এবছরের ২৩শে এপ্রিল পর্যন্ত মোট ৩৪৫ জন MERS মধ্যপ্রাচ্যের কোরোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছে, যার মধ্যে মৃত্যু ঘটেছে মোট ১০৭ জনের। আর সৌদি আরবে সর্বাধিক লোক আক্রান্ত হয়েছে। তা ছাড়াও আরব আমিরাত, ইউরোপ, এশিয়া ও উত্তর আফ্রিকার মোট ১১ টি দেশে এই রোগে আক্রান্ত লোকের খোঁজ পাওয়া গেছে।
২০১২ সালের এপ্রিল মাসে জর্ডানের আম্মান শহরের জারকা হাসপাতালের সাতজন নার্স ও তাদের একজনের ভাই কোন এক গুরুতর শ্বাসজনিত রোগে আক্রান্ত হয়েছিল। তাদের মধ্যে একজন নার্স প্রান হারায়, ও বাকীরা সুস্থ হয়ে ওঠে। এখন মনে করা হচ্ছে জর্ডানের ঐ নার্স মধ্যপ্রাচ্যের কোরোনা ভাইরাসের আক্রমণের প্রথম শিকার। ঐ বছরের জুন মাসে সৌদি আরব ও কাতার ও আরব আমিরাতেও এই রোগে আক্রান্ত রোগী হাসপাতালে আসতে থাকে। তবে সে সময়ে অল্প কিছু এলাকায় অল্প কিছু রোগীর মধ্যে এই রোগ সীমাবদ্ধ ছিল। ২০১৩ সালে এই রোগের প্রসার কিছুটা স্তিমিত হয়ে গিয়েছিল, প্রতিমাসে গড়ে ১৫ জন নতুন রোগী আক্রান্ত হচ্ছিল। কিন্তু গত কয়েক সপ্তাহে হঠাত করে এই রোগে আক্রান্ত রোগীর পরিমান অনেক বেড়ে গেছে।
কিছু বিজ্ঞানী মনে করছেন যে এই ভাইরাসের উদ্ভব হয়েছে আরেকটি ভাইরাস থেকে যেটা উটকে আক্রমন করে থাকে। গবেষনায় প্রমানিত যে সৌদি উটমাত্রই এই ভাইরাসের এন্টিবডি উপস্থিত, মানে এখানের উট এই রোগে সচরাচর আক্রান্ত হয়।এক গবেষনায় দেখা গেছে একটি অন্চলে মানুষ আর উটে পাওয়া ভাইরাসের আর এন এ প্রায়-একই। সম্প্রতি মালয়শিয়া ও মিশরের দুজন রোগী গণমাধ্য়মের প্রতিবেদনে এসেছেন, তাদের উভয়েই সৌদি আরব ভ্রমণকালে উটের খামারে গেছেন বা উটের দুধ বা মাংস খেয়েছেন। এই ভাইরাসের পছন্দের জায়গা হল শ্বাসনালি ও বৃক্কের বহিত্বক। এখানে বাসা বেঁধে এরা ঐসব অংগের স্বাভাবিক রোগ প্রতিষেধক ব্যাবস্থাকে কুপোকাত করে দেয়। এতে করে রোগী শ্বাসপ্রশ্বাস বা রেচন সংক্রান্ত পুরাতন বা নতুন কোন রোগের আক্রমণকে নিজে থেকে আর প্রতিহত করতে পারেনা।
প্রকৃতির কোন আজব খেয়ালে এই ভাইরাস মানুষে আক্রমনের ক্ষমতা লাভ করেছে ও খাবার ও বাতাসের মাধ্যেমে তা ছড়িয়ে যাচ্ছে। পশুর রোগজীবাণু রূপান্তরিত হয়ে মানুষকে আক্রমন বা জুওনোসিস এর নজির প্রচুর আছে। জলাতন্ক আর এনথ্রাক্স এর কথা আমরা সবাই জানি। গত দশকেই ২০০৯ সালে নেদারল্যান্ডসের যেসব এলাকায় নিবিড় ছাগলপালন করা হয়, ছাগলের দুধের পনিরের বেশ কদর আছে ইউরোপে, সেইসব এলাকায় ছাগলের কিউ-জ্বর মানুষে মধ্য়ে ছড়ইয়ে পড়আর খবর পাওয়া গিয়েছিল। সোউদি আরবের অভাবনীয় নগরায়্ন ও বড় আকারের উটের বানিজ্য়িক খামারগুলো শহরের কাছাকাছি অবস্থানে নিয়ে আসার কারনে উটের রোগ মানুষে আসতে শুরু করেছে বলে মনে করা হচছে।
