লবের গতিকে সেখানেই রুখে দিতে – সেই মুক্তিবাহিনীকে আরেকবার ধন্যবাদ দিতে হয় কারণ তারা মানেকশকে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর অবস্থান আর ও গতিবিধির খবরাখবর দিয়েছিল, সবিস্তার তফসিলির সাথে। আরো ধন্যবাদ দিতে হয় জনাব চৌয়েনলাইকে, যে কিনা ভুট্টোর হাজার টানাহেঁচড়া সত্ত্বেও পাকিস্তানকে এই যুদ্ধের সময়ে বড় কোন সামরিক সহায়তা দেয়নি। চীনা সরঞ্জামের অভাবে পাকিস্তানিরা লড়ছিল আমেরিকান বন্দুক, আমেরিকান ট্যাঙ্ক আর আমেরিকান যুদ্ধবিমান নিয়ে। তাবৎ দুনিয়াতে তানহা তানহা আমেরিকার প্রেসিডেন্টই একমাত্র পাকিস্তানের সহায় হয়েছিল, অথবা বলা চলে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ঝুঁকেই পড়েছিল পাকিস্তানের পেছনে।

তো বুঝতেই পারছেন আরও কত বড় বড় শক্তি আমার সাথে আমার প্রিয়তমা পার্বতী আর স্যামের সাথে টাইগারে মিলনকে নাকামিয়াত করতে উঠে পড়ে লেগেছিল।

১৪ই ডিসেম্বরের রাতে শাহীদ আর বুদ্ধ, মানে আমি, আমাদের অতি পুরাতন ও বহু ব্যাবহৃত মধ্যরাতের মন্ত্রবলে উড়ন্ত অশরীরীর মত ঢাকা শহরের ওপর দিয়ে, চারপাশ দিয়ে ভেসে বেড়াচ্ছিল, বেড়াচ্ছিলাম। ডিসেম্বরের ঘন কুয়াশা ও অন্ধকারে গা ঢাকা দিয়ে ওরা, অথবা আমরা, ভারতীয় অবরোধের ফাঁক গলে ঢাকায় প্রবেশ করল অথবা করলাম। ওরা, অথবা আমরা, যখন অজ্ঞাতসারে ঢাকার রাস্তায় রাস্তায় বেফিকর চলছিলাম, তখন রাস্তায় দু' একজন বদ-কিসমত মিসকিন ছাড়া আর কেউ নজরে আসছিলনা। মন্ত্রবলে আমরা শুনতে পাচ্ছিলাম, শের-এ-পাকিস্তান তার স্টাফদের ওপরে গলা ফাটিয়ে তম্বিহ করছিল আখরি-মরদ-তক জঙ্গ জারী রাখতে। পরেরদিন যখন টাইগার স্যামের বাহুডোরে ধরা দিল তখন সেই পাকিস্তানি আখরি-মরদ হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছিল নাকি সেই মরতবায় জান্নাতুল ফেরদৌসে ঢুকবার মোক্ষম সুযোগ হাতছাড়া হওয়ায় বেখাপ্পা ধরনের খাপ্পা হয়েছিল, সেটা জানার মন্ত্র এখনো আমার হাসেল হয়নি।

এবং এভাবে শহীদ আর আমি, অথবা বুদ্ধ, ঢাকা শহরে প্রত্যাবর্তন করলাম। আমাদের সেই বহু প্রতীক্ষিত পুনর্মিলনের কয়েক ঘণ্টা আগে। আমরা এমন অনেক কিছু দেখলাম, এমন কিছু মোশায়দা করলাম, যা একেবারেই সত্য নয়, কোন অবস্থাতেই হাকিকাত নয়, যা কোন ভাবেই সম্ভব ছিলনা, কারণ আমাদের সোনার ছেলেরা কোনদিনও এরকম খারাপ কাজ, এত জঘন্য বুরাই’ আনজাম করতে পারেনা। আমরা দেখলাম চশমাপরা ডিমের মত নাযুক মাথাগুলোকে গুলি নিয়ে রাস্তার ধারে হেলে পড়তে, আমরা দেখলাম শতশত ও হাজারে হাজারে ওস্তাদ ও আলেম বুদ্ধিজীবীদের হালাল করা হল, কিন্তু সেগুলো সত্য অথবা হাকিকাত ছিল না, কারণ এসব হাকিকাত হয়না, হরগিজ না।

