আমার রবীন্দ্রপাঠ
ফকির ইলিয়াস
------------------
একসময় তাঁকে পড়েছি খুব। এখন শুনে যাই। তাঁর গান। কবিতা। গদ্য। জীবনের প্রেমে , চারপাশের প্রকৃতিতে তিনি জেগে থাকেন। জাগিয়ে রাখেন। ছায়া হয়ে চলেন সাথে সাথে। প্রজন্মের পর প্রজন্ম। যারা আলো চায় , তারাই গেয়ে উঠে -- ‘‘ আলো আমার আলো ওগো ’’।
তিনি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। কবিগুরু। বাঙালির শ্রেষ্ট মনন। আলোকবর্তিকা। কি লিখেন নি তিনি ? তাঁর রচনা সম্ভার , মানুষের মন কে গর্বিত ই করে না - শক্তি ও দেয় ।
ধরা যাক , ‘১৪০০ সাল ’ কবিতাটির কথা। তিনি যে চিত্র এঁকে গিয়েছিলেন , তা নবীন পাঠককে এখনো ভাবায়। মনে হয় ,কবিগুরুকে সামনে রেখেই কেউ পড়ছে সেই অমর কবিতাখানি ! তিনি, থেকে
গেছেন এভাবেই আমাদের জীবনে।
দুই
সমাজ, জীবন ও প্রকৃতি কে নতুন করে সবসময় সাজাতে চেয়েছেন কবিগুরু। বৈশাখ ,বর্ষা, শরত,হেমন্ত,
শীত ,বসন্ত সব ঋতু ছাড়িয়ে তাঁর কাছে বড় হয়ে উঠেছে মানবঋতু। জীর্ণতা মুছে দিয়ে নতুনকে আহ্বান
করেছেন কবি তাঁর প্রতিটি লেখায়।
সমাজের সকল দেয়াল ভেংগে তিনি মানবতার জয়গান গেