সেইতো অনেক দিন হয়ে গেল - প্রায় সাড়ে তিন দশক। এতোদিন পর আপনাদের টমির গল্প বলতে হবে এমনটা কখনও ভাবিনি। টমি যে কখন - কিভাবে আমাদের বাসায় এসেছিলো মনে নেই। এটা মনে রাখার মতো কোন ঘটনাও না। কিন্তু টমির অস্তিত্ব - বিশেষ করে আমাদের পরিবারের একজন হয়ে বসবাস করার কাহিনীটা অবশ্য একটা বিষয় বটে।
ও হো! আমি তো টমির কাহিনী শুরু করে দিলাম আর বেচারা টমির সাথে আপনাদের পরিচয়ই করিয়ে দিলাম না। এইটা ঠিক হলো না! টমি ছিলো আমাদের পরিবারের একমাত্র পোষা কুকুরের নাম। প্রথম দিন থেকেই মাঝারি গড়নের ধপধপে সাদা কুকুরটা ছিল আমাদের পরিবারের সবার পছন্দ (অবশ্য মা'র পছন্দের ছিলো না - মা ওজু নষ্টের ভয়ে ওকে এড়িয়ে চলতো)। একটা ছোট্ট বাচ্চা কুকুর ধীরে ধীরে আমাদের পরিবারে মিশে গিয়ে ছিলো। রাতে বিরাতে কোন মানুষের পক্ষে আমাদের বাসার কাছ দিয়ে টমির সম্ভাষন না শুনে যাতায়াত সম্ভব হতো না। বিশেষ করে আব্বার রাতে চলাফেরার একান্ত অনুগত সহচর ছিলো টমি। সকালের নাস্তায় রুটি, দুপুরে ভাতের মাড় আর রাতে উচ্ছিষ্ট ছিলো টমির জন্যে বরাদ্ধ।
টমি আমাদের সাথে বসবাস করার করার সময়ই দেশ উত্তাল হলো - এলো একাত্তর। ঢাকা আক্রান্ত হলো। দেশের সকল স্কুল কলেজের সাথে আমাদের স্কুলও বন্ধ হয়ে গেল। আমরা সবাই বাসায় বসে অলস সময় কাটানো শুরু করলাম। সেই সময়ই টমি আমাদের খেলার সাথী হয়ে উঠেছিলো। সবার ঘরের বাইরে যাওয়া নিষেধ। তাই বাসার বারান্দায় টমিকে নানান কসরত শেখাতে ব্যস্ত হয়ে গেলেন বড় ভাই বোনেরা। আমরা ছোটরা তালি দিয়ে উতসাহিত করতাম। এভাবে হৈ চৈ আর আনন্দ করে সময় কাটাচ্ছিলাম।
যদ্দুর মনে পড়ে দিনটি এপ্রিল মাসের কোন একদিন হবে। কারন মার্চের শেষের দিকে ঢাকা থেকে চলে এসেছিলো বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া কয়েকজন পাড়ার ছেলে। এরা মাঠে স্থানীয় যুবকদের নিয়ে প্রতিরোধের প্রস্তুতি নিতো - মার্চপাস্ট করতো। যেদিনের কথা বলছি - সেইদিন দুপুরে বাসার বারান্দা দিয়ে কে যেন দৌড়ে ভিতরে ঢুকে গিয়েছিলো। আমরা ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। টমিও তারস্বরে ঘেউ ঘেউ জুড়ে দিয়েছিলো।
কিছুক্ষন পর পাড়ার কিছু ছেলে আর স্থানীয় যুবকদের একটা দল আমার বাসার সীমানার ভিতরে ঢুকে গেল। তাদের উত্তেজিত ভঙ্গী আর হাতে রামদা আর বল্লম ধরনের অস্ত্র দেখে বোনরা প্রথম চিতকার শুরু করলো - যুবকদের থেকে কেউ একজন আশ্বাস দিয়ে আমাদের ভিতরে পাঠিয়ে দিলো। ভিতরে গিয়ে দেখলাম একটা রুমের দরজা বন্ধ - মা তার সামনে বসে সেলাই মেশিনে কি যেন সেলাই করছে। আমরা কিছুই বুঝতে পারছিলামনা আসলে বাসার ভিতরে কি হচ্ছিলো।
এর মধ্যে পাশের বাসার বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া বড়ভাই ভিতরে ঢুকে গেলো। উনাদের অবশ্য আমাদের বাসায় অবারিত প্রবেশাধিকার ছিলো। উনি ভিতরে এসে মার কাছে জানতে চাইলো - "খালাম্মা, বাসার ভিতরে কি কোন লোক ঢুকেছে ?"