টাইগার একজন নিতান্ত ভদ্রলোক। আর আমাদের এক একজন জোয়ান দশ দশ জন বাঙ্গালি বাবুর চাইতে উৎকৃষ্ট।

আমরা এই অসম্ভব অমূলপ্রত্যক্ষভরা রাতে ভেসে চললাম, রাস্তায় দোকানে আর গলির সারি সারি বারান্দায় আর জানালায় আগুনের লকলকে শিখাগুলো কমলা রঙ্গের যথাক্রমে গাঁদা, ডালিয়া ও পলাশ ফুলের মত ফুটে ফুটে উঠছিল। কান-থেকে-কান জবেহ করা গ্রীবাদেশগুলো নাম ও নিশানাহীন গর্ত আর খন্দকে হারিয়ে যাচ্ছিল, এক এক করে।

আমি জানতাম শহীদ এগুলো হজম করতে পারবেনা। ডর পোক কাহিকা। সে প্রায় কেঁদেই ফেলছিল।

আমাকে ডেকে বলছিল, আমাকেই বোধ করি, এ কি হচ্ছে? ইয়াল্লাহ মাবুদ! এমন কেন হচ্ছে? আমার বিশ্বাস হচ্ছেনা, এত লা পরওয়াহি, এত জুলুম কি মানুষ করতে পারে?

বুদ্ধ, বেশ গুরু-গম্ভীর গলায় জবাব দিল, অথবা সেই কথাগুলো আমারই কণ্ঠ ভেদ করে বেরিয়েছিল হয়তো, কিংবা সেগুলো সেলিম সিনাই এর ও হতে পারে। তখন সেই গুরুগম্ভীর গলা বলে চলল, শহীদ শোন, কখনো কখনো আমারা কি দেখবো, আর কি দেখবোনা, সেই ফয়সালা আমাদের নিজেদেরই ঠিক করে নিতে হয়। নজর ফিরিয়ে নাও। এসব দেখো না। তোমার চোখ ফিরিয়ে নাও।

শহীদ চোখ ফেরালো না। ও তাকিয়ে রইল গার্লস স্কুলের মাঠে যেখানে মহিলা ডাক্তার আর নার্সদের বেয়োনেট দিয়ে হালকা করে খুঁচিয়ে নেয়া হচ্ছিল। আমি আর শহীদের সেখানে পৌঁছানোর দিন সপ্তাহ মাস ও মাসের পরে মাস ধরে সেই গার্লস স্কুল সংলগ্ন শহরের সুপ্রসিদ্ধ স্নিগ্ধ ও সফেদ মসজিদের গম্বুজ আর মিনারটি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে নিশ্চুপ খামোশি নিয়ে ফেল ফেল করে দেখছিল মৃদু বেয়োনেটের খোঁচর পরে ধর্ষণ, দু-চার বার ধর্ষণের পরে বেয়োনেটের খোঁচা, আবার ধর্ষণ, তারপরে মাথায় একটা মাত্র তানহা গুলি। একজন, দুজন, চারজন, আট জন, ষোলোজন...

