কতদিন হয়ে গেল। উদভ্রান্তের মতো ছুটছি তো ছুটছি। কিছুটা কান্তও কি হইনি? হয়েছি। তবুও ভুলতে পারিনা। ভুলতে পারিনা সেই দিনের কথা। এখনও বা’ পায়ে ব্যথা অনুভব করি। তার চেয়েও যে জ্বালা প্রতিনিয়ত আমাকে দগ্ধ করে। এর নাম ‘অন্তর্জ্বালা’।
২২ আগস্ট, ২০০৭ খৃস্টাব্দ। সেদিন ছাত্র-শিক্ষক-সাংবাদিকদের ওপর হায়েনার মতো ঝাপিয়ে পড়েছিলেন বাংলার দেশপ্রেমিক (!) সেনারা। ২১ আগস্টে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘটনার পর সারা দেশেই বিক্ষুব্দ ছাত্র-জনতার দ্রোহ ছড়িয়ে পড়ে। আমাদেরও দ্রোহের স্বর বিদ্রোহে কেঁপে উঠেছিল সেদিন।
তারপর অনেক কিছুই হয়েছে। ২০০৭ এর ১১ জানুয়ারি জরুরি অবস্থা জারি হয়। দু’দিন পর জারি আসে জরুরি মতা অধ্যাদেশ ২০০৭। এর ৫ ধারার দোহাই দিয়ে নিষিদ্ধ করা হয় সভা-সমাবেশ, মিছিল, অবরোধ, বক্তৃতা, বিবৃতি, বিক্ষোভের উত্তেজক কর্মকাণ্ড সম্পর্কিত তথ্য বা সংবাদ প্রকাশ; সরকারের বিরুদ্ধে উস্কানিমূলক সংবাদ, সম্পাদকীয়, উপ সম্পাদকীয়, কার্টুন প্রকাশ বা আলোচনা অনুষ্ঠান স¤প্রচার নিষিদ্ধ করা হয়। ৬ ধারায় নিষিদ্ধ করা হয় সরকার বা সরকারি কার্যক্রমের বিরুদ্ধে উস্কানিমূল বক্তব্য বা কাজে বাধা দেওয়া, সরকারের কার্যক্রম নিয়ে ব্যঙ্গচিত্র বা কার্টুন আঁকা, প্রকাশ, প্রদর্শন বা প্রচার এবং কুশপুত্তলিকা তৈরি বা দাহ ইত্যাদি।
শুধু তাই নয়, এ দুই ধারার মাধ্যমে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের পাশাপাশি সব ধরনের গণমাধ্যমের ওপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা হয় সেদিন।
তারপর ১১ জানুয়ারি। আর তারও পরের প্রায় দুই বছরের শাসনামলের চিত্র আমরা সবাই জানি, সবার চোখেই ভাসে। শেষমেশ নির্বাচনের তারিখ এলো, জরুরি বিধিমালা ২০০৭ এর ৫ ও ৬ ধারা বিলুপ্ত করা হলো। দেশপ্রেমিক সেনাদের ঘরে ফিরিয়ে নেওয়ার প্রক্রিয়াও শুরু হলো।
তবে...তবে এবং তবে। যে কথা বলতে এই লেখা শুরু করেছিলাম তা আর বলা হলো না। বলা হয়নি বলে বলবো না, তা কিন্তু নয়। বলবো এবং বলছি...।
তার আগে একটু অন্যকথা বলি।
আমাদের এই দেশপ্রেমি সেনারাও কারো বাবা, কারো ভাই, কারো স্বামী কিংবা ছেলে। তাদের ভরসার কেন্দ্র। নাদিশার (কল্পিত নাম) কাছেও তার কর্নেল বাবা একটা ভরসার নাম। তার আদর্শ। অমি যতবার এই মেয়েটার কাছে সেনাবাহিনী নিয়ে বিষদগার করেছি ততবারই তার ভৎর্সনার শিকার হয়েছি। আমার সব কথাই শুনতে রাজি এই মেয়েটা, শুধু তার বাবা বাহিনীর বিরুদ্ধে কিছু নয়।
যাক, বলছিলাম ২২ আগস্টের কথা। সেদিন রাত আটটার পর দেশে কারফিউ বলবৎ হয়। তবে সরকারের তরফ থেকে পত্রিকা অফিসগুলোতে নির্দেশনা আসে, সাংবাদিকরা তাদের পরিচয়পত্র (আইডি কার্ড) দেখালে কোন সমস্যা নেই।
আমিও দেখিয়েছিলাম। তখন রাত ৯টা কি সাড়ে ৯টা। ধানমন্ডি ২৭ এর নন্দনের অপরদিকে আমাদের অফিস। কাজ করি দিনের শিফটে। তবে ছাত্র-জনতা বিক্ষেভের কারণে সেদিন ফিরতে দেরি হয়ে গিয়েছিল। অফিসের গাড়ির জন্য আমরা চারজন, আমি, ক্রীড়া রিপোর্টার মাসুদ পারভেজ, সনৎ বাবলা আর পল্টু ভাই অপো করছি। র্যাব, পুলিশের কয়েকটা ভ্যান আমাদের ক্রস করে চলে যায়। তখনও আমরা নিজেদের নিরাপদই ভাবছি। গলায় ঝোলানো দাসত্বের পরিচয়পত্রটা (ইদানিং এটি ফ্যাশন হলেও সেকেলে; এক সময় দাশদেরও লোহার পাতে খোঁদাই করে নম্বর লিখে তা ঝুলিয়ে দেওয়া হতো) ঝুলিয়ে গর্বই হচ্ছিল। সাই সাই করে আর্মির গাড়িগুলো নিজেদের যতই অতিক্রম করছে ততই গর্বটা বুক ফেটে বেরিয়ে পড়ার উপক্রম।
আমরা দাঁড়িয়ে আছি। চারজন। আটটা হাত, চারজোড়া চোখ, ২০৬গুণ৪টা হাড়। এখনও সেই হাড়ে ব্যথা অনুভূত হয়।
হঠাৎ আর্মির একটা ভ্যান আর তারও সামনে একটা জিপ এসে থামে। অফিসার বেরিয়ে এলেন জিপ থেকে।
বললেন, হোয়াট ইজ দিস?
