কাল সারাদিন ক্যালিডোস্কোপ ঘুরেছে।
স্মৃতির সরণিতে নানা শাখাপ্রশাখার জাফরি দিয়ে ঝুঁজিয়ে আসা আলো আর অফুরান কুয়াশার ঝাপসা বিস্তার সরিয়ে কত যে টুকরো ছবি!
শিশু তার প্রথম খেলা আবিস্কার করে খাবার নিয়ে, মায়ের বুকে। মায়ের কোল থেকে নামার পরেও হয়ত তার খাবার নিয়ে খেলার সাধ থেকে যায়। আমাদের তিন ভাইয়ের, বিশেষ করে আমার - ছিল। কিন্তু বড় হয়ে গেলে তো খাবার নিয়ে খেলতে মানা, তাই খেলতে হত সাবধানে। আমাদের সেই ছোটবেলায় ভাত খাওয়া হত কাঁসার থালায়। আমি খানিকটা ভাত-ডাল-তরকারী একসাথে মেখে নিয়ে ছোট ছোট গোল্লা পাকিয়ে সার দিয়ে থালার ধার ধরে সাজিয়ে ফেলতাম। তার পর এক এক গরাসে একটা করে গোল্লা। আর খেলাটা চূড়ান্তে উঠত যখন মাকে পাশে বসিয়ে মার হাত থেকে গোল্লা গুলো খাওয়া যেত। অমৃত। আমরা তিন ভাই-ই খেলাটা খেলেছি। আমি খেলেছি বহুদিন ধরে। বিশ্ববিদ্যালয়ের জীবন পার করেও। তার পর আর সে খেলা সম্ভব হয়নি, হবে না আর কোনদিন-ই।
মা খুব সৌখীন মানুষ ছিল। তাঁতের নরম শাড়ী, জবা-কুসুম তেল আর পন্ডস ক্রিমের নিয়মিত যোগান - যাই ঘটুক না কেন বাবার এই ব্যাপারে কখনো ভুল হতনা। আর ছিল বাহারি চিরুনি। কোন কোন বিকেলে মা যখন গা ধুয়ে পাটভাঙা শাড়ী পরে হাল্কা পন্ডসের সুবাসে ঘর ভরিয়ে আলতার শিশি নিয়ে বসত, একঢাল নরম চুলে লাগাত চিরুনির টান, আর আমি তার পায়ের পাতার বেড় ধরে আস্তে আস্তে আলতা-ভেজানো তুলো কি স্পঞ্জের টুকরো দিয়ে রাঙ্গিয়ে তুলতাম দুটি অপরূপ চরণ - সে আনন্দের কোন প্রকাশ আর কোন ভাবেই সম্ভব নয়।
উত্তরবঙ্গের দিনগুলোতে মা ঝলমল করত আবার পড়াশোনার জগতে ফিরতে পেরে। বাড়ির খুব কাছে মেয়েদের এক নামী বিদ্যালয়ে বয়স্কদের জন্য বিশেষ শিক্ষার আয়োজন করা হয়েছিল। প্রতিবছর একসাথে দুটি করে ক্লাস - পঞ্চম-ষষ্ঠ, সপ্তম-অষ্টম, নবম-দশম। পরীক্ষা হত নিয়মিত আর বয়স্ক একসাথে। মা দু’বছর পড়ার সুযোগ পেয়েছিল। দু'বার-ই সবার মধ্যে প্রথম হয়ে উত্তীর্ণ হয়েছিল। বয়স্কদের বিভাগের দায়িত্বে ছিলেন সহ-প্রধান শিক্ষক। ছাত্রীর গুণে মুগ্ধ, অবসরের কাছে পৌঁছে যাওয়া মানুষটি চলে আসতেন আমাদের বাড়িতে। বাবাকে বলতেন তাঁর প্রিয় শিষ্যাটি যেন লেখাপড়া চালিয়ে যেতে পারে সেটা নিশ্চিত করতে। গুরুর সেই উৎসাহ-ভরসা-আবেগ পরবর্ত্তীতে মাকে অনেক কঠিন সাঁকো পার করে দিয়েছিল। আমদেরও।
