বিজ্ঞান শিক্ষাতে অনীহা নিয়ে লেখা প্রথম লেখাতে আমরা দেখেছিলাম ভালো মানের পাঠ্য বইয়ের অভাব কিভাবে বিজ্ঞানশিক্ষাকে বাঁধাগ্রস্ত করে। যদিও সে লেখাতে মূলত ভালো বইয়ের অভাবকেই বড় করে দেখানো হয়েছে কিন্তু তারপরও মন্ত্যবের ঘরে ভালো শিক্ষকের অভাবের কথাও উঠে এসেছে। তাই খুব সহজেই বোঝা যায়, বিজ্ঞান শিক্ষাতে অনীহার পেছনে ভালো শিক্ষকের অভাব কারনটি বেশ প্রতিষ্ঠিত এবং স্বীকৃত।
শুরু করা যাক নিজের একটা ঘটণা দিয়ে। আমি তখন অষ্টম শ্রেণীর ছাত্র। একজন বিজ্ঞানের স্কুল শিক্ষককে জিজ্ঞেস করেছিলাম যে, সোডিয়াম হাইড্রোক্সাইড এবং হাইড্রোক্লোরিক এসিডের বিক্রিয়া থেকে তৈরী হয় সোডিয়াম ক্লোরাইড অর্থাৎ খাদ্য লবন এবং পানি। এখন আমি যদি উল্টা কাজটা করি অর্থাৎ খাদ্য লবন আর পানিকে এক সাথে করি তাহলে কি সোডিয়াম হাইড্রোক্সাইড এবং হাইড্রোক্লোরিক এসিড তৈরী হবে না ? হলে সেই এসিড যায় কোথায় কারন লবন আর পানি তো আজ পর্যন্ত অসংখ্যবার মিশিয়েছি ছোটবেলা থেকে, এসিড হয় এমন তো শুনিনি। প্রসংগত উল্লেখ্য তখনো আমি উভমুখী , একমুখী ইত্যাদি বিষয় পড়িনি। যাই হোক, আমার এই প্রশ্নে স্যার বিন্দুমাত্র বিচলিত না হয়ে বললেন, “এসিড তৈরি হয়তো !! তুমি খেয়াল করবে যে, লবনে পানি দিলে একটা ঝাঁঝালো (!!) বুদ্বুদ তৈরি হয়, সেটা আসলে এসিডের কারনে”। তখন এগুলি বোঝার মত জ্ঞান আমার হয়নি, তবু সে বয়েসেই বেশ বুঝতে পেরেছিলাম, স্যার কি চমৎকার একটি গোঁজামিল দিলেন। এটা আসলে খুব সামান্য উদাহরণ শিক্ষকদের প্রকৃত দশার।
অংকের শিক্ষকদের একটি সর্বজনবিদিত রোগ হচ্ছে, তাঁর নিয়মে অংক না করলে সেটি কেটে দেওয়া। ব্যাপারটা কতখানি হাস্যকর তা একটু বড় হয়েই টের পেয়েছি। নিজে জীবনে যত না এর ভুক্তভোগী হয়েছি, তার চেয়ে বেশি হয়েছি প্রাইভেট টিউশনীর ছাত্রদের জন্য। দেখা গেল, একটা অংক করিয়ে দিলাম, সে পরের দিন মুখ হাড়ি করে এসে বলছে, “ভাইয়া এটা স্কুলের স্যার কেটে দিয়েছেন, বলেছেন এভাবে করলে হবে না। ” আমি দেখতে চাইলাম স্যার এর নিয়মে করা অংক। দেখার পর হাসবো না কাদঁবো কিছুই বুঝলাম না, কারন শিক্ষক মহাশয় তার “শর্টকাট” নিয়মে এক জায়গায় উভয় পক্ষকে এমন রাশি দিয়েও ভাগ করেছেন যার মান নিশ্চিন্তে শুন্য হতে পারে। ব্যাপারগুলি শুরুতে বেশ অবাক লাগতো, কিন্তু পরবর্তীতে বুঝতে পেরেছি এর পেছনে রয়েছে এক ধরণের নিরাপত্তাহীনতা। খুব শুরুর থেকে যদি তাকাই, এই যুগে কারা হন স্কুলের শিক্ষক ? কিছু ব্যতিক্রম বাদ দিলে, শিক্ষকদের প্রতি