যেন তার নিজের সাথেই কথা বলছিল বুদ্ধ, মানে যেন আমি ব্যস্ত ছিলাম আমার নিজের সাথে কথা বলতে। আমি, মানে আমি ও বুদ্ধ, বলছিলাম, "এবার একটু নিরাপত্তার কথা ভাবা উচিত। কেন যে মরতে আমরা এখানে ফিরে এসেছি কে জানে" । এরপর আমি একটা দরজা ঠেলে দাখিল হলাম একটা একটি পলস্তারা খসা পুরাতন ইমারতে। যা দেখতে পেলাম তাতে মনে হল সেখানে একটা চা-খানা, একটা সাইকেল মেরামতের দোকান, আর খুব সম্ভবত একটা নোটারিপাবলিকের দপ্তর আছে, বা ছিল। খাটো টেবিলের এর ওপরে একটা হাফ-রিম চশমা, কিছু সিলমোহর আর স্ট্যাম্প পেপার পড়েছিল, এসব ভুয়া সিল আর জাল স্ট্যাম্প পেপার একদা কোন এক নোটারিপাবলিকে তিন পয়সার ফেলনা পাবলিকের বদলে সত্যমিথ্যা বিচারক ও সাবুদ দাতা হিসাবে এই মহল্লায় ও মনে হয় বলা যায় এই সমাজে সুপ্রতিষ্ঠিত করেছিল। বলার অপেক্ষা রাখেনা যে নোটারিপাবলিক তার দপ্তরে আমার জন্য অপেক্ষা করে ছিল না, এরকম সময়ে তার এখানে থাকা তার স্বাস্থ্যের জন্য মঙ্গলজনক হত না। তবে সে যদি থাকতো তাহলে বাইরে যা দেখে এলাম সেটা হকিকত না মিথ্যা যাচাই করা মুমকিন হত।

যা হলে ভাল হত অথবা আমরা যা চাই যে হোক, সেরকম সবসময় হয়ে ওঠেনা।

খাটো টেবিলের পেছনে আমি কিছু কাপড় পড়ে থাকতে দেখলাম। একটা পাজামা-একটা পাঞ্জাবি আর একটা মিলের মোটা চাদর। এগুলো সেখানে কিভাবে এলো, ভাবাতে ভাবতে আমি আমার পাকিস্তানি চৌকশ বাহিনীর খাকি উর্দি আর অতিসম্মানের চুতিয়া ইউনিটের বহু ইজ্জত-দার কুত্তী-তমঘা সংবলিত ব্যারেট-ক্যাপটা ছেড়ে পাজামা-পাঞ্জাবি-চাদর পরে নিলাম। এগুলো এখানে কিভাবে এল আর কোন মন্ত্রবলে এই কাপড়গুলো আমার গায়ে খাপে খাপে জুড়ে গেল, তার হদিস আমি করতে পারলাম না। তা সত্তেও আমি বনে গেলাম একান্ত এই শহরের, যার বেগানা জবানের একটি শব্দও আমি জানিনা, এই শহরে এখন আমি একজন বেনাম লাওয়ারিশ পলাতক পাকিস্তানী।

শহীদ রাস্তাতেই ছিল। ভোরের মিঠে আলোয় সে পাকিস্তানি জওয়ানের অবশিষ্ট বাকী কাজগুলো খতম করতে ছোটাছুটি করতে দেখছিল। ঠিক তখনই গ্রেনেডটা ফাটল। আমি, অথবা বুদ্ধ, সেই পরিত্যক্ত ভবনে , সেই পলেস্তারা খসা পুরাতন ইমারতের মেহফুজ পাঁজরের ভেতরে মজুদ ছিলাম। কিন্তু, আফসোস, শহীদের চারপাশে কোন দেয়াল ছিলনা।

কেন? কে? কিভাবে? কে জানে। কিন্তু কেউ নিশ্চয় ছুঁড়েছিল। অখণ্ডিত শহীদ তার জীবনের আখের সেকেন্ডটিতে থুতনি উঁচু করে ওপরের দিকে দেখার এক অদমনীয় খোয়ায়েশ মেহসুস করেছিল।

