সুবিধাবাদের উন্মাদনা ও প্রতিপত্তির আঁতাত
ফকির ইলিয়াস
====================================
পোপ বেনেডিক্ট ষোড়শের যুক্তরাষ্ট্র সফরকে কেন্দ্র করে ব্যস্ত হয়ে উঠেছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। ওয়াশিংটন সফর শেষ করে ১৮ এপ্রিল শুক্রবার পোপ নিউইয়র্কে আসেন। নিরাপত্তা বেষ্টনীতে ঘেরা ছিল নগরী। জাতিসংঘে ভাষণ দেন পোপ বেনেডিক্ট। শুক্র, শনি ও রোববার (১৮.১৯.২০ এপ্রিল) তিনি অবস্খান করেন নিউইর্য়কে। তিনি ঘুরে দেখেছেন বিভিন্ন স্খান। গিয়েছিলেন বিধ্বস্ত টুইন টাওয়ারের গ্রাউন্ড জিরোতেও।
পোপকে ঘিরে দু’ধরনের উন্মাদনা লক্ষ্য করলাম। একটি হচ্ছে নিরাপত্তার বাড়াবাড়ি। আর অন্যটি হচ্ছে পোপের আশীর্বাদ নেয়ার জন্য হুড়োহুড়ি। মার্কিনি সমাজের প্রায় সব শ্রেণীর মানুষই ছুটেছে তার কাছে। পোপ তার হাতের সেই সোনালি লাঠি উঁচিয়ে আশীর্বাদ দিচ্ছেন। কখনও হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন কারও মাথায়। এসব দৃশ্য ছিল মার্কিনি টিভিগুলোর প্রধান শিরোনাম। ওই তিন দিন। দেখে অবাক হয়েছে অনেক প্রগতিশীল মার্কিনিও পোপের স্পর্শ পেয়ে তাদের পাপ মোচনের চেষ্টা করেছেন। বড় বড় কর্পোরেটের কর্ণধাররা পোপের সফরের বিভিন্ন ক্ষেত্রে স্পন্সর হয়ে অর্থের জোগান দিয়েছেন।
যুক্তরাষ্ট্রে খ্রিস্টীয় চার্চগুলোর প্রতিপত্তি অত্যন্ত ব্যাপক। কিছু চার্চের ধর্মযাজক যৌন ব্যভিচারে লিপ্ত হয়ে পড়েছেন বেশকিছু কাল থেকেই। ধর্মযাজকরা গ্রেফতারও হয়েছেন। চার্চের বিরুদ্ধে সম্ভ্রম হানির মামলাও হয়েছে। মামলাগুলো নিষ্পত্তি করতে ব্যাপক আর্থিক মূল্য দিতে হয়েছে চার্চগুলোকে। একটি পরিসংখ্যানে দেখা গেছে গত এক দশকে যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন চার্চের বিরুদ্ধে মামলায় প্রায় সাড়ে তিন বিলিয়ন ডলার ক্ষতিপূরণ দিতে হয়েছে এসব ধর্মীয় স্খাপনাকে। তারপরও তাদের দাপটের কমতি নেই। সে প্রমাণ যুক্তরাষ্ট্রে আবারও দেখা গেল পোপ বেনেডিক্টের সফরকে কেন্দ্র করে।
পোপ যুক্তরাষ্ট্রের ধর্মযাজকদের যৌন নিপীড়নের ঘটনাগুলোকে ‘ডিপ শেম’ (চরম লজ্জা) বলে আখ্যায়িত করেছেন। তিনি বলেছেন, ধর্ম তা মেনে নেয় না। পোপ যৌন নিপীড়িত ক’জনের সঙ্গে একান্তে দেখাও করেছেন। তাদের সঙ্গে প্রার্থনা সভায়ও যোগ দিয়েছেন।
এদিকে পোপের সফরকে কেন্দ্র করে ধর্মযাজকদের বিরুদ্ধে বিক্ষোভকারীরাও ছিল সোচ্চার। জাতিসংঘ চত্বর এবং অন্যান্য স্খানেও বিক্ষোভকারীরা জমায়েত হয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছে। তারা বলেছে, ‘গড ইয়েস’ ‘চার্চ নো’। অর্থাৎ ঈশ্বরকে হ্যাঁ বল। চার্চকে না বল। তাদের বক্তব্য হচ্ছে চার্চের নামে এক ধরনের ধর্ম বাণিজ্য চলছে। মানবসমাজের তা মেনে নেয়া উচিত নয়। বিক্ষোভকারীরা বিভিন্ন পরিসংখ্যান দিয়ে লিফলেট বিতরণ করেছে। তারা বলেছে, পোপের এ সফরের উচ্চমূল্য পরিশোধ করছে রাষ্ট্রের জনগণ ট্যাক্স আদায়ের মধ্য দিয়ে। প্রতিবার পোপ যখন বিভিন্ন রাষ্ট্র সফরে যান তখন খরচ হয় বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার।
দুই.
