----------------------------------------------------------------
ছোটবেলায় প্রথম যে বইটি পড়ে দুনিয়ায় টিঁকে থাকার রীতি-নীতি সম্পর্কে জানতে পারি সেটি ছিল ঈশ্বর চন্দ্র বিদ্যাসাগর-এর করা ঈশপ-এর গল্পের অনুবাদ - ‘কথামালা’। আমার বাবার আমাকে প্রথম উপহার যা আমার মনে পড়ে। বইটি হারিয়ে গেছে। গল্পগুলি রয়ে গেছে মনের ভিতর। যত বড় হয়েছি, গল্পগুলি তত বেশী করে অনুভব করেছি। আবার কখনো কখনো সেগুলি থেকে অন্য রকমের মজা পেয়েছি। সম্প্রতি ইচ্ছে হচ্ছিল গল্পগুলি ফিরে পড়ার। ভাবলাম, আপনাদের-ও সঙ্গী করে নি-ই। ইংরেজী পাঠের অনুসারী বঙ্গানুবাদ করেছি, তবে আক্ষরিক নয়। সাথে ফাউ হিসেবে থাকছে আমার দু-এক কথা।
[গল্পসূত্রঃ স্থানীয় গ্রন্থাগার থেকে পাওয়া R. Worthington (DUKE Classics)-এর বই এবং আন্তর্জাল-এ লভ্য http://www.aesop-fable.com -এ ইংরেজী অনুবাদের ঈশপের গল্পগুলি।
গল্পক্রমঃ R. Worthington-এর বইয়ে যেমন আছে]
----------------------------------------------------------------
(৬)
The One-Eyed Doe
এক চোখ-নষ্ট হরিণ-এর গল্প
এক হরিণ-এর একটা চোখ নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। দেখতে না পাওয়া বিপদ-এর হাত থেকে বাঁচতে সে সমুদ্রের ধারের মাঠে ঘাস খেয়ে বেড়াত। তার ভাল চোখটা সে ফিরিয়ে রাখত ডাঙ্গার দিকে যাতে কোন শিকারী বা শিকার ধরা কুকুর এলে দূর থেকেই তাকে দেখতে পেয়ে যায়। সমুদ্রের দিক থেকে সে কোন বিপদের ভয় করত না। তাই তার নষ্ট চোখটা সে ঐ দিকে রেখে রেখে চরে বেড়াত। একদিন সমুদ্রে সেই এলাকা দিয়ে নৌকা বেয়ে যাচ্ছিল কিছু লোক। তারা হরিণটাকে দেখতে পেয়ে অনায়াসে তাক করে তাকে মেরে ফেলল।
মরার সময় হরিণটা বলে গেল, “কি দুর্ভাগা আমি! ডাঙ্গার দিক থেকে যাতে বিপদে না পড়ি তার জন্য কত ব্যবস্থা নিলাম, এমনকি এই সাগরের ধারে চলে এলাম, ভেবেছিলাম বেঁচে গেলাম, উল্টে আরো সহজে মারা পড়লাম।”
প্রাচীন বচনঃ যে দিক থেকে সবচেয়ে কম সন্দেহ করা যায়, অনেক সময় সেদিক থেকেই বিপদ ঘনিয়ে আসে।
আমি বলিঃ অন্ধ বিশ্বাস পতন ঘটায়। যুক্তি দিয়ে সবসময় সবদিকে নজরদারী জারী রাখতে লাগে।
(৭)
The Dog, Cock and Fox
কুকুর, মোরগ আর শিয়াল-এর গল্প
এক কুকুর আর তার সাথী এক মোরগ। দু’জনে মিলে ঘুরতে বেড়িয়েছিল। ঘুরতে ঘুরতে রাত হয়ে গেল। তখন তারা আশ্রয়ের জন্য ঘন বনের মধ্যে চলে এল। মোরগ চড়ে বসল এক গাছের অনেক উঁচু একটা ডালে আর কুকুর সেই গাছের নীচে তার বিছানা পেতে নিল। ভোর হলে, যেমন সে রোজ করে, মোরগ ডেকে উঠল কোঁকড়-কো করে। সেই আওয়াজ শুনে এক শিয়ালের মনে হল সকালের নাস্তাটা আজ মোরগের মাংসে সেরে ফেললে খাসা হয়। শিয়াল তখন ঐ ডালটার নীচে চলে এল আর নানাভাবে মোরগের মিষ্টি গলার আওয়াজের সুখ্যাতি করে তার সাথে দোস্তি পাতাতে চাইল।
“আপনি রাজী থাকলে,” বলল সে মোরগকে, “আজকের দিনটা আপনার সাথে কাটাতে পারলে আমার খুব ভাল লাগবে।”
মোরগ বলল, “মশায়, এক কাজ করেন, একটু এগিয়ে এই গাছের গোড়ায় চলে যান। আমার মালপত্র যে টানে সে ঐখানে ঘুমিয়ে আছে। তারে ডেকে তোলেন, সে আপনাকে এখানে আসার জন্য দরজা খুলে দিবে।”