আগিলা দিনে এইজাতীয় রোগের প্রাদুরভাবের খবর গুম করে ফেলা যেত সহযেই। সরকারি মিডিয়ার গলা চিপে ধরলেই মোটামুটি কাজহত। কিন্তু এখন টুইটার, ব্লগ, ফেসবুকের জামানা। তাই প্রতিটি সন্দেহজনক কেসের খবর পাবলিক জেনে যাচ্ছে। তবে এর ইতিবাচক দিক হল যে এতে করে এই রোগের প্রকার ও গতি সম্পরকে সন্ক্রামক রোগ নিয়ে যারা কাজ করেন, তাদের কিছুটা সুবিধা হচ্ছে। "ক্রাউড এপিডেমিক ইন্টেলিজেন্স" বলে একটি নতুন আনংগিকের উপাত্তসুত্র ক্রমশ জনপ্রিয়তা পাচ্ছে। গত কয়েকসপ্তাহে জরডান, মালয়শিয়া, ফিলিপিন ও ইউরোপের দেশগুলোতে এই রোগের প্রাদুর্ভাব আমাদের বুঝিয়ে দিয়েছে যে মধ্য়প্রাচ্য়ে চাকুরীরত শ্রমিক ও পর্যটকেরা তাদের নিজ নিজ দেশে এই রোগ বয়ে নিয়ে যাচ্ছেন ও ঐসব দেশে এই ভাইরাস প্রসারের ঝুঁকি ক্রমশ বাড়ছে।
মধ্যপ্রাচ্যে বাংলাদেশী শ্রমিকের জীবনযাপন কিরকম, সেটা নতুন বলার কিছু নেই। এখানে গবাদিপশুর ঠিক ওপরে, কিছু কিছু ক্ষেত্রে গবাদিপশুর সমান কাতারেই বাংলাদেশী শ্রমিকের স্থান। যারা কিছুটা ভাগ্যবান, তারা শপিংমলের টয়লেট বা বাগান বা রাস্তা পরিস্কারের কাজ পান। অন্যেরা ৫০ ডিগ্রী সেলসিয়াসে ৪০-৫০ তলা নির্মানাধীন দালানের মাথায় চড়ে ঢালাই বসানোর মত বিপদজনক সব কাজ করেন। যাদের দালাল বা কোফিল (স্থানীয় স্পন্সর) আক্ষরিক অর্থে এক একজন শুওরের বাচ্চা, তাদের পাঠিয়ে দেয়া হয় গভীর মরু ক্যাম্পে। ওখানে তাদের পায়ে হেঁটে মাইলের পর মাইল খেজুরের বাগান পরিস্কার করার বা খোলা আকাশের নিচে উট-ভেড়া খামারে কাজ করতে হয়। ঐসব প্রত্যন্ত অঞ্চলে মানুষের খাবারের একটি বড় উপাদান উটের মাংস, কারন উটের মাংস বিশেষ করে বয়স্ক উটের মাংস এখানে বেশ শস্তা। মূলত উতপাদন খরচ অনেক কম বলেই উটের মাংসের দাম কম। উন্নত প্রজাতির নরম মাংস ওয়ালা উট আমদানি হয় অস্ট্রেলিয়া থেকে প্রচুর পরিমানে, সুপারমারকেটে দেদারসে সেগুলো পাওয়া যায়, কিন্তু সেগুলো গরীব শ্রমিকের নাগালের বাইরে।
গতকাল হারাদ এলাকায় এরকম একটি খামারে কিছুক্ষণ থেমেছিলাম। হারাদ নামটিকে টলকিনের পাঠকেরা চিনবেন গন্ডর ও মরডরের দক্ষিনের এলাকা হিসাবে। এই দেশে হারাদ এর কাছাকাছি দুইটি আন্তনগর হাইওয়ের একে অন্য়ের সাথে উলম্ব হয়ে মিলেছে। এখানে মাটির তলায় ফসিল সাগর, সেই প্রচন্ড লবনাক্ত পানি নলকূপের মাধ্য়মে তুলে এনে মরুভুমির ভেতরে গবাদিপ্শুর জন্য় ঘাস চাষ করা হয়। অনেকক্ষন ধুসর মরুভূমির পর সবুজ ঘাসের গালিচার ওপর দিয়ে বয়ে চলা মৃ্দু বাতাস বেশ দৃষ্টিনন্দন।
