বাংলা কবিতার মূলধারা : বিবর্তনের স্পন্দন
ফকির ইলিয়াস
==================================
বাংলা কবিতার মূলধারা কী, সে সম্পর্কে বিভিন্ন উদাহরণ উপস্থাপন করা যেতে পারে। তবে সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে বাংলা ভাষাভাষী মানুষ আত্মিকভাবে যেসব পঙ্ক্তিমালাকে গ্রহণ করে নিয়েছে, সে সময়ে সেগুলোই হয়ে উঠেছে বাংলা কবিতার মূলধারা।
বৈষ্ণব পদাবলি, ধর্মীয় শ্লোক, চর্যাপদ -থেকে শুরু করে এক সময়ে খনার বচনের মতো পঙ্ক্তিও মুখে মুখে ফিরেছে। জননন্দিত হয়েছে। লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে, কালে কালে কিন্তু কবিতার ধারা বদলে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পাঠক-পাঠিকার রুচিও বদলেছে। গ্রহণ এবং বর্জনের স্রোতের মধ্যেই নির্মিত হচ্ছে এবং হয়েছে সব নতুন বিবর্তনের স্পন্দন।
একজন মরমি কবি বাউল সাধক ফকির আরকুম শাহের একটি গান এক্ষেত্রে প্রণিধানযোগ্য। ‘তুমি আমি, আমি তুমি জানিয়েছি মনে/বিচিতে জন্মিয়া গাছ বিচি ধরে কেনে/এক হইতে দুই হইলো প্রেমেরই কারণ/সে অবধি আশিকের মন করে উচাটন/বন্ধু নিরধনিয়ার ধন/কেমনে পাইমুরে কালা তোর দরশন।’
বীজ থেকে গাছ জন্ম নেয়। আবার সেই গাছই ধারণ করে নিজের বীজ। এই বিজ্ঞানসম্মত ‘রিসাইক্লিং প্রসেস’, সে চেতনা উঠে এসেছে একজন মরমি সাধকের পঙ্ক্তিমালায়। আমার মতে, এ চক্রাকারে ঘূর্ণনের মাধ্যমেই নির্মিত হচ্ছে- হয়েই যাচ্ছে; একটি ভাষা সাহিত্যের, কবিতার মূলধারা।
বেশিদূর না গিয়ে তিরিশের দশকের পঞ্চকবির সাধনার কথাই ধরা যাক। পাঁচজনের মধ্য থেকে টিকে থেকেছেন সর্বজনীনভাবেই জীবনানন্দ দাশ। রবীন্দ্র ছায়া-পরবর্তী সময়ে বাঙালি পাঠক তার কাব্যরুচিকে বিভিন্নভাবে আস্বাদনে ব্রতি হয়েছে।
জনপ্রিয় সমিল ছন্দের কবিতা লিখে জসীমউদ্দীন ‘পল্লীকবি’ খ্যাতি পেয়েছেন। বেগম সুফিয়া কামাল পৌঁছে গেছেন বাঙালির ঘরে ঘরে। আরো স্পষ্ট করে বলতে গেলে সেই কালই সহায়ক হয়ে এসব কবির খ্যাতিকে শিখরে পৌঁছিয়েছে। সেসব কবিতা কি বাংলা কবিতার মূলধারা অংশ নয়?
পঞ্চাশের দশকে বাংলা কবিতায় নতুন বাঁক নির্মাণের চেষ্টা আমরা গৌরবের সঙ্গে লক্ষ্য করি। এ সময়ে আহসান হাবীব, হাসান হাফিজুর রহমানের মতো কবিরা তাদের পরিশুদ্ধ ধীশক্তি দিয়ে নিজস্ব সাক্ষরতা প্রতিষ্ঠায় সমর্থ হন।
বাংলা কবিতাকে নবতর পরিপূর্ণতা দিতে এগিয়ে আসেন শামসুর রাহমান। তার কর্মযজ্ঞের ব্যাপৃতি বাংলা কবিতার নান্দনিকতা বহুগুণ বাড়িয়ে দেয়। জীবন ও রাজনীতির পাঁজর ছিঁড়ে শামসুর রাহমান লিখেন, ' স্বাধীনতা তুমি’ কিংবা ‘তোমাকে পাওয়ার জন্য হে স্বাধীনতা’- এ রকম বেশকিছু কবিতা।
বাংলা কবিতার মূলধারার স্তম্ভ নির্মাণে বাঙালি জাতির স্বাধিকার আন্দোলন বিস্ময়কর ভূমিকা রেখেছে বলে আমি মনে করি। বায়ান্নোর ভাষা আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধ বাংলা কবিতার খাতাকে শুধু সমৃদ্ধই করেনি, দিয়েছে বহমান বিশ্বকবিতার মাঠে সোনালি ফসল। যা কি-না যে কোনো ভাষার কবিতার মতোই শক্তিশালী, সাবলীল।