পরে মিনারের চিলেকোঠায় বসে সে আমাকে বলেছিল, "হঠাৎ মনে হল আমার মাথার ভেতরে একটা আনার, এই এতো বড়, একশো পাওয়ারের লাইট-বাল্বের মত বড় একটা আনার, ঠিক লাইট-বাল্বের মত জ্বলছিল, তুমি বুঝতে পারছ বুদ্ধ, ফিলিপ্স এর ষাট পাওয়ারের লাইট-বাল্বের মত রোশনাই হয়ে জ্বলছিল। আমি আর থাকতে পারিনি, আমি ওপরে তাকালাম।"

এবং ওয়াকেই, আসলেই, বেশক, আনারের মত কিছু একটা ওপর থেকে শহীদের গায়ের ওপর এসে পড়ছিল, পতিত হচ্ছিল, মাধ্যাকর্ষণের নিয়মানুসারে পড়তে পড়তে সেটা তার চেহারায় এসে লাগলো, তারপরে কোমর তক এসে এক প্রচণ্ড ধামাকায় ধ্রিম করে বিস্ফোরিত হল। বিস্ফোরণে তার পা দুটো কোমর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে, একেবারে কাটা ও যুদা হয়ে শহরের অন্য কোথাও গিয়ে পতিত হল।

আমি যখন শহীদের নজদিকিতে গিয়ে পৌঁছলাম, দ্বিখণ্ডিত হবার বেকায়দা নিয়েও শহীদের হুঁশ নগদ বহাল ছিল। আমাকে বলল, "বুদ্ধ, আমাকে ঐযে ঐখানে নিয়ে চল।"

আমি শহীদের দ্বিখন্ডিত দেহের মাথাওয়ালা অংশকে সেই স্নিগ্ধ সফেদ মসজিদের মিনারের সরু সিঁড়ী ভেঙ্গে চিলেকোঠায় তুলে নিয়ে এলাম। মধ্যরাতের মন্ত্রবলের কিছু কিছু সুবিধা আমরা মাঝে মধ্যে গ্রহণ করে থাকি। যেখান বসে শহীদ তার সেই আনার ও লাইট-বাল্ব বিষয়ক আবোলতাবোল বকেছিল। চিলেকোঠার অপরিচ্ছন্ন মেঝেতে বুদ্ধ দেখতে পেল, অথবা আমি দেখতে পেলাম, অথবা আপনারা ধরে নিতে পারেন আসলে সেই দর্শক ছিল সেলিম সিনাই, তো সেই চিলেকোঠার মেঝেতে দেখা গল একদল লাল পিপড়া আর একদল কালো পিপড়া হাতাহাতি, কাড়াকাড়ি, কামড়াকামড়িতে লিপ্ত একটা আরশোলার মরদেহ নিয়ে। নিচে, শহরতলে, দগ্ধ বাসাবাড়ি, ভাঙ্গা কাঁচ, আর ধুন্দলা ধোঁয়ার আন্ধার অন্ধকার কোঁখ থেকে পিপড়ার দলের মত অগণিত মানুষ, অগণিত আম আদমি, মর্দ-জেনানা, এসে জড়ো হচ্ছিল। যুদ্ধ শেষ হয়েছে, বিজয় উদযাপন হবে সহসাই। মিনারের চিলেকোঠার আসল পিপড়াগুলো শহরতলের পিপড়ার মত মানুষদের অগ্রাহ্য করে তাদের জঙ্গ-বাহাস চালু রেখেছিল।