প্রায় ৩০ জন বাংলাদেশী শ্রমিক ও দুইজন ফিলিপিনো অর্ধনারীশ্বর এই খামারের স্থায়ী বাসিন্দা। এখানের সবাই মোটামুটি জানেন এই রোগ সম্বন্ধে, কিন্তু এইসব রোগবালাই নিয়ে চিন্তাকরার মত সময় বা সুযোগ তারা এখনো পাননি। ২০১৩ সালের জুলাই-নভেম্বর মাসে তাদের উপর কেয়ামত গেছে। সরকারি নীতি বদলের কারনে অনেকেই এখানে চাকরী করার অনুমতি হারান, আসলে অনেকে জানতেনই না যে তাদের কর্মদাতা প্রতিষ্ঠানের কোন আনুষ্ঠানিক ভিত্তি নেই, এর মালিক তাদের সবাইকে তার নিজের বাসায় চাকর মালি ড্রাইভার হিসাবে এখানে এনেছে। তখন শতশত শ্রমিককে রাস্তাঘাটে ধরে বেধে ঢাকায় পাঠিয়ে দেয়া হয়েছিল। এখন অবস্থা কিছুটা স্বআভাবিক। তবে বেআইনী প্রতিষ্ঠানগুলো উঠে যাওয়ায় বেশীরভাগ বাংলাদেশী শ্রমিকের চুক্তি হাতবদল হয়ে চলে গেছে নতুন প্রতিষ্ঠানের কাছে। এই খামারটির জনবল এখন একটি আনুষ্ঠানিক জনবল সরবরাহ প্রতিষ্ঠানের সাথে চুক্তিবদ্ধ। ঐ নতুন প্রতিষ্ঠানটি প্রতিনিয়ত ভয় দেখাচ্ছে যেন শ্রমিকেরা নগদ পয়সা জমা দিয়ে তাদের চুক্তি নবায়ন করিয়ে নেয়, নাহলে সোজা দেশে ফেরত। এখানে যাদের কাগজপত্রে ঘাপলা আছে তারা বেতন তো পাচ্ছেই না, উল্টো জেল এড়াতে দেশে ও এদেশে দালাল খরচ মিলিয়ে মোটামুটি বিশ-ত্রিশ হাজার রিয়াল (৪-৬ লাখ টাকা) যোগাড় করতে হবে।
তাদের দিনের ১৮ ঘন্টা যায় অমানুষিক পরিশ্রমে, আর রাত কাটে কিভাবে ঐ টাকা যোগাড় করা যায়, তা ভেবে।কথা বলার সময়ে একজন আগ্রহ নিয়ে জানতে চাইলো, "ভাই উটের দুধ খাইলে এই রোগ হবে কন্ফার্ম?" রোদেপোড়া চেহারায় তার কোটরের গভীরে ঢুকে যাওয়া চোখের ঝিলিক আমাকে নিস্তব্ধ করে দিল। গাড়ির একসেলেটরে চাপ দিয়ে আমি দ্রুত স্থান ত্যাগ করলাম।
***
হালনাগাদঃ মে ৯ শুক্রবার, আর ৪ জনের প্রাণ নিল করোনা ভাইরাস। এই নিয়ে সৌদিআরবে এই রোগে মৃতের সংখ্যা দাঁড়াল ১২১।
মন্তব্য
লেখাটা পড়ছিলাম আর মন খারাপ হচ্ছিলো। শেষটায় বেশি মন খারাপ করিয়ে দিলেন।
একজনের ৫০° সেলসিয়াসের ঘাম ৪ ঘন্টার বিমান দূরত্বে পরিণত হয় অন্যের বিলাসি আইফোনে।
---------
চাবি থাকনই শেষ কথা নয়; তালার হদিস রাখতে হইবো
শুরুর কিছুদিন মন খারাপ হত। এখন আমিও ঠুস ঠাস বলে বসি, ঈশ! এরা এত ইনেফিশিয়েন্ট কেন ...