বিশ্ব কবিতার খামার থেকে কবিতার বীজ সংগ্রহ করা, নৈর্ব্যক্তিক উপাদান, উপাত্ত এবং উৎসের সল্পব্দানকে আমি কোনোমতেই খাটো করে দেখি না। বিভিন্ন বক্তব্য, বিভিন্ন ভাষায় সমান উজ্জ্বলতা পায় না। প্রকৃতির রূপ-রস-গন্ধ-স্পর্শও সব কবির দ্বারা সমানভাবে আহরিত হয় না। তাই অন্য কোনো ভাষার কবিতার প্রতি মন আকৃষ্ট হলেই তা যে প্রভাব ফেলবে বা ফেলতে পারে, তাও আমি বিশ্বাস করি না।বাংলা কবিতা,
ইউরোপীয় কবিতা, পারস্য কবিতার প্রভাব বয়ে বেড়িয়েছে এমন কথাও বলেন কেউ কেউ। দক্ষিণ আমেরিকা, আফ্রিকার কবিতা ও ভাববিনিময় করে নিজস্বতা নিয়ে দাঁড়িয়েছে।
বিশ্বের বিভিন্ন সাহিত্যে ফোকলোর লিটারেচারের বিবর্তন আমরা লক্ষ্য করি। লোকজ আবহ, আধ্যাত্মিক চেতনা, মরমিবাদ নিয়ে কবিতা লিখেছেন মার্কিন কবি অ্যালেন গিনসবার্গ, ডব্লিউ এস মারউইন, জন অ্যাশবেরি সহ অনেক বিশিষ্ট কবি। আনন্দের কথা হচ্ছে, পাশ্চাত্যে এসব কবি বিশেষভাবে সম্মানিত হন। আদৃত হন। বাংলার লোককবি, মরমি কবিরা সেভাবে সম্মানিত হওয়ার সুযোগ পান না। এটা পরিতাপের বিষয় বৈকি!
বাংলা কবিতার স্তম্ভ নির্মিত হয়েছে বিভিন্নভাবে, বিভিন্ন সময়ে। আল মাহমুদের ‘সোনালি কাবিন গুচ্ছ’, নির্মলেন্দু গুণের ‘হুলিয়া’, শহীদ কাদরীর ‘তোমাকে অভিবাদন, প্রিয়তমা’, আবু জাফর ওবায়দুল্লাহর ‘আমি কিংবদন্তির কথা বলছি’, সৈয়দ শামসুল হকের ‘বৈশাখে রচিত পঙ্ক্তিমালা’, রফিক আজাদের ‘ভাত দে হারামজাদা, নইলে মানচিত্র খাব’সহ এ রকম বেশ কিছু পঙ্ক্তিমালা বাঙালি পাঠককে শাণিত করেছে।
আমরা লক্ষ্য করছি, এ সময়ে বেশকিছু তরুণ কবি বিভিন্ন অঞ্চলের আঞ্চলিক ভাষায় দেহতত্ত্ব, প্রেমতত্ত্ব, কামতত্ত্ব, বিরহ-বিচ্ছেদ তত্ত্বসহ মরমিবাদের নানা চিত্রকলা, উপমা ব্যবহার করে কবিতা লিখছেন। কালে এগুলোও মূলধারার প্রতীক বলে বিবেচিত হবে, সে বিশ্বাস আমি করেই যাচ্ছি। আধুনিক কবি, লোককবি, সবার সম্মিলিত সাধনার মাধ্যমেই নির্মিত হচ্ছে বাংলা কবিতার মূলধারার মাঠ।
------------------------------------------------------------------------------
দৈনিক সমকাল। ৪ এপ্রিল ২০০৮,শুক্রবার প্রকাশিত
মন্তব্য
ফকির ইলিয়াস ভাই,
গতকাল সকালে নিউজ এর আগে পড়ছি আপনার এই লেখা সমকালে। সচলায়তন আপনার লেখাটির লিন্ক দেব আর সাথে নিজের কিছু কথা কিন্তু সাইট এ প্রথমেই নজরে আসল ।
আপনি আগের এক পোস্ট এ অনুযোগ করেছেন , লেখার দর্শক বাড়ছে , কিন্তু বাড়ছে না পাঠক । এ ব্যপারে মাহ্বুব লীলেন যে মতামত দিয়েছেন তার সাথে একমত ।
তবে, পাঠক বলতে আপনি কি বুঝাচ্ছেন ? আপনার লেখা পাঠ করা । পত্রিকায় পাঠ প্রতিক্রয়ার সুযো্গ সীমিত ,সমকালে রিপন আর ফারুক কালেরখেয়া তে একটা বিভাগ রেখেছিল , রিপন -ফারুক সমকালে নেই আর সেই বিভাগও নেই , থাকলে নিশ্চয় টের পেতেন আপনার লেখার পাঠকপ্রিয়তা নেহাত্ কম নয় ।
আপনি যে কালের প্রতিনিধি (যদিও আমি কাল বিভাজন মানি না ) সে কালের তিন জনের লেখার নিয়মিত পাঠক এই অধম ঃ রুদ্র, মাহবুব লীলেন আর আপনি ।
এই লেখার উপর মত দিব আলাদা।
ভাল থাকুন ।
নুরুজ্জামান মানিক
*******************************************
বলে এক আর করে আর এক যারা
তারাই প্রচণ্ড বাঁচা বেঁচে আছে দাপটে হরষে
এই প্রতারক কালে (মুজিব মেহদী)
বিনীত ধন্যবাদ আপনাকে।
পাঠক বলতে আমি বোদ্ধা পাঠক বুঝিয়েছি, আমার নয়।
যারা পড়ে মন্তব্য করবেন ,তা যতোই কঠিন - নির্মম হোক । সেটাই
দরকার। এতে লেখক ও বুঝতে পারেন, তিনি কি করছেন ।
আপনার পঠনের জন্য আবারো ধন্যবাদ।
এই লেখা টা আরো দীর্ঘ হতে পারতো। হয়তো আগামীতে আরো
পরিবর্ধিত হবে।
আপনার উপরের মন্তব্যে কমল কুমার মজুমদারের কথা মনে পড়ে গেল যিনি ১২ জন পাঠক চেয়েছিলেন ।
আপনার লেখার উপর হাত দিতে চেয়েছিলাম কিন্তু যেহেতু আমি "বোদ্ধা পাঠক " নই ,তাই বিরত রইলাম ।
নুরুজ্জামান মানিক
*******************************************
বলে এক আর করে আর এক যারা
তারাই প্রচণ্ড বাঁচা বেঁচে আছে দাপটে হরষে
এই প্রতারক কালে (মুজিব মেহদী)
আপনাকে বোদ্ধা পাঠক ই মনে হয়েছে শুরুতেই।
প্লিজ , লিখুন।
ধন্যবাদ । কিন্তু আমি তো সাহিতের লোক নই মানে সাহিত্যিক/সাহিত্যকর্মীও নই ;আবার সাহিত্যের পন্ডিত,গবেষক বা অধ্যাপকও নই। এই কথাটি তুললাম ,কারণ আমার ব্যক্তিগত পর্যবেক্ষন (ভুল হতে পারে) হল, এই বিষয়ে (কবিতা নিয়ে আলোচনা বা সাহিত্য সমালোচনা ) যারা লেখালেখি করেন ,তারা সবাই উল্লেখিত শ্রেনীভুত্ত।সুতরাং এমন ধারণা করার আশঙ্কা থাকে যে, উল্লেখিত শ্রেনীভুক্তরাই এতদ্বিষয়ের লেখার সোল এজেন্ট। এই উপপাদ্য যদি সতঃসিদ্ধ হয় তবে আমার লেখার প্রয়াস অপরাধ বলেই কি গন্য হবে না ।
নুরুজ্জামান মানিক
*******************************************
বলে এক আর করে আর এক যারা
তারাই প্রচণ্ড বাঁচা বেঁচে আছে দাপটে হরষে
এই প্রতারক কালে (মুজিব মেহদী)
কবিতা একটা ঝামেলার জিনিস
যখন কবিতার ক বুঝতাম না (এখনও যে কোন ঘোড়ার ডিম বুঝি কে জানে?) তখন তরতর করে কবিতার বইয়ের বিশাল বিশাল রিভিউ লিখে ফেলতাম
কিন্তু ২০০৪ সাল থেকে আমি জানামতে সব তরুণ লেখকের প্রথম বইটা সংগ্রহ শুরু করেছি। পড়তে পড়তে বইয়ের পাতা ভরে ফেলেছি নোট করে
ভাবছিলাম কিছু একটা লিখব- কম্পারেটিভ স্টাডি জাতীয়
কিন্তু কিছুই এগোচ্ছে না
শুধু বুঝতে পারছি সাম্প্রতিক কবিতা বদলে গেছে। কিন্তু কোথায় বদলেছে তা ধরতে পারছি না
এবং এর সঙ্গে আরেকটা জিনিস যুক্ত হয়েছে। তা হলো কবিতা নামে নিজে এ যাবৎ কালে যা লিখেছি তার উপর এক ধরনের ঘেন্না জন্মে গেছে
বারবার মনে হচ্ছে এভাবে নয়। অন্য কোনোভাবে লেখা উচিৎ এই সময়
কিন্তু কীভাবে আমি জানি না
এটাই আপনার কৃতিত্ব । ভাঙছেন । গড়ছেন।
বাংলা কবিতার মূলধারা : বিবর্তনের স্পন্দন
লেখাটি পড়লাম।
দেহ-মন কারও জন্য ব্যবসা বন্ধ রাখে না।
কতকাল বৃষ্টেতে ভিজি না,
ভুলে-গেছি কী, বৃষ্টির ঘ্রাণ?
....................................
বনের বেঞ্চিতে ওম শান্তি!
....................................
বোধহয় কারও জন্ম হয় না, জন্ম হয় মৃত্যুর !
বিনীত ধন্যবাদ , আপনাকে।
নতুন মন্তব্য করুন