চিলেকোঠার একমাত্র আসবাব ছিল একটা জলচৌকি, তার ওপরে পরস্পরের সাথে বিজলীর তার দিয়ে যুক্ত একটি গ্রামোফোন ও একটি লাউডস্পিকার। বুদ্ধ, অথবা আমি, অথবা অন্বয় কেউ, শহীদের আধখানা দেহ আর মিনারের চিলেকোঠার সেই একমাত্র আসবাব ইয়ানি সেই একটি জলচৌকি যার ওপরে একে অপরের সাথে তার দিয়ে যুক্ত একটা গ্রামোফোন আর একটা লাউডস্পিকার রাখা ছিল, সেই জলচৌকির মাঝে দাঁড়িয়ে মিনারের উচ্চতা থেকে নিম্নে আর চারিদিক অবলোকন করছিলাম। ঠিক কি কারণে আমি বা বুদ্ধ একেবারেই চাচ্ছিলাম না তার এই আধখানা বন্ধুর সাথে মিনারের এই যান্ত্রিক মুয়াজ্জিনের সাথে পরিচিতি ঘটুক সেটা জানিনা। হয়তো শহীদকে আমার অনেক পরহেজগার মনে হত। হয়তো আমার মনে হত তার মাসুম পাক ক্বলবে এই মিনার ও চিলেকোঠা ও এর আপাত: আসমানি আজানের বিষয়ে মোহমুক্তি ঘটুক।

হঠাৎ চিৎকারের শব্দে আমার, বুদ্ধের ও সেলিমের একসঙ্গে সম্বিত ফিরে এলো।

ওরা লক্ষ করল, সেই সাথে আমিও লক্ষ করলাম আরশোলার মরদেহ টি নিঃসঙ্গ পড়ে আছে। শহীদের শরীর থেকে রক্ত গড়াচ্ছিল, রাস্তা থেকে টপ টপ করে, সিঁড়িতে ঝির ঝির করে আর এই চিলেকোঠায় তা বইছিল চিটাগুড়ের মত করে। সেই গাঢ় সান্দ্র গমনপথ অনুসরণ করে পিপড়ার দল, কাতারে আবদ্ধ হয়ে, কি লাল কি কালো, পিপড়ার দল জিহাদে শহীদের জান্নাতুল ফেরদৌসে পৌঁছানোর নিশ্চয়তা নিয়ে একে একে পৌঁছে গিয়েছিল রক্তের উৎসে। এক লহমায় শুধু একটি নয়, দু' দুটি যুদ্ধের শিকার হয়ে শহীদ বেকায়দা চিৎকার করে তার উন্মত্ততা প্রকাশ করছিল, করেই চলেছিল। বুদ্ধকে, ও সেই সাথে আমাকেও পিপড়া ছাড়েনি। শহীদকে তো রক্ষা করা দরকার। লাফাতে লাফাতে আমার, বুদ্ধের বা অন্য কারো, কনুই লেগে গেল লাউডস্পিকারের বোতামে।

নিচের পিঁপড়ের মত মানুষের দল, যারা শহরতলে, দগ্ধ বাসাবাড়ি, ভাঙ্গা কাঁচ, আর ধোঁয়াশা ধোয়ার মধ্য থেকে পিঁপড়ার দলের মত অগণিত মানুষ এসে জড় হচ্ছিল, যুদ্ধশেষে উদযাপনের জন্য তইরী হচ্ছিল, তারা অনেকদিন মনে রেখেছিল, কিভাবে স্নিগ্ধ মসজিদ আর মিনারটিও যুদ্ধের তীব্র বেদনা প্রকাশ করতে তাদের এতদিনের নীরবতা ভেঙ্গে তীক্ষ্ণ আর্তনাদ করে উঠেছিল।

তার পর সবশেষ। নীরবতা।

(সালমান রুশদীর মিডনাইট'স চিলড্রেনের একটি ছোট অংশকে অনুবাদ করার ধৃষ্টতা করেছি এখানে)


মন্তব্য

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

গুড জব! ভাষা পছন্দ হয়েছে। পুরোটা অনুবাদ করার অনুরোধ করবো না - কারণ, সেটার দরকার নেই। রুশদী'র শক্তিটা বোঝার জন্য তার বই ইংরেজীতে পড়া ছাড়া উপায় নেই।

