থাকতে কি চাও নির্বিরোধ ?

সবজান্তা এর ছবি
লিখেছেন সবজান্তা (তারিখ: রবি, ১৬/১২/২০০৭ - ২:১৬পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

খুব সম্ভবত রবীন্দ্রনাথই বলেছিলেন ( ভুল ও হতে পারে, সে জন্য আগাম ক্ষমাপ্রার্থী ) , সন্ধ্যা বেলায় প্রদীপ জ্বলার পিছে থাকে, সকাল বেলায় সলতে পাকানোর কাহিনী। আমিও তাই সলতে পাকানোর ইতিহাসটাই আগে একটু ব্যাখ্যা করি।

কথা ছিলো বিজয় দিবস নিয়ে কিছু একটা লেখার। বিজয় কিংবা স্বাধীনতা দিবস নিয়ে কিছু লেখা আমার জন্য একটু কষ্টকর। খুব সম্ভবত আমরা এই ফোরামে যারা আছি , তাদের অনেকের জন্যই। যখন বিষয়টা হয়ে যায় নির্দিষ্ট কিছু, এবং তা সম্পর্কে আপনার জ্ঞান সম্পূর্ণ পুথিগত এবং লোকমুখে শোনা, তখন লেখাটা বোধহয় খুব সহজ কাজ না। সঙ্গত কারনেই আমি বেশ সময় নষ্ট করেছি, কিন্তু কোন লেখাই লেখতে পারিনি। যাই লেখতে গিয়েছি, মনে হয়েছে এমনটা কোন গল্পে পড়েছি, এটা পাঠক আগের থেকেই জানে। নিজ চোখে দেখা হয়নি বলে হয়ত, তেমন কিছু লেখা আমার পক্ষে কঠিণ, যাতে নতুনত্ব আছে। যখন হতাশ হয়ে লেখার আশা মোটামুটি ছেড়ে দিয়েছি,তখন প্রায় হঠাৎ করেই ভাবলাম, কেমন হয় যদি এই বিজয়ের পর আমরা নতুন প্রজন্ম কেমন কি ভাবছি তা নিয়ে লেখি ?

নতুন প্রজন্ম মুক্তিযুদ্ধকে ভালো করে জানে না, তারা মুক্তিযুদ্ধের জন্য তেমন করে অনুভব করে না, এ সবই অনেক পুরানো হতাশা। আমরা চর্বিত চর্বণের মত বলে যেতে থাকি, কিন্তু কেউ তা নিয়ে ভাবি না। কেন আমাদের দেশের একটা কিশোর/তরুণ, দেশ বলে একটা কিছু অনুভব করে না ? কারন খোজার জন্য এফ বি আই কিংবা সি আই ডি র দরকার নেই। আপনি নিজেই জানেন কেনো। আমাদের এই দেশে এই বিজয়কে আমরা কিভাবে উদযাপন করেছি ?

নিরস ইতিহাস বই ছাড়া, বর্তমান প্রজন্মকে অতীত জানানোর অন্যতম উপায় হচ্ছে চলচ্চিত্র কিংবা নাটক। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর কত অসংখ্য ভালো চলচ্চিত্র হয়েছে সেটি নিয়ে। এমন কি এখনো হচ্ছে। তাদের শিল্পমান কত উচুঁদরের। এমনকি অস্কার বিজয়ী পর্যন্ত।

আর সেইখানে আমাদের দেশে কি হয়েছে ? হাতে গোনা কয়েকটি ভালো চলচ্চিত্র। সত্যি বলতে কি হাতের কড়েও গোনা লাগে না, ২ হাতের দশ আঙ্গুল দিয়েই গুনে শেষ করা যায় এমন ছবির সংখ্যা। সাম্প্রতিক কালেও কিছু হচ্ছে, কিন্তু তার মান মোটেই গর্ব করার মত না। কাহিণীর অসংগতি, দুর্বল অভিনয় সব কিছুর জগা খিচুরি এগুলো। তাও যা হচ্ছে ব্যাতিক্রমী ধারার নির্মাতাদের দ্বারা। মূল ধারার নির্মাতাদের কথাতো বাদ ই দিলাম। তারা সাধারণ ছবিই বানাতে পারে না। নেই কোন অভিনয়, নেই কোন কাহিনী, নেই কোন ক্যামেরার কাজ, তারা কি বানাবে মুক্তিযুদ্ধের মত বিশাল বিষয় নিয়ে ছবি ?