শিয়ালকে ঐদিকে আসতে দেখেই কুকুর একেবারে লাফ দিয়ে উঠল আর শিয়ালের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে তাকে টুকরো টুকরো করে ছিঁড়ে ফেলল।
প্রাচীন বচনঃ অন্যদের যারা ফাঁদে ফেলতে চায়, প্রায়ই তারা নিজেরাই নিজেদের ফাঁদে পড়ে যায়।
আমি বলিঃ চেনা শয়তান যখন ভাল কথা বলে মন ভোলায়, জেনে রেখো সে তোমায় ডোবানোর ফন্দী আঁটছে।
(৮)
The Mouse, the Frog, and the Hawk
ইঁদুর, ব্যাঙ, আর বাজপাখীর গল্প
এক ইঁদুর, এমনই কপাল খারাপ তার, এক ব্যাঙ-এর সাথে জিগরী দোস্তি পাতিয়ে বসল। ব্যাঙটা একদিন, মাথায় নষ্টামি বুদ্ধি চাপলে যা হয়, ইঁদুরটার এক পায়ের সাথে নিজের এক পা আচ্ছা করে বেঁধে ফেলল। তারপর টানতে টানতে তাকে নিয়ে চলল সে নিজে যেই পুকুরে থাকত সেখানে। পুকুর-পাড়ে পৌঁছে, হঠাৎ সে ঝপাং করে দিল লাফ, ইঁদুর-সুদ্ধ সোজা জলে গিয়ে পড়ল। জলে পড়ে সেই ব্যাঙের সে কি মাতামাতি! সাঁতরাচ্ছে, ঘ্যাঙর ঘ্যাঙর করে ডাকাডাকি করছে, যেন এক বিরাট কাজ করে ফেলেছে সে। ইঁদুরটা কি কষ্ট যে পেল! খানিকক্ষনের মধ্যেই জলে ডুবে, দম আটকে মারা গেল বেচারা। তার শরীরটা জলে ভাসতে থাকল। তখনো ব্যাঙের পা-এর সাথে তার পা বাঁধা। উড়তে উড়তে এক বাজপাখীর নজরে পড়ল সেই জলে-ভাসা ইঁদুর। ছোঁ মেরে নেমে এসে ইঁদুরটা নিয়ে সে উঠে গেল ঐ-ই-ই উঁচুতে। ইঁদুরের পায়ে পা বাঁধা থাকায় সেই ব্যাঙ-ও তখন বাজ-এর থাবায় বন্দী। এর পর ইঁদুরের সাথে সাথে ব্যাঙটা-ও চলে গেল বাজ-এর পেটে।
প্রাচীন বচনঃ যেমন কাজ তার তেমন ফল।
আমি বলিঃ যে পাজী সে হয়ত ছাড়া পাবে না, কিন্তু তার হাতে নিজেকে ছেড়ে দ্যায় যে হতভাগা সে মারা পড়বে সবার আগে।
(৯)
The Dog and the Oyster
এক কুকুর আর ঝিনুক-এর গল্প
এক কুকুর খুব ডিম খেতে ভালবাসত। একদিন সে একটা অয়স্টার বা দুই-খোলের ঝিনুক কুড়িয়ে পায়। ঝিনুকটাকে ডিম ভেবে মুখখানা এত্তবড় হাঁ করে সে ওটাকে গিলে ফেলল। কিছুক্ষণের মধ্যেই ভয়ানক পেটের যন্ত্রণায় ছটফট করতে করতে সে আর্তনাদ করতে থাকে, “এমন বুদ্ধু আমি, গোল দেখলেই ভাবি ডিম, আমার এইরকম চরম কষ্টই পাওয়া উচিত।”
প্রাচীন বচনঃ হড়বড়িয়ে কাজ করে, পস্তাতে হয় পরে পরে।
আমি বলিঃ হড়বড়াং - চিৎপটাং - মন্তব্য লাফাং - ডুপ্লি ঘ্যাচাং - কপাল চাপ্রাং - ঠাং-ঠাং-ঠাং
(১০)
The Wolf and the Shepherds
এক নেকড়ে আর ভেড়া চড়ানো রাখালেরা
রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিল এক নেকড়ে। একটা বাড়ির পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় সে দেখে বাড়ির মধ্যে ভেড়া চড়ানো রাখালের দল রাতের খাবার সারছে গাদা গাদা মাংস দিয়ে। নেকড়েটা তাই দেখে সেই রাখালদের ডেকে বলল, “এই কাজটাই যদি আমি করতাম, চ্যাঁচামেচি করে তোমরা দুনিয়া মাথায় তুলে ফেলতে।”
প্রাচীন বচনঃ লোকেরা নিজেরা যা করে সেটাই অন্য কেউ করলে তখন তাকে দোষ দিতে থাকে।
আমি বলিঃ নিজের বিশ্বাসটাই শুধু ঠিক বলে যারা জাহির করে, তারাই অন্য লোকেরা একই রকম করলে সেই লোকেদের মুখ বন্ধ করে দিতে চায়।
(চলবে কি? আপনারা চাইলে)
আগের নীতিগল্পরা
(১-৫) : http://www.sachalayatan.com/guest_writer/50053
একলহমা
মন্তব্য
এটা কি সংস্কৃত বচন?