ধর্মীয় লেবাস ধারণ করে বিভিন্ন সুবিধা নেয়ার প্রবণতা বিশ্বে বেড়েই চলেছে। বাড়ছে তা নিয়ে উন্মাদনাও। কিন্তু এই যে উন্মাদনা তা মানব সমাজের জন্য কি সত্য কোন কল্যাণ বয়ে আনতে পারে, কিংবা পারবে?
একটি সংবাদ পড়ে আমার খুব হাসি পেয়েছে। জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশের দুই সাবেক প্রধানমন্ত্রীর মুক্তি দাবি করেছে। তাদের এই মুক্তির দাবিকে দুটি সমান্তরাল সমীকরণে ভাগ করা যায়। প্রথমটি হচ্ছে, জামায়াত-বিএনপি এবং আওয়ামী লীগের কাছ থেকে অতীতে ব্যাপক সুযোগ-সুবিধা পেয়েছে। সে কৃতজ্ঞতাবোধ প্রকাশের জন্যই এখন জামায়াত দুই নেত্রীর মুক্তি দাবি করছে। আর দ্বিতীয়টি হচ্ছে রাজনীতির মাঠ ঘোলা করে নিজেদের গা বাঁচানোর জন্য বিএনপি-আওয়ামী লীগের প্যারালাল বক্তব্য দিচ্ছে জামায়াত। সে সুযোগে তারা প্রধান দুই দলের যে কোন একটির সঙ্গে আন্দোলনের জোট, নির্বাচনী জোট করার মতলব আঁটছে।
এই দুটির কোনটা সত্য তা দেশের জনগণই ভাল বোঝেন এবং বাকিটা আগামীতে দেখবেন। তবে এক ধরনের উন্মাদনা সৃষ্টি করে মৌলবাদীরা যে দেশে তাদের প্রতিপত্তি বাড়াতে চাইছে সে ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই। সুবিধাবাদী রাজনীতির চরিত্র এমনটিই হয়। যে কোন সিঁড়ি বেয়ে নিজ স্বার্থ হাসিলের চেষ্টায় তারা কখনই কসুর করে না।
সেদিন হঠাৎ বিএনপির একাংশের এক সভায় এসে হাজির হয়েছিলেন অর্থমন্ত্রী এম সাইফুর রহমান। বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে তার বক্তব্য শুনলাম। তার হাত থেকে মাইক পড়ে যাচ্ছিল। কথা অস্পষ্ট। ‘আমরা চাই... আমরা চাই...’ বলতে বলতে তিনি হুইল চেয়ারে বসে কাঁপছিলেন। তার এই অবস্খা দেখে আমার মনে পড়েগিয়েছিল তার অতীত হুঙ্কারের কথা। জাতীয় চার নেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দিন আহমদ, এম মনসুর আলী, এইচ এম কামরুজ্জামানকে তীব্র কটাক্ষ করেছিলেন সাইফুর রহমান। বলেছিলেন, ‘কোথাকার কোন সৈয়দ নজরুল...’।
আমার প্রশ্ন জাগে আজ কোথায় সাইফুর রহমান। কোথায় নাসের রহমান-কায়সার রহমানের দাপট? অথচ জাতীয় চার নেতা দক্ষতা-বিচক্ষণতা দিয়ে বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটি স্বাধীন করতে পেরেছিলেন বলেই বিলাত ফেরত চার্টার্ড একাউন্ট্যান্ট সাইফুর রহমান এ দেশে অর্থমন্ত্রী হতে পেরেছিলেন। এভাবেই ইতিহাস তার পুনরাবৃত্তির আখ্যান লিখে যায় কালের মোহনায়।
তিন.
বাংলাদেশের রাজনীতি সেই ইতিহাসের শক্তি ধারণ করেই চলেছে। কে কোন সময় জনগণ কর্তৃক গৃহীত হবে, আর কে প্রত্যাখ্যাত হবে তা বলা বড় কঠিন।
কিছু ঘটনা সেসব কথাই আমাদের আবার মনে করিয়ে দিচ্ছে। একটি ভয়াবহ সংবাদ আমাদের শঙ্কিত করেছে। খবর বেরিয়েছে, শেখ হাসিনার আইনজীবীদের কোন অদৃশ্য শক্তি নানা ধরনের হুমকি-ধমকি দিচ্ছে। এই ঘটনা যদি সত্যি হয় তবে আমাদের সামনে আরও মহানিদান অপেক্ষা করছে তা স্বীকার না করে কোন উপায় নেই। কারণ, একজন রাজনীতিক আইনি সহায়তা পেতেই পারেন। তার আইনজীবীদের হুমকি দেয়ার কিসের আলামত বহন করে? তাহেল কি সাজানো কোন সঙ্কটের দিকেই এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। যা গণতন্ত্রের জন্য, জনগণের জন্য হুমকির কারণ হতে পারে দীর্ঘমেয়াদি সময়ের জন্য।
ঢাকায় নবনিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়ে বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছেন। তিনি বলেছেন, দুই নেত্রীর বিরুদ্ধে যথার্থ কোন অভিযোগ প্রমাণ করতে না পারলে রাষ্ট্রপক্ষের উচিত তাদের বিনা বিচারে আটক না রাখা। মার্কিন রাষ্ট্রদূত জেমস মরিয়ার্টি আরও বলেছেন, সেনাবাহিনী বাংলাদেশের রাষ্ট্রক্ষমতায় দীর্ঘসময় তাদের ছায়া বিস্তৃত করে রাখলে বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়তে পারে। মার্কিন রাষ্ট্রদূতের এই আশঙ্কা বাংলাদেশের গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ বাঁচাতে সতর্কবাণীর সমান। কারণ সংস্কারের নামে ভার চাপিয়ে দিয়ে কোন কোন নেতানেত্রীকে রাজনীতি বিচ্ছিন্ন করার সুযোগ নিয়ে প্রকৃত অপরাধীরা, লুটেরা রাজনীতির গডফাদাররা পুনরায় পুনর্বাসিত হওয়ার সম্ভাবনা জোরালো হয়ে উঠতে পারে। তাতে লাভ আর আসল দুটোই খোয়ানোর সম্ভাবনা দেখা দিতে পারে।
আমরা অতীতে দেখেছি রাজনীতিকরা জনগণকে যতটা পর্যবেক্ষণ করেন তার চেয়ে বেশি জনগণই পর্যবেক্ষণ করেন রাজনীতির গতিপ্রকৃতি এবং রাজনীতিবিদের এবং সেই গভীর পর্যবেক্ষণে জানগণই জয়ী হয়। এখনও যদি অন্যায়ভাবে কোন তত্ত্ব চাপিয়ে দিয়ে বাংলাদেশের মানুষকে কণ্ঠরুদ্ধ করার চেষ্টা করা হয় তবে তা বুমেরাং হয়ে সব হিসাব পাল্টে দিতে পারে।
