[মুল গল্প বা গল্পগুলো পড়েছিলাম সম্ভবত মাধ্যমিক পরীক্ষার পর। গল্পগুলো এতো ভাল লেগে গিয়েছিলো যে, সেইগুলি পরেবহুবার বলেছি।সব সময়ই মুল শ্রোতা ছিলো ভিন্ন ভিন্ন কিন্তু একজন শ্রোতা থাকতো কমন। সেই কমন শ্রোতা আমার প্রানপ্রিয় গিন্নী একদিন বললো - "জানো,তুমি প্রতিবারই গল্পগুলো বদলিয়ে ফেল।" আমিও লক্ষ্য করলাম - ঠিকই। শ্রোতা আর সময়ের উপর নির্ভর করে কখনও একাধিক গল্প এক করে বলি - কখনও বা একটাকেই ফেনিয়ে বলি। বিষয়টা ডারউইন সাহেবের অভিযোজন তত্ত্বের সাথে কেমন করে যেন একাত্ব হয়ে যাচ্ছে। আবারও পরিবর্তনের আগেই গল্পের সর্বশেষ ভার্সানের উপর একটা সময়ের সীল মোহর করে দেওয়া বাসনা থেকেই আজকের লেখা। এবার তাইলে মুল গল্পে আসা যাক।]
একজন টাউট কিসিমের লোক এক গ্রামে বাস করতো। ছোটখাট মিথ্যা বলা, মানুষ ঠকানো আর মানুষের মধ্যের ঝগড়া লাগানো ছিল তার প্রিয় কাজ। যেহেতু বড় ধরনের অপকর্ম করতো না - তাই গ্রামবাসী তাকে সহ্যই করতো। কিন্তু এক সময় ওর উপদ্রপ এতো বেড়ে গেলো যে, গ্রামবাসী অতিষ্ঠ হয়ে তাকে গ্রাম থেকে তাড়িয়ে দিলো। টাউট আর কি করবে, গ্রামের শেষ প্রান্তে একটা রাস্তার পাশে বসে ভাবতে লাগলো। এরই মধ্যে একজন সাধক তার দলবল নিয়ে সেই রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিলো। টাউট ভাবলো - ভালই হলো, সাধুর পিছনে হাটা শুরু করি। পরের গ্রামের গেলে নিশ্চয় আমাকে মানুষ সাধুই ভাববে।
দিন যায়, মাস যায় - টাউট সাধুর দলের সাথে হাটে আর হাটে।
এভাবে একসময় ওরা অচিন এক রাজ্যে চলে এলো। আস্তানা গেড়ে সাধু আর তার দলবল খাবারের আয়োজন শুরু করলো। সাধু নতুন শিষ্যকে নির্দেশ দিলো বাজারে যেতে। নতুন শিষ্য বাজার থেকে ফিরে মহা উল্লাসে জানালো - সে রান্নার জন্যে তেলের বদলে ঘি কিনে এনেছে। কারন এই রাজ্যে তেল আর ঘিয়ের দাম সমান। এমনকি মুড়ি আর মুড়কি, চিনি আর মিছরি সবই একই দামে বিক্রি হয়। এই দেশের রাজার নির্দেশে এই ভাবে বাজারে বেচাকেনা হয়।
শুনামাত্রই সাধু তার শিষ্যদের দ্রুত পাততাড়ি গুটাতে নির্দেশ দিলেন । সব শিষ্যই বিনা বাক্য ব্যয়ে নির্দেশ পালনে লেগে গেলেও নবদীক্ষিত শিষ্যটি রাজী হলো না। এই বিষয়ে সে সাধু মতামত জানতে চাইলে - সাধু শুধু বললো - "যে দেশে মুড়ি আর মুড়কি এক দরে বিক্রি হয় - মানুষ সেই দেশে নিরাপদ নয়।"
সাধুসহ সবাই চলে গেলেও নবদীক্ষাপ্রাপ্ত শিষ্যটি মনে আনন্দে লোকালয়ের দিকে চলে গেল।
(২)
এক চোর চুরি করতে গিয়ে বাড়ীর জানালা ভেঙ্গে মারাত্বক আহত হয়ে মৃত্যু শয্যায়। খবর গেল রাজ দরবারে - শুনে রাজা মহা রাগী - নির্দেশ দিলেন তাকে রাজ দরবারে হাজির করা হোক। রাজা ভাবতেই পারছিলেন না - তার দেশে বিনা বিচারে একটা মানুষ মারা যাবে! যথারীতি রাজদরবারে আহত চোর হাজির। তাকে জিজ্ঞাসা করা হলে তার দুরবস্থার জন্যে জানালা বানানো ছুতারকে দায়ী করলো। সেই দেশের আইন অনুসারে হত্যা বা হত্যার চেষ্টার শাস্তি মৃত্যুদন্ড। রাজা আগামী প্রত্যুষে সেই ছুতারকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদন্ডের আদেশ দিলেন। পুরো রাজযন্ত্র সেই নির্দেশ বাস্তবায়নে নেমে পড়লো। একদল কর্মচারী গেল ফাঁসীর মঞ্চ বানাতে, আরেকদল গেল সেই ছুতারকে ধরতে। ছুতারকে ধরে নিয়ে যাওয়া হলো ফাঁসির মঞ্চ নির্মানস্থলে - কারন তার উচ্চতা অনুযায়ী ফাঁসীর কাঠামোটা বানাতে হবে। এইটাই নিয়ম - একজনকে একটা মঞ্চে ফাঁসী দেবার পর কাঠামোটি নদীতে ফেলে দিতে হয়।
