একজন দাসের কথা বলছি। দাসই তো! সমাজের দাস, দেশের দাস এবং আগুন ঝড়া সময়ের দাস। এই দাস যুগোপৎ সময়ের সীমাহীন অন্ধকারে বেড়ে ওঠেননি। এই দাস নাগরিক কৃতদাসের মতো অন্ধকারকে বরণ করে নেননি কখনো, প্রতিবাদে বারবার কেঁপে ওঠেছে তার কণ্ঠস্বর। মুষ্ঠিবদ্ধ হাত ও হাতের আঙুল বারবার মনে করিয়ে দিয়েছে আমারও প্রতিবাদের ভাষা আছে, আছে নিজস্ব সত্ত্বা।
ইদানিং একটি কথা বেশ প্রচলিত হয়ে ওঠেছে আর তা হলো ‘অমুক নতুন লেখকের বই বাজারে এসেছে’। আমি ভেবে ভাই না যদি তিনি নতুন লেখকই হবেন তবে বই লিখলেন কি করে। সেই অর্থে আমি যে দাসের কথা বলবো তিনি নতুন লেখক বৈ অন্য কিছু নয়। নতুন লেখক!
এই আগুন ঝড়া সময়ের দাসের সঙ্গে আমার পরিচয় হয় ১৯৯৮ কি ৯৯’র দিকে। তখন তিনি ছিলেন কোনো এক বিভাগীয় শহরের প্রথম আলো প্রতিনিধি। অদ্ভুত। সেই পরিচয়ের সময়টা আজো আমার মনে পড়ে। ছোট-খাটো একটা মানুষ। কখনো সিগারেট টিগারেট খেতেন না। বলতেন, ওসব পশ্চিমের সংস্কৃতি। আমার দেশের ‘পান পাতা’ আছে, আমি ওতেই বেশি স্বচ্ছন্দ বোধ করি। বয়সে আমার তিন-চার বছর বেশি হবেন। তবে মেশেছেন এবং মেখেছেন বন্ধুর মতোই। অদ্ভুত একটা মানুষ। সম্পৃক্ত ছিলেন উদীচীর সঙ্গে।
২০০৫ এর দিকে আমার বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটে। বিশ্ববিদ্যালয় জীবন! এ যেন শেষ হতেই চায় না। তাই তিনি পড়েননি গতানুগতিক ধারায়। এ ধারার ঘোর বিরোধী ছিলেন দাহকালের এই দাস। যদি সত্যি কথা বলি তবে তিনি ছিলেন ‘দাসানুদাস’ মানে দাসেরও দাস, গোলামের গোলাম। একটু ঘুরিয়ে পেচিয়ে বললে হবে ‘একান্ত অনুগতজন’। তবে তার এই আনুগত্য ছিল দেশের প্রতি, সময়ের প্রতি। লেখাতেও তুলে এনেছেন সেই আনুগত্যের কথা, গদ্যাকারে।
বলতে পারেন বড্ড স্বজনপ্রীতি করে ফেলছি। ব্লগে এই মর্মে কয়েকটি পোস্টও দেওয়া হয়েছে। বলা হয়েছে বিজ্ঞাপন হয়ে যায় এমন কোনো লেখা আমরা যেন না লিখি। কেন লিখবো না বলেন? না লিখলে কী কেউ কারো সম্পর্কে জানতে পারবে।
বলছিলাম, এক ‘দাসানুদাসে’র কথা। ২০০৫ সালের শেষদিক। হঠাৎ করে বলা নেই কওয়া নেই প্রথম আলো থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে নিলেন। ভেতরে কি ছিল আমি তা জানি না। তবে চাকরিটা ছেড়ে দেওয়ার আগে তাকে দেওয়া হয় একটি বিভাগের ব্যুরোচিফের দায়িত্ব। তবে সব মোহ ছেড়ে তিনি চলে আসেন ঢাকায়, কিছু একটা করবেন বলে। করা হয়েছে যা তা হলো সাপ্তাহিক ২০০০ এর কল্যাণে দেশের এ মাথা থেকে ওমাথা চষে বেড়িয়েছেন।
মাঝে মধ্যে মাঝ রাতে আমার বাসায় গিয়ে হাজির হতেন ২০০৫ পূর্ববর্তী সময়গুলোতে। মৌসুমি ভৌমিকের ‘আমি শুনেছি সেদিন তুমি সাগরের ঢেউয়ে চেপে নীল জল দিগন্ত ছুঁয়ে এসেছো’ কিংবা নচিকেতার ‘অন্তবিহীন পথে চলাই জীবন’ এর মতো গানগুলো ব্যাকুল হয়ে শুনতেন আর আন মনে লিখে যেতেন। রাত শেষে দেখতাম সে লেখা হয়ে ওঠেছে জীবন্ত। যেন এই মাত্র বিপ্লবের ডাক দিল কোনো বিপ্লবী।