মা সময় নষ্ট করার মানুষ ছিলনা। মূলধারার লেখাপড়ায় ফিরতে পারার সুযোগ আসার আগে তাই শিখে ফেলেছিল সেই সময়ের মেয়েদের কাছে এক বিশেষ আকর্ষণীয় বিদ্যা - সেলাই মেশিনে সেলাই করা - রীতিমত ‘ক্লাস' করে। বিদ্যেটা সে আয়ত্ব করেছিল চমৎকার ভাবে। ফলে একটা থান কাপড় কেমন ভাবে নানা মাপের টুকরো হয়ে আবার জুড়ে জুড়ে গড়ে ওঠে একটা আহা-মরি-মরি নূতন জামা, ফ্রক কি ব্লাউজ কিংবা ধরো, সেলাই যন্ত্রটার-ই ফ্রিল দেওয়া একটা বাহারী ঢাকনা - সে এক আশ্চর্য মজা। মার সাথে সাথে আমিও হাত লাগাতাম। মা হাতল ঘোরাচ্ছে, সেলাইয়ের কাপড়টা ঠেলে দিচ্ছে সূঁচ-এর নীচের দাঁত-চাপকের মাঝখানে, আমি উল্টো দিকে সমান টানে টেনে নিচ্ছি সেটা আর সাঁই সাঁই করে সূঁচ উঠছে-নামছে। মা একাই আঙ্গুলের টিপে সবটা করতে পারত; কিন্তু সে আমায় জুড়ে নিত তার সৃষ্টিতে, বোঝাপড়ায়। জীবনের কত সেলাই যে একসাথে করেছি আমরা - কখনো আমি এপাশে কখনো মা।
জীবনের এই যৌথ যাপন আসলে মার জীবনমন্ত্র ছিল। শুধু নিজের ছোট্ট সংসারটিই নয়। তার জীবন সংপৃক্ত ছিল আরো বহু জীবনকে জড়িয়ে নিয়ে। তার ভাইদের কাছে মা’র আদরের ডাকনাম ছিল সৌদামিনী। যথার্থই সৌদামিনী। বিদ্যুৎ ত বটেই, প্রয়োজনে ঐ নরম-সরম মানুষটাই একেবারে বজ্র-বিদ্যুৎ! ফলে আশপাশের মেয়েদের সাথে মা’র প্রবল বন্ধুত্ব। আমাদের বাড়িতে তাই বিভিন্ন বয়সের দিদি-কাকি-মাসি-পিসীদের আড্ডা জমত প্রায় রোজ-ই। তাদের কখনো ফিসফিস কখনো কলকল হাসিতে ভেঙ্গে পড়া। কারও হাতে ঊল কাঁটা আর কোলে উলের গোলা, কারও হাতের গোল ফ্রেমে আটকানো রুমালে এমব্রয়ডারীর সূঁচ রঙ্গিন সুতো নিয়ে উঠছে-নামছে, কেউ এনেছে কুলের আচার, বড়ি কি কাসুন্দি, কেউ এসেছে পরামর্শ চাইতে কিংবা শুধুই গল্পের ঝুলি নিয়ে কি কয়েক ফোঁটা লুকোনো চোখের জল মুছে নিতে। সেইসব রঙ্গিন বিকেল অস্ত গেছে বহুকাল।
বড় হতে হতে আমি তার বন্ধু হয়ে উঠে ছিলাম। আমাদের তিন ভাইয়ের সর্ব কনিষ্ঠটি ছোট থেকেই মজার মানুষ। তার কাছেই, তার পরিবারেই মার থেকে যাওয়া। কিন্তু তাকে নিয়ে মা’র ছিল সর্বদার অহৈতুকী উদ্বেগ। মেজ ভাইটি আমাদের পরিবারের অক্ষদণ্ড। যেখানেই থাক, যতদূরেই থাক শেষ দিন পর্যন্তও তার উপর মার ছিল অসীম নির্ভরতা। আর আমি ছিলাম তার গল্প করার, গল্প শোনার সঙ্গী। সেই সাথে ভাইদের দায়িত্ব। দুর্গাপূজার সময় তিন ছেলেকে নিজের হাতে সেলাই করা নূতন জামাপ্যান্ট পড়িয়ে আমার দুই হাতে ছোট দুই ভাইয়ের হাত ধরিয়ে দিত। পিঠোপিঠি তিন ভাই হাতে হাত ধরে চলো। যতদূর যাও। বড় হতে হতে হৃদয়ের সম্পর্কে আমার প্রাপ্তি হয়েছিল আমার দাদাকে, আমার ছোট আরো পাঁচ ভাই আর দুই বোনকে। মার স্নেহে ভিজেছি সকলে।