যখন মাপ অনুসারের মঞ্চ বানানো হলো - তখন দেখা গেল ছুতার বেচারা হাউ মাউ করে কাঁদছে আর বলছে - "আমাকে ভুল করে ফাঁসী দেওয়া হচ্ছে, আমি অপরাধী না।"
কথাগুলো রাজার কানে গেল - রাজা আবার চিন্তিত হলেন। কারন তার রাজ্যে অন্যায় বিচার, ভাবাই যায় না! তাই ছুতারকে ডাকা হলো রাজদরবারে। ছুতার বললো - "জাঁহাপনা, আমার কি দোষ? আমি জীবনে অনেক জানালা বানিয়েছি, কিন্তু আর একট জানালাও ভাঙ্গেনি। এটা ভেঙ্গেছে, কারন আমি যখন কাজ করছিলাম, তখন পাশের বাড়ীর সুন্দরী বৌ'য়র দিকে চোখ চলে গিয়েছিলো।"
রাজা ভাবলেন - তাইতো, দোষী তাহলে পাশের বাড়ীর সুন্দরী বৌটা।
এবার রাজা বললেন - বৌটাকেই ফাঁসিতে ঝুলানো হোক।
পাইক-পেয়াদা যখন বৌকে ধরতে গেল, সে বললো - "দেখো আমি আসলে সুন্দরী না। সেইদিন আমি লাল শাড়ীটা পড়েছিলাম বরেই আমাকে সুন্দর লাগছিলো।" নমুনা হিসাবে সে লাল শাড়ীটাও দেখালো।
সবাই আবার রাজার কাছে গেল। রাজা বললেন - "যথার্থ, যে তাঁতী লাল শাড়িটা বানিয়েছে, তাকেই তাইলে ঝুলাও।"
তাঁতীটাকে ধরে ফাঁসীর মঞ্চের দিকে নিয়ে যাওয়ার সময় - সে হৈ চৈ করে বরলো- আরে আমি কি লাল শাড়ী বানাই নাকি? আমি তো বানাই সাদা শাড়ী। লাল রঙতো করেছে জোলা।
ততক্ষনে গভীর রাত - রাজা মদিরারসের আবেশে ঝিমুচ্ছে আর ঠুমরী উপভোগ করছিলেন।
তারপর ন্যায় বিচার বলে কথা - রাজার নির্দেষে জোলাকে ফাঁসীর জন্যে নিয়ে যাওয়া হলো। আসন্ন মৃত্যুর ভয়ে জোলা বাকরুদ্ধ - তাই তারপক্ষে আর কোন বিতর্ক তৈরী সম্ভব হলো না।
কিন্তু সমস্যা হলো অন্য জায়গায়। জোলা মহাশয় ছিলো বেশ লম্বা। যখন তাকে মঞ্চে দাড় করানো হলো - দেখা গেল তার গলা উঠে গেল আড়া কাঠে উপড়ে। কোন কোন ভাবেই তাকে ঝুলানো যাচ্ছে না। মহা ফ্যাসাদে পড়ে গেল রাজন্যবর্গ।
একজন ভয়ে ভয়ে রাজার কানের কাছে কথাটা বললো। রাজা শুনে মহারাগী হয়ে গেল। বললো - "তোমরা সবাই অপদার্থ। সকাল হবার আগেই একজনকে ফাঁসী দিতেই হবে। যাও, একজন সুবিধামতো লোককে এনে ঝুলাও।"
রাজার আদেশে রাজকর্মীরা ছুটলো গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে। অবশেষে পাওয়া গেল একজন। বেশ নাদুসনুদুস। সে যেন কি বলতো চাচ্ছিলো - কিন্তু তার ভাষা বুঝলোনা রাজকর্মীরা। মনে হলো ভিন দেশী সে। তার ভাষা বুঝার মতো কাউকে পাওয়া গেল না - যারা কিছুটা বুঝতো - তারা ভয়ে সামনে এলো না। ভিন ভাষায় হৈ চৈ করতে করতে লোকটা ফাঁসী ঝুলে গেল।
(৩)
দীর্ঘদিন পর সাধু তার দলবলসহ সেই রাস্তা দিয়ে ফিরে যাচ্ছিলো। কৌতুহল বসত দলবলে সাধু থেমে তার ফেলে যাওয়া শিষ্যের কথা জানতে চাইল স্থানীয়দের কাছে। তাকে বলা হলো তার শিষ্যকে মৃত্যুদন্ড দেওয়া হয়েছে। সাধু বিস্তারিত জানতে না চেয়ে শুধু জিজ্ঞাসা করলো - "এখনও কি তোমাদের এখানে মুড়ি আর মুড়কি এক দরে বিক্রি হয়?"