সত্যিই মনটা বিষণ্ণ হয়ে উঠলো।
তধ্যসম্বৃদ্ধ একটি পোস্ট।
যথাযথ সম্মান প্রদর্শনপূর্বক বলছি, সৌদি বা আরবদের মত এমন স্বার্থপর মানুষ (!) পুরো দুনিয়াতে খুব কমই আছে। নিজে ওখানে যাইনি, তবে ওখানকার ঘটনা যত শুনেছি, তাতে ঐ দলের লোকগুলোর আত্মকেন্দ্রিকতা ছাড়া আর কিছুই দেখিনি। ওরা অন্য দেশের মানুষকে মানুষ মনে করে কী না, সেটা নিয়েই আমার সন্দেহ।
আমাদের দেশের অনেকেই আছেন, যারা নাকি সারা দুনিয়ার উপর মার্কিন কর্তৃত্ব নিয়ে অসন্তুষ্ট। আমি বলছি না, মার্কিনীরা সাধু-সন্ত জাতি, তবে এই আরবদের হাতে পুরো দুনিয়ার দায়ভার থাকলে কি হত সেটা ভাবতেও ভয় হয়।
যাই হোক, ধান ভানতে শিবের গীত ধরে ফেললাম। আসলে, মধ্যপ্রাচ্যে থাকা আমার দেশের মানুষগুলোকে ওরা যখন Sub-human প্রাণী হিসেবে ব্যবহার করে, আপনার ভাষায় "গবাদিপশুর সমান কাতারেই বাংলাদেশী শ্রমিকের স্থান। " -তখন সত্যিই আমার রাগ উঠে যায়, ঐ তেলে জবজবে হয়ে থাকা নাদুস-নুদুস শেখ গুলোর উপর।
@দুর্দান্ত: এই লেখাটা আপনার 'দুর্দান্ত' নামের প্রতি সুবিচার করেছে। টাইপোগুলো ঠিক করে নেবেন, সংখ্যার দিকথেকে এরা একটু বেশি হয়ে গিয়েছে।
শুভেচ্ছা
সহমর্মিতা বা এম্পেথি বলে মানুষের যে সহজাত প্রবৃত্তি, সেটা অত্র অঞ্চলের মানুষের খুব কম থাকে। আসলে পিতার পঞ্চম স্ত্রীর অষ্টম সন্তান হলে নিজেকেই বাঁচতে হয়েছে ডজন ডজন ভাইকে কনুই আর লেঙ্গি মেরে মেরে। সহমর্মিতা এখানে এক ধরনের দুর্বলতা।
লেখাটার জন্য ধন্যবাদ। নিউজে দেখেছি যে মার্কিন দেশেও এই রোগ ধরা পড়েছে। রোগী মিডলইস্টে হেলথকেয়ার প্রফেশনের ছিল।
________________________________________
অন্ধকার শেষ হ'লে যেই স্তর জেগে ওঠে আলোর আবেগে...
হুম! ক্রমশ আর ছড়িয়ে যাচ্ছে।
--------------------------------------------------------
এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।
এক লহমার... টুকিটাকি
কি বলেন? অস্ট্রেলিয়া থেকে আনতে হচ্ছে? জানতাম, সৌদি দেশে দুটি জিনিস অফুরন্ত; একঃ উট, দুইঃ খেজুর।
আচ্ছা, অস্ট্রেলিয়ান উটও কি সৌদি উটের মত পবিত্র বলে গণ্য হয়?
এমন একজনের সাথে আলাপ হয়েছিল সেই সময়টিতে; আশ্চর্য হল, লোকটি এত কিছুর পরও তার দুর্ভাগ্যের জন্য দায়ী করছিলেন বাংলাদেশের 'নাস্তিক সরকারকে' (তার ভাষায়); আরবীয় নির্যাতন বা শোসন তাকে স্পর্শই করতে পারেনি!!!
ছবিটা পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছিলাম! আয়নামতির একটা পোস্টে পড়েছিলাম আধুনিক ক্রীতদাস প্রথার কথা! আসলেই ক্রীতদাস প্রথা বিলুপ্ত হয়নি, হবার নয়, মানুষ নিজে ক্রীতদাস হতে না চাইলেও অন্যকে করতে চায়, এজন্যই নতুন নতুন ফর্মেটে এই প্রাচীন প্রথাটির উত্তরণ ঘটছেই শুধু!
আচ্ছা, দুর্দান্ত, আপনি ঐ দেশে কর্মসূত্রে আছেন? নাকি ভ্রমন সূত্রে?
.............................
তুমি কষে ধর হাল
আমি তুলে বাঁধি পাল
সৌদি উট পবিত্র কিনা জানিনা, তবে কিছু উট মানুষের চাইতেও বেশী আরাম আয়েশে থাকে।
লেখাটা পড়ে খুব ভালো লাগল আবার খুব মনও খারাপ হল
ফাহিমা দিলশাদ
উষ্ট্রমূত্রে তাইলে কুনু ফায়দা হয় নাই? খুবই খারাপ কথা। কি ভালই না হইতো, দুগ্ধে রোগগ্রস্ত মূত্রে নিরাময়, এইরাম হইলে
----ইমরান ওয়াহিদ
মনটা খারাপ হয়ে গেল।
__________________________________
----আমার মুক্তি আলোয় আলোয় এই আকাশে---
নিজেদেরকেই একটু সাবধান হতে হবে। আশা করছি খুব দ্রুত নেই কোন একটা ভ্যাকসিন আবিস্কার করবে।
পুনরাবৃত্তি হয়ে যাচ্ছে, তবু বলি - মনটা খারাপ হয়ে গেলো!!
অট: আপনার প্রো পিকে তো এটা আই অফ হোরাস, তাই না? কোন বিশেষ কারণ আছে কি এই প্রো পিকের পেছনে? (অনধিকার অনুপ্রবেশ হয়ে গেলে দু:খিত)
____________________________
নতুন মন্তব্য করুন