মা কোন উত্তর না দিয়ে শুধু উনার দিকে একবার তাকালো। মার তাকানোর ভঙ্গীতে একটা বিরক্তির ভাব ফুটে উঠেছিলো।
বাইরের ঘরে আব্বা একটা বই পড়ছিলেন। উনি এমন ভাবে পড়ছিলেন - মনে হচ্ছিলো উনি জগত সংসারের থেকে উনি বিচ্ছিন্ন।
কিছুক্ষন ভিতরে থেকে যুবকদের দল বিফল মনে চলে গেলো।
ওদের চলে যাবার পর আব্বা উঠে একটা জলন্ত কুপী বাতি নিয়ে বন্ধ ঘরটাতে গেলেন। তখন এমনেতেই বিদ্যুতের ব্যবস্থা ছিলো না - তাই একটা কুপি বাতির আলোতে বাসার সবচেয়ে বড় চালের ড্রামটা খুললেন। আমরা অবাক হয়ে দেখলাম ভিতর থেকে একটা জলজ্যান্ত মানুষ বেরিয়ে আসছে - আরে এতো শের আলী ভাইএর বাবা, এর ভিতরে ঢুকলেন কিভাবে!
ড্রাম থেকে বেরিয়ে উনি - আব্বাকে উদ্দুতে কিছু বলছিলেন, যার অর্থ আমরা বুঝতে পারিনি। তবে যা বুঝতে পারলাম - আব্বা সেই রুমটা আপাতত উনার জন্যে বরাদ্ধ করে দিলেন। আমাদের কিছুটা মন খারাপ হলো - কারন এখন সবাইকে অন্যরুমে গাদাগাদি করে ঘুমাতে হবে ।
(২)
গল্পের এই পর্যায়ে মনে হয় শের আলী ভাইকে পাঠকের সাথে পরিচয় করিয়ে দেওয়া দরকার মনে করছি। ছিপ ছিপে গড়নের উঠতি যুবক শের আলীর গায়ের রং কালো। শায়েস্তাগঞ্জ রেলকলোনীর যেই দিকটায় থাকতাম - সেখানে রেলওয়ের একটা নিজস্ব একটা রাস্তা আছে - সেই রাস্তার অপরপার্শ্বে ছিলো বস্তিমতো একটা এলাকায় কয়েকটা বিহারী পরিবার থাকতো। এদের কেউই রেলওয়েতে চাকুরী না করলেও কর্তৃপক্ষের বিশেষ বিবেচনায় ওদের সেখানে থাকতে দেওয়া হতো। সেই বস্তির ছেলে শের আলী ভাই। হা ডু ডু খেলায় বিশেষ দক্ষতার কারনে উনি ছিলেন শের আলী আমাদের কাছে একজন প্রিয় মানুষ ছিলেন। ছিপছিপে শরীর নিয়ে যখন "ডাক" দিয়ে বিপক্ষে সীমানায় যেতেন - তখন আমরা ছোটরা জগত সংসারের সবচেয়ে আনন্দিত মানুষে রূপান্তরিত হতাম - কারন জয় ছিলো আমাদেরই। শের আলীর কারনে আমাদের পাড়া ছিলো হা ডু ডু তে চ্যাম্পিয়ান। তাছাড়াও আব্বার মাছ শিকারী দলের সহকারী হিসাবে শের আলী আব্বার খুবই প্রিয় ছিলো। শীতের রাতে পাঁচ মাইল হেঁটে কোন পুকুরে চারা (মাছের জন্যে বিশেষ খাবার) ফেলে আসতে হবে - শের আলী এক বাক্যে রাজী হয়ে যেত।