পূর্ণ সম্মান নিয়েই বলতে চাই, অধিকাংশ শিক্ষকই তার ছাত্র জীবনে মোটেই আহামরি কিছু ছিলেন না, কিংবা আরো একটু নির্দিষ্ট করে বললে, তাদের অধিকাংশই ভালো ছাত্র ছিলেন না। আপনি নিজেই ভেবে দেখুন আপনার ছাত্র জীবনে আপনি কিংবা আপনার পরিচিত কয়জন ভালো কিংবা চলনসই ছাত্র ভেবেছিলেন আপনারা পাশ করে স্কুলে শিক্ষকতা করবেন ? আমার হিসাব ভুল না হলে সংখ্যাটা খুব বেশি হওয়ার কথা না। এধরণের মধ্য কিংবা নিম্ন মানের ছাত্ররা যখন স্কুলে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পান, তখন স্বাভাবিকভাবেই তারা নিজেরা বুঝতে পারেন তাদের সীমাবদ্ধতাটা। সে ব্যাপারগুলি যাতে সামনে না আসে, যাতে ছাত্ররা তাদের প্রতি অনুগত থাকে, তাই তারা নিয়মের ব্যাপারে অতিরিক্ত কড়া থাকেন।দুঃখজনকভাবে অংক শেখানোর চেয়েও তারা এক ধরণের গানিতিক পলিটিক্সেই ব্যস্ত থাকেন। অবশ্য নিয়ম নিয়ে কড়াকড়ির আরেক কারন শিক্ষকের নিজেরই প্রাইভেট টিউশনি কিংবা কোচিং ব্যবসা। বাংলাদেশের একটি স্বনামধন্য সরকারী স্কুলে আমার অনেকগুলি বন্ধু ছিলো, সেই সুবাদেই জানতে পেরেছিলাম যে, ওদের স্কুলের শিক্ষককে খুশি করার জন্য অংক,বিজ্ঞান, ইংরেজী এমনকি বাংলা, ইসলামিয়াত পর্যন্ত ব্যাচে প্রাইভেট পড়তে হত। অন্যথায় ভালো মার্কের আশা করাটা বোকামি। এদিক থেকে অবশ্য বেসরকারী স্কুলগুলি তুলনামূলকভাবে ভালো। এতটা নির্লজ্জ ব্যবসার কথা বেসরকারী কোন স্কুল থেকে শুনিনি।
প্রাইভেট পড়াটা হয়ত খারাপ না, কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায় সে কোচিং এর মান নিয়েও। নিজের অভিজ্ঞতা থেকে দেখেছি যে কোচিং এর অবস্থা আরো খারাপ। বিজ্ঞানের বিখ্যাত শিক্ষকদের কোচিং এ প্রতি ব্যাচে এমনও আছে ৩৫-৪০ জন করে পড়ে। শিক্ষকের সময়ই নেই তাদেরকে কিছু শেখানোর। সেই থোড়বড়িখাড়া আর খাড়াবড়িথোড়। বানের জলের মত আসতে থাকা ছাত্রের তোড়ে শিক্ষক মশাই কোনমতে একটা ব্যাচ শেষ করতে পারলেই বাঁচেন।ছাত্রদের তো তিনি হ্যান্ডনোট দিয়েই দিচ্ছেন, কাজেই সেটা মুখস্ত করলেই তাদের হয়ে যাবে। আর ছাত্রদের তথা তাদের বাবা মাদেরও বিশেষ চিন্তা নেই, কারন বাসায় তো ওকে ঠিক মত শেখানোর জন্য বুয়েটের ছাত্র রাখা আছেই। এই সম্পূর্ন অসুস্থ প্রক্রিয়ায় ছাত্রের সবচেয়ে বেশি যে ক্ষতি হয়, তা হচ্ছে সে নিজে পড়ার সময় পায়না। এ টিচার সে টিচার করে তার সারাদিন কেটে যায়, তাই বই এর ভেতরে কি লেখা আছে পড়ার সময় সে পায়না। সে শুধু প্রশ্নের উত্তর মুখস্ত করে আর অনুশীলনীর অংক সমাধান করে, এমনকি নিজের থেকে চিন্তা করে জ্যামিতির কোন সমস্যা সমাধান করার সময়ও তার নেই।