আমি দাসত্বের কার্ডটা দেখিয়ে বললাম- আমরা সাংবাদিক। অফিসের গাড়ির জন্য অপেক্ষা করছি।
অফিসার বললেন- সো হোয়াট।
এই ‘সো হোয়াট’ বলার পর ভ্যান থেকে নেমে এলো আরও ক’জন দেশপ্রেমিক সৈনিক। গুণতে পারিনি। অফিসারের হাতে মোটা লাঠি।
কিছু বুঝে ওঠার আগেই প্রথম আঘাতটা এলো। তাও আমার ওপরই (বাড়িয়ে বলছি না)। হাটুর চার ইঞ্চি উপরে। রক্ত জমে কালো দাগ হয়ে গেছে সেই জায়গাটায়। এখনো সেই চিহ্নটার দিকে তাকিয়ে সেদিনের কথা মনেকরি।
আমি তখনো দাঁড়িয়ে আছি। এরমধ্যেই বাবলা দা (স্পোর্টস রিপোর্টার) আর পল্টু ভাই ভোঁ দৌড় দিয়েছেন। কেবল আছি আমি আর মাসুদ পারভেজ।
স্বাস্থ্যের দিক দিয়ে মাসুদ পারভেজ যতোটা না নাদুস-নুদুস আমি ততোটাই রোগা-কঙ্কাল। এক আঘাতেই আমার প্রাণ যায় যায় অবস্থা। দ্বিতীয় আঘাতটাও একই জায়গায়। আমার আর তখন দাঁড়িয়ে থাকার অবস্থা নেই। তবুও দৌড়ে পালিয়েছিলাম সেদিন। ঈশ্বর হয়তো আমার পায়ে অতিরিক্ত আরও দুইটা পা লাগিয়ে দিয়েছিলেন সেদিন! একটু সামনে এগিয়ে শুধু শুনলাম মাসুদ পারভেজের চিৎকার। আমার কানে এখনো সেই চিৎকারের শব্দ প্রতিধ্বনিত হয়।
তার পরের খবর সবাই জানেন। মাসুদ ভাই বিবিসিতে সাক্ষাৎকারে সব বলেছিলেন। আরও কত শত জনের নির্যাতনের কথা আমরা জানি। শুনেছি।
সেদিন যখন শুনলাম দেশপ্রেমিক সেনাদের ব্যারাকে ফিরিয়ে নেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়ে গেছে তখন থেকেই অন্যরকম একটা কষ্ট আমার হৃদয়ে উঁকি দিয়ে যাচ্ছে।
ওরা ফিরে যাচ্ছে। অথচ তাদের যোগ্য প্রাপ্য আমরা দিতে ব্যর্থ হয়েছি। সিভিল সোসাইটিতে এসব বন্য আনসিভিলিয়ানদের (সবার জন্য প্রযোজ্য নয়) হাজারবার ভৎর্সনা করি। চপটাঘাত করি তাদের চিন্তায়। তাদের অস্তিত্বে।
সালাম জানাই সেইসব দেশপ্রমিক বীর সেনাদের, যারা বিদেশে তাদের সাহসি ভূমিকার মাধ্যমে আমাদের দেশকে বিশ্ববাসীর সামনে তুলে ধরেছেন। আমরা তাদেরও যোগ্য সম্মান দিতে ব্যর্থ। আমরা তাদের কাছে এমনই ভূমিকা প্রত্যাশা করি।
মন্তব্য
শক্তিমানকে কখনো তার প্রাপ্য মর্যাদা দেয়া যায় না। দিতে গেলে প্রতিদান পাওয়া বাধ্যতামূলক।
==========================
পৃথিবীর তাবৎ গ্রাম আজ বসন্তের মতো ক্ষীণায়ু
সেনানিবাসে সিভিল আইন খাটে না, তবে লোকালয়ে সামরিক আইন খাটানো যায়।
---------
চাবি থাকনই শেষ কথা নয়; তালার হদিস রাখতে হইবো
ধন্যবাদ পলাশ দত্ত।
অনেকদিন পর লিখলাম। দেখা যাক কেউ পড়ে কিনা!