যুদ্ধ শুরু হয়েছে তবে তখনও শায়েস্তাগঞ্জে পাকিস্তানী আর্মী যায়নি। ছাত্র-যুবকরা নিশ্চিত যুদ্ধের আশংকায় প্রতিরোধের জন্যে প্রস্তুতি নিতে থাকে। গুজব শুনা গেল, বিহারী পাড়া থেকে সেই যুদ্ধপ্রস্তুতির খবর ও প্রস্তুতিগ্রহনরত ছাত্র-যুবকদের নামধাম কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টে পাঠিয়েছে। সন্দেহভাজনদের ধরার জন্যে সেই ছাত্র-যুবকদের অভিযানের সময় শের আলীর বাবা দৌড়ে আমাদের বাসায় চলে আসে এবং নিশ্চিত আশ্রয় পায়।
তারপর থেকে কয়েকদিন ভদ্রলোক আমাদের বাসায় লুকিয়ে ছিলো শের আলীর বাবা। রাতে আসতো শের আলী আর ওর ছোট ভাই। কিছুক্ষন থেকে চলে যেতো। সেই সময় রুমটিতে আমাদের প্রবেশাধিকার থাকতো না। এভাবে মনে হয় চার বা পাঁচ দিন অতিক্রান্ত হলো। একদিন ভোরে হৈ চৈ শুনে সবার ঘুম ভেঙ্গে গেল। শুনা গেল মিলিটারী শাহজীবাজার পর্যন্ত এসে গেছে। দুই একদিনের মধ্যে শায়েস্তাগঞ্জে চলে আসবে। এই খবর শুনে প্রতিরোধের জন্যে প্রস্তুতি গ্রহনরত ছাত্র-যুবকের দল কোথায় যেন হারিয়ে গেল - (পরে শুনেছিলাম ভারতে চলে গিয়েছিলো মুক্তিবাহিনীতে যোগ দিতে)। সেই সুযোগে শের আলীর বাবা দিনের আলোতে বেড়িয়ে এলো। শের আলী আসলো তার মাকে নিয়ে আব্বাকে শুকরিয়া জানাতে। অনেক কান্নাকাটা করলো। শের আলী কথাগুলোর শুধু একটা লাইন মনে আছে যা - "চাচা, আমার চামড়া দিয়ে জুতা বানিয়ে আপনার পায়ে পড়িয়ে দিলেও আপনার ঋণ শোধ হবে না।" এই বাক্যটার কার্যকরনের ক্ষেত্রে একটা অন্ভুদ চিত্র - একজন মানুষ তার চামড়া নিচ্ছে আর আরেকজন জুতার মাপ দিচ্ছে.......মনে হয় সেই কারনেই লাইনটা মনে আছে এখনও।
(৩)
তারপর আর্মি চলে আসলো। আমরা স্থানান্তরিত হলাম। ঘুরে বেড়ালাম অনেক আশ্রয়ে। অবশেষে শায়েস্তাগঞ্জের বাসায় সেপ্টেম্বরের দিকে ফিরে আসলাম। নিজের আবাসে ফিরে আসার যে কি আনন্দ - তা একটা ছোট্ট মানুষকে কিভাবে আন্দোলিত করে - তা আজও সচেতজ। হবিগঞ্জ থেকে রিক্সায় পুরো পরিবার আর লটবহর নিয়ে দুপুরের দিকে বাসার সামনে নামি। যখন টিভিতে কোন দেশের উদ্বাস্তুদের এক স্থান থেকে অন্যস্থানে যেতে দেখি - তখনই আমাদের সেই রিক্সাভ্রমনের কথা এখন মনে হয় । কয়েকটা লেপ আর তোষক, কিছু পরিধেয় বস্ত্র আর কিছু রান্নার তৈযসপত্র নিয়ে যখন বাসায় গেটের সামনে নামি - হঠাত করে কোথা থেকে টমি এসে হাজির। দীর্ঘ ছয় মাসের উদ্বাস্তু জীবনে টমির কথা মনে হয় কেউ একবারও মনে করেনি - আমি যে করিনি - সেইটা নিশ্চিত। কিন্তু টমি আমাদের ভুলেনি। এসেই সবার কাছে ছুটে গেল, গড়াগড়ি খেল, নানান ধরনের কুঁইকুঁই ধ্বনি তৈরী করলো। আমরা একটু আদর দিতেই সুবোধের মতো বাসার ভিতরে ঢুকে গেল।
