ভাইয়াটাকে ত্যজ্জ করেছে বাবা। পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়েছে। সে বিজ্ঞাপন নিয়ে ভাই আমার, আমার কাছে ছুটে আসে। এসে বলে- ‘তোরা আমার শিকড় কেটে দিলি। আমি এখন শিকড়হীন, অস্তিত্বহীন। একটুও কষ্ট হলো না তোদের।’
আমার কষ্ট হয়েছিল, কষ্ট হয়েছিল, কষ্ট হয়েছিল আমার মায়ের জন্য। বাবার জন্যে। কত কষ্ট থেকে বাবা তার প্রিয় সন্তানটাকে উপড়ে ফেলে দিলো। কত কষ্টে। কত কষ্টে ভাইটা নিরুদ্দেশ।
অস্তিত্বহীন, উদভ্রান্ত ৩৬ বছরের এক যুবক। বারবার ফোন করছিল একবার দেখা করার জন্য। আমি তাকে এতটুকু সুযোগ দিইনি সেদিন। শেষমেশ চলে আসে আমার অফিসে। ধানমন্ডি ২৭। ইটিসি’র সামনে দাঁড়িয়ে ফোন দেয়। বারবার কেটে দিচ্ছিলাম, বারবার। কতোবার জানি না, অসংখ্যবার। তবুও ও যেন ধৈর্যহারা হয় না। থার্ড ফোর থেকে নিচে নেমে আসতে এক মিনিট সময় লাগে। আমাকে দেখেই ছুটে আসে। জড়িয়ে ধরতে চায়, তবুও ধরা হয় না। ধরা কণ্ঠে বলে, তোর প্রেস্টিজে লাগবে, তাই উপরে যাইনি, আমার যা অবস্থা!
ভাইয়া, আমার প্রিয় ভাইয়াটা আমার থেকে ৮/৯ বছরের বড়। সমাজ পরিবর্তনের স্বপ্ন আজ তাকে সমাজ থেকে বিচ্যুত করেছে! বলে, তোরা তো একদিন অনেক বড় হবি, তোদের নাম- ডাক ছড়িয়ে পড়বে চারদিকে, আমাকে সেই নাম ডাক দিস না, আমি গর্ব করে তোদের নামটা যেন বলতে পারি, সে অধিকারটা থেকে বঞ্চিত করিস না। সেই অধিকারটা কেড়ে নিস না তোরা।
আমি নিশ্চুপ থাকি। গলার মধ্যে দলা পাকিয়ে কি যেন আটকে থাকে। বলতে শুরু করে আবার, তুই তখন খুব ছোট্ট। তোকে ২০টা যোগ অঙ্ক দিয়ে বলেছিলাম- এই অঙ্কগুলো পারলে একটা ‘নানচাক্কু’ পাবি। তুই ১৯টা পেরেছিলি। আমি কিন্তু তোকে তোর পুরষ্কারটা দিয়েছিলাম। মনে আছে তোর, মনে আছে?