স্কুল পর্যায়ে এমনভাবে চললেও, কলেজে এসে এরকম একই বিষয়ে ২-৩ জনের কাছে পড়া কষ্টসাধ্য হয়ে পড়ে। উচ্চমাধ্যমিকের সিলেবাস এমনিতেই যথেষ্ট বিশাল এবং জটিল, তাই একই বিষয় অনেকের কাছে পড়ার সময় হয়ে উঠে না। মাধ্যমিকের অনেক তারাই আচানক উচ্চমাধ্যমিকে এসে মাটিতে নামে। আর বিজ্ঞানের এই রুদ্রমূর্তি দেখে অনেকেই সাহস পায় না আর বিজ্ঞান নিয়ে অনার্স পড়ার।
এতো গেল স্কুলের কথা। দেখা যাক কলেজে কি চলে।
উচ্চমাধ্যমিকে স্থানাংক জ্যামিতিতে এ আর খলিফার উপপাদ্য বলে একটি উপপাদ্যের সাহায্য নিয়ে কিছু শিক্ষক অংক করতেন, কেউ আবার ঐ নিয়ম দেখলেই লাল কালি চালাতেন। তবে এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে এগিয়ে আছেন পরিসংখ্যান এর শিক্ষকেরা। একটা উপপাদ্যের অনেক নিয়ম থাকতেই পারে, কিন্তু শিক্ষকরা এক এক জন এক এক নিয়মে অংক করাতেন এবং নিজের নিয়মের বাইরে গেলেই কলম চালাতেন। ব্যাপারটা অনেকটা আন্ডারওয়ার্ল্ডের মত। কয়েকজন শিক্ষক মিলে ( মূলত ঢাকা কলেজ, নটরডেম, সিটি কলেজ, ভিকারুননেসা এর শিক্ষক ) সম্পূর্ণ ঢাকা শহরকে কয়েক ভাগে ( মানে ছাত্রদেরকে) ভাগ করে ফেলেছেন। তাঁরা তাদের ছাত্রদেরক এক নিয়মে শিখিয়ে যাচ্ছেন, আর তার বাইরের নিয়মকে নির্দ্বিধায় কেটে দিচ্ছেন। এই অসুস্থ প্রতিযোগিতার কারনে ছাত্রদের ক্ষতি হচ্ছে সবচেয়ে বেশি কারন একই অংক যে অনেক নিয়মেই করা যেতে পারে সে কথা তারা বেমালুম ভুলে যাচ্ছে।
উচ্চমাধ্যমিকের শিক্ষকদের জ্ঞান এবং দক্ষতা , স্কুলের শিক্ষকদের তুলনায় গড়ে ভালো।স্কুল পর্যায়ের অনেক ভালো এবং নামজাদা শিক্ষককেই দেখেছি বিজ্ঞান এর ব্যাপারে গভীর জ্ঞান না নিয়েই শুধু মাত্র বাগাড়াম্বর করে দিন পার করতেন। সে তুলনায় কলেজের শিক্ষকরা স্বাভাবিক ভাবেই বেশি জ্ঞানের অধিকারী। তবে ব্যতিক্রম যে নেই তা বলবো না। নিজেরই একটা ঘটণা বলি। কলেজে উঠে পদার্থবিজ্ঞান পড়ার জন্য গেলাম দেশের নামকরা একজন শিক্ষকের কাছে, যিনি আরো ২ জন লেখকের সাথে পদার্থবিদ্যার একটি বই লিখেছেন, যা উচ্চমাধ্যমিক শ্রেনীতে বোর্ডের অনুমোদিত জনপ্রিয় পাঠ্যগুলির একটি। উনি শুধু মাত্র ভালো ছাত্র পড়ানোর ক্ষেত্রে এতটাই বদ্ধপরিকর যে নটরডেম, ঢাকা কলেজ, হলিক্রস, ভিকারুননিসা ছাড়া আর কোন ছাত্র-ছাত্রী পড়ান না। শুধু তাই না, এদের মধ্যে থেকেও উনি ভর্তি পরীক্ষার মাধ্যমে ছাত্র বাছাই করেন। যাই হোক, অনেক কাঠ খড় পুড়িয়ে ভর্তি হলাম উনার কাছে। প্রথম প্রথম তো রীতিমত মুগ্ধ আমি, এত সুন্দর করে স্যার পড়ান আর উনার বেসিক এত পরিষ্কার। সত্যি কথা বলতে কি এখনো ভেক্টর এবং ক্লাসিকাল মেকানিক্সের প্রব্লেম সলভ করার সময় স্যার শেখানো পদ্ধতিই কাজে আসে। কিন্তু গন্ডগোল লাগলো দ্বিতীয় পত্রে। আধুনিক পদার্থবিদ্যা, তাড়িতচৌম্বক বিদ্যা, আলোর তত্বগুলি ( সমাবর্তন, অপবর্তন ইত্যাদি ) এগুলি পড়ানোর সময় উনার দুর্বলতা প্রকাশ পেতে লাগলো খুব প্রকটভাবে। উনার মত একজন বই লিখিয়ে নামজাদা শিক্ষকেরই যখন এই হাল, দেশের আনাচে কানাচের অবস্থা সম্পর্কে আশা করি একটা ধারণা করা কঠিন হবে না।তবে সবাইকে এত মোটা দাগে দোষের ভাগীদার করা যাবে না। উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়েই অনেক ভালো শিক্ষক দেখেছি আমি, বিশেষত রসায়ণ এবং গণিতের।
এই পর্বের দ্বিতীয় খন্ডে এর কারনগুলি এবং শিক্ষকদের তরফের কিছু যুক্তিও আশা করি তুলে ধরতে পারবো।
(চলবে )
চিত্র কৃতজ্ঞতাঃ CartoonStock.com
এই সিরিজের পূর্বের লেখাসমূহঃ
মন্তব্য
তোমার লেখা খুবই সমসাময়িক এবং অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মেসেজ বহন করে। আমি পরবর্তি লেখাগুলোর জন্যই বেশি অপেক্ষা করছি।
ভাল লিখেছেন।
শিক্ষাব্যবস্থার এরকম একটা ঝামেলার উপরেই আমি জীবনে আমার প্রথম ব্লগ লিখেছিলাম। তখন সামহোয়্যারে ব্লগ খুলেছিলাম - পরে অবশ্য ত্যাগ করেছি।
ওটাকে সংগ্রহে রেখেছি আমার ব্লগস্পটের জায়গায়।
________________________________
সমস্যা জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ; পালিয়ে লাভ নাই।
________________________________
সমস্যা জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ; পালিয়ে লাভ নাই।
ভাল লিখেছেন কমরেড ।
একবার স্কুলে অংক স্যারের সাথে তুমুল ঝগড়া বেঁধে গিয়েছিল আমার, বই এর মত উদাহরণে করিনি বলে, অনেক রাগ উঠে গিয়েছিল সেদিন, স্যার ও খেপা, এই ছেলে তর্ক করবে কেন, কোন সাহসে, পরে স্যার অন্য স্যারের সাথে কথা বলতে বাধ্য হন এবং পরে সেই স্যার আমাকেই সাপোর্ট করেন যে আমি নিয়মটা ঠিকই আছে ।
- খেকশিয়াল
ধন্যবাদ রাবাব, শামীম ভাই এবং কমরেড খেকশিয়ালকে।
@শামীম ভাই, আপনার লেখাটাও বেশ সুন্দর। আমাদের সবারই আসলে এগুলো নিয়ে ভাবা উচিত এবং তার চেয়েও জরুরী ভিত্তিতে এ অবস্থার পরিবর্তনে কিছু করা উচিত।
----------------------------------------------
অলমিতি বিস্তারেণ
অলমিতি বিস্তারেণ
নতুন মন্তব্য করুন