গেট পেরিয়ে খানিকটা খোলা জায়গা তারপর পাকা বারান্দা মতো সিমেন্টের চাতাল। সেই খোলা যায়গায় ঘাস গজিয়ে আমাদের মতো ছোটদের গলার সমান উচু হয়ে গেছে। সেই ঘাস সরাতেই পাঁকা টমেটোর গন্ধ, ঘাসের ভিতরে দেখলাম শশা গাছ আর তাতে প্রচুর শশা ধরে আছে। মিস্টি কুমড়া আর চাল কুমড়ার ফলনও দেখা গেল। জঙ্গলে সাপ থাকতে পারে বলে আব্বা সাবধান করে দিলেন। টমি আগে আগে গিয়ে শুকে শুকে আমাদের আমাদের নিরাপত্তা নিম্চিত করছিলো । আমরা ছোটরা যখন এই প্রাকৃতিক প্রাচুর্য্য নিয়ে ব্যস্ত - মা আর বড় বোনরা বাসার ভিতরে যেতে এগিয়ে গেল। হটাত মার একটা তীব্র আর্তনাদ আমাদের সব আনন্দকে ভেঙে খান খান করে দিলো। সবাই দৌড়ে গেলাম মার কাছে। গিয়ে মাকে কিছু জিজ্ঞাসা না করেই বুঝতে পারি, মা কেন এমনভাবে কাঁদছেন। মার দীর্ঘদিনের সাজানো সংসারের কিছু পুরোনো কাপড় আর ভাঙ্গা চিনেমাটির থালাবাসন হয়ে উচ্ছিষ্ট তলানীর মতো মেঝেতে পড়ে আছে । বাসার মুল দরজা ভাঙ্গা। একটা কপাট অর্ধেক হয়ে ঝুলে আছে। শুধু মেঝের উপর কিছু ছড়িয়ে ছিঠিয়ে পড়ে থাকা কাপড় আর বাসনকোসন ছাড়া - ভিতরে পুরোটাই খালি। বাসার সামনে আব্বার সখের ফুল বাগানটা পরিনত হয়েছে বিরাট জঙ্গলে আর তার সে জঙ্গলের ভিতরে দেখা যাচ্ছিলো ভিজে মোটা হয়ে যাওয়া আব্বার প্রিয় লাল বইগুলো।
বিষাদের একটা গভীর কালো ছায়া সবাইকে ঘিরে ধরলো। শুধু আমাদের বাসায় বড় হওয়া মফিজ ভাই বললেন - যা হইছে তা তো আর ফিরানো যাবে না। সবাই ভিতরে যাও, দেখি কি করা যায়। যাই হোক বিকেলের মধ্যে কিছু থালা-বাসন, বিছানা আর মশারী যোগাড় হলো। রাত্রিতে মেঝে উপর পাতা বিছানায় ঘুমিয়ে আমার নতুন জীবন শুরু হলো।
(৪)
শায়েস্তাগঞ্জের নতুন জীবনের দ্বিতীয় দিনের ঘুম ভাংলো টমির চিতকারে। বিশ্রী ভাবে হৈ চৈ করছে টমি। বিষয়টা কি? সকালে চোর আসবে কোথা থেকে। আব্বা দরজা খুলে বেড়িয়ে দেখে শের আলী ভীত ভঙ্গীতে দাড়িয়ে আছে আর টমি ঘেউ ঘেউ করেই যাচ্ছে। আব্বা টমিকে থামালেন। আমরা অবাক - শের আলীতো এই বাসায় পরিচিত এবং টমি ওকে ভালভাবে চেনেও। আজ কি হলো ও শের আলীকে আসতে দিতে চাচ্ছে না!
