এল এন জি -২
বাংলাদেশ কেন বিদেশ থেকে ভারতের চাইতে বেশী দাম দিয়ে গ্যাস কিনছে, সেটা গণমাধ্যমের একটি আলোচনার বিষয়। এই বেশী দাম বা কম দাম পর্যালাচনায় যাবার আগে কতগুলি ধারণা পরিস্কার করা দরকার
আগের পোস্টে বলেছিলাম যে বিশ্বে এল এন জি ও সামগ্রিক গ্যাসের বাজারের প্রবৃদ্ধি বেশ শক্তপোক্ত। তা হলেও গ্যাস এখনো পুরোপুরি কমোডিটি বা পণ্যে পরিনত হতে পারেনি। খনিজ তেল যেমন দুনিয়ার সর্বত্র অবাধ কেনাবেচা করা যায়, একটি চালানের ক্রেতা-বিক্রেতার বনিবনা না হলে ঐ চালান চোখের নিমেষে হাতবদল করে ফেলা যায়। সেকারনে তেলের একটি বিশাল কাগুজে বাজারও আছে - যেখানে শুধু চুক্তিগুলোই কেনাবেচা হয়। গ্যাসের ক্ষেত্রে তেমন টি এখনো হয়ে ওঠেনি। গ্যাসের অবাধ কেনাবেচার জন্য যে অবকাঠামোর দরকার, তা দুনিয়ার সর্বত্র নেই। উত্তর আমেরিকা, ইউরোপ, জাপান - এই দেশগুলোই ৫০-৬০ বছর ধরে তিলে তিলে তাদের গ্যাস অবকাঠামো গড়ে তুলেছে
তেলের বাজারে যেমন ইউরোপে ব্রেন্ট বা আমেরিকায় ডব্লিই টি আই এর মত মূল্যসূচক আছে, তেমন গ্যাসের বাজারেও কতগুলি সূচক আছে। তফাত হল, এই সূচকগুলির ভিত্তিগুলি সমান নয়। খুলে বলি, আমেরিকার মূল সূচক “হেনরি-হাব” মূলত পাইপে পরিবাহিত স্থানীয় বায়বীয় গ্যাসের দাম - এই দামের বিশেষ কোনো ফর্মূলা নেই। অন্যদিকে জাপান আর কোরিয়ার গ্যাসের দামগুলো ফর্মূলা নির্ভর। এই দেশগুলোতে গ্যাস বলতে প্রায় সবই আমদানি করা। তাই তারা গ্যাসের দামকে তেলের দামের সাথে ফর্মূলা করে নির্ধারণ করে। বলা হয় ব্রেন্টের ক% বা ডব্লিঊ টি আই এর খ% হারে গ্যাসের দাম হবে। তখন তেলের দামের সাথে গ্যাসের দাম মুক্তভাবে ওঠা নামা করে থাকে
এসব বাজারের বাইরে এশিয়া ও মধ্যপ্রাচ্যের নতুন গ্যাস আমদানিকারকদের আরেক ধরনের হিসাব আছে। এর মধ্যে চীন, ইন্দোনেশিয়া বা ভারত, মানে যাদের নিজস্ব কয়লা আছে তারা চাইলে নিজের জ্বালানীর চাহিদা কয়লা দিয়ে পূরণ করতে পারতো। কিন্তু পরিবেশ ও রাজনৈতিক কারনে সেটার বদলে তারা ক্রমে গ্যাসের দিকে ঝু]কছে। এরা যখন আমদানি করে, তখন তাদের চোখে গ্যাসের দামের সূচক হিসাবে তারা কয়লাকে ব্যাবহার করে। যেহেতু তাদের নিজস্ব বিকল্প আছে, তাই বিক্রেতাদের সাথে দরকষাকষির সময়ে তাদের অবস্থানও বেশ সবল থাকে। ফলে এরা যখন গ্য়াস কেনে, তার দাম সুচ্কের ধারে কাছে থাকে