মন্তব্য
কিন্তু আমরা তো তা চাইনি । নাইন-ইলেভেন তা হলে
কি পরিবর্তন সাধন করলো ?
ইলিয়াস ভাই
গল্পতো গল্পই !
লেখতে চাই ..কিন্তু কি লিখবো?
আর গল্পই তো সমাজ / স্বজন/স্বদেশ
হুমম
আপনার কথা অস্বীকার করার উপায় নেই।
লেখতে চাই ..কিন্তু কি লিখবো?
কিছু কিছু জিনিস বোধহয় কখনো পুরোনো হয়না।
আগে শোনা।তাও ভাল লাগলো।
---------------------------
দুঃখ সুখের স্পর্শ নীরে
সাঁতরে বেড়াই;
নিঃসংগ এক,নিঃসংগ মেঘ।
---------------------------------
বাঁইচ্যা আছি
শোনা গল্প নতুন কাঠামোতে পড়লাম। ভাল লাগল।
আপনাকে এখানে দেখে ভাল লাগছে খুব!
**********************************
যাহা বলিব সত্য বলিব
**********************************
যাহা বলিব, সত্য বলিব
পুরোনো গল্পটা আবার নতুন করে মনে পড়ে গেলো।
ভাল্লাগলো।
...........................
সংশোধনহীন স্বপ্ন দেখার স্বপ্ন দেখি একদিন
...........................
একটি নিমেষ ধরতে চেয়ে আমার এমন কাঙালপনা
একটু লবণ দিয়ে চর্বিত চর্ব্ব্যনটুকু স্বুসাদু লেগেছে। লবণের কারণে ধক ও হয়েছে বেশ!
বাংগালী দাঁত থাকতে দাঁতের মর্যদা বোঝে না।
সম্ভবত ডঃ মুঃ শহীদুল্লাহ বলেছিলেনঃ- যে দেশে গুনের কদর নেই সে দেশে গুনী জন্মাতে পারে না। ঠিক বললাম কি?
--------------
কালবেলা
লেখক এস্কিমো কথক এস্কিমোর জন্য একটা মুশকিলই ডেকে আনল বলে মনে হচ্ছে। এই গল্পগুলো বলবার সময় আর আগের মতো সৃজনশীল হওয়া হয়ত সম্ভব হবে না কথকের পক্ষে। লেখক এস্কিমোর এই পাঠটার একটা প্রতিরূপ কথকের মাথায় জায়গা করে নিয়ে ওখান থেকে কেবলই শাসনের তরবারি ঘুরাবে।
................................................................
আমার সমস্ত কৃতকর্মের জন্য দায়ী আমি বটে
তবে সহযোগিতায় ছিল মেঘ : আলতাফ হোসেন
... ... ... ... ... ... ... ... ... ... ... ... ... ... ... ... ... ...
কচুরিপানার নিচে জেগে থাকে ক্রন্দনশীলা সব নদী
আপনে তাইলে বলছেন - একটা গল্পের কথকের মৃত্যু হলো।
লেখতে চাই ..কিন্তু কি লিখবো?
গল্প আগে শুনি নাই। বেশ ভাল হইছে
-
কৈলাশ
চমত্কার!!!
আগে পড়েছিলাম - 'ঘি আর তেলের দাম সমান' ফরম্যাটে।
এটাও ভালো লাগলো ।
। আমি যে গল্পটা পড়েছিলাম তার শেষটায় শিষ্য বেঁচে ছিল-মানে নিজের বুদ্ধির জোরে অন্য একজনকে ফাঁসিতে ঝোলানোর প্রক্রিয়ায় সফল হয়েছিল আর শেষমেষ গুরুর সাথে পালিয়েছিল রাজ্য ছেড়ে। ব্যাপার না! গল্প তো গল্পই-গল্পের শিক্ষাটাই আসল
দেবদ্যুতি
নতুন মন্তব্য করুন