ডিসেম্বর মাসের মাঝামাঝি সময়ে আমারা অষ্টম শ্রেনীতে বৃত্তি পরীক্ষা দিয়েছিলাম । অন্য একটা স্কুলে আমাদের আসন পড়ল । পরীক্ষা দুই দিনে হয়, তার মধ্যে প্রথম দিন পরীক্ষা পরীক্ষা ভাব করে পরীক্ষা দিলাম । পরীক্ষা দিয়ে ভদ্র মানুষের মত হল বের হয়ে বাড়ি চলে আসলাম । পরেরদিন পরীক্ষার পর সবাইকে দেখা গেল বেশ তরল মেজাজে এদিক সেদিন ঘুরে বেড়াচ্ছে । এখানে ওখানে জটলা করে আড্ডা দিচ্ছে । এর মধ্যে দুইটা জটলার সাইজ দেখার মত ।
কাছের জটলাতে গিয়ে মাথা গলিয়ে দিলাম । এখানে আলোচনা হচ্ছে খেলাধুলার বিষয়ে । কালকে আমাদের স্কুলের মাঠে এলাকার অন্য একটা স্কুলের ছেলেদের সাথে ক্রিকেট খেলার ব্যাপারে আলোচনা করছে । আমি তখন ক্রিকেট ভাল খেলতে পারতাম না (এখনো পারি না) তাই সাধারনত ক্রিকেট খেলা হলে আমার ডাক পড়ত না । ফুটবল খেলা হলে অবশ্য অন্য কথা । তবুও মনের ভিতর একটা আশা থেকেই যায়, "আমাকে দলে নিতেও তো পারে" । এই আশায় কিছুক্ষন জটলার মধ্যে থাকলাম । কিন্তু আমাকে ছাড়াই দল ঠিক করে ফেলার পর "এখানে আমার পাওয়ার আর কিছু নেই" মনে করে জটলা থেকে বেরিয়ে আসলাম ।
পাশের জটলার দিকে চোখ পড়ল । এদিকে যখন খেলাধুলার ব্যপারে আলাপ হচ্ছে ওদিকে মনে হয় sophisticated কিছুর আলাপ হচ্ছে, মানে আমি ভাত পেতে পারি মনে করে ঐ দিকে গেলাম । এখানে আলাপের বিষয় বস্তু হল নতুন নতুন গালি । একজন (এই ছেলেই সাধারনত দেশ বিদেশ থেকে গালাগালি শিখে এসে আমাদেরকে শেখায়) একটা একটা করে গালি, তার অর্থ, সঠিক উচ্চারন, উৎস, প্রয়োগ পদ্ধতি ইত্যাদি বলছে, বাকিরা মনযোগ দিয়ে শুনছে । জ্ঞান অর্জন করতে আমি দেশে যাওয়ার নির্দেশ, আর এতো নিজে বয়ে এসে জ্ঞান বিলাচ্ছে । ফিরিয়ে দেয় কোন গাধা । আমি অন্তত না । আমিও মন দিয়ে জ্ঞান আহরন করতে শুরু করলাম ।
গোটা দশেক গালাগাল শেখার পর কোন কারনে জটলাট ভেঙ্গে গেল । আমি আর আমার এক মানসিক ভাবে অসুস্থ বন্ধু (সবাই তাকে পাগলা হাসান নামে ডাকত) স্কুলের গেট থেকে একটু দূরে সরে এসে রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে গল্প করতে লাগলাম । গল্প মানে যা যা এতক্ষন শিখেছি তাই নিয়ে একটা ছোটখাট 'রিভিশন' আর কি । দুজনের মধ্যে কোন একজন প্রস্তাব করল দক্ষতা বাড়ানর জন্য আশেপাশের সবকিছুর উপর গালির প্রয়োগ করা যেতে পারে । এইটা আমাদের ইংরেজি বইতে ছিল । নতুন কোন ইংরেজি শব্দ শিখলে সেটা বিভিন্ন ভাবে যেন বাক্যে ব্যবহার করার চেষ্টা করা হয়, তাহলে ভাষার উপর দক্ষতা বাড়বে ।
প্রথম দিকে আমরা দূরবর্তী লোকজনকে গালাগালি করলাম মৃদু স্বরে । যেমন দূরে আমাদের অপছন্দের এক সহপাঠীকে দেখা যাচ্ছিল, তাকে উদ্দেশ্য করে বলা হল " অমুক শালা একটা x!!~@yz এর পোলা " । "ঠিক বলেছিস, আস্ত @#?!~ " । ইত্যাদি ইত্যাদি । কিছুক্ষন পর গালি দেয়ার মত পাবলিক ফুরিয়ে গেলে আমরা স্কুলটাকে গালাগালি করা শুরু করলাম । যেহেতু নিজের স্কুল না কাজেই গালি দিতে খুব একটা বিবেক দংশন হচ্ছিল না । স্কুলকে গালাগাল করতে করতে কখন যেন গালাগালির বিষয় হয়ে দাঁড়াল স্কুলের মেয়েরা । উল্লেখ্য যে স্কুলটা ছিল শুধু মেয়েদের স্কুল । মাত্র জুত করে দুইটা গালি দিয়ে হাসানের দিকে তাকিয়েছি জবাবের আশায়, এমন সময় বালিকা কন্ঠে কে জানি পাশ থেকে বলে " তুমি অমুক না ? "
মাথা ঘুরিয়ে তাকালাম । স্কুলের পোষাকে আমার সমবয়সী ধরনের এক মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে । হাতে পরীক্ষার সরঞ্জাম দেখে বুঝলাম আজকে সেও আমাদের সাথে পরীক্ষা দিয়েছে । মানে আমাদেরই সমবয়সী । ব্যাজ দেখে বুঝলাম সে এই স্কুলেরই ছাত্রী । আমি তখন মেয়েদের সাথে সামনা সামনি দাঁড়িয়ে কথা বলতেই পারতাম না । বয়ঃসন্ধি কালের রোগ আর কি । পারতপক্ষে পালিয়ে বেড়াতাম মেয়েদের সামনে থেকে । আর আমার কপালেই কিনা এই আপদ লেখা ছিল । স্বাভাবিক অবস্থায় এই মেয়ে আমাকে হঠাৎ করে কিছু জিজ্ঞেস করলে আমি থতমত খাওয়ার কথা, আর আমাকে সে ধরেছে এরকম মোক্ষম সময়ে । আমাদের গালাগালি চর্চা এতক্ষন ধরে শুনেছে কিনা, কে এই মেয়ে, আমাকে কেমনে চিনল ? এখন আমার নামে বাসায় যদি নালিস করে তাহলে তো আমার খবর আছে । ইত্যাদি চিন্তা করে আমি মধ্য ডিসেম্বরে শীতের পড়ন্ত বিকালে ঘামতে শুরু করলাম ।
কোন রকমে বললাম " হ্যাঁ " । মুখ দিয়ে বেশি আওয়াজ বের হয়নি, মাথা নেড়ে পুষিয়ে দিয়েছি ।
তারপর আমাকে জিজ্ঞেস করল, " আমাকে চিনতে পেরেছ ? "
"না" - এইবারো খুব একটা আওয়াজ বের হয় নি, মাথা নেড়ে backup দিতে হয়েছে ।
" আমি সেগুফতা " , সে বল্ল । চিনতে পারলাম না ।
"ও আচ্ছা " বলে হাঁ করে রইলাম ।
হাঁ করে তাকিয়ে আছি দেখে বলল , " চিনতে পারনি , তাই না ?"
আমি আবার মাথা নাড়লাম । মেয়েটা চেহারায় হতাশ ভাব তুলে ধীরে ধীরে কিছুদূর হেঁটে রাস্তায় বাঁক নিয়ে চোখের আড়ালে চলে গেল । বয়ঃসন্ধিকালের অপরিপক্ক মনের আমি বুঝলাম না আমার কি করা উচিৎ ছিল । এই প্রথম একটা মেয়ে আমাকে নিজে থেকে ডেকে আলাপ করল, কিন্তু কি বিচ্ছিরি পরিস্থিতিতে । নিজের কপালকে সদ্য শেখা গালি গুলোর একটা দিয়ে দিলাম ।
**********************
পুনশ্চঃ
এতক্ষন হাসান পাগলা কোন কথা বলেনি । এবার বলল " দোস্ত এইটা কে ? "
" আমি জানি না @~!#(@ " , বললাম আমি ।
" তোকে তো চিনে রে ~+!?(@ "
হাসানের মুখে গালিটা শুনেই আমার মনে পড়ে গেল এই মেয়েটা কে । অনেকদিন আগে একজন স্যারের বাসায় অঙ্ক করতে যেতাম, সেগুফতাও পড়ত । হাসানের উচ্চারন করা শব্দটি ঐ স্যারের নামের সাথে মিলে যায় । " ব্যাটা &!!~~!@ এর পো, এতক্ষন এই গালিটা দিতে পারতা না ? এখন এই গালি দিতেসো ?", হাসানকে বললাম ।
"হ রাস্তা ঘাটে খাচরা কথা কইয়া তোর মত বিপদে পড়ি আর কি "
**********************
পুনঃপুনশ্চঃ
সেগুফতা কোন কালে এই লেখাটা পড়বে কিনা জানি না, পড়তেও তো পারে, বলা যায় না । তাই এই পুনঃপুনশ্চ । যদি কোনদিন এই লেখা পড়া হয় আমাকে একটা মেসেজ দিও । কপালে থাকলে আবার কথা হবে, তবে এই বার চিনতে পারব, কোন অভদ্রতা করুম না
মন্তব্য
লেখা ভালৈছে।
শুভকামনা।
ধন্যবাদ
অনেক দূরে যাব
যেখানে আকাশ লাল, মাটিটা ধূসর নীল ...
এইরকম ধরা টরা দিছিলেন নাকি কোন আমলে? নাকি আপনিই সেগুফতা?
_________________________________
ভরসা থাকুক টেলিগ্রাফের তারে বসা ফিঙের ল্যাজে
_________________________________
ভরসা থাকুক টেলিগ্রাফের তারে বসা ফিঙের ল্যাজে
হুমম!! এটি একটি খোলা চিঠি!!!
=================
দারুন হইসে! এইবার কউ মেয়ে দেখতে কেমন? এতদিন পরও মনে আছে যখন তাইলে তো মনে হয় চলব!
তোমার নিজের ব্যবস্থা তো হইয়াই গেছে। তাই মেসেজ পাইলে অতি সত্বর আমারে ফরোয়ার্ড করে দিয়ো!!
[][][][][][][][][][][][][][][][][][]
ওরে বিহঙ্গ, ওরে বিহঙ্গ মোর,
এখনি, অন্ধ, বন্ধ, কোরো না পাখা।
ইচ্ছার আগুনে জ্বলছি...
আমি জানতাম আপনি এই কথা বলবেন । একবার ভাবসিলাম লেখার মধ্যে সেগুফতার চেহারা-সুরতের বর্ননা দেই । বর্ননা যখন দেই নাই, ধরে নেন অর্ধেক মানবী আর অর্ধেক কল্পনা । তাতেও যদি খায়েশ না মিটে তাইলে বলি । মেয়েটা দেখতে একদম সাধারন, কিন্তু সুদর্শনা । হইসে ? নাকি আরো ডিটেইল বর্ননা চান ?
অনেক দূরে যাব
যেখানে আকাশ লাল, মাটিটা ধূসর নীল ...