বিশ্ববিদ্যালয় যখন আন্দোলনে উত্তাল সেই সময়ের কথা। ১৯৯৯-২০০০। তখন আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে (শাবিপ্রবি) নামকরণ বিরোধী আন্দোলন চলছে। আমরা ক’জন দিলাম আত্মাহুতির হুমকি। সেই খবর পত্রিকাগুলোতে ফলাও করে ছাপা হলো। তবে সে খবরে ক’জন মানুষ ভয় পেয়েছিলেন তা আমি জানি না। খোদ যার পক্ষে আমরা এ হুমকি দিয়েছিলাম, সেই ড. জাফর ইকবালও আমাদের খোঁজ একবারও নেননি। নিয়েছিলেন এবং শঙ্কিত ছিলেন একজন, তিনিই আমি যে দাসের কথা বলছি। সব সময় আমাদের কাছাকাছি থাকার চেষ্টা করতেন তখন। অনেকে বললো- তোদের তো নাম হয়ে গেছে, তোরা তো বিখ্যাত হয়ে গেছিস। শুধু এই লোকটা বলতো- বিখ্যাত হওয়ার জন্য আত্মাহুতির প্রয়োজন নেই, কর্মই বলে দেবে তুমি কতোটা বিখ্যাত। রাত জেগে তিনি আমাদের সঙ্গে ক্যাম্পাসে কাটিয়েছেন যেকোনো ছোট ঘটনায়ও। শুধু যা ঘটছে তাই লেখার জন্য। বাড়িয়ে নয়, নয় কমিয়ে। তাই মাঝে মধ্যে অন্য পত্রিকাগুলো যখন কোনো ঘটনাকে ফলাও করে প্রকাশ করতো সে তুলনায় আমাদের সংবাদগুলো একটু কম আকর্র্ষণীয় হতো। কখনো টু-সি, বেশিরভাগ সিঙ্গেল কলাম। পরদিন ক্যাম্পাসে আমাদের সবাই বলতো- তোরা সব দালাল। তোদের কিনে ফেলেছে। এমন অজস্র ঘটনা আছে যার সাক্ষী আমরা।
যাক মোদ্দা কথা হলো ‘শনিকাল’ উপন্যাস আকারে লিখেছেন দাহকালের এই দাস।
....আমি ঘোরের মধ্যে, স্বপ্নের মধ্যে জেগে জেগে একটি স্বপ্নই বুনছি। রাতের বেলা ঘুমিয়ে যাবার আগে কাপড়ে সুতো দিয়ে রঙিন করে তুলছি একটি স্বপ্ন। সবরাতে কি আর ঘুম আসতো? মধ্যরাতে দূরের আকাশগাঁয়ে হাসি দিয়ে ওঠা চাঁদের আলোয় দোলে ওঠতো স্বপ্ন। স্বপ্ন জেগে ওঠতো সূর্যের সোনারোদে। সে স্বপ্ন আমার, আমাদের। আমাদের সকলের মনের আকাশটায় উঁকি দিয়ে যায়। স্বপ্নটা রঙিন। নানা রঙে আঁকা এই স্বপ্নের নাম স্বাধীনতা।...
শুরুটা করেছেন এভাবেই।
তিনি তার লেখায় একজন প্রিয় মানুষের কথা তুলে এনেছেন। স্মিতা। যিনি একাত্তর, উনসত্তরে এই ব-দ্বীপ ভূমির মিছিলের ছিলেন একজন প্রিয় মুখ।
হঠাৎ করেই ৩৬ বছর পর আয়নার সামনে দাঁড়ায় স্মিতা। তার মনে হয় সময় অনেক পেরিয়েছে। তবে মধ্যরাত এখনো শেষ হয়নি। একাত্তরে মুক্তিযোদ্ধাদের তথ্য যোগাড় করে দিতেন এই স্মিতা। যেতেন এখানে ওখানে। এখনো যান। তবে কোথাও কোনো পরিবর্তন তার চোখে পড়ে না। দালাল ভরা দেশে ক্ষুধা দেখে তার চোখ। প্রতিবাদের আগুন দেখে না স্মিতা। তার মনে হয় এখন দরকার আগুনশিশুর। আর তা না হলে...।
পুরো নাম পার্থ সারথি দাস। প্রকাশ করেছে পাঠসূত্র।
মন্তব্য
রিভিউ ভালো লাগলো। পড়ার জন্য আগ্রহী হলাম।
ধন্যবাদ আনোয়ার সাদাত শিমুল ভাই।
রক্তে নেবো প্রতিশোধ...
সিলেটের পার্থ?
দীর্ঘবছর ওর সাথে দেখা হয়নি ।
বই কিনবো ।
লেলিনকে ধন্যবাদ
----------------------------------------
শমন,শেকল,ডানা
-------------------------------------
জীবনযাপনে আজ যতো ক্লান্তি থাক,
বেঁচে থাকা শ্লাঘনীয় তবু ।।
জি সিলেটের পার্থ সারথি দাস।
ভালো থাকবেন মোরশেদ ভাই।
রক্তে নেবো প্রতিশোধ...
নতুন মন্তব্য করুন