অটঃ ইসলামী ফাউন্ডেশন থেকে প্রকাশিত নসীম হিযাজী'র কিছু উর্দু উপন্যাসের বাংলা অনুবাদ পাওয়া যায়। সেগুলোর ভাষা কেমন যেন অদ্ভুত উর্দু-ফার্সী মেশানো এছলামী বাংলা। সফিউদ্দিন সরদার নামে এক বাঙালী 'নসীম হিযাজী'ও একই ভাষায় উপন্যাস লিখতেন। সেই ভাষাটা ছিল উদ্দেশ্যমূলক - বাংলাকে খৎনা করার উদ্দেশ্যে। সেই হিসাবে তোমার ভাষাটা অথেনটিক। স্যাটায়ারের জন্য উপযুক্ত।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

দুর্দান্ত এর ছবি

ভাষা নিয়ে খেলার চেষ্টা আপনার ভাল লেগেছে, জেনে আরো উতসাহী হলাম। এই বইয়ের আরো অনুবাদ আমার আওয়্তার বাইরে আসলে, চেষ্টাও করবো না।

মুক্তিযুদ্ধের পেছনের ডাইনামিক্স সম্বন্ধে রুশদীর যে বক্তব্য়, তা নিয়ে আপনার কোন মন্তব্য় নেই?

কনফুসিয়াস এর ছবি

অনুবাদ দুর্দান্ত হয়েছে, অথবা সেরকমই মালুম হচ্ছে, যদিও বেশক হয়ে বলতে পারছি না। ঃ-) কিছু কিছু শব্দের অর্থ ধরতে পারিনি। কিছু কিছু শব্দের ব্যবহার বুঝতে পারিনি। তারচেয়ে বড় কথা মূল বইটাও পড়া হয়নি।
তবু আপনাকে ৫ তারা দিলাম। পর পর দুবার পড়া হয়ে গেল এটুকু অংশ। আবারও বলছি স্টাইলটা দারুণ লেগেছে। এবং মূল বইটা মাত্রই আমার রিডিং লিস্টে যুক্ত হয়ে গেলো আপনার সুবাদে। ধন্যবাদ।

-----------------------------------
বই,আর্ট, নানা কিছু এবং বইদ্বীপ

দুর্দান্ত এর ছবি

সময় নিয়ে পড়ার জন্য ধন্য়বাদ!

"কিছু কিছু শব্দের অর্থ ধরতে পারিনি। কিছু কিছু শব্দের ব্যবহার বুঝতে পারিনি।"

রুশদি'র ইংরেজীতে একরকম 'ভারতীয় বাবু' সুলভ অতিরঞ্জন থাকে, যাতে কিছুটা ধোয়াশা থাকে, যার সবটুকু অনুবাদ আমার পক্ষে সম্ভব হয়নি। তাই অতিমাত্রায় আরবী-ফার্সি শব্দাবলী ব্য়াবহার করেছি, যাতে সেই ধোঁয়াশা ভিন্নভাবে হলেও বজায় থাকে। তবে বিদেশী শব্দের আশেপায়াশে আমি বাংলায় হিন্ট রাখার চেষ্টা করেছি যাতে অন্তত কাছাকাছি ভাব বুঝতে পারা যায়। আপনার কথায় বুঝতে পারছি, সেটা কিছুটা সফল হয়েছে।

অতিথি লেখক এর ছবি

অনুবাদ দুর্দান্ত হয়েছে। উত্তম জাঝা!

''দিবাকর''

দুর্দান্ত এর ছবি

ধন্যবাদ।

প্রৌঢ় ভাবনা এর ছবি

দিল্লীর জামে মসজিদ এলাকার কম্যুনিস্ট যাদুকরেরা অবশ্য সেনাবাহিনীর বাংলাদেশে প্রবেশের ভিন্ন আরেকটি কারণ আমাকে জানিয়েছিল। ওরা বলেছিল, বাংলাদেশের ভেতরে ও মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে মুজিব আর আওয়ামী লীগের জনপ্রিয়তা ক্রমশ কমছিল। ভবিতব্য জাতীর জনকের এই ম্রীয়মান জেল্লা আর তার বিপরীতে বিপ্লবী মুক্তিবাহিনীর শণৈ শণৈ বাড়তে থাকা এই জনপ্রিয়তা হুকুমতে দিল্লী, দিল্লীর সরকার আর কংগ্রেস পার্টিকে বহুত পেরেশান রেখেছিল।