আমার মনে আছে। আমি ১৫টা পেরেছিলাম। তবুও ভাই আমার পুরষ্কার দিতে এতটুকু কার্পণ্য করেনি। আমার সব মনে আছে, সব। আমি চুপ করে থাকি। শুধু বলেছিলাম, তুমি এখানে এসেছো কেন? গত তিনমাসে ভাইয়া আমার অনেক বুড়িয়ে গেছে। মাথার চুল সাদা হয়ে গেছে। চোখে না ঘুমানোর স্পষ্ট ছাপ। কান্তি। কতো রাত ভাইয়া আমার ঘুমায় না কে জানে! কি খায়, না খায়, কে জানে। হয়তো খায়ও না। কে খাওয়াবে? কে টাকা দেবে? পাছে কেউ দেখে ফেলে এই ভেবে আমি বারবার বলছিলাম- এখানে আর কখনো এসোনা। তোমার পায়ে পড়ি আর এসোনা। পকেট থেকে তিন শ’ টাকা বের করে তার হাতে দিয়ে বললাম- মাসের শেষ, তুমি এই টাকাটা রাখো।
ভাইয়া আমার দেওয়া তিনটা এক শ’ টাকার নোটের দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে। এক দৃষ্টিতে। অনেকক্ষণ তাকিয়ে থেকে শুধু বলে- আমি তোর কাছে টাকা চাইতে আসিনি, তোরা আমাকে উপড়ে ফেলে দিস না।
ভাইয়ার কথাগুলো আকুতির মতো শোনালো। আর্তনাদ হয়ে আমার বুকে গিয়ে হাতুড়ির মতো আঘাত করছিলো।
শার্টটার হাতের নিচে ছেড়া, কলারটাও ছিড়ে গেছে। নিচের দিকের দুটো বোতামও খোলা। মানুষ দেখবে এই ভেবে হাত দুটো চাপ দিয়ে রাখে সেই খুলে যাওয়া বুতামগুলোর স্থানে। প্যান্টটাও ময়লা। অনেকদিন না ধুয়ে ধুয়ে ময়লার রঙ পেয়ে গেছে আমার প্রিয় ভাইটার প্যান্ট।
মনে আছে, আমি তখন কাস ফোর কি ফাইভে। বাবা তখন চাকরি সূত্রে থাকে রংপুর। আমরা থাকি কুমিল্লায়, সরকারি কোয়ার্টারে। ২৮ রোজা পেরিয়ে ২৯ রোজা। অথচ বাবার আসার নাম নেই। এদিকে আশপাশের সবাই ঈদের নতুন জামা-কাপড় নিয়ে আনন্দে উন্মাতাল। বিকেলে খেলার মাঠে গিয়ে শুনি উমুকে এটা, তুমুকে ওটা কিনেছে। অথচ আমার কেনা হয়নি একটা সূতাও। কষ্টে আমার বুক ফেঁটে যাচ্ছিলো। বাবার উপর প্রচণ্ড রাগ হচ্ছিলো। বাসায় ফিরে দেখি ভাইয়া আমার জন্য একটু টি-শার্ট, ফুল প্যান্ট আর বাটা জুতো কিনে নিয়ে এসেছে। সেদিন আমার যে কি খুশি, সে কে দেখে।
হ্যাভি স্মার্ট আমার প্রিয় মেধাবী ভাইটা আজ ছেড়া শার্ট, ময়লা প্যান্ট পরে না খেয়ে ঘুরে বেড়ায়। কি অদ্ভুত আজ আমি তার হাতে টাকা গুঁজে দিই। সে আমার সাথে কথা বললে আমার প্রেস্টিজে লাগে। কি অদ্ভুত।
ভাইয়া চলে যাচ্ছে। কেমন যেন খুড়িয়ে খুড়িয়ে হাঁটছিল তখন। ওর ছেড়া শার্টটা পতপত করে পতাকার মতো উড়ছিলো বাতাসে। একটিবারের জন্য পিছে ফিরে তাকায়নি। শেষবারের মতো দেখা হয়নি তার মুখটা। যাওয়ার আগে মোবাইল সেটটা আমার হাতে দিয়ে বলেছিল- শেকড় যখন তোরা উপড়ে ফেলেছিস, আমার আর রেখে কি লাভ? এইটা রাখ, তোর কাজে আসবে। আমার তো কেউ নেই। তোকে প্রচণ্ড পছন্দ করতাম, ধরে নে এটা আমার প থেকে শেষ উপহার।
আমার প্রিয় ভাইটা চলে যাচ্ছে...। আমার বুক ভেঙে কান্না আসছিলো তখন। অথচ আমি কাঁদতে পারছিলাম না, পাছে কেউ দেখে ফেলে। ইচ্ছা করছিলো চিৎকার কাঁদি। ভাই আমার চলে গেছে। আমি চলে এসেছি।
কতো খবর এডিট করি। শুধু এডিট হয় না আমার কষ্টগুলো। আড়ালে কেউ দেখে ফেলে, তাই ঢেকে রাখি। নিজের মাঝে নিজেকে লুকিয়ে রাখি। রাত জেগে কাঁদি। দিন জেগে কাজ করি। এই আমার জীবন।
বাবা বলে, ‘বাবা তুই আসবি না, অন্তত ঈদে একবার বাড়িতে এসে দেখে যা- আমরা বেঁচে আছি নাকি মরেও বেঁচে আছি’- ভাইয়ার ‘তোরা আমার শেকড় কেটে নিলি’ এই এক একটা শব্দ আজো কানে আলপিনের মতো বিঁধে।
আমি তাকে দূরদূর করে তাড়িয়ে দিয়েছি....। ভাইয়ার শেষ কথাগুলো আজো আমার কানে আলপিনের মতো বিঁধে- আমার তো কেউ নেই, কেউ নেই, কেউ...।
মন্তব্য
কৈশোরে, আমার থেকে বছর সাতেকের বড় অগ্রজ কে দেখেছি সারাটাদিন বাবার কাছে বখাটে, দূর হ ধরনের শব্দমালা অগ্রাহ্য করে যেতে। ভার্সিটি জীবনে নিজের মতোন করে জীবন যাপন করতে। মাঝেমধ্যে উধাও হয়ে যেতো না বলে, রোটারি, লিও ক্লাব অথবা কোন পরিচিতের বিয়ে - মাঝে মাঝে বাড়িতে ফিরতো না দুই তিনদিন।
তারপর অনেক দিন চলে যায়। সময়ের প্রয়োজনে আমাদের বিশাল বাড়িটা প্রায় খালি হয়ে যায়। এখন আমার বাবা অসুস্থ, একা হাঁটতে পারেন না। পাশে থাকে সেই একদা বখাটে ভাইটি। একা বয়ে বেড়ায় পুত্রত্বের ভার।
আমি এই প্লটটা নিয়ে একটা গল্প লিখতে চেয়েছিলাম। অনেকবার শুরু করেছি। পারিনি। নিজের জীবনের গল্প এভাবে লেখা যায় না।
-
কান্না পাইয়ে দিলেন। আপনি পারেন না নিয়মগুলো ভেঙে ফেলে, অগ্রজের পাশে দাঁড়াতে?
আমি ও আমার স্বপ্নেরা লুকোচুরি খেলি
আবার লিখবো হয়তো কোন দিন
নাহ, সচলায়তনে আর আসা যাবে না। এত বেশি কষ্টের লেখা, কান্নার লেখা পড়তে হয়, যে আসলে মনটাই খারাপ হয়ে যায়। নিজের জীবনের টুকিটাকি ঝামেলাতে আমরা কমবেশি সবাই জর্জরিত। এখন ব্লগে এসেও সেই দুঃস্বপ্ন পিছু না ছাড়ে,তাহলে আমার আর যাওয়ার জায়গা কই !!
লেখাটা পড়ে মন বিষন্ন হয়ে গেল। যত যাই বলি না কেনো, লেখাটা খুবই চমৎকার হয়েছে।
------------------------------------------------------
অলমিতি বিস্তারেণ
অলমিতি বিস্তারেণ
এই শব্দটার সঙ্গে আমারও অনেক ক্ষয় জড়িত। আমার দুই সহোদর
আমার অনেকগুলো বন্ধু এবং আমি নিজেও অনেকটা ক্ষয় বয়ে বেড়াই এই বাক্যটা থেকে
প্লিজ তাকে ঘৃণা করবেন না
বাবা-মা যত গালাগালি করেন সব আবেগ থেকে করেন
কিন্তু আপনিতো যুক্তির মানুষ
আপনার ভাইয়ের জন্য বোধহয় কিছু একটা করা যায়
সমাজ পরিবর্তনের স্বপ্ন দেখে যারা ঠকে তারা শরীরে পচে গেলেও ভেতরে পচে না
এটা আমি বিশ্বাস করি
প্লিজ ট্রাই সামথিং
আই উইল বি দেয়ার
প্লিজ আর মন্তব্য নয়! আমি অফিসে। চোখ ছলছল করছে। হয়তো কেঁদে ফেলছি। সবাই আমাকে পাগল ভাববে। প্লিজ! এমন হৃদয় ছোঁয়া মন্তব্য আর করবেন না।
মাহবুব লীলেন ভাই, ধন্যবাদ। ধন্যবাদ সবজান্তা ও সৌরভকে । আপনারা ভালো থাকবেন। সমাজে ভালো থাকা মানুষের সংখ্যা খুব কম। সবাই ভালো থাকার মুখোশ পরে থাকে।
রক্তে নেবো প্রতিশোধ...
রক্তে নেবো প্রতিশোধ...
বড়ো কষ্টের!
যতবার তাকে পাই মৃত্যুর শীতল ঢেউ এসে থামে বুকে
আমার জীবন নিয়ে সে থাকে আনন্দ ও স্পর্শের সুখে!
পড়তে পড়তে গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠলো...
প্রত্যেকে নিজের জায়গা থেকে সবচেয়ে নিবিড় করে জানে তার কষ্ট। তবুও অনেক দূর থেকে হলেও বলি, এইসব জন্মান্তরের সম্পর্কের শেকড় কি কখনও উপড়ে ফেল যায়? আদৌ? সমাজ বদলের স্বপ্ন দেখা এই মানুষটাকে আবার কাছে টেনে নেয়া যায় না? প্লিজ।
----------------------------------------------------
আমার এই পথ চাওয়াতেই আনন্দ
----------------------------------------------------
আমার এই পথ চাওয়াতেই আনন্দ
সমাজ বদলের স্বপ্ন আমিও দেখি। কারণ এই ভাইয়ার আদর্শই আমার আদর্শ। এবং এখনো সেই আদর্শই আকড়ে ধরে থাকবো।
এইসব জন্মান্তরের সম্পর্কের শেকড় কখনও উপড়ে ফেলা যায় না ঠিক, টিকিয়ে রাখা বড় কষ্টের!
শুধু জানবেন এই ভাইটাকে আমি প্রচণ্ড ভালোবাসি।
***************************************
রক্তে নেবো প্রতিশোধ...
রক্তে নেবো প্রতিশোধ...
সবার সূরে সূর মিলিয়ে তাকে ফিরিয়ে আনাতে বলছি আমিও।
মনে রাখবেন, ভালোবাসার একটা নিজস্ব ক্ষমতা আছে। আপনার ভালোবাসা একদিন আপনাকে সেই শক্তি যোগাবে।
উদাহরণ দেই, কাউকে ভালোবাসলে মনের কথা সহজে বলা যায় না - ভয় সঙ্কোচ ইত্যাদি কারণে। কিন্তু একপর্যায়ে ভালোবাসার মাত্রাটা যখন বারাবারি রকমের হয়ে যায় তখন কিন্তু সেই সঙ্কোচ বানের জলের মতোই ভেসে যায়!
আপনার ভাইয়ের প্রতি আপনার ভালোবাসা সেই বানের ডাক দিক, এই প্রত্যাশায় রইলাম।
আপনার ভাইয়াকে শুধু বুঝিয়ে দিন যে আপনি তার পাশে আছেন তাহলে দেখবেন আপনার কষ্ট কমে যাবে আর ভাইয়ার ও মনে হবে অন্তত একজন তার পাশে আছে। ভালবাসার মানুষদের উপেক্ষা করতে নেই।
অনেকেই ইদানীং খুব মন খারাপ করা লেখা লিখছেন। এটা কিন্তু ঠিক হচ্ছে না। আপনার লেখা খুব ভাল লাগলো বলে মন খারাপের রিস্কটা নিয়ে নিলাম।
আপনার ভাইয়ের সাথে যোগাযোগ করুন যেভাবেই হোক। তাঁর সমস্যা কী, সেটা আগে দেখুন।
হাঁটুপানির জলদস্যু
মনটা বড়ো খারাপ হয়ে গেল।
~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
টাকা দিয়ে যা কেনা যায় না, তার পেছনেই সবচেয়ে বেশি অর্থ ব্যয় করতে হয় কেনু, কেনু, কেনু?
জন্মদিনে অনেক অনেক শুভকামনা।
ভালো থাকুন, নিরাপদে থাকুন।
শুভ হোক প্রতিমুহূর্ত..
====================
অবিরাম ছুটে চলায় হঠাৎ থমকে যাওয়া
'
=========================================
নিজেকেই নিজে চিনি না, পরকে চেনার মিছে বাহানা
নতুন মন্তব্য করুন