আব্দুল্লাহ এ এম
হা: হা: হা:
- একলহমা
ভালো লাগছে সিরিজটা। জানা গল্পগুলো রিভিশন হচ্ছে আর ভুলে যাওয়াগুলো নতুন করে শুনছি।
তবে, ১০ নম্বরটা নিয়ে আমার একটা কথা আছে। রাখালরা ভেড়া দেখাশোনা করে, তারা হয়ত কিছুটা পেতেই পারে তা থেকে, নেকড়ের কোন অধিকার নেই আরেকজনের জিনিসে হামলা করে সেটা নিয়ে নেওয়ার।
লেখা হয়েছে যথারীতি, জবরদস্ত
১০ নং নিয়ে বক্তব্যের সাথে সহমত।
পড়া আর উৎসাহ দেওয়ার জন্য
- একলহমা
চালাতে থাকুন, অনুবাদগুলো একসময় কাজে লাগাতে পারবেন। এই ধরণের অনুবাদ/লেখার দরকার আছে।
ফেইসবুক
---------------------------------------------
এক আকাশের নীচেই যখন এই আমাদের ঘর,
কেমন ক'রে আমরা বলো হতে পারি পর. . .
"অনুবাদগুলো একসময় কাজে লাগাতে পারবেন"
- আমার আর কোন কাজে লাগবে রাজু-ভাই! পড়ুয়ারা কেউ কোন কাজে লাগাতে চাইলে, লাগাতে পারলে আন্তরিক খুশী হব।
পড়বার আর উৎসাহ দেওয়ার জন্য
- একলহমা
আগেরটাও পড়েছি। ভালো লাগছে
-------------------------------------------------
ক্লাশভর্তি উজ্জ্বল সন্তান, ওরা জুড়ে দেবে ফুলস্কেফ সমস্ত কাগজ !
আমি বাজে ছেলে, আমি লাষ্ট বেঞ্চি, আমি পারবো না !
আমার হবে না, আমি বুঝে গেছি, আমি সত্যি মূর্খ, আকাঠ !
অনেক আশফাক-ভাই।
- একলহমা
এই সিরিজে আপনার নিজের অংশটুকু আমি খুব আগ্রহ নিয়ে পড়ি। লেখা চলুক, ভাইয়া।
-নিয়াজ
অনেক নিয়াজ ভাই। আশা করি আগ্রহের প্রতি অবিচার করি নি।
- একলহমা
মোটেও অবিচার করেন নি ।
-নিয়াজ
ঠিক ঠিক আমার ও সেইটুকু বেশ ভালো লাগে।
____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?
সাক্ষী মশায়, এই শ্লোক নামানোর পরেও শুধু কাঁচকলা! কপাল চাপ্রাং - কপাল চাপ্রাং - ঠাং-ঠাং-ঠাং (টু দি পাওয়ার ইনফিনিটিং)। তবে আমার আমদানীর যা হাল, কাঁচকলাই বা জোটে কয়টা। তাই অনেক
- একলহমা
সিরিজ চলুক।
চলুক তবে।
- একলহমা
বেশ কিছু গল্প মোটামুটিই ভালই লাগল।
alamgir_promity
চলুক
আব্দুল্লাহ এ এম
নতুন মন্তব্য করুন