ভাষার অর্জন, প্রজন্মের ভাষাপ্রেম
ফকির ইলিয়াস
------------------------------------
শুধু ভাষার সৌন্দর্যই নয়, রাষ্ট্রের অবকাঠামোর সৌন্দর্য, স্খিতিশীলতা এবং শান্তির অব্যাহত ধারা বহাল থাকলে বাংলাদেশও হতে পারে বিশ্বের অন্যতম বিনিয়োগ, পর্যটন এবং বাণিজ্য নগরী। আর সেজন্য রাষ্ট্রীয়, রাজনৈতিক সদিচ্ছার প্রয়োজনীয়তা থেকেই যাচ্ছে। আমি মনে করি, প্রজন্মকে ভাষাপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করতে হলে আগে সামাজিক নিরাপত্তা, শিক্ষার উজ্জ্বলতা দিতে হবে। সকল বাধা সরিয়ে নিতে হবে। শুধু অর্জন নিয়ে বসে থাকলেই চলবে না, অর্থনৈতিক, সামাজিক মুক্তিই দিতে পারে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের শান্তির নিবাস।
যুক্তরাষ্ট্রের ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সিরিজ আয়োজিত একটি সেমিনারের প্রধান আলোচ্য বিষয় ছিল ভাষার অর্জন। একটি ভাষা কী ফসল ফলাতে পারে সে বিষয়ে ভাষা বিশেষজ্ঞরা বক্তব্য রাখছিলেন। একজন স্প্যানিশ ভাষা বিশেষজ্ঞ জিসান রডরিগাস তার বক্তব্যে তুলে ধরেছিলেন, সাহিত্য-সংস্কৃতিতে স্প্যানিশ ভাষার অগ্রগতি এবং আধিপত্যের কথা। তিনি স্প্যানিশ ভাষাভাষী কজন নোবেল বিজয়ী সাহিত্যিকের নাম উলেখ করে বলেছিলেন, এরা স্প্যানিশ ভাষায়ই তাদের লেখাগুলো লিখেছিলেন। তাদের লেখার দক্ষতা, মুন্সিয়ানা, ভাবপ্রকাশ এবং বিষয় নির্বাচন বিশ্বের বোদ্ধা পাঠককে সাড়া দিতে সক্ষম হয়। তারপর স্খান করে নেয় বিশ্ব সাহিত্যে। একটি লেখা যখন নিজ ভাষায় বিশ্ব মানবের পক্ষে, বিশ্বভাষা হয়েই মাথা উঁচু করে তখনো গোটা মানবসমাজ তা গ্রহণে আগ্রহী হয়ে পড়ে। একুশে ফেব্রচ্ছারি এলে বাঙালিরা বাংলাভাষার অর্জন, দেনাপাওনার হিসাবও মেলানোর চেষ্টা করেন। সন্দেহ নেই ১৯৫২ সালে বাংলা ভাষার জন্য রক্ত দিয়ে যে স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার বীজ বপন করা হয়েছিল, তা আজ সুপ্রতিষ্ঠিত হয়েছে। একটি রাষ্ট্র, একটি বৃহৎ জাতি বাংলাদেশ এবং বাঙালি।
একটি রাষ্ট্রে একটি ভাষাই যে সবার মাতৃভাষা হবে, তারও কোনো সম্ভাবনা শতভাগ নিশ্চিত নয়। বাংলাদেশে উপজাতি মানুষের ভাষার দিকে নজর দিলে আমরা সে দৃষ্টাìত্ম পাবো। আর বহুজাতিক-বহুভাষিক ‘মাল্টিকাচারাল কান্ট্রি’ বলে সুপরিচিত যুক্তরাষ্ট্র তো তার বড়ো উদাহরণ। ভাষার স্বীকৃতি দিতে গিয়ে নিউইয়র্কের বোর্ড অফ এডুকেশন বাংলা ভাষাভাষী দোভাষীর ব্যবস্খা করেছে। বিভিন্ন হেলথ ইনস্যুরেন্স, হাসপাতালগুলো গর্বের সঙ্গে সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে রেখেছে-‘আমরা বাংলায় কথা বলি’। বাংলা ভাষার এই অর্জন প্রজন্মের জন্য দ্বার উন্মুক্ত করছে এই বিদেশেও।