বিশ্ব ইতিহাস বলে, সুবিধাবাদীরা সবসময়ই নানা উন্মাদনা ছড়াতে ব্যস্ত থাকে। তা ধর্মীয় হোক, সামাজিক হোক কিংবা রাজনীতিবিদই হোক। অবৈধ প্রতিপত্তি বাড়াতে গোপন আঁতাতও গড়ে ওঠে মূলত জনগণকে ঠেকানোর জন্য। বলা হয়ে তাকে, খ্রিস্টান ধর্মের শ্রেষ্ঠ যাজক, ‘পোপ’ পদটিও নাকি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গোপন নির্বাচনেই মনোনীত হয়। জাতিসংঘ থেকে চার্চগৃহ সবই নিয়ন্ত্রণ করে যুক্তরাষ্ট্র। একদিকে প্রতিপত্তি বিস্তার যেমন করেছে অন্যদিকে নানা ধরনের উন্মাদনা সৃষ্টি করে বাণিজ্যও হাতড়ে নিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। যে ভিয়েতনামে দীর্ঘমেয়াদি যুদ্ধ করেছিল যুক্তরাষ্ট্র, সেই ভিয়েতনামে এখন যুক্তরাষ্ট্র গড়ে তুলেছে বিশাল আকারের নিজস্ব প্রোডাকশন হাউজ। কারণ শ্রমের মূল্য সেখানে কম। বাংলাদেশও একই কায়দা অনুসরণ করা হচ্ছে, প্রতিপত্তির আঁতাত গড়ে তুলতে। পার্থক্য হচ্ছে সেখানে অর্থনৈতিক মুক্তির কর্মযজ্ঞ শূন্যের কোঠায় আটকে আছে রাষ্ট্রীয় আবহেলায়।
নিউইয়র্ক, ২৩.এপ্রিল.২০০৮
--------------------------------------------------------
দৈনিক সংবাদ। ২৫ এপ্রিল২০০৮ শুক্রবার প্রকাশিত
মন্তব্য
অতি সময়োপযোগী আর সুচিন্তিত রাজনৈতিক সমীক্ষা। অভ্যন্তরীন ও আন্তর্জাতিক রাজনীতিকে ঘিরে।
আপনাকে কবি হিসেবেই দেখেছি বেশী। রাজনৈতিক আলোচনায় কম। সেখানেও তুখোড়...। বক্তব্য, পর্য়বেক্ষনের সাথে পুরো সহমত।
**********************************
যাহা বলিব সত্য বলিব
**********************************
যাহা বলিব, সত্য বলিব
সম্পূর্ন একমত আপনার লেখার ------- নিজেদের অধঃপতন ঠেকাতে আমরা বরাবরই আশ্রয় নেই কাল্পনিক অবতারের ---- ধর্ম নাম নিয়ে যার বিচরণ আমাদের মাঝে
বাংলাদেশ নিয়ে বলবার কিছু নেই ------ আমরা আজ কথা বলতে আর শুনতে ভুলে গেছি ----- নতুন জন্মানো ছাড়া এ থেকে মুক্তি নেই আমাদের ----- জানিনা কবে আর কিভাবে জন্মান্তর ঘটবে আমাদের! জানলে আপনি লেখেন প্লিজ------ আমাদের আজ প্রয়োজন।
.....................................................................................
সময়ের কাছে এসে সাক্ষ্য দিয়ে চ'লে যেতে হয়
কী কাজ করেছি আর কী কথা ভেবেছি..........
.....................................................................................
সময়ের কাছে এসে সাক্ষ্য দিয়ে চ'লে যেতে হয়
কী কাজ করেছি আর কী কথা ভেবেছি..........
নতুন মন্তব্য করুন