আব্বার হস্তক্ষেপে অবশেষে শের আলী বরান্দায় এসে দাড়ালো। আব্বা ভিতরে ঢুকে গেলে দরজার ফাঁক দিয়ে উকি দিয়ে দেখি একটা সাদা প্যান্ট নীচের দিকে গুটানো, সাদাশার্ট আর গলায় লাল রুমাল বাঁধা শের আলী বিরক্ত মুখে দাড়িয়ে আছে। আমাদের একজনকে দেখে একটা দেশলাই দিতে বলে প্যান্টের পকেট থেকে একটা সিগারেটের প্যাকেট বের করলো। আমরা সবাই বোকা হয়ে গেলাম , বোনদের একজন বললো - "শের আমাদের বাসায় সিগারেট খাবে!" এর মধ্যে আব্বা এসে গেলেন। বাইরে দাড়িয়ে কিছুক্ষন কথা বলে শের আলী চলে গেল।
ভিতরে এসে আব্বা যা বললেন তার মর্মার্থ হলো - শের আলীদের বাসায় কিছু আসবাবপত্র ও তৈজসপত্র আছে। সেগুলো সে বিক্রি করতে চায়। বিকালে আব্বা রেলের কয়েকজন লালশার্ট পড়া রেলকুলির সহায়তায় আমাদের আসবাবপত্র আর তৈজসগুলি শের আলীর থেকে নগদমূল্যে কিনে আনলেন। মজার বিষয় হলো - এই সবই আমাদের বাসার জিনিস ছিলো।
রাতে খেতে বসে আব্বা মাকে জিজ্ঞাসা করলেন - টমি শের আলীকে দেখে হৈ চৈ করে উঠেছিলো কেনো জানো? মা মাথা নেড়ে নেতিবাচক জবাব দিলে - আব্বা বললেন - "টমি প্রভুভক্ত ও কৃতজ্ঞ। শের আলীরাই যে আমাদের বাসা লুট করেছে - টমি তার স্বাক্ষী।"
(৫)
একসময় ডিসেম্বর মাস আসলো। দেশ স্বাধীন হলো। ইতোমধ্যে অবশ্য টমির সাথে আমাদের আরেকবার বিচ্ছেদ ঘটে। আমরা শায়েস্তাগঞ্জ ছেড়ে অনেকপথ ঘুরে গ্রামের বাড়ী মুনশীগঞ্জে চলে যাই। পরে ফেব্রুয়ারী মাসে আবার বাসায় ফিরে - যথারীতি টমি আমাদের কাছে এসে হাজির। এই বিচ্ছেদের দিনগুলো নিয়ে টমিরও যেমন কোন বিকার ছিল না - নির্বোধ প্রানীটির কৃতজ্ঞতার প্রতি আমাদেরও তেমন ভ্রুক্ষেপ ছিলো না। টমি যথারীতি বাসার বারান্দায় থাকা শুরু করলো। আমরা নতুন দেশে ক্ষতবিক্ষত পরিবারটাকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। আমাদের স্কুল খুলে গেল। আমাদের খেলার মাঠের উপর গড়ে উঠা রাজাকার ট্রেনিং ক্যাম্প সরে গেল - আমরা নিয়মিত খেলা শুরু করলাম। কিন্তু রাস্তার ওপরের বিহারী পাড়াটা আর আগের মতো থাকলো না। দুই-তিনটা পরিবার ছাড়া বাকীগুলো কোথায় যেন চলে গিয়েছিলো। কেউ কেউ বলেছে - শ্রীমঙ্গলে রেডক্রস ক্যাম্পে ওরা আশ্রয় নিয়েছিলো। এর মধ্যে শের আলী ও তার পরিবারও থাকতে পারে। মোদ্দাকথা তারপর শের আলী আর ওর বাবাকে কোনদিন দেখিনি।
(৬)
মুক্তিযুদ্ধ আর তার পরবর্তী সময় আমাদের পরিবারকে অনেক চড়াই উতরাই পার হতে হয়েছে। সেই কঠিন সময়ে আমাদের ইচ্ছায় হোক বা অনিচ্ছায়ই হোক - টমি আমাদের সাথে ছিলো। আমাদের বাসার বারান্দায় থেকে অতন্দ্রপহরীর ভুমিকা নিয়েছে। হয়তো সেই কারনেই টমিকে একটা কঠিন আঘাত পেতে হয়েছে। আমাদের বোনরা বড় হয়েছে - আর পাড়ার বখাটে ছেলেদের নিয়মিত হাটার রাস্তা হিসাবে ব্যবহূত হতো আমাদের বাসার সামনের রাস্তাটা। কিন্তু টমির কারনে সেই রোমিওদের কাব্যিক আচরন ব্যহত হতো হয়তো - তাই একদিন রাত্রে দেখি বারান্দায় রক্ত আর টমি এক কোনে বসে কুই কুই করে কাঁদছে। কাছে আলো নিয়ে দেখি টমির গায়ে বিরাট একটা ক্ষত - কেউ একজন দা দিয়ে কোপ দিয়ে একটা গভীর ক্ষত তৈরী করেছে। এদিকে আব্বা খুবই অসুস্থ। টমিকে পশু হাসপাতালে নিতে অনেক চেষ্টা করি। একজন ছোট মানুষের যা সবচেয়ে বড় অস্ত্র তা হলো কান্না আর অনশনের হুমকী দেওয়া - তাই ব্যবহার করেছি। অবশেষে আব্বার অফিসের পিয়ন কোথা থেকে কিছু মলম আর ব্যন্ডেজ এনে টমিকে ড্রেসিং করে দিয়েছিলো। কিন্তু এতে শেষ রক্ষা হলো না। টমির ক্ষতস্থানে মাছি বসা শুরু করলো। টমি সারাদিন ঘুমিয়ে থাকতো - খাওয়া দাওয়াও ছেগেই দিয়েছিলো। একসময় প্রচন্ড দুর্গন্ধ ছড়ানো শুরু হলো টমির ক্ষত থেকে। ওর সামনে যাওয়াও কঠিন হয়ে গেল।