আরেকটি গুর“ত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে ভাষার সঙ্গে অর্থনীতির ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। চীন এ সময়ে প্রোডাকশনের ক্ষেত্রে বিশ্বের চারণ ভূমি। তাই বহুজাতিক কোম্পানিগুলো তাদের নিজস্ব শোরুম, নির্মাণ কারখানা তৈরি করছে চীনে। এজন্য এখন যারা যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিজনেস ম্যানেজমেন্টে উচ্চশিক্ষা নিচ্ছে, কিংবা নিতে চাইছে তাদের জন্য চীনা ভাষা অপশনাল করা হয়েছে। এবং অনেক নবিস ব্যবসায়ী নিজ ব্যবসা প্রসারের প্রয়োজনে জাপানি, কিংবা চীনা ভাষা রপ্ত করে নিচ্ছেনও। লক্ষ্য একটিই, বিশ্বে ব্যবসার প্রসারকে হাতের মুঠোয় নিয়ে আসা। চীন, জাপান, হংকং, কোরিয়া প্রভৃতি দেশের বাণিজ্যিক ভবিষ্যৎই তাদের ভাষা প্রসারে বিশ্বব্যাপী ভূমিকা রাখছে। দৃষ্টি কাড়ছে বিলিয়নিয়ার ব্যবসায়ীদের।
ভাষা একটি রাষ্ট্রের সংস্কৃতিকে প্রভাবিত করে গভীরভাবে। যে শিশু ঐ রাষ্ট্রের ভাষার মর্ম মূলে পৌঁছতে পারে, তার লক্ষ্যের পরবর্তী ধাপটি হয় সে ভাষার সংস্কৃতি-ঐতিহ্য সম্পর্কে জানা। যুক্তরাষ্ট্রের স্কুলগুলোতে প্রথম থেকে পঞ্চম গ্রেডের ছাত্রছাত্রীদের একেকটি দেশের উপর বিশেষ এসাইনমেন্ট দিয়ে ঐ দেশ সম্পর্কে পুরো জ্ঞানদানে উদ্বুদ্ধ করা হয়। লক্ষ্যবিন্দু হচ্ছে একজন মার্কিনি যাতে বড়ো হয়ে ঐ রাষ্ট্র, ঐ ভাষার সারটুকু আহরণ করে যুক্তরাষ্ট্রের কল্যাণে কাজে লাগাতে পারে।
দুই.
একটি রাষ্ট্রের ভাষা কি বদলে যায়? ভাষা কি আধুনিক হয়? এসব প্রশ্নগুলো আমরা মাঝে মাঝেই দেখি। বাংলা সাহিত্যে একটি নতুন ট্রেন্ড শুরু হয়েছে ‘কবিতার ভাষা’। বিভিন্ন সাহিত্য সাময়িকী, লিটল ম্যাগাজিনগুলো ‘কবিতার ভাষা সংখ্যা’ প্রকাশ করছে মাঝে মাঝে। একটি ভাষায়, অন্য ভাষার ঘনিষ্ঠ প্রভাব পড়াটা খুবই স্বাভাবিক। বাংলা ভাষায় অনেক ইংরেজি প্রতিশব্দ মিশে আছে, যা এখন আমরা বাংলা বলেই মনে করি।
ভাষার বদলে যাওয়া সম্পর্কে যুক্তরাষ্ট্র অভিবাসী সুইডিশ একজন ভাষা বিজ্ঞানী এডলফ মেকিনসের ভাষ্য হচ্ছে যেহেতু অক্ষর, শব্দগুলো বদলায় না অতএব মৌলিক ভাষা বদলাবার কোনে সম্ভাবনা নেই। যা বদলায় তা হচ্ছে বাক্য গঠনের ধরন। চিত্রকল্পের ব্যবহার এবং বাক্য প্রকরণের গতিবিন্যাস। যে কবি অনুপ্রাস কিংবা নেপথ্য চিত্রের আধুনিক বিন্যাস ঘটিয়ে কবিতা লিখছেন, তিনিই দাবি করছেন তিনি নতুন ভাষায় লিখছেন। যদিও শুধুমাত্র তার বলার ধরনটি বদলেছে। বাংলা সাহিত্যে বিদেশী গল্প, কবিতা, উপন্যাসের ছায়া অবলম্বন করে অনেক গল্প, কবিতা, উপন্যাস, নাটিকা রচিত হয়েছে। মনে রাখতে হবে, একটি অন্যভাষার লেখা যখন পাঠকের মনে দাগ কাটে, তিনি যদি লেখক হন তবে তার আগামী লেখায় এর কিছু প্রভাব পড়তে পারে। প্রজন্ম থেকে প্রজন্মাìত্মরে এভাবেই ছড়িয়ে পড়ছে ভাষার বিবর্তনের আলো। অন্যভাষার দ্যূতিময় সারবস্তুকে নিজ ভাষার পাঠকের জন্য তুলে আনাকে এমন দোষের কিছু বলে, বৃহৎ সাহিত্য ভাণ্ডার বিবেচনা করে না।
বাংলাদেশে গেলো দুই দশকে নামী-দামি বিদ্যালয়গুলোতে ইংরেজি শিক্ষার প্রসার বেড়েছে। বিশ্বের বর্তমান প্রবাহমানতার নিরিখে ইংরেজি শিক্ষা অত্যাবশ্যক বলেই আমি মনে করি। কারণ ইংরেজি শিক্ষার মাধ্যমে একজন শিক্ষার্থী খুব সহজেই সমসাময়িক বিশ্ব স্ট্যান্ডার্ডকে মোকাবিলা করতে পারে। নিজেকে খাপ খাওয়াতে পারে। আর রাষ্ট্রের সর্বক্ষেত্রে বাংলা ভাষার প্রয়োগ সম্পর্কে প্রথমে যে কথাটি আসে, রাষ্ট্রের আইনি প্রক্রিয়া, দলিল দস্তাবেজ এখনো যখন সেই ব্রিটিশ শাসনের ছায়া নির্ভর, সেখানে শুধু ভাষা পরিবর্তনের কথা আসছে কেন? বদলালে তো আমূল বদলে দিতে হবে পুরো দলিলপত্র, প্রক্রিয়া। বিজ্ঞান-প্রযুক্তির কল্যাণে বদলে যাচ্ছে গোটা বিশ্বভাষা পরিস্ফুটনের দৃশ্যকল্প। ছাপা বই প্রকাশনার পাশাপাশি এখন ইন্টারনেটে ই-বুক প্রকাশের প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করেছে পাঠকের তৃষ্ণাকে। এখনো এক সঙ্গে একই সময়ে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে লাখ লাখ পাঠক-পাঠিকা একই বই পড়তে পারছেন। মেধা এবং মনন বিকাশে তাই ভাষার বিস্তার ছড়িয়ে পড়ছে বিশ্বের এক প্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্ত পর্যন্ত।
এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে বাংলা ভাষা, বাংলা সাহিত্য এবং সংস্কৃতির ঐতিহ্যকে যদি ভাষাìত্মরের মাধ্যমে বিশ্বের অন্য ভাষাভাষী মানুষের কাছে ছড়িয়ে দেওয়া যায়। তবেই উপকৃত হতে পারে বাংলাদেশ, বাংলা ভাষা। শুধু ভাষার সৌন্দর্যই নয়, রাষ্ট্রের অবকাঠামোর সৌন্দর্য, স্খিতিশীলতা এবং শান্তির অব্যাহত ধারা বহাল থাকলে বাংলাদেশও হতে পারে বিশ্বের অন্যতম বিনিয়োগ, পর্যটন এবং বাণিজ্য নগরী। আর সেজন্য রাষ্ট্রীয়, রাজনৈতিক সদিচ্ছার প্রয়োজনীয়তা থেকেই যাচ্ছে। আমি মনে করি, প্রজন্মকে ভাষাপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করতে হলে আগে সামাজিক নিরাপত্তা, শিক্ষার উজ্জ্বলতা দিতে হবে। সকল বাধা সরিয়ে নিতে হবে। শুধু অর্জন নিয়ে বসে থাকলেই চলবে না, অর্থনৈতিক, সামাজিক মুক্তিই দিতে পারে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের শান্তির নিবাস।
মন্তব্য
নতুন মন্তব্য করুন