ছোটবেলায় প্রথম যে বইটি পড়ে দুনিয়ায় টিঁকে থাকার রীতি-নীতি সম্পর্কে জানতে পারি সেটি ছিল ঈশ্বর চন্দ্র বিদ্যাসাগর-এর করা ঈশপ-এর গল্পের অনুবাদ - ‘কথামালা’। আমার বাবার আমাকে প্রথম উপহার যা আমার মনে পড়ে। বইটি হারিয়ে গেছে। গল্পগুলি রয়ে গেছে মনের ভিতর। যত বড় হয়েছি, গল্পগুলি তত বেশী করে অনুভব করেছি। আবার কখনো কখনো সেগুলি থেকে অন্য রকমের মজা পেয়েছি। সম্প্রতি ইচ্ছে হচ্ছিল গল্পগুলি ফিরে পড়ার। ভাবলাম, আপনাদের-ও সঙ্গী করে নি-ই। ইংরেজী পাঠের অনুসারী বঙ্গানুবাদ করেছি, তবে আক্ষরিক নয়। সাথে ফাউ হিসেবে থাকছে আমার দু-এক কথা।
[গল্পসূত্রঃ স্থানীয় গ্রন্থাগার থেকে পাওয়া R. Worthington (DUKE Classics)-এর বই এবং আন্তর্জাল-এ লভ্য http://www.aesop-fable.com -এ ইংরেজী অনুবাদের ঈশপের গল্পগুলি।
গল্পক্রমঃ R. Worthington-এর বইয়ে যেমন আছে]
(১)
The Wolf Turned Shepherd
রাখাল সাজা নেকড়ে
ধরা খাওয়ার ভয়ে এক নেকড়ে কিছুতেই ভেড়ার পালের কাছ ঘেঁষতে পারে না। তখন জামা-কাপড় চাপিয়ে সে এক রাখাল সেজে নিল। এইবার সে সোজা চলে এল ভেড়াগুলোর পাশে। আসল রাখাল তখন ঘুম লাগাচ্ছে আর ভেড়াগুলো নিশ্চিন্তে ঘাস খাচ্ছে। মুস্কিলটা হল ভেড়া পাকড়াতে গেলে অন্ততঃ কোন একটাকে দলছুট করা দরকার! নেকড়ে-রাখাল তাই আসল রাখাল-এর মত হুস-হাস আওয়াজ করে ভেড়াগুলোকে এদিক ওদিক ভাগানোর তাল করল। তাতে লাভ হল এই - গলা দিয়ে নেকড়ের হাউ-হাউ বেরিয়ে এল। ব্যাস, রাখাল গেল জেগে। পিটুনির চোটে নেকড়ে শেষ।
নীতিশিক্ষাঃ ছদ্মবেশ ধরে কাজ করতে গেলে বাড়াবাড়ি হয়ে যাবেই (আর সব পণ্ড হবে)
আমি আরো বলিঃ মুখ খুলতে দিলেই ধরা পরবে কার ছাল গায়ে কে এসেছে।
(২)
The Stag at the Pool
জলের ধারের শিঙেল হরিণ
মাঠের ধারে দিঘীর জলে নিজের ছায়ায় বাহারী শিং-এর রূপ দেখে দেখে এক শিঙেল হরিণ একেবারে মুগ্ধ। কিন্তু মেজাজ খিঁচড়ে দিল তার কুচ্ছিৎ দেখতে কাঠি কাঠি পা-গুলো। এমন সময় এক সিংহ এসে হাজির সেই জলের ধারে। হরিণ তখন একটু আগে দুচ্ছাই করা ঐ পাগুলোরই ভরসায় দে দৌড়, দে দৌড়। বেঁচে গিয়েওছিল প্রায়। মারা পড়ল জঙ্গলে ঢুকে গাছপালায় শিং জড়িয়ে গিয়ে। সিংহের হাতে মরতে মরতে হরিণ আফশোষ করল - “কী হতভাগা আমি! বুদ্ধুর বুদ্ধু! যে পাগুলো আমায় বাঁচাতে পারত সেগুলোকেই গাল পাড়ছিলাম, আর যে শিংগুলো নিয়ে এত গর্ব করছিলাম সেগুলোর জন্যই শেষে মারা পড়লাম।”
নীতিশিক্ষাঃ আসলেই যা দামী, প্রায়ই তার ঠিকমত কদর হয় না।
আমি আরো বলিঃ অহংকারীরা তাদের দুর্বলতার হদিশ পায় না বলেই তাদের পেড়ে ফেলা যায়।
(৩)
The Fox and the Mask
শেয়াল ও মুখোশ
এক শেয়াল একবার এক নাটুয়ার বাড়ি ঢুকে পড়ল। মাল-পত্তর ঘাঁটাঘাঁটি করতে গিয়ে পেয়ে গেল একটা মুখোশ। মানুষের মুখের এক চমৎকার নকল। শেয়ালটা থাবা দিয়ে ঐ মুখোশ নাড়াচাড়া করতে করতে বলে উঠল - “কি সুন্দর মাথা একটা। কিন্তু কোন দাম নেই এর কারণ এটার ভিতরে এক ছটাকও মগজ নেই। ”
নীতিশিক্ষাঃ বুদ্ধি ছাড়া সুন্দর মুখের দাম সামান্যই।
আমি আরো বলিঃ শিল্পের দাম বুঝলে শেয়াল তো মানুষ-ই হয়ে যেত!
(৪)
The Bear and the Fox
ভালুক আর শেয়াল
এক ভালুক-এর খুব ইচ্ছা সবাইকে জানায় কি বিরাট পরোপকারী আর দয়ালু স্বভাব তার। এই নিয়ে বক্তালি করতে গিয়ে সে জানাল যে সমস্ত পশুপাখীর মধ্যে সে-ই মানুষকে সবার চেয়ে বেশী সম্মান দ্যায় কারণ সে কখন-ও কোন মরা মানুষ নিয়ে টানাটানি করে না।
এক শেয়াল সে সব শুনে মুচকি হেসে ভালুকটাকে বলে, “হুঁঃ! সবসময় জ্যান্ত মানুষ খাওয়ার বদলে তুমি যদি মরা মানুষ খেতে সেটাই বরং তাদের পক্ষে ভাল হত।”
নীতিশিক্ষাঃ না মরলে দ্যায় না, অমন সম্মান দেওয়ার কোন মানে হয় না।
আমি আরো বলিঃ শিয়ালের উস্কানিতে মরা সেজেও আর ভালুকের হাত থেকে বাঁচা যাবে না!
(৫)
The Wolf and the Lamb
নেকড়ে ও ভেড়ার গল্প
ঘুরতে ঘুরতে এক নেকড়ে একটা দলছুট ভেড়াকে একলা পেয়ে গেল। নেকড়ের ইচ্ছে হল বেশ মহত্ব দেখায়। ভেড়াটার উপর কোন হামলা না চালিয়ে বরং কিছু যুক্তি-তক্ক দিয়ে সেটাকে বুঝিয়ে দেওয়া যাক যে ভেড়াটাকে খাওয়ার ব্যাপারটা নেকড়ের হক-এর মধ্যেই পড়ে। সে ভেড়াটাকে বলল
“এই যে মশায়, গেল সনে আপনি আমাকে বিস্তর অপমান করেছিলেন।”
ভেড়াটা ভ্যাঁ করে কেঁদে ফেলল “কিন্তু, আমার তো গত বছর জন্মই হয়নি!”
নেকড়েটা তখন বলে, “হতে পারে। কিন্তু, আমার মাঠের ঘাস খাও তুমি”
“না হুজুর,” ভেড়া উত্তর দ্যায়, “ঘাস খেতে কেমন তাই আমি জানি না এখনো।”
নেকড়ে ছাড়ে না, “তুই আমার কুয়ো থেকে জল খাস। ”
“না, না,” আর্তনাদ করে ওঠে ভেড়াটা, “আমি এখনো এক ফোঁটা জল ও মুখে দিইনি। আমি ত এখনো শুধু মা’র দুধ খাই! ”
“হুম! আমার সব অভিযোগ-এর তুই ভালই জবাব দিয়ে দিয়েছিস। কিন্তু, তা বললে তো আর আমার পেট চলবে না।” এই বলতে বলতেই ভেড়াটার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে শয়তান নেকড়ে তাকে টুকরো টুকরো করে খেয়ে ফেলল।
নীতিশিক্ষাঃ অত্যাচারী সবসময়ই অত্যাচার করার জন্য কিছু না কিছু কারণ খুঁজে বার করে ফেলে।
আমি আরো বলিঃ যারা কোন কথা শুনবে না ঠিক করেই রেখেছে, তাদের সাথে যুক্তি-তর্কে গিয়ে ক্ষতি ছাড়া লাভ নেই।
(চলবে কি? জানি না)
একলহমা
মন্তব্য
____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?
- একলহমা
একনকার বাচ্চারা ঈশপকে চেনে কিনা সন্দেহ। কথামালা পড়তে দেবার মত মা-বাবা অনেক কম এখন।
আজকের বাচ্চারা নিশ্চয়ই তাদের মত করে নানা নীতিমালার গল্প পড়ে। ইতিহাসের চাকা ঘুরতে থাকে। হয়ত কোন একদিন সেই যুগের বাচ্চারা আবার ঈশপের গল্প পড়বে। যদি বাংলা ভাষায় পড়তে চায়, হয়ত তারা চলে আসবে সচলায়তন-এ!
মন্তব্যের জন্য
- একলহমা
কথামালা!!! আহ!!
এখন বাজারে ঈশপের অনেক গল্পসমগ্র পাওয়া যায় -আমার ছেলেকে কয়েকটা কিনে দিয়েছি। কিন্তু একটারও মান ভালো না। নাহ, মান ভালো না কথাটা ঠিক হলো না - এগুলোর আসলে কোনো মানই নেই। তার তুলনায় আপনার অনুবাদ হাজার গুনে ভালো। তাড়াতাড়ি পরের পর্বগুলো ছাড়েন তো - সবগুলো মিলে একটা ই-বুক করে ফেলি, নাহলে অন্তত কপি-পেস্ট-প্রিন্ট করে ছেলেকে দিই পড়ার জন্য (অবশ্যই আপনার অনুমতি সাপেক্ষে)।
____________________________
অনেক , প্রোফেসর। দ্বিধায় ছিলাম কারো ভাল লাগবে কি না এবং আদৌ কোন কাজের হচ্ছে কি না। আপনার কথায় মনে হচ্ছে লাইনে আছি। গোটা বইটাই অনুবাদের ইচ্ছা আছে। দেখি, সাধ্যে কুলায় কি না।
এগুলো নিয়ে আপনি যা খুশী করতে পারেন, আমার কোন আপত্তি নেই। আসলে, আমার ভালই লাগছে।
- একলহমা
বাহ, অনুবাদ ও পুনর্বিশ্লেষণ উভয়ই ভালো লাগলো।
------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
আমি এক গভীরভাবে অচল মানুষ
হয়তো এই নবীন শতাব্দীতে
নক্ষত্রের নিচে।
অনেক ।
- একলহমা
জীবনের সর্বক্ষেত্রে এই কথাটা প্রযোজ্য।
গল্পানুবাদ ভাল হয়েছে, চলুক।
আব্দুল্লাহ এ এম
অনেক আব্দুল্লাহ-ভাই
- একলহমা
ইসরাত
-একলহমা
ঈশপের গল্পের কোনো তুলনা হয়না। আমি ব্যক্তিগত মনে করি ছোটবেলায় ধর্মবই পড়ানোর থেকে ঈশপের গল্প পড়লে মোরালিটি অনেক বেশি উন্নত হবে।
____________________________
- একলহমা
ডুপ্লি, ঘ্যাচাং।
- একলহমা
পুরাই একমত।
মন্তব্যের জন্য
- একলহমা
এটাও ডুপ্লি, দু:খিত।
- একলহমা
আধুনিক মরালসংযোগ উত্তম হইছে
@ কৌস্তুভ
"মরালসংযোগ" হা: হা: হা:, এইটাও ভালো হইচ্চে।
কমেন্টাইয়া উৎসাহ যোগানের জইন্য অনেক ।
- একলহমা
আমি যেসব বাচ্চাদের দেখি বেশিরভাগই বড় হচ্ছে প্রতিযোগিতা করার জন্য, সকাল থেকে সন্ধ্যা -কেবল পড়া, হোমওয়ার্ক, প্রাইভেট টিউটর, কোচিং, দিনশেষে টিভি দেখা, একটু সময়ের জন্য খাওয়া। আমি ছোটবেলায় ক্লাস ৩ এ থাকতে যে পরিমাণ সময় পেতাম বাইরের বই পড়ার জন্য, খেলার জন্য; এখন ক্লাস ওয়ানের একটা বাচ্চাও অতটুকু সময় পায় না।
আর বাবা-মায়েদের ঝোঁক হচ্ছে ক্লাসের বইয়ের দিকে, এর বাইরে হলে শিশুতোষ বিজ্ঞানের বই (জীবজগতের কথা, বা ডায়নোসরের ছবিওয়ালা বই এধরণের), এগুলো পড়লে জ্ঞান বাড়বে -এটা সত্য। তবে, তার সাথে পড়ে মজা পাবে এমন বই শিশুদের হাতে তুলে দিতে বাবা মা সংকোচ বোধ করেন।
আমাদের মাঝে অনেক পড়ুয়া (টেক্সট বই না) ছিল, যারা সবসময়ই কিছু না কিছু পড়তে থাকত। পরের প্রজন্মের বাচ্চাদের মাঝে ক'জন পড়ুয়া হবে সেটা নিয়ে আমি শংকিত।
আর, ঈশপের উপরে আরো উপদেশ জুড়ে দেবার জন্য লেখাটা বেশি মজার হয়েছে।
শংকা ত অবশ্যই হবে। তবে জোরদার লড়ে গেলে খানিকটা কাজ হয়। (একটা ব্যাপার নজর করে দেখবেন, বদমাইশরা এটা খুব ভাল জানে আর, লড়েও যায়। আমাদেরও লড়ে যেতে হবে। নান্য পন্থা বিদ্যতে)।
আপনার ভাল লাগা জানানোর জন্য অনেক
- একলহমা
কতদিন পর ঈশপের গল্প পড়লাম! আপনার লেখার জন্যই এই ছোট ছোট নীতি গল্পগুলোও অসাধারণ লাগে। চলুক এই লেখা।
-নিয়াজ
অনেক , নিয়াজ-ভাই।
- একলহমা
চলুক।
ফেইসবুক
---------------------------------------------
এক আকাশের নীচেই যখন এই আমাদের ঘর,
কেমন ক'রে আমরা বলো হতে পারি পর. . .
ঠিকাছে।
- একলহমা
আহারে! এই শিক্ষা পেতে পেতে আমাদের এক জীবন পেরিয়ে যায়! কেবল শিখি আর ভুলি, আবার শিখি আবার ভুলি, আবার শিখি আবার ভুলি-------- (যতবার খুশি পড়তে পারেন )
লেখা চলুক
অফটপিকঃ মডুরা সব কোথায়? ছুটিতে নাকি? আপনেরে দেখে না ক্যান?
~~~~~~~~~~~~~~~~
আমার লেখা কইবে কথা যখন আমি থাকবোনা...
"(যতবার খুশি পড়তে পারেন)"
হা:-হা:-হা: খুব ভাল বলেছেন। বারে বারেই পড়তে লাগে বৈকি!
- একলহমা
নতুন মন্তব্য করুন