(৭)
একদিন ভোরে উঠে টমিকে দেখতে গেলাম। কিন্তু হায়, টমি কই? ওর কুন্ডলী পাকিয়ে শুয়ে থাকার যায়গাটা খালি। সারাদিন অপেক্ষা করলাম। - টমি এলো না। এদিকে আব্বার শরীরও ভীষন খারাপ হয়ে গেল। রাতের ট্রেনে আব্বাকে ঢাকা পাঠানো হবে। সবাই সেই আয়োজন নিয়ে ব্যস্ত। টমির মতো পথের কুকুরের জন্যে কারো একটু সময়ও নেই। সেইটাই স্বাভাবিক। রাতে যখন আব্বাকে ট্রেচারে করে বের করা হচ্ছে - সুরমা মেইলে উঠানো হবে - তখন আব্বা আমাকে ডাকলেন। মুখের খুব কাছ গিয়ে আব্বার কথা শুনতে হলো - কারন ডাক্তার কথা বলতে নিষেধ করেছে।
আব্বা জানতে চাইলেন - টমি কি ফিরেছে কিনা?
আমি মাথা নেড়ে না বোধক জবাব দিলাম।
আব্বা বললেন - "টমি জীবনের শেষ দিনে ওর কৃতজ্ঞতা জানিয়ে গেল। কারন আমাদের বাসায় যদি ও মারা যেত তা হলে আমাদের কষ্ট হতো। সেই কষ্টটা থেকে আমাদের বাঁচাতে দুরে গিয়ে মারা গেছে।"
আমার ভিতর থেকে একটা কান্না এসে আমাকে প্রচন্ড ধাক্কা ভাবে আমাকে ঝাকানি দিয়েছিলো। আমি উচ্চস্বরে কেঁদে উঠলে সবাই ধরে আমাকে আবার ট্রেচার থেকে সরিয়েছিলো।
সেই দিনটা ছিল ১৯৭২ সালের ১৫ই ডিসেম্বর। পরের দিন ১৬ই ডিসেম্বর - মুক্ত স্বাধীন পরিবেশে প্রথম বিজয় দিবস পালিত হলো। দারুন আনন্দের পরিবেশ চারিদিকে। কিন্তু আমাদের পরিবারের ছিলো গভীর অন্ধকার আর অনিশ্চিত ভবিষ্যতের যাত্রা শুরু দিন। আমরা শংকিত ছিলাম - আব্বা কি কখনও সুস্থ্য হয়ে ফিরে আসবেন? সংসারের একমাত্র উপার্জক্ষম মানুষটি যদি ফিরে না আসে আমাদের জন্যে ভবিষ্যতের সময়গুলো কেমন হবে? ভাবছিলাম - যদি যুদ্ধটা না হতো - তবে কি আমাদের কঠিন অবস্থায় পড়তে হতো? এই রকমের হাজারো দুঃচিন্তা মনকে বিষন্ন করে ফেলেছিলো। অন্যদিকে টমির অন্তর্ধানে আমাদের বাসায়ও একটা শূন্যতা সৃষ্টি হয়ে ছিলো। এই সব অনিশ্চয়তা আর শূন্যতাকে মাথায় নিয়ে সারাদিন রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়িয়ে যখন দেখি সূর্য্য ডুবে গেছে - তখন অন্ধকার মনে করিয়ে দিলো - আমাকে বাসায় ফিরতে হবে।
অবশেষে অন্ধকারকে ভয় পেয়ে ফিরে এলাম বিষাদময় বাসায় - যেখানে টমি নেই - আব্বাও নেই।
[এই লেখাটা মুলত সহব্লগার জ্বিনের বাদশার অনুপ্রেরনায় লেখা - সুতরাং তাকেই উতসর্গ করে নিজেকে দায়মুক্ত করলাম]
মন্তব্য
হৃদয় নাড়া দেয়া লেখা।
কিছু বলার ভাষা নেই ,,,,
পোস্টটা আবারও এটাই নিশ্চিত করে দিলো যে ৭১ এর ঘাতক-দালালদের কোন প্রাণীর সাথে তুলনা করলে সেই প্রাণীরই অপমান হয়
এমন একটা লেখা উৎসর্গে পাওয়াও ভাগ্যের ব্যাপার ,,,, আমার ব্লগিং জীবন সার্থক ,,,আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ প্রিয় এস্কিমোভাই
========================
যার ঘড়ি সে তৈয়ার করে,ঘড়ির ভিতর লুকাইছে
========================
যার ঘড়ি সে তৈয়ার করে,ঘড়ির ভিতর লুকাইছে
আপনার কাছে আমার কৃতজ্ঞতারও সীমা নেই।
লেখতে চাই ..কিন্তু কি লিখবো?
