ঈশপের গল্প (১১ - ১৫)

এক লহমা এর ছবি
লিখেছেন এক লহমা [অতিথি] (তারিখ: সোম, ০২/০৯/২০১৩ - ৪:৪৮অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

----------------------------------------------------------------
ঈশপের নীতিগল্পগুলি পড়েছি অনেক ছোটবেলায়। যত বড় হয়েছি, গল্পগুলি তত বেশী করে অনুভব করেছি। সম্প্রতি ইচ্ছে হ’ল সে’গুলি ফিরে পড়ার, ধরে রাখার - নিজের মত করে ।
ইংরেজী পাঠের অনুসারী বঙ্গানুবাদ, আক্ষরিক নয়। সাথে আমার দু-এক কথা। 

[গল্পসূত্রঃ R. Worthington (DUKE Classics)-এর বই এবং আন্তর্জাল-এ লভ্য http://www.aesop-fable.com -এ ইংরেজী অনুবাদের ঈশপের গল্পগুলি। 

গল্পক্রমঃ R. Worthington-এর বইয়ে যেমন আছে]
----------------------------------------------------------------

(১১)
The Hares and the Frogs

খরগোশ-এর দল আর ব্যাঙ-দের গল্প

খরগোশদের সবকিছুতে এত ভয় করে! আর সেই কবে থেকে যে তারা জেনে গেছিল - সবসময় হুঁশিয়ার হয়ে থাকতে হবে তাদের! একসময় খুব দুঃখ হল তাদের, আর সহ্য হয়না এ যন্ত্রণা। এক ধাক্কায় এবার সব মিটিয়ে ফেলা দরকার, একটা হু-ই-ই উঁচু খাড়াই পাহাড় থেকে নীচের হ্রদের গহীন জলে ঝাঁপিয়ে পড়ে সব শেষ করে দিলেই পরম শান্তি। দলে দলে হ্রদের দিকে চলল তারা। তাদের এত এত পায়ের আওয়াজে জলের ধারে সার দিয়ে বসে থাকা ব্যাঙদের মনে ভীষন ভয় ধরে গেল। বাঁচবার জন্য হুড়মুড় করে লাফিয়ে ঝাঁপিয়ে তারা ডুব লাগাল গভীর জলের নীচে। ব্যাঙেদের এইভাবে দুদ্দাড় করে হাওয়া হয়ে যেতে দেখে, খরগোশদের একজন বলে উঠল, “আরে দাঁড়াও, দাঁড়াও দোস্তোরা সব, বাদ দাও যা করতে যাচ্ছিলে, দেখতেই পাচ্ছ, আমাদের থেকেও অনেক ভীতুরা দিব্যি বহাল তবিয়তে বেঁচে আছে।”

প্রাচীন বচনঃ আমাদের থেকেও যারা অসহায় অবস্থায় আছে তাদের দেখলে নিজেদের উপর আস্থা জেগে ওঠে।

আমি বলিঃ পালিয়ে যাওয়া ছাড়া যারা বাঁচতে জানে না, সামান্যতম আশঙ্কাতেই তারা লাফিয়ে পালিয়ে যাবে। একবার থেমে দেখবেও না ঘটনাটা কি! কি হবে তাদের দিয়ে!

(১২)
The Lion and the Boar

সিংহ আর শুয়োরের গল্প

এক গ্রীষ্মের দিন। ভয়ানক গরমের চোটে তেষ্টায় সবার অবস্থা কাহিল। এক সিংহ আর এক শুয়োর এক সাথে এসে হাজির ছোট এক কূয়োর ধারে। কে আগে জল খাবে এই নিয়ে দুজনের মধ্যে লেগে গেল তুমুল ঝগড়া। তারপর সেই ঝগড়া থেকে শুরু হল মারামারি, মরণপণ - প্রাণ থাকতে অন্যজনকে আগে জল খেতে দেবে না। লড়তে লড়তে একসময় দুজনেই একটু থেমেছে, দম নিয়ে নিতে - আরো ভয়ংকর হিংস্র লড়াই লড়ার জন্য। এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখে একটু তফাতে সার দিয়ে বসে আছে - শকুনেরা, ভূরিভোজের অপেক্ষায়। অচল হয়ে যেই একজন শুয়ে পড়বে, সবাই মিলে ঝাঁপিয়ে পড়বে তার উপরে। এই দেখে দুজনেই সঙ্গে সঙ্গে তাদের যুদ্ধ থামিয়ে দিল, বললঃ “আমাদের বরং দোস্তি করে নেওয়াই ভাল। না হলে তো কাক শকুনের খাদ্য হতে হবে, স্রেফ আমাদের দম ফুরিয়ে পড়ে যাওয়ার অপেক্ষা।”

প্রাচীন বচনঃ একদল যখন লড়াই করে আরেকদল তখন তাদের উপর নজর রাখে, লড়িয়েদের কেউ একজন হেরে গেলেই তার হার থেকে তারা তখন নিজেদের ফায়দা তুলবে।

আমি বলিঃ এযুগের ধান্দাবাজ শকুনেরা আর শুধুই দর্শক নয়, তারাই লড়াইগুলোর আয়োজন করে। ধর্মের নামে, ইজ্মের নামে, দলের নামে, শতেক অজুহাতে, তারাই আমজনতাকে লড়িয়ে দ্যায় পরস্পরের বিরুদ্ধে। তারপর ফায়দা তোলে সকলের দুরবস্থা থেকে।

(১৩)
The Mischievous Dog

নচ্ছার কুকুরের গল্প

এক কুকুর লোকজন দেখলে চুপচাপ তাদের দিকে তেড়ে যেত, তারপর তারা কিছু টের পাওয়ার আগেই তাদের গোড়ালিতে কামড় বসাত। কুকুরটার মালিক মাঝে মাঝে তার গলায় একটা ঘন্টা বেঁধে দিত যাতে সে কোথাও গেলে চারপাশের সবাইকে জানিয়ে দিতে বাধ্য হয় যে সে এসে গেছে। আবার মাঝে মাঝে তার গলায় একটা শিকল বেঁধে সেই শিকলে একটা ওজনদার ভার ঝুলিয়ে দিত যাতে সে লোকজনকে কামড়ানোর জন্য ছুট লাগাতে না পারে।

কুকুরটা দিনে দিনে তার এই ঘন্টা আর ভার-টা নিয়ে খুব অহঙ্কারী হয়ে উঠল। ওগুলো নিয়ে সেই বাজার এলাকার সব জায়গায় সে দেখিয়ে বেড়াত। তখন এক বুড়ো শিকারী কুকুর একদিন তাকে ডেকে বলল, “এত নিজেকে দেখিয়ে বেড়ানোর কি হয়েছে তোর? যে ঘন্টা আর ভার-টা ঝুলিয়ে ঘুরে বেড়াস, সেগুলো কোন সম্মান-পদক নয়, বরং, অপমানের চিহ্ন। সব্বাইকে জানিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা যে তুই একটা নচ্ছার স্বভাবের কুকুর।”

প্রাচীন বচনঃ কোনভাবে তাকে নিয়ে কথা হলেই অনেকে সেটাকে সুখ্যাতি ভেবে ভুল করে বসে।

আমি বলিঃ দেশের সেবার নামে মাস্তানি করে আহাম্মকেরা ভাবে লোকেরা তাদের মাথায় করে রেখেছে। পরের ভোটে হারার আগে বোঝেনা লোকেরা আসলে তাদের কি চোখে দেখছে।

(১৪)
The Quack Frog

এক হাতুড়ে-ডাক্তার ব্যাঙ-এর গল্প

এক ব্যাঙ একদিন বনের সব জন্তু-জানোয়ারদের ডেকে জানিয়ে দিল যে সে সবার সব রোগ সারিয়ে দিতে পারে। এক শিয়াল তখন তাকে জিজ্ঞেস করল, “সকলের জন্য নিদান দেওয়ার ভান কর কি করে হে? নিজের খোঁড়াদের মত লাফিয়ে চলা আর কুঁচকানো চামড়া-টাই তো তুমি সারাতে পার না?”