অন্যদিকে বাংলাদেশ, পাকিস্তান বা আরব আমিরাতের কাছে হিসাব ভিন্ন। এই দেশগুলি যদি গ্যাস আমদানি না করে, তাহলে তাদের সামনে একটাই পথ খেলা আছে, আর সেটা হল তেল। অনেক ক্ষেত্রে এই দেশগুলোর শিল্পকারখানাগুলি এখনই গ্যাস নিতে পারে। ভবিষ্যতে হয়তো কখনো পারমানবিক শক্তি বা নবায়নযোগ্য জ্বালানিও এই দেশগুলোর মূল চালিকা হতে পারবে, তবে তার জন্যও দরকারী নতুন অবকাঠামোতে সুবিশাল বিনীয়োগ দরকার, আর দরকার পাঁচ-দশ বছর সময়। এই দেশগুলো যে তাদের গ্যাস আমদানির সময়ে তেলেকে তাদের সূচক হিসাবে ধরে নেবে - এটাই তো স্বাভাবিক। আরব আমিরাতে নিজস্ব গ্যাস আছে, কিন্তু সেটা তাদের জন্য যথেষ্ট নয়, এটা ঘটেছে ৭০/৮০ র দশকে তাদের কিছু অদূরদরশী সিদ্ধান্তের জন্য। তেলের “গরমে” তারা গ্যাসকে আবর্জনা ভেবে বিদেশীদের হাতে তুলে দিয়ে এখন মাথায় হাত। বাড়ীর পাশের এত এত কাতারী আর ইরানি গ্যাস থাকলেও ভূরাজনৈতিক কারনে তাদের কাছে অচ্ছু্ৎ
বাংলাদেশের নিজস্ব গ্যাস আছে। কিন্তু গত ২০ বছরে এর উন্নয়ন বা আহরণে কোনো বড় কাজ হয়নি। মিয়ানমারের সাথে মোকদ্দমায় বাংলাদেশ যে সাগর জিতে নিল, তার সীমানা ঘেষে মিয়ানমার বড় তেলগ্যাসের ক্ষেত্র খুঁজে পেয়েছে। অথচ বাংলাদেশ এখনো ঐ এলাকার জরিপটাই ঠিকমত করে উঠতে পারলো না। এর সাথে গত দশকের বিদ্যুৎ উন্নয়নের প্রায় পুরোটাই গড়ে উঠেছে তেল নির্ভর হয়ে।
এখন প্রশ্ন আসতে পারে, হোক বাংলাদেশের নিজস্ব বিকল্প তেল, বিশ্ববাজারে তো গ্যাসের দাম কমেছে, তো সেকারনেও তো গ্যাসের দাম কম হবার কথা। হবার কথা ছিল, যদি বাংলাদেশ একবারে বড় আকারের গ্যাস আমদানি করতে পারতো। যেখানে জাপান বছরে ৮০ মিলিয়ন টন আর ভারত ৪০ মিলিয়ন টন আমদানি করতে পারে, বাংলাদেশ সেখানে আমদানি ক্ষমতা মাত্র ৬ মিলিয়ন টন।
যেহেতু এসব চুক্তি হয় ১০-১৫ বছর ধরে, সেকারনে বিক্রেতা দুপক্ষই তাদের স্বার্থ রক্ষা করে। তেলের দামের ওঠানামার সুবিধা নিতে ক্রেতারা তেলের দাম নির্ভর ফর্মূলা ভিত্তিক মূল্যায়ন পছন্দ করে, তেমনি বিক্রেতারা “ছোট” খদ্দেরদের কাছে গ্যাসের দামের ওপরে একটি থোক মাশুল আদায় করে। এর ফলে দীর্ঘ মেয়াদী চুক্তির মাধ্যমে আমদানি করা গ্যাসের দাম আর বিশ্ববাজারে বহুল প্রচারিত সুচক মূল্যের মধ্যে বিস্তর ফারাক থাকতে পারে। তাবে আমদানিকারক তার লাভক্ষতির বিচার করে তার বিকল্প (তেল পোড়ানোর খরচ) এর সাথে তুলনা করে, বাজার দরের সাথে নয়
গ্যাস আমদানীর ক্ষেত্রে বাংলাদেশ আর ভারত সমতুল্য নয়। সেকারনে ভারত যে দামে গ্যাস আমদানি করবে, বাংলাদেশ তার চাইতে কিছুটা বেশী দামেই কিনবে।
এই পরিস্থিতির সমাধান একটাই : বাংলাদেশকে তার নিজের নবায়নযোগ্য জ্বালানি, কয়লা ও গ্যাস উন্নয়ন করতে হবে।
মন্তব্য
--------------------------------------------------------
এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।
এক লহমার... টুকিটাকি
আপনি ইন্ডিয়ার সাথে আমাদের এল এন জি এর দামের পার্থক্য থাকার কথা বললেন কিন্তু তাদের তুলনায় আনাদের এল পি জি এর মূল্য এতো বেশি থাকার কারণ কি?
নতুন মন্তব্য করুন