রক্তে নেবো প্রতিশোধ...
সিভিল সোসাইটিতে এসব বন্য আনসিভিলিয়ানদের (সবার জন্য প্রযোজ্য নয়) হাজারবার ভৎর্সনা করি। চপটাঘাত করি তাদের চিন্তায়। তাদের অস্তিত্বে।
-------------------------------
আকালের স্রোতে ভেসে চলি নিশাচর।
-------------------------------
আকালের স্রোতে ভেসে চলি নিশাচর।
ধন্যবাদ। তবে মন্তব্য কই।
রক্তে নেবো প্রতিশোধ...
তবু ভাগ্যিস নব্বই এ ফিরে যেতে হয়নি |
জয়তু বাংলার বীর সেনারা |
মইন ইউ. বলেছেন, ওনারা পাকিস্থানী আর্মী নন!
কিছু ব্যাপার ভোলা যায় না।
________________________________
সমস্যা জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ; পালিয়ে লাভ নাই।
________________________________
সমস্যা জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ; পালিয়ে লাভ নাই।
ওনারা পাকিস্তানি নন বলেই ওদের যোগ্য প্রাপ্য দেওয়ার প্রশ্ন উঠছে।
রক্তে নেবো প্রতিশোধ...
এদের এত যে শৌর্য বীর্য... তার একটুও যদি রাজাকারদের বিরুদ্ধে ব্যাবহার করতো...
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
ওদের কারো কারো শৌর্যের চেয়ে বীর্য বেশী। আবার কেউ কেউ রাজাকারের বীর্যের ফসল। তারা কিভাবে রাজাকারদের বিরুদ্ধে যাবে?
রক্তে নেবো প্রতিশোধ...
দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনীর নামে বিষো'গার করার জন্য পোস্টে মাইনাস লাইবেরিয়া থিকা এখন আমরা সচলে তাগো শৌর্য-বীর্যের কাহিনী শুনি। আর আপনি আইছেন বাংলাদেশ থিকা ওগো নামে বদনাম করতে!
আমাগোরে যুবরাজ সাহেব কইছেন-
সূত্রঃ লিংক
= = = = = = = = = = =
ফুল খেলবার দিন নয় অদ্য
ধ্বংসের মুখোমুখি আমরা
চোখে আজ স্বপ্নের নেই নীল মদ্য
কাঠ ফাটা রোদ সেঁকে চামড়া
আমি জিজ্ঞাস করছিলাম এই বহু আগেটা কবে?
কোনো জবাব পাই নাই...
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
আপনার জন্য খুব খারাপ লাগছে লেনিন।
আপনি ভালো থাকুন।
বাংলাদেশ সেনাবাহিনী বোধহয় শুধু বাঙালিদেরই ব্লাডি সিভিলিয়ান ভাবে।
বাইরের দেশের কাউকে ভাবেনা
-----------------------------------
আমার মাঝে এক মানবীর ধবল বসবাস
আমার সাথেই সেই মানবীর তুমুল সহবাস
-----------------------------------
আমার মাঝে এক মানবীর ধবল বসবাস
আমার সাথেই সেই মানবীর তুমুল সহবাস
মনে আছে লেনিন । সেদিন আমরা সহব্লগাররা আপনাদের নিয়ে খুব উদ্বিগ্ন ছিলাম । বিবিসিতে পরে বিপ্লব রহমানের সাক্ষাৎকার ও নিয়েছিল ।
ধর্মজীবি রাজনীতি আর সামরিকতন্ত্রের গাঁটছড়া থেকে মুক্তি না পেলে একটা সুস্থ স্বাভাবিক বাংলাদেশ পাওয়া যাবেনা কোনদিনই ।
-------------------------------------
জীবনযাপনে আজ যতো ক্লান্তি থাক,
বেঁচে থাকা শ্লাঘনীয় তবু ।।
-------------------------------------
জীবনযাপনে আজ যতো ক্লান্তি থাক,
বেঁচে থাকা শ্লাঘনীয় তবু ।।
আপনার জন্য ভয়ানক কষ্ট হলো লেখাটি পড়ে! শালারা সাধারণ মানুষের কষ্টার্জিত ধনে পোদ্দারি করে সেই মানুষদেরই পেটায়! পড়ে তেতো হয়ে যায় মনটা।
ভাই এহেছান লেনিন, আপনি ভালো থাকবেন।
~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
একলা পথে চলা আমার করবো রমণীয়...
~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
টাকা দিয়ে যা কেনা যায় না, তার পেছনেই সবচেয়ে বেশি অর্থ ব্যয় করতে হয় কেনু, কেনু, কেনু?
নতুন মন্তব্য করুন