প্রাচীন বচনঃ অন্যের স্বভাব শোধরানোর আগে নিজেকে শোধরালে লোকের কাছে বিশ্বাসযোগ্যতা বাড়ে।

আমি বলিঃ ঠিকমত চেপে না ধরা পর্যন্ত সব-জান্তা ভন্ডরা দিব্যি তাদের লোক-ঠকান ব্যাবসা চালিয়ে যেতে থাকে।

(১৫)
The Ass the Fox, and the Lion

গাধা, শিয়াল আর সিংহের গল্প

এক গাধা আর এক শিয়াল জোট বাঁধল যে তারা একসাথে খাবার জোগাড় করবে। বনে ঢুকতেই তারা দেখে এক সিংহ আসছে। শিয়াল তাড়াতাড়ি সিংহের কাছে গিয়ে তাকে কথা দিল যে সিংহ যদি শিয়াল-কে না মারে তবে সে গাধাকে তার হাতে তুলে দেবে। সিংহ রাজী হয়ে গেল - শিয়ালের কোন ক্ষতি সে করবে না। শিয়াল তখন গাধাকে পথ দেখানোর ছল করে এক গভীর গর্তে নিয়ে গিয়ে ফেলল। সিংহ যেই দেখল যে গাধার ব্যবস্থা হয়ে গেছে তখন প্রথমেই থাবা মেরে শিয়ালটাকে খেল, আর তারপর ধীরেসুস্থে সময় নিয়ে গাধাটাকে ধরল।

প্রাচীন বচনঃ বিশ্বাসঘাতকের কপালে বেইমানি-ই জোটে।

আমি বলিঃ সময় থাকতে বেইমানদের মুখোশ খুলে তাদের থেকে সরতে না পারলে নিজের ধ্বংস অনিবার্য।

(আপনারা চাইলে, চলবে)

আগের নীতিগল্পরা
(১ - ৫) http://www.sachalayatan.com/guest_writer/50053
(৬ - ১০) http://www.sachalayatan.com/guest_writer/50072

একলহমা


মন্তব্য

 মেঘলা মানুষ এর ছবি

"... আমাদের ঠেকেও অনেক ভীতুরা বহাল তবিয়তে বেঁচে আছে"
ভাবনায় ফেলে দেবার মত একটা কথা চিন্তিত

অতিথি লেখক এর ছবি

চিন্তিত
পড়া আর মন্তব্য-র জন্য আপনারে অসংখ্য -ধইন্যাপাতা-
- একলহমা

অতিথি লেখক এর ছবি

হড়বড় না করেও মন্তব্য লাফাং - ডুপ্লি ঘ্যাচাং - কপাল চাপ্রাং - ঠাং-ঠাং-ঠাং
- একলহমা

সাক্ষী সত্যানন্দ এর ছবি

এযুগের ধান্দাবাজ শকুনেরা আর শুধুই দর্শক নয়, তারাই লড়াইগুলোর আয়োজন করে। ধর্মের নামে, ইজ্মের নামে, দলের নামে, শতেক অজুহাতে, তারাই আমজনতাকে লড়িয়ে দ্যায় পরস্পরের বিরুদ্ধে। তারপর ফায়দা তোলে সকলের দুরবস্থা থেকে।

তিতা কথা, খেলব না (মাঠ ছেড়ে যাবার উপায় নেই যদিও) মন খারাপ

____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?

অতিথি লেখক এর ছবি

ঠিক, মাঠ ছেড়ে যাওয়ার উপায় থাকে না। উপায় থাকে একটাই - শকুনদের সাথেই লড়ে যাওয়া।
পড়া আর মন্তব্য-র জন্য অনেক আপনারে অসংখ্য -ধইন্যাপাতা-
- একলহমা

ফাহিম হাসান এর ছবি

চলুক

অতিথি লেখক এর ছবি

চলুক তবে হাসিআপনারে অসংখ্য -ধইন্যাপাতা- লন।
- একলহমা

পঞ্চ সুখ  এর ছবি

আমি আমার মেয়ের জন্য ঈশপের গল্প ইন্টারনেট থেকে খুজতে গিয়ে কোথাও বাংলা অনুবাদ খুজে পাইনি । বাজার থেকে যে কিনে সেটাও সম্ভব হয়নি দেশের বাইরে থাকার কারনে। পরে বাধ্য ইংলিশ ভার্সন প্রিন্ট নিয়ে অনুবাদ করে রাতে ঘুমানোর আগে শোনাতে হয়। আপনি আপনার অনুবাদ চালিয়ে যান। আমি সহ আমার মত হয়ত আরও কেউ উপকৃত হবে। আপনার লেখাগুলো আমি প্রিন্ট নিয়ে বাচ্চাকে শোনাব। অসংখ্য ধন্যবাদ আপনাকে।

অতিথি লেখক এর ছবি

আপনার কথা মনে অনেক জোর দিল। আমার এই আমার-মতো-করে-করা-অনুবাদগুলি আপনার কাজে লাগবে জেনে কি যে আনন্দ পেলাম বলে বোঝানর নয়। অনেক আপনারে অসংখ্য -ধইন্যাপাতা-
আশা করি ধৈর্য্য রাখতে পারব কাজটা শেষ করার জন্য।
- একলহমা

অতিথি লেখক এর ছবি

আপনাকে তো আধুনিক ঈশপ নাম দেওয়া উচিত হাততালি
ইসরাত

অতিথি লেখক এর ছবি

না:, অত কিছু নয়, হাসি
আপনারে অসংখ্য -ধইন্যাপাতা-
- একলহমা

প্রৌঢ় ভাবনা এর ছবি

বাহ্, বেশ সুন্দর করে গুছিয়ে লিখছেনতো সিরিজটা ! যদিও সবগুলো পড়া হয়নি তবে অবসরে পড়ে ফেলবো। চলুক,চলুক। হাসি

অতিথি লেখক এর ছবি

অনেক ধন‌্যবাদ ভাবনা-দাদা। আসল কাজ তো করে গেছেন ঈশপ কথক ঠাকুর। আমি শুধু ওনার পায়ের ছাপ ধরে হেঁটে চলেছি। আপনাদের সকলের উৎসাহে আর শুভেচ্ছায় যদ্দিন দম রাখতে পারব, নিশ্চয় ভেসে থাকব। তারপর, অনন্ত রাত্রির সমারোহ।
- একলহমা

অতিথি লেখক এর ছবি

ভাইয়া, এই সিরিজটা অনেকেরই অনেক উপকারে লাগছে, চালিয়ে যান। খুব ভালো একটা ব্যাপার হতেও পারে শেষে হাসি

-নিয়াজ

অতিথি লেখক এর ছবি

অনেক ধন্যবাদ, নিয়াজ ভাই। হাসি
- একলহমা

বন্দনা এর ছবি

১৪ নাম্বারটা সবচেয়ে দারুণ। পরের পর্ব আসুক।

অতিথি লেখক এর ছবি

ধন্যবাদ বন্দনা-দিদি। আসছে।
- একলহমা

কৌস্তুভ এর ছবি

আমি নবরূপের এই কাহিনীসিরিজটির নাম দিতে চাই 'একলহমার ঝুলি'।

অতিথি লেখক এর ছবি

হাঃ হাঃ কৌ, থেঙ্কু।
- একলহমা

সাক্ষী সত্যানন্দ এর ছবি

চলুক
ভুট দিলাম

____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।