রাজনীতির প্রস্থান তোরণ ও বৈষম্যের পরিধি
ফকির ইলিয়াস
===================================
বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভানেত্রী শেখ হাসিনাকে চিকিৎসালয় থেকে আবার বিশেষ কারাগারে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে। শেখ হাসিনা বলেছেন, তিনি সম্পূর্ণ অসুস্থ। তার কয়েকটি শারীরিক টেস্ট বাকি রেখেই তাকে হাসপাতাল থেকে কারাগারে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে। অন্যদিকে সরকারি ভাষ্য অনুযায়ী, শেখ হাসিনা সম্পূর্ণ সুস্থ। এ জন্যই তাকে কারাগারে পাঠানো হয়েছে।
এসব ঘটনা খুবই জটিল করে তুলেছে বর্তমান সরকার এবং রাজনীতির প্রেক্ষাপটকে। একটি কথা আমরা সবাই জানি, শুধু ভুক্তভোগী রোগীই তার নিজ শরীরের প্রকৃত অবস্থা অনুধাবন করতে পারেন। ডাক্তাররা রোগীর মুখে বিবরণ শোনেন এবং বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় রোগ নির্ণয় করে ওষুধপথ্য দিয়ে থাকেন। সর্বক্ষেত্রেই রোগীর বক্তব্য প্রাধান্য পায়। প্রয়োজন মতো ডাক্তাররা রোগীর কাছ থেকে লিখিত সম্মতিও নেন। এটাই হচ্ছে নিয়ম। কিন্তু সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ব্যাপারে আমরা তার ব্যতিক্রম লক্ষ্য করছি। তিনি বলছেন, তিনি অসুস্খ আর সরকার পক্ষ বলার চেষ্টা করছে তিনি ‘সুস্খ’।
শেখ হাসিনা কোন বাহানা করে হাসপাতালে থাকতে চাইছেন বা চাইবেন এমনটি বাংলাদেশের মানুষ বিশ্বাস করে না। যদি তাই হতো, তবে তিনি বিদেশেই থেকে যেতে পারতেন। অনেক সঙ্কট সামনে আছে, তা জেনেও বাংলাদেশে যাওয়ার জন্য উদগ্রীব হতেন না। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর বিদেশে এসে কীভাবে তাকে দেশে ফিরতে হয়েছিল তা কারও অজানা নয়। তাহলে তিনি কোন মিথ্যা অজুহাতে হাসপাতালে অতিরিক্ত সময় থাকতে চাইবেন তা কোন মতেই বিশ্বাসযোগ্য হতে পারে না। বরং তার ডাক্তারের ভাষ্য অনুযায়ী শেখ হাসিনার শারীরিক অবস্খা ক্রমশ খারাপের দিকেই ধাবিত হতে পারে। কিন্তু এতভাবে বলার পরও বর্তমান সরকার এতে কর্ণপাত করছে বলে মনে হচ্ছে না। যা শেখ হাসিনার প্রতি এই সরকারের অবহেলাকে ক্রমশ দিনে দিনে ষ্পষ্ট করে তুলছে। অন্যদিকে সরকার ব্যস্ত রয়েছে তাদের ‘প্রস্খান তোরণ’ নির্মাণে। আর তা করতে গিয়ে প্রতিদিন চলছে নতুন নতুন পরীক্ষা-নিরীক্ষা। নতুন রাজনৈতিক কুটচালাচালি।
জার্মানি সতর্কবাণী উচ্চারণ করে বলেছে, বর্তমান ক্ষমতাসীনরা হিসাবে ভুল করলে গণতন্ত্রের পথযাত্রা ব্যাহত হতে পারে। জার্মানির সাংসদ প্রতিনিধি দল যারা সম্প্রতি বাংলাদেশ সফর করে গেছে তারা এ বছরের মধ্যেই বাংলাদেশের রাজনীতির আশু পরিবর্তন আশা করেছে। এ রকম সতর্কবাণী আরও কড়া আকারে আসতে পারে এ রকমই ধারণা অনেকের। ইউরোপ আমেরিকার অনেকগুলো দেশ পরিস্খিতি পর্যবেক্ষণ করছে গভীরভাবে।
দুই
বাংলাদেশে যে ভয়াবহ চিত্রটি প্রতিদিন আরও ভয়াবহ তা হলো দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি চাল, ডাল, নুনের দাম বৃদ্ধির চিত্র। ভারত থেকে চাল আমদানির পরও চালের দাম খুব স্খিতিশীল থাকবে না, এমন একটি ভবিষ্যদ্বাণী মাননীয় প্রধান উপদেষ্টা এবং অর্থ উপদেষ্টার মুখ থেকে দেশবাসী ইতিমধ্যেই আকার ইঙ্গিতে শুনেছেন। মাননীয় উপদেষ্টাদের যুক্তি হচ্ছে, বিশ্বের প্রতিটি দেশে অর্থনৈতিক মন্দার চাপ বাংলাদেশেও পড়ছে। ফলে দ্রব্যমূল্যের স্খিতিশীলতা রক্ষা খুব কষ্টসাধ্য ব্যাপার।