আমার বিয়ের পর তার এল মহা খুশীর দিন। দীর্ঘদিনের আকাঙ্ক্ষার মেয়েটি এল তার জীবনে। পুত্রবধূ নয়, কন্যা। দুজনের মনন মিলত এক তারে। একসাথে বসে বাংলাদেশের নাটক দেখা! টিভির পর্দা ছোট, একাত্ম আকাশ অসীম। নিয়মতান্ত্রিক মানুষটির এই কন্যার জন্য ছিল অজস্র ছাড়। আমাদের পরবাসে থিতু হতে গিয়ে এই দুটি মানুষের জীবন আলাদা হয়ে গেল। দূরভাষে আমার থেকে এই কন্যার সাথেই হত তার বেশীরভাগ আলাপচারী। আবার এই কন্যা তাকে উপহার দিয়েছিল তার বিশেষ প্রাপ্তি - তার বড় নাতনী। চোখে হারাত তাকে। পরবাস জীবন একেও নিয়ে চলে এসেছিল তার কোল থেকে। আমাদের পরবাসের প্রথম পর্যায়ে একটি বছর মা-বাবা আমাদের সাথে ছিল। ছোট্ট দুই কামরার ঘরে ছোটবড় মিলিয়ে পাঁচটি মানুষ। তার সাথে প্রায়ই নূতন পাওয়া বন্ধুদের নিয়ে ‘তিল ঠাঁই আর নাহিরে’ দীর্ঘ আড্ডাবাজী। এখন সকলি অতীত।
ধীরে ধীরে তিন ভাইয়ের বিয়ে হয়ে নাতিনাতনী নিয়ে ভরা সংসার। প্রত্যেকের জন্য তার নিজস্ব বিচার, নিজস্ব বোধ। কত যে সম্পর্ক! রক্তের, রক্তের বাইরের, হৃদয়ের! বোন-দিদি-পিসী-মাসি-বৌমা-বৌদি-মা-জেম্মা-বেয়ান-ঠাকুমা - বিস্তৃত জীবন তার। ছড়িয়ে ছিল, ছড়িয়ে রইল অশ্রুসিক্ত অনেক জীবনে!
ক্রমাগত নিজেকে মিলিয়ে দেওয়া, বিলিয়ে দেওয়া। তারপর কালের অমোঘ নিয়মে সংসার তাকে ছাড়িয়ে এগিয়ে চলে। শরীর অশক্ত কিন্তু চিন্তা-চেতনা সজাগ, সতেজ। মনোযোগী পাঠক বহমান জীবনপ্রবাহে সংপৃক্ত।
পৃথিবীর অপর প্রান্তের এক ঘাটে ‘সন্ধ্যা' আজ রাতের আকাশে মিলিয়ে গেল।
যদিও হৃদয় ভেঙ্গে আসে, তবু দীর্ঘ যন্ত্রণা আরো দীর্ঘ, আরো জটীল হয়ে পড়ার আগে চলে যাওয়াটা কাঙ্ক্ষিত ছিল - তার নিজের কাছে, তার প্রিয়জনদের কাছেও।
প্রতি শুক্রবারের সন্ধ্যায় যে সময়-সংকেত বেজে উঠত আমার ফোন-ঘড়িতে - একুশে জানুয়ারী, ২০২০-তে তাকে থামিয়ে দিলাম, আর দরকার নেই।
মন্তব্য
ভালো লাগলো পড়ে। গোল্লা বানিয়ে খাওয়ার মজাটা অন্যরকম। আপনার লেখাও সেই রয়ে সয়ে বানানো গোল্লার মতই। তবে চেখে দেখার সুযোগ পাওয়া যায় অনেকদিন পরপর।
ক্লাসের ব্রেকে পড়ছিলাম, কী করে যেন শেষ লাইনটা পড়া হয়নি। আজ আবার পড়তে গিয়ে বুক ভেঙে গেলো এক লহমা।
--মোখলেস হোসেন
অনেক ধন্যবাদ।
বুঝতে পেরেছি।
--------------------------------------------------------
এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।
এক লহমার... টুকিটাকি
মধ্য বয়সে জনক জননীকে হারালে তাঁদের মনে রাখতে সময়- সংকেত থামিয়ে দিলেও মনে রাখার খাতায় তাঁরা থেকে যান খুব মোটা অক্ষরে। সব সময় চোখে লেগে থাকেন, মনে পড়ে থাকেন । মনেহয় ছোট বেলায় তাঁদের যত না প্রয়োজন ছিল এই বড় বেলার প্রয়োজন তার থেকেও বেশি।
আপনার এই বেদনা বিধুর লেখা আমার মন ছুঁয়ে দিল।
ঠিক।
অনেক ধন্যবাদ।
--------------------------------------------------------
এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।
এক লহমার... টুকিটাকি
যে মুহূর্তে মায়ের নাড়ি ছিঁড়ে জগতের আলো দেখেছিলেন সেই মুহূর্ত থেকে ভৌতভাবে তাঁর কাছ থেকে ক্রমশঃ দূরে সরেছেন। কিন্তু চাইলেই কি মায়ের কাছ থেকে দূরে সরা যায়! যে বয়সে সন্তানদের সন্তানেরা পৃথিবীর আলো দেখে ফেলে সেই বয়সেও কখনো কখনো মায়ের ওপর তীব্র অভিমান হতে পারে। মা আসলে কেবল অর্ধসংখ্যক ক্রোমজমে বাস করেন না, তিনি বাস করেন আমাদের সমগ্র অস্তিত্ত্বে।
আপনাকে কোন প্রকার সান্ত্বনা দেবো না। কারণ, এই শোকের কোন সান্ত্বনা হয় না। এই শোক আপনাকে বয়ে বেড়াতে হবে আপনার জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত। যদি প্রার্থনায় বিশ্বাস করেন তাহলে তাঁর জন্য প্রার্থনা করুন। নতুবা এমন কিছু করুন যেটা তিনি বেঁচে থাকলে তাঁকে আনন্দ দিতো।
ভালো থাকবেন।
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
আমার তো প্রার্থনা নেই। শুধুই তাকে স্মরণ। তার যে সাধ পূরণ করতে পারিনি সে হচ্ছে বাংলা সাহিত্যের অধ্যাপক হওয়া। লেখালেখি করে আমার সাধ্যের মধ্যে তার সেই সাধ পূর্ণ করার চেষ্টা। এইটুকুই।
--------------------------------------------------------
এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।
এক লহমার... টুকিটাকি
একটা বই বের হোক তবে।
..................................................................
#Banshibir.
অনেক ধন্যবাদ গো পীরদাদা। কিন্তু
(১) কি গুণমানে কি পরিমাণে - বই বার করার মত লেখা জমা হয়েছে কি?
(২) এই সব একান্ত ব্যক্তিগত, ছোট ছোট ব্লগরব্লগর কে পড়তে যাবে?
--------------------------------------------------------
এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।
এক লহমার... টুকিটাকি
মনটা হু হু করে উঠলো, দুচোখে জলের ধারা আর বাঁধ মানলো না। সান্ত্বনা জানানোর ভাষা নেই, কিছু বলার নেই।
আমারও চোখ ভেসে যাচ্ছে।
--------------------------------------------------------
এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।
এক লহমার... টুকিটাকি
মায়ের জন্য ভালবাসা...
____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?
অনেক ভালবাসা তোমাদের। আছো কেমন তোমরা? শরীর-স্বাস্থ্য ঠিক আছে ত?