বাংলাদেশে চলচ্চিত্র অপেক্ষা নাটকের স্থান বেশ শক্ত। মঞ্চে অনেক শক্তিশালী অভিনেতা এবং নির্দেশকরা কাজ করে থাকেন। মঞ্চ নিয়ে আমি সম্যক অবগত না হওয়ায় এ নিয়ে আমি কিছু বলতে পারছি না। তবে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র হচ্ছে টেলিভিশন নাটক। এটি নিয়ে পর্যবেক্ষণটিও বেশ দুঃখ জনক। ছোট বেলা থেকেই দেখে আসছি, ডিসেম্বর কিংবা মার্চ মাস মানেই টিভিতে যুদ্ধের নাটক। যুদ্ধ মানেই সেই একই বাধাধরা কাহিনী। কেনো এমন হবে ? কেন লক্ষ লোকের মনস্তত্ত্বকে আমরা মাত্র ২৫-৩০-৩৫ বছর পরেই বুঝতে পারবো না ?
যুদ্ধ মানে কি শুধুই যুদ্ধ ? তার সাথে জড়িত মানুষগুলোর চিন্তা ভাবনাও কি এর অংশ না ? যুদ্ধের সমান্তরালে মানুষের জীবন কি গুরুত্বপূর্ণ না ? কিন্তু আমাদের দেশের প্রথিতযশা নাট্যকার কিংবা লেখকরা বোধহয় এসবের কথা ভুলে গিয়েছেন। না হলে কিভাবে মুক্তিযুদ্ধের মত বিষয়ের নাটককে আমাদের মত যুদ্ধপরবর্তী প্রজন্ম ফালতু বা বোরিং বলে অভিধায়িত করতে পারে ? লেখার শুরুতেই , নবীন লেখক হিসেবে আমি আমার সীমাবদ্ধতার কথা বলেছি। একটা কিছু নিয়ে নতুন করে লিখতে হলে, আমার মত ছোকড়া, মাঝারি লেখককে (কিংবা অলেখক ) তার সম্পর্কে কিছুটা হলেও প্রত্যক্ষ জ্ঞান থাকতে হয়। কিন্তু দেশের অনেক দিকপাল লেখক আছেন যারা মুক্তিযুদ্ধকে সামনা সামনি দেখেছেন, তারা কেন একটু সময় দিয়ে কালোত্তীর্ণ একটি উপন্যাস বা চিত্রনাট্য লেখেন না ? দেশের কাছে কি তারা অন্তত এতটুকু ঋণী নন?

তবে এই ক্ষেত্রে কিছুটা এগিয়ে আছে আমদের সংগীতাঙ্গন। সেই সাবিনা ইয়াসমিনের “সব কটা জানালা খুলে দাওনা” থেকে অধুনা জেমসের “বাংলাদেশ”। এমন অনেক গানই আছে, যা শুনলে গায়ে কাটা দিয়ে উঠে, চোখ ঝাপসা হয়ে যায়, মনে হয় , নাহ, এটা আমার দেশ! আমার বাংলাদেশ !

নতুন প্রজন্মের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে জ্ঞান বেশ ভীতিজাগানিয়া। এবং অনেক ক্ষেত্রে তাদের চিন্তা ভাবনাও শঙ্কা উদ্রেককারী।আমার সৌভাগ্য ( নাকি দুর্ভাগ্য ) হয়েছিল, দেশের প্রথিতযশা ইংরেজী মাধ্যম স্কুলগুলোর কিছু ছাত্র-ছাত্রীর সাথে কথা বলার। তাদের অনেকেরই ঠিক মত এটাই জানা নেই, ১৬ ডিসেম্বর কিংবা ২৬ শে মার্চ , কোনটা কি দিবস, কেনো পালন করি। এতেও বোধহয় আমি তেমন আতংকিত হতাম না, কিন্তু তাদের পাকিস্তান প্রেম আমাকে ভীত করে তুলেছিল। তারা ক্রিকেটেই শুধু পাকিস্তানকে সমর্থন করে না, তারা অনেকেই মনে করে পাকিস্তান তো বাংলাদেশের ভাই। যুদ্ধের কথা উঠলে, তাদের বক্তব্য, কত না কত বছর আগে কি না কি হয়ে গিয়েছে, সেটা নিয়ে এত ঘাটাঘাটি করার কি দরকার ? এদের সাথে কথা বলে এবং আমার ব্যাক্তিগত অভিজ্ঞতায় যে জিনিশটা আমি বুঝতে পেরেছি, দুর্ভাগ্যজনক হলেও, দেশের তথাকথিত “এলিট” ক্লাসের এক অংশের পাকিস্তান প্রেম ভয়াবহ। এরা এখনো পাকিস্তানকে নিজের দ্বিতীয় দেশ বলেই ভাবতে ভালোবাসেন। আমি এমন একজন ধনকুবেরের কথা জানি , যিনি এখনো ভাবেন, পাকিস্তান আর বাংলাদেশ একই সত্ত্বা। এমন লোকের কথাও জানি , যিনি পাকিস্তানের ক্রিকেট খেলা দেখার জন্য বিশ্বের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্ত চষে বেরিয়েছেন। অথচ নিজের দেশের খেলা একটিও দেখেছেন কিনা সন্দেহ। এহেন লোকদের সন্তানরা যে কি হবে তা সহজেই অনুমেয়। এমন একটি পাকিস্তানপ্রেমী ভদ্রলোকের তনয়ের সাথে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কথা বলার এক পর্যায়ে সে আমাকে বলে বসলো, “ওহ, রাবিশ! তুমি এসব ইমোশনাল কথা বিশ্বাস কর ?” ইচ্ছা করছিল, সদ্যকেনা বাটার স্যান্ডেল দিয়ে মারি দু ঘা।