কিন্তু বিভিন্ন টিভি চ্যানেল খুচরা ব্যবসায়ীদের দেয়া সাক্ষাৎকারে দেখেছি উপদেষ্টাদের এসব কথা শোনার পরপর তারা বিনা নোটিশেই নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম বাড়িয়ে দিয়েছে। বাংলাদেশ তো সেই দেশ, যে দেশে বাজেটের পূর্বাভাস লক্ষ্য করেই মুনাফাখোর ব্যবসায়ীরা দ্রব্যের মূল্য বাড়িয়ে দেয় ইচ্ছেমতো। কথা হচ্ছে, বাজার নিয়ন্ত্রণে সরকার পর্যাপ্ত ব্যবস্খা গ্রহণ করছে না কেন? কেন বিডিআরের চাল, ডাল বিক্রি প্রকল্পের পাশাপাশি বাজারে মূল্য স্খিতিশীল রাখতে কড়া নজরদারি বাড়ানো হচ্ছে না।
আমরা জানি বিশ্বের তেল, গ্যাস, নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম বাড়ার পাশাপাশি মানুষের শ্রমের মূল্যও বাড়ছে, বেড়েছে। বাংলাদেশে একজন রোজকামলার দৈনিক আয় কত বেড়েছে তাও দেখার বিষয়। উচ্চবিত্ত, উচ্চমধ্যবিত্তদের সাধের প্লট-ফ্ল্যাটের দাম যেমন বাড়ছে তেমনি বাড়ছে ক্রেতাও। কিন্তু দিনমজুরের আয় বাড়ছে না। এই যে বৈষম্যের পরিধি তাই প্রধান অন্তরায় হয়ে দাঁড়াচ্ছে বাংলাদেশের সামাজিক জীবনে। কালো টাকার মালিক হোক আর মুনাফাখোর সাদা টাকার মালিক হোক সবার লক্ষ্য কিন্তু এই সমাজের শ্রমজীবী মানুষকে শোষণ। এই শোষণের মাত্রাটি বাড়ছে। বিভিন্ন সেক্টরে থাকা সুবিধাবাদীরা এই সুযোগে তাদের পুরনো অভিলাষ পূরণে মেতে উঠেছে।
তিন
বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে ভারতীয় সেনাবাহিনীর সাবেক অফিসারদের একটি দল বাংলাদেশ সফরে এসেছিলেন। লে. জে. জ্যাকবের নেতৃত্বে এই দলটির বাংলাদেশ সফর নিয়ে নানা কথা বলছে এবং লিখছে একটি চিহ্নিত মহল। তারা বলতে চাইছে, একাত্তরের নভেম্বর ডিসেম্বর মাসে মুক্তিযুদ্ধের পর্বটিকে ভারত, ‘পাক-ভারত’ যুদ্ধ বলেই ধরে নিয়েছিল। আমার প্রশ্ন হচ্ছে, ভারত কি কখনও বলছে এটা ছিল পাক-ভারত যদ্ধ? না হলে এসব প্রো-রাজাকার তাত্ত্বিকরা ঘোলাজলে মাছ শিকারের চেষ্টা করছেন কেন?
এসব তাত্ত্বিক আরও বলেন, আমন্ত্রণ জানালে বিজয় দিবসে জানানো উচিত ছিল। স্বাধীনতা দিবসে নয়। এর কারণ কি হতে পারে?
বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনীকে সার্বিক সাহায্য করেছে ভারতীয় মিত্র বাহিনী। স্বীকৃতি দেয়ার পর সহযোগিতা প্রকাশ্যে দেয়া হয়েছে।
ভারত বাংলাদেশকে স্বাধীন করে দেয়নি ঠিকই, কিন্তু সবধরনের সহযোগিতা দিয়ে স্বাধীনতা ত্বরান্বিত করেছে। সেই কৃতজ্ঞতাবোধ টুকুও নেই আমাদের? তা জানাতে গেলেও গা-জ্বালা ধরবে তথাকথিত ডানপন্থি বুদ্ধির ঢেঁকিদের?
রাজনীতিতে আমরা শুধু সম্মুখ তোরণই দেখেছি এতদিন। এখন দেখছি প্রস্খান তোরণও। এই তোরণ দিয়েই বেরিয়ে গিয়ে পথ প্রশস্ত করে দিতে হবে গণতন্ত্রের। বৈষম্যের পরিধি কমিয়ে আনতে হবে। কাজটি মোটেই সহজ নয়। সেনাপ্রধান মইন উ আহমেদের আমন্ত্রণে ভারতীয় সাবেক সেনারা বাংলাদেশ সফরে এসে অনেক অজানা কথা বলে গেছেন। আর এ জন্যই রাজাকারদের দোসর লেখক বুদ্ধিজীবীরা নাখোশ হয়েছে। এটাও তাদের অপকৌশল মাত্র।
-----------------------------------------------------
দৈনিক সংবাদ । ৪ এপ্রিল ২০০৮ শুক্রবার প্রকাশিত
মন্তব্য
ওদের বলা উচিত অপবুদ্ধিজীবী
~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
টাকা দিয়ে যা কেনা যায় না, তার পেছনেই সবচেয়ে বেশি অর্থ ব্যয় করতে হয় কেনু, কেনু, কেনু?
সুন্দর নাম দিয়েছেন
রাজাকারদের কোন কৃতজ্ঞতাবোধ নেই। এরা ভিক্ষেও করবে, আবার ভিক্ষেদাতার সমালোচনাও করবে। এটাই স্বাভাবিক!
**********************************
যাহা বলিব সত্য বলিব
**********************************
যাহা বলিব, সত্য বলিব
দু:খজনক হচ্ছে , এরা এখনো আমাদের দেশমতৃকাকে সম্মান করে না।
নতুন মন্তব্য করুন