দূর শৈশবে ক্যালিডোস্কোপ ঘুরিয়ে নক্সা দেখতে দেখতে ঘোর লেগে যেত। আজ এই বেলা-ঢলে আসা প্রহরে জীবন-ক্যালিডোস্কোপ নিয়েও আমার এক-ই দশা, ঘোর লেগে আসে। একসঙ্গে ঝাঁক ঝাঁক স্মৃতি এসে ঘুরে যায় কাঁচকি মাছের ঝাঁক-এর মত। মনোযোগ দিয়ে দেখতে গেলে পলক ফেলার আগেই সব শুনশান, কেউ নেই। তখন আবার চুপটি করে বসে থাকা গহীন দিঘীর পারে। খুব সাবধানে। ঘোর লেগে জলে পড়ে গেলে, সাঁতার জানি না আমি, তলিয়ে যাব। আর না, সাবধানে পা টিপে টিপে জলের ধার থেকে সরে আসি। কিন্তু টের পাই, জল ও আসছে। বুকে হেঁটে, সাপের মতো। দৃষ্টিসীমার ঠিক বাইরে বাইরে। আসুক, পালিয়ে লাভ নেই। আমি মন সরিয়ে নিই।
জলে নামি নি তা নয়। সারা জীবনে নানা সময়ে কখনো পুকুর, কখনো নদী, কখনো দিঘী, বাস করেছি জলের পাশেই। আজো বৎসারান্তে একবার অন্ততঃ সমুদ্রের পাড়ে হাঁটতে না পারলে আমি অস্থির হয়ে উঠি। কিন্তু জলে নামি না। উৎসাহ জুটেছে বহুবার। জলে নেমেওছি। এমন কি, সাঁতারের স্কুলেও ভর্তি হয়েছি। সাঁতার শেখা হয়নি তবু, হবেও না আর। আসলে জলের সাথে আমার দোস্তি হয় নি। অথচ বুকের গভীরে ছলাৎ ছলাৎ ঢেউ ভাঙ্গে। একটু অসতর্ক হলেই এ পাথর ও পাথরে ছলকে ওঠে।
জল আমার কাছে এক বিষম রহস্য, প্রেম যেন বা। না কি বরং ঘুরিয়ে বলি - প্রেম এক বিষম রহস্য, জল যেন বা। তাকে ছাড়া জীবন বাঁচে না। কিন্তু যদি পাকে পাকে জড়িয়ে ধরে, ছাপিয়ে ওঠে, ডুবিয়ে দ্যায়, ভেসে ওঠা যায় কি আবার? আমার তো জানার-ই কথা। কিন্তু আজ ত প্রেমের কথা বলতে বসি নি। জলের কথা। তবে, জলকে বাদ দিয়ে প্রেমের কথা হয় কি করে কিংবা প্রেমকে বাদ দিয়ে জলের! দুই-ই ঘোর লাগিয়ে দ্যায়। বিদ্যেধরী বলেন আমি সর্বদা ঘোরের মধ্যই থাকি। আমি বলি - "সে ত তোমারই ঘোরে।" তিনি বলেন - "সেটা ওপর ওপর, ভিতরে ভিতরে অন্য আবেশ বয়ে চলে।" ভুল নয়, চেনেন আমাকে আমার থেকেও বেশী। সবসময়ই আমি মেতে থাকি। একেক সময় একেকটা নিয়ে।
সেই যখন ছবি তুলতাম, ছবি তুলতে তুলতে ক্লান্ত হয়ে গিয়ে ফ্লিকার-এ ছবি বসাতে শুরু করেছিলাম। বসাতে বসাতে দেখলাম, ছবির সমুদ্র। নিজের ছবির ঘোর কেটে গেল এর ফলে। ঘোর লেগে গেল ভাল ছবি দেখার। বিশেষ করে ভাল লাগল বাংলাদেশের এক গুচ্ছ ছেলে মেয়েদের তোলা ছবি গুলো। এর পরে এল নুতন ঘোর। ছবি তোলা মানুষেরা। অচেনা অদেখা ভাই-বোনেদের, বন্ধুদের পয়ে গেলাম। এদের নিয়ে ঘোর না লেগে বাঁচব কি করে! আবার, এদের তোলা কোন কোন ছবিতে কিছু বলতে গিয়ে স্তব্ধ হয়ে বসে থাকতাম, টের পেতাম শব্দরা সারি বেঁধে দাঁড়িয়ে পড়ছে নেমে আসার অপেক্ষায়। এক সময় আঙ্গুলের ডগা বেয়ে নেমে আসত তারা। সময়ের সারি বেয়ে সে রোগ ও একসময় সেরে গেছে আমার। কেটে গেছে ঘোর। শুধু কোনো কোনো ছবি উল্কি দিয়ে আঁকা ছবির মত বসে গেছে ভিতরে কোথাও।
সেই সব ছবিগুলো আজ-ও আবিষ্ট করে রাখে। তাদের সবাই যে খুব বিশিষ্ট ছবি তা নয়। কিন্তু আমার মনে তারা যে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছিল সেটি বিশিষ্ট। কবি-ফোটোগ্রাফার বন্ধু অমর এক আশ্চর্য মানুষ। পশ্চিমবঙ্গের এক সময়ের উত্তাল দিনগুলোতে কবিতাও যখন পথ চলেছিল নানা ভাঙ্গ্চুরের মধ্য দিয়ে অমর সেই পথে হেঁটেছিল অনেক পা। আর সেই দিনগুলোর সুবাদে সে আহরণ করেছে অজস্র কবিতা। বিভিন্ন ছবির সাথে, নিজের বা তার বন্ধুদের, নানা কবিদের কবিতা থেকে সে তুলে আনত অনবদ্য টুকরাগুলি। কি করে সে অসাধারন কাজটি করত দিনের পর দিন তা আজো আমায় হতবাক করে রাখে। তার ছবিগুলি সে প্রায় সর্বদাই উৎসর্গ করে রাখত তার বন্ধুদের। তার একটি ছবি সে একদিন উৎসর্গ করলে আমায়, যেমন করেছে আরো বহুবার। ছবিটিতে একটি লোক জলের মধ্যে এগিয়ে চলেছে, স্নানের জন্যই হবে। এই ছবির সাথে সে তুলে দিয়েছিল শঙ্খ ঘোষের একটি কবিতার কয়েকটি চরণ। কবিতাংশটি অনবদ্য। কিন্তু সেদিন ঐ কবিতার টুকরোটিতে আমি মন দিতে পারি নি। আমায় বিঁধে ফেলেছিল ঐ ছবিটি। আরো ঠিক করে বললে ছবির থেকে আমার নিজের মনে তৈরী হওয়া ছবিটি। একটি লোক স্বেচ্ছায় চলে যাচ্ছে জলের গভীরে।
সেই অনুভূতি জন্ম দিয়েছিল কিছু পংক্তির। এর পরে আমার তোলা একটি ছবির সাথে তাদের বসিয়েও দিয়েছিলাম। কিন্তু জলের মাঝে লোকটির সেই ছবিটি আমায় ছেড়ে যায় নি। আস্তে আস্তে বুঝলাম, ছেড়ে যায়নি ঐ প্রায় কবিতার মত পংক্তিগুলিও। গত তিন বছরে নানা সময় তাদের নিয়ে বসে গিয়েছি। কাটা-ছেঁড়া করেছি, আবার ফিরিয়ে নিয়ে গেছি আগের, আগের, তারো আগের রূপে। আবার পাল্টে ফেলেছি, এখানে, ওখানে। পংক্তিগুলোর লোকটা ত আমি-ই। তবে এই আমি নই। এই আমি অল্প্রের জন্য ঐ লোকটা হতে হতে বেঁচে গিয়েছি। বিদ্যেধরী তার জাদুমন্ত্রে বাঁচিয়ে দিয়েছে আমায়। যদি না বাঁচতাম! ভেসে যেতাম খড়কুটোর মত। যায় ত কত জন, ডুবেই হয়ত যায় শেষে, যায় না কি?
গত পরশু রাতে পংক্তিগুলিকে নিয়ে আমার ঘোর কেটে গিয়েছে। এমনি-ই।
জলের কাছে
জলের কাছে চাইনি যেতে আমি
চাইনি আমি জল, ঘিরবে পায়ে পায়ে ।
চাইনি আমি, জলেই যাবে সমস্ত সম্বল!
হয়ত এখন, এটাই ভাল হবে -
আলতো যাওয়া, এমনি করে ঝরে।
মানুষ-জনে ব্যস্ত যখন রবে!
সন্ধ্যা হয়ে এলে, কত কি মনে পড়ে -
“আজ রাতটা কাটিয়ে গেলে পারো!
একটা তো রাত! অন্ধকার-ও গাঢ়!”
তোমার সাথে কথা
কান্না-হাসি মেখে
তাকিয়ে থাকা তোমার -
বসার থেকে, শোয়ার থেকে -
পলক ফেলার আগে
ভাবতে কেমন লাগে!
এই এখানে বড় রাস্তার পাশে
আলোয় ভাসে সবাই, ধোঁয়ায় -
দরজা ধরে দাঁড়িয়ে নেই কেউ,
মৌরী-জিরের সুবাসিত ছোঁয়ায়।
এখান থেকে দুই-পা হেঁটে গেলে-ই
বাসের চাকা জীবন পিষে ফেলে।
জলের কাছে হয়নি আমার যাওয়া।
এই অবেলায় জল, আপনি ঘিরে আসে!
জল-ই নিল যা ছিল সম্বল।
মন্তব্য
আপনার ভিতর কাব্যিকতা আছে মাইরি! আছে কাব্য!!
দেব প্রসাদ দেবু
ছোটবেলায় পড়া নন্টে-ফন্টের কথা মনে পড়ে গেলো আপনার মন্তব্যটা পড়ে। মাইরি বলছি দেবুদা!!
____________________________
ঠিক! মজাই বটে! বেঁটে লোক আমি, এদিকে জিনিস ভাঙ্গি আকছার, গিন্নী ঐ নামে আওয়াজ দ্যান মাঝে মাঝে, এবারে নণ্টে ফণ্টে জুটে গেলেই ষোলর জায়গায় আঠার কলা পূর্ণ হয়!
--------------------------------------------------------
এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।
এক লহমার... টুকিটাকি
আছে মনে হচ্ছে? বেশ, থাক তা হইলে! নেন, কয়গা পাতা নেন।
--------------------------------------------------------
এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।
এক লহমার... টুকিটাকি
পুরোই জলজ লেখা!!
আপনার রঙীন পাথরের আয়নাঘূর্ণির সব কটি লেখা খুব ভালো লাগে। কিন্তু এবারের লেখাটা একেবারেই অন্যরকম। ভাষার কারুকার্য এত সুন্দর এই পর্বে যে মনে হচ্ছে গদ্য কবিতা।
"কিন্তু টের পাই, জল ও আসছে। বুকে হেঁটে, সাপের মতো। দৃষ্টিসীমার ঠিক বাইরে বাইরে। আসুক, পালিয়ে লাভ নেই।" দারুন লাগলো উপমাটা।
____________________________
প্রোফেসর, বড্ড মায়ায় জড়িয়ে ফেলছেন!
--------------------------------------------------------
এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।
এক লহমার... টুকিটাকি
মানুষের শরীরের বেশিরভাগ জল। মানুষের পূর্বপুরুষ এককালে জল থেকে উঠে এসেছিল। অমাবশ্যা-পূর্ণিমায় মানুষের শরীরের ভেতরের জল ওঠানামা করে। সুতরাং জলকে অস্বীকার করার কোন উপায় নেই।
প্রথম অনুচ্ছেদটা পড়ে বহুকাল আগের একটা দৃশ্য চোখের সামনে ভেসে উঠলো। অগভীর একটা ছোট পুকুরের জল আশ্চর্য রকমের টলটলে। পাড় ঘেঁষে গজিয়ে ওঠা জলমৌরীর লতা পুকুরে হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। পুকুরের স্বচ্ছ জলের তলায় রূপালী চেলী মাছ ঘুরে বেড়ায়। জলের উপরতলে একজোড়া খল্লা মাছ কপোত-কপোতীর হাত ধরাধরি করে হাঁটার মতো ভেসে বেড়ায়। কী মনে করে যেন হঠাৎ তারা শূন্যে লাফিয়ে ওঠে। জলে তাদের ডানা ঝাপটানোর শব্দে চারপাশের নিস্তব্ধতা ভেঙে পড়তে চায়। একলা ভেসে চলা পাতিহাঁস বা পাড় ঘেঁষে হেটে যাওয়া কানি বক সেই শব্দে একটু চমকে ওঠে। আবার সব কিছু আগের মতো শুনশান হয়ে যায়। পুকুরের আয়নায় ফুটে ওঠা নীল আকাশ আর তাতে সাদা তুলোর মতো ছেঁড়া মেঘের দলের সাঁতার কোন শব্দেই চমকে ওঠে না।
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
মন্তব্যে
____________________________
পুরাই!
--------------------------------------------------------
এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।
এক লহমার... টুকিটাকি
পান্ডবদা, ফক্কুড়ির লোভ সামলানো গেল না। এই মন্তব্যটা কান-ঘেঁষে বেঁচে গেল - রিপোর্টিং হতে হতে!
ঠ্যাঙ-টানা সরিয়ে রেখে, আমি আপ্লুত! লেখার একটা বিশেষ সার্থকতা যখন পাঠক তার ভাবনা লেখার খাতে বইয়ে দ্যায়। আপনার মন্তব্যের দ্বিতীয় অংশ গদ্য লেখার ক্লাস খুললে আদর্শ লেখা হিসেবে ধরে ধরে, বিশ্লেষণ করে বোঝানোর মত সৃষ্টি হয়েছে। আমার লেখাটার পক্ষে এ বড় কম প্রাপ্তি নয় গো দাদা!
--------------------------------------------------------
এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।
এক লহমার... টুকিটাকি
আপনার এই সিরিজ শেষ হলে যে বইটা প্রকাশিতব্য সেই বইটার আগাম কাস্টমার হয়ে থাকলাম
-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.--.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.
সকল লোকের মাঝে বসে, আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা? আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?
বই চাই
------------------------------------------------------------------------------------------------------------
“We sit in the mud, my friend, and reach for the stars.”
অলীক জানালা _________
দ্বিতীয় কপিটাই আপনার!
--------------------------------------------------------
এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।
এক লহমার... টুকিটাকি
আমি নাই! প্রথম কপিই আপনার, নীড়ুদাদা!
--------------------------------------------------------
এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।
এক লহমার... টুকিটাকি
____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?
থেঙ্ক্যু, থেঙ্ক্যু
--------------------------------------------------------
এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।
এক লহমার... টুকিটাকি
৩ নাম্বার কপিটা আমার
____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?
কবুল!
--------------------------------------------------------
এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।
এক লহমার... টুকিটাকি
____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?
বাহ
_ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _
একজীবনের অপূর্ণ সাধ মেটাতে চাই
আরেক জীবন, চতুর্দিকের সর্বব্যাপী জীবন্ত সুখ
সবকিছুতে আমার একটা হিস্যা তো চাই
অনেক
--------------------------------------------------------
এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।
এক লহমার... টুকিটাকি
মাসুদ সজীব
--------------------------------------------------------
এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।
এক লহমার... টুকিটাকি
নতুন মন্তব্য করুন