--------------------------------------------------------
এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।
এক লহমার... টুকিটাকি
আপনার লেখা থেকে ধারণা করি, একটা পরিপূর্ণ জীবন তিনি কাটিয়ে গেছেন, আপনাদের সবার অসীম ভালোবাসার মধ্য দিয়ে।
আপনার জন্যে কোন স্বান্তনা নেই আসলে। এই কষ্টের কোন সীমা নেই, তবু জানবেন, মা না থাকার কষ্টটাই আমাদের মা হয়ে রয়ে গেছে আমাদের সঙ্গে...।
-----------------------------------
বই,আর্ট, নানা কিছু এবং বইদ্বীপ ।
অনেক ধন্যবাদ।
অন্যের উপর নির্ভর করে,চলচ্ছক্তিহীন হয়ে যে তাকে পড়ে থাকতে হয়নি, এ বড় সৌভাগ্যের - সকলের কাছে। তবুও ... ...
--------------------------------------------------------
এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।
এক লহমার... টুকিটাকি
প্রিয় এক লহমা,
আপনার লেখা পড়ে মনের জানালা ধরে অনেক স্মৃতি হুড়মুড়িয়ে নাড়িয়ে গেল, ঠিক যেন কোন দুরন্ত শিশু আচমকা টুক্কি বলে ওঠে। শৈশবের বাহারি টুকরো-টাকরা নকশা ভেসে উঠলো মনের মুকুরে। কি সব দিন ছিল! ছোটবেলার সেইসব আশ্চর্য দিনগুলো কেন হারিয়ে যায়! শীতের সকালে উনুনের পাশে বসে মায়ের হাতের পিঠার স্বাদ, বিকেলের নরোম রোদে মায়ের কোলে মাথা রেখে গল্পের বইপাঠ শোনা, জ্বরের ঘোরে গভীর রাতে ঘুম ভেঙে মায়ের জলপট্টির ভরসা, রাশভারি বাবার দরবার থেকে ক্রিকেট ব্যাট কেনার আরজি পাশ করিয়ে আনা, শাসনের ভ্রুকুটির আড়ালেও প্রশ্রয়ের দারুণ মিষ্টি চোরা হাসি – কেন যে আবার ফিরে আসে না, জানিনা।
কার কাছে যেন শুনেছিলাম, নিদারুণ শোকের আয়ুও নাকি এক বছর। এসব স্তোতবাক্যে আমার একফোঁটা বিশ্বাস নেই। বাবা চলে গেছেন আজ চার বছর। কই, আজও মাঝে মাঝে নীরব ঘরে তার পাইপের ধোঁয়ার গন্ধ পাই যে! এখনও মাঝে মাঝেই মনে হয় আড়াল থেকে আমার নিমগ্ন পড়া দেখছেন স্মিত মুখে, তাকালেই মুখটা গম্ভীর করে ফেলবেন। এখনও বেসামাল হোঁচট খেলে মনে হয়, এই তো সেই শাসনের কন্ঠস্বর বলে উঠবেঃ ছেলের বাবা হয়েছো, আর হাঁটতে শিখলে না। বিভিন্ন প্রকারের ছেলেমানুষী বাহাদুরী দেখে হাসছেন আর নীরবে মাথা নাড়ছেন।
তাই আপনাকে প্রবোধ দেবো না। নিজেই যে নিজেকে আজও বোঝাতে পারি না, আপনাকে কি বোঝাবো! আপনার লেখাটা পড়ে মাকে ফোন করলাম। বাবার কথা বলে মুঠোফোনের দুপাশে দুটি রক্তস্রোত নীরবে কাঁদলো। মন কি তাতে হালকা হয়! হাজারদুয়ারী মনের যে অগণিত স্মৃতির নিজস্ব ভান্ডার আছে। সুদক্ষ ম্যাজিশিয়ানের মতো, মাঝে মাঝেই অতর্কিতে আমাদের সামনে হাজির যাপিত জীবনের অলৌকিক আনন্দময় কিছু টুকরো ছবি। আমাদেরকে কাঁদিয়েই যেন তার সার্থকতা।
অচিনদেশে পাড়ি দেওয়া আমার বাবা নিজের প্রয়াত মায়ের কথা ভেবে মনভার করে আমাকে যে কথাটি বলতেন, সেটি বলেই আজ থামবো। দেয়ালজোড়া সেই প্রবল ব্যাক্তিত্বময়ী চেহারার, সাদা থানের ঘোমটা দেয়া ছবির সামনে দাঁড়িয়ে বাবা স্বগতোক্তি করতেনঃ মা নেই যার, সংসার অরণ্য তার।
মায়ের অমলিন মমতার ছায়াহীন সংসারে তারপরও ভালো থাকার চেষ্টা করে যেতে হবে, নিদেনপক্ষে আমাদের আত্মজ-আত্মজাদের জন্যে তো বটেই। প্রকৃতির দানে, আমরাও যে মাতা-পিতা হবার অলৌকিক দায়ীত্বের অংশীদার। সৃষ্টির আনন্দযজ্ঞ চলমান থাকতে হবে তো! অগত্যা...