আরেকটা ওয়াযাহ আপনারাও ইতোমধ্যে অবগত হয়ে গেছেন, মুক্তিযুদ্ধের এই বিশৃঙ্খলা যদি এই ডিসেম্বরেই না মারা যায়, তাহলে এই বিপ্লব সীমানা পেরিয়ে পশ্চিমবঙ্গে সংক্রমিত হতে পারে। এই অবস্থা চলতে দিলে, কে জানে, একটি স্বাধীন সার্বভৌম মুস্তাকিল ও এতেহাদি অখণ্ড বাংলা আখেরে বঙ্গোপসাগর ও পূর্বের পাহাড় জংগল খোয়া যাবার দরজা খুলে দিতে পারে।

আমার একটি লেখায় আপনার মন্তব্যের প্রত্যুত্তরে লিখেছিলাম,

লিখেছেন প্রৌঢ় ভাবনা [অতিথি] (তারিখ: সোম, ২৩/০৪/২০১২ - ১০:৩১অপরাহ্ন)
আমি একজন খুব অল্প জানা মানুষ। বয়সের অভিজ্ঞতায় যে টুকু জানি বুঝি তাই শেয়ারর করাটা জরুরী মনে করলাম। ভুলত্রুটি মার্জনা করবেন।
ঐ সময়ে ঐ এলাকায় বিএলএফ যে কয়টি অপারেশন করেছে প্রায় সব কটিই স্থানীয় রাজাকারের বিরুদ্ধে। সম্ভবত একবার তারা পাকবাহিনীর সাথে সম্মুখ যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছিলো। ঠিক জানিনা, সেটা পরিকল্পিত আক্রমন ছিলো নাকি আক্রান্ত হয়ে আত্মরক্ষার প্রয়াস।
তদানিন্তন চার তুখোড় নেতা, সিরাজুল আলম খান, শেখ ফজলুল হক মনি, আব্দুর রাজ্জাক এবং তোফায়েল আহমেদের নেতৃত্বে ষাট হাজার বিশ্বস্থ সমর্থক সমন্বয়ে বিএলএফ (মুজিব বাহিনী) গঠিত হয়েছিলো। সম্মুখ যুদ্ধে অংশগ্রহনকারী এফএফ (মুক্তি বাহিনী) বাহিনী থাকতে সমান্তরাল আরেকটি বিশেষ বাহিনী কেন প্রয়োজন হয়েছিলো তা সম্ভবত সাধারণজনের অজ্ঞাত। আমার জানামতে বিএলএফ সারা বাংলাদেশে সম্মুখ যুদ্ধে খুব একটা অংশ নেয়নি। তাদেরকে রাজনৈতিক কাজে ব্যবহার করা হয়েছে। সে সময়ে কানাঘুষায় যা জেনেছিলাম, (আপনাদের মনপুত না হলে আমার জানা ভুল) মুক্তিযুদ্ধ দীর্ঘায়িত হলে যুদ্ধের নেতৃত্ব বামদের করায়ত্ব হবার আশংকায় মুজিব বাহিনীকে সর্বদা প্রস্তুত রাখা হয়েছিলো। অবশ্যই আমার জানা ভুল হতে পারে। আপনাদের মতামতের অপেক্ষায় রইলাম।

সালমান রুশদীর এই বইটি পড়ার সুযোগ হয়নি। তবে আপনার অনুবাদের তরিকাটি মনপছন্দ।

দুর্দান্ত এর ছবি

তাহলে রুশদী ঠিকই লিখেছে বললেন?
আপনি সময় করে আমার অখাদ্য লেখা পড়েন, এটা অনেক বড় পাওয়া, অগ্রজ। ধন্যবাদ।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।