আমরা জন্মেছি অনেক পরে। ঐসময়ের ঘটনা গুলো শুনলে ভাল লাগে। সেই সময় সম্পর্কে ধারণা হয়। বাবা মার কাছে শুনি সব সময়।
আপনার ঘটনা শেয়ার করার জন্য ধন্যবাদ।
----
স্পর্শ
খুব মনছোঁয়া উপাখ্যান আপনার! আমাদের বেলায় টমি ছিল না, শের আলীর মতো বিশ্বাসঘাতকও ছিলনা। তবে আমাদের পাড়ায় বই বাধনোর দোকানের জয়নাল রাজাকার ছিল। অনেককেই ভুগিয়েছে।
আপনাকে আবার দেখে ভীষন ভালো লাগছে! ভাল থাকবেন এস্কিমো!
**********************************
কৌনিক দুরত্ব মাপে পৌরাণিক ঘোড়া!
**********************************
যাহা বলিব, সত্য বলিব
আমি আছি তো!
লেখতে চাই ..কিন্তু কি লিখবো?
লেখাটা হৃদয় ছুঁয়ে গেছে।
কি মাঝি? ডরাইলা?
ছুঁয়ে যাওয়া নয়
কলজের একপাশ থেকে ঢুকে অন্য পাশ দিয়ে ফুড়ে বের হয়ে যাওয়া একটা লেখা
০২
ছোটবেলা আমার অনেকগুলো কুকুর ছিল
অথবা কুকুর ছাড়া কোনো বন্ধুই ছিল না আমার
এখন মনে হচ্ছে কুকুর নিয়ে লেখা আমার দায়ের পর্যায়ে পড়ে গেছে অনেকদিন...
কী মন্তব্য করবো বুঝতে পারছিনা.. বুকের ভেতরটা একদম এলোমেলো করে দিলেন !
এস্কিমো, নিয়মিত লিখুন
আকতার আহমেদ মৃদুল আহমেদের কথাটাই বলে দিয়েছে! অসাধারণ লেখা, এস্কিমো! অসাধারণ! জ্বিনের বাদশাকে ধন্যবাদ আপনার কাছ থেকে এরকম একটা লেখা বের করে আনার জন্য।
---------------------------------------------
বুদ্ধিমানেরা তর্ক করে, প্রতিভাবানেরা এগিয়ে যায়!
--------------------------------------------------------------------------------------------
বললুম, 'আমার মনের সব কপাট খোলা ভোজরাজজী। আমি হাঁচি-টিকটিকি-ভূত-প্রেত-দত্যি-দানো-বেদবেদান্ত-আইনস্টাইন-ফাইনস্টাইন সব মানি!'
ব্যস্ততার কারনে অনেকিদন থেকেই মন্তব্য করা হচ্ছেনা। কিন্তু এটা পড়ে মন্তব্য না করলে অন্যায় হবে। মন ছুয়ে যাওয়া লেখা। কেন যে আপনি নিয়মিত লেখেন না! অবশ্য নিয়মিত লেখার বদলে যদি অনেক বিরতি দিয়েও এরকম লেখা পাই মাঝে মাঝে তাতেও অনেক ভালো লাগবে। অনেক ধন্যবাদ।
ধন্যবাদ।
লেখতে চাই ..কিন্তু কি লিখবো?
ভালো লাগলো পড়ে
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
অসাধারণ!!!
ধন্যবাদ, এস্কিমো ভাই।
অনেক অনেক ধন্যবাদ।
লেখতে চাই ..কিন্তু কি লিখবো?
নতুন মন্তব্য করুন