ভাল লাগলো।
আফছোছ
বড়ই আফছোছ । তবে ভাল দিকও আছে । ঐদিন কাহিনী চেগিয়ে গিয়েছিল দেখে সেটা নিয়ে একটা ফোঁপরা পোস্ট দিতে পারলাম ।
অনেক দূরে যাব
যেখানে আকাশ লাল, মাটিটা ধূসর নীল ...
মেসেজ পাইছেন?
জানাইয়েন।
-----------------------------------
... করি বাংলায় চিৎকার ...
-----------------------------------
বই,আর্ট, নানা কিছু এবং বইদ্বীপ ।
মেসেজ পাইলে শুধু জানাব না, ঐটা নিয়েও আরেকটা পোস্ট দিমু সচলায়তনে । ঠিক আছে ?
অনেক দূরে যাব
যেখানে আকাশ লাল, মাটিটা ধূসর নীল ...
দুইদিনের এই দুনিয়ার এইসব করে লাভ নাই, ভাই এনকিদু। লাইনে আসেন।।। লাইনে।
---------------------------------
এইটা তো আমার কৈশরের কথা । এর পর কতবার লাইনে আইলাম আর লাইন ছাড়লাম হিসাব আমি নিজেও জানি না । তবে একটা কথা ভাল ভাবে বুঝেছি । লাইনে থাকলে দুনিয়াটা আসলেই দুই দিনের । মাঝে মাঝে বেলাইনে গেলে দুই-দুগুনে-চাইর করা যায় ।
অনেক দূরে যাব
যেখানে আকাশ লাল, মাটিটা ধূসর নীল ...
আহারে !
এইরকম ভুলও মানুষ করে !!
সুদর্শনা একটি মেয়েকে ভুলে যাওয়া একটি ছেলের পক্ষে ঘোর পাপ, জনাব।
লেখা দারুণ হয়েছে।
...........................
সংশোধনহীন স্বপ্ন দেখার স্বপ্ন দেখি একদিন
...........................
একটি নিমেষ ধরতে চেয়ে আমার এমন কাঙালপনা
ধন্যবাদ ।
ছেলে বা বালকেরা এসব ব্যপার সাধারনত মনে রাখেনা । তবে বালক থেকে একবার লোক হয়ে গেলে তখন বিপদ হয়, মাথায় সারাদিন এগুলাই ঘুরে । লোকের পরে আরেকটা অধ্যয় আছে, তখন আর কিছু ঘুরে টুরে না । ইদানিং মনে হয় আমার ঐটা শুরু হয়েছে । কে জানে এটার নাম কি ।
অনেক দূরে যাব
যেখানে আকাশ লাল, মাটিটা ধূসর নীল ...
আশার পিদীম এখনো ত্যাল ধইরা রাখতে পারসে? কত্তবড় পিদীম! পড়ে ভালো লাগলো এনকিদু।
-জুলিয়ান সিদ্দিকী
ধন্যবাদ ।
আমার তেল বেশি, কিন্তু পিদিম টা খালি পড়ে আছে । ঐ লাইনে (পিদিমে) ব্যয় করা হয়ে উঠনি ঠিক মত । পিদিমে তেল দেয়ার অভ্যাস থাকলে এই ঘটনাটা অন্যভাবেও লেখা হতে পারত । তবে পরেও পিদিমে তেল দেয়ার সুযোগ পেয়েছিলাম, তখনও দেয়া হয়নি । সে আরেক গল্প, পরে একদিন লিখব ।
এখন মাঝে মাঝে ভাবি, তেল সব ইঞ্জিনে না ঢেলে পিদিমে একটু আধটু ঢালতে পারলে মনে হয় মন্দ হত না ।
অনেক দূরে যাব
যেখানে আকাশ লাল, মাটিটা ধূসর নীল ...
নতুন মন্তব্য করুন