নতুন প্রজন্ম নিয়ে চিন্তা ততোটা ভীতিকর নয় যখন সেটা অজ্ঞানতা প্রসূত। কিন্তু যখন দেখি, একদল তরুণ ইচ্ছাকৃতভাবে বিপথগামী হয়ে বাকিদেরও সেই পথে টানে, তখন চিন্তিত হতেই হয়। অনেকেই হয়ত জানেন, বাংলাভাষার প্রথম দিকের একটি ব্লগসাইটের কথা। যেখানে স্বাধীনতা বিরোধী জামাত শিবির চক্রের অনুগতরা এক তরফা স্বাধীনতা বিরোধী মতবাদ প্রচার করতো। এবং রহস্যজনকভাবে কতৃপক্ষ নিশ্চুপ থাকতো। এভাবেই, ইয়াহু গ্রুপ, ফোরাম কিংবা ব্লগের মাধ্যমে এই বিষ ছড়িয়ে পড়ছে সারা শরীরে।

এই লেখাটা লিখতে লিখতে হঠাৎ খেয়াল করলাম, আমিও সেই একি পথে হেটে যাচ্ছি। কি করা উচিত, কি না করা উচিত, তা নিয়ে জ্ঞান বিতরনে আসলে কোন লাভ নেই। আমরা যারা এখনো মুক্তিযুদ্ধে বিশ্বাস করি, তারা সবাই বুঝতে পারছি যে, সামনের দিনগুলো আমাদের জন্য অনেক কঠিণ। আমাদের সামনে শেষ সুযোগ গর্জে উঠবার। নিশ্চুপ থাকবার কোন সুযোগ নেই। যা হওয়ার হবে -- এই চিন্তা থেকে বের না হয়ে আসতে পারলে আমরা কেউই হয়ত মুক্তি পাবো না। আমার খুব প্রিয় এক জোড়া পংক্তি দিয়েই লেখাটা শেষ করতে চাই--

থাকতে কি চাও নির্বিরোধ ?
রক্তেই হবে সে ঋণ শোধ


মন্তব্য

অতিথি লেখক এর ছবি

ইতিহাসের বিবৃতি সবসময় একই রকম থাকে, থাকারও কথা শুধু আমাদেরটা ছাড়া....
কিংবদন্তী (http://kingbadantee.blogspot.com/)

হাসান মোরশেদ এর ছবি

আরো খারাপ দিন আসছে সামনে ।
এক অর্থে এই ভালো হয়তো । চুড়ান্ত খারাপ দিন না আসলে ঘুরে দাঁড়ানো হয়না । সমস্যা হলো এই, এই খারাপ দিন মোকাবেলা করার মতো নেতৃত্ব কিংবা সংগঠন নেই । সংগঠিত অপরাধীদের সংগঠন ছাড়া মোকাবেলা করা যায়,বিচ্ছিন্ন ভাবে আমরা যতো বেশীই হই না কেনো ।
----------------------------------------
পাখীটা উড়ে যেতেই চাঁদ উঠে পড়লো-
আজো সেই রক্তমাখা মুন্ডুটাই উঠলো ।।

-------------------------------------
জীবনযাপনে আজ যতো ক্লান্তি থাক,
বেঁচে থাকা শ্লাঘনীয় তবু ।।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।