স্বরূপ-সন্ধানী
------------------------------------
অন্ধকারে সব-চেয়ে সে-শরণ ভালো
যে-প্রেম জ্ঞানের থেকে পেয়েছে গভীরভাবে আলো।
সুভাষ মুখোপাধ্যায়-এর অনুবাদে নাজিম হিকমত:
বিংশ শতাব্দীতে মানুষের শোকের আয়ূ বড় জোর একবছর।
বাবা নেই বা মা নেই এই অনুভূতি বাকি জীবনের।
আপনার সহৃদয় সাহচর্যের অনেক ধন্যবাদ।
আপনার বাবাকে হারানোর শোক, জানি একই রকম দুঃসহ। সমবেদনা জানবেন।
--------------------------------------------------------
এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।
এক লহমার... টুকিটাকি
সুভাষ মুখোপাধ্যায় অনুদিত নাজিম হিকমতের আপাত সত্য স্তোতবাক্যটির রেফারেন্সের জন্যে আন্তরিক ধন্যবাদ জানবেন। কোন এক আড্ডায় শুনেছিলাম। অলস ক্রাউডসোর্সিং আর কি।
শাস্ত্র বলে, বাবার মৃত্যুর পর সন্তানের মহাগুরুনিপাতযোগ চলে নিদেনপক্ষে একবছর। সেই সময় সন্তানদের প্রতি গুরুজনদের উপদেশ থাকে সাবধানে চলাফেরা করবার। আমার ক্ষেত্রে মনে হয় মহাগুরুনিপাতযোগ এখনও চলছে। মাঝে মাঝেই মনে হয় জীবনপ্রান্তর থেকে ছায়াদানকারী সুবিশাল গাছটি আর নেই। তাই এইসব নিজস্ব প্রলাপ আপনাদের সাথে ভাগ করে নেওয়া।
আপনার সহৃদয় সমবেদনার জন্যে কৃতজ্ঞতা। আমার মতো অন্তর্মুখী মানুষের জন্যে এটা সত্যিই বড় পাওয়া।
ভালো থাকবেন।
স্বরূপ-সন্ধানী
-------------------------------------------
অন্ধকারে সব-চেয়ে সে-শরণ ভালো
যে-প্রেম জ্ঞানের থেকে পেয়েছে গভীরভাবে আলো
আপনার লেখা অসম্ভব ভালো লাগে। মাঝে মাঝে ভাবি এতো সুন্দর করে লেখেন কি করে। যারাই ভালো লেখে তাদেরই আমার যাদুকর মনে হয়।
---------------------------------------------------
মিথ্যা ধুয়ে যাক মুখে, গান হোক বৃষ্টি হোক খুব।
অনেক ধন্যবাদ, সোহেল। আমার ত আর লেখা আসে না, ভাই! কেমন যেন ছন্নছাড়া লাগে নিজেকে। পুরানো লেখাগুলোয় অজস্র ভুল চোখে পরে। বিষণ্ণ লাগে। তার পরেও যদি আপনাদের ভালো লাগে সে আপনাদের মনের মায়ার খেলা।
--------------------------------------------------------
এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।
এক লহমার... টুকিটাকি
মনের মায়া? কিন্তু সেওতো সব লেখায় খেলতে পারেনা। আপনার যাদুর কলমটার কালি যেন কোনদিন শেষ না হয়।
---------------------------------------------------
মিথ্যা ধুয়ে যাক মুখে, গান হোক বৃষ্টি হোক খুব।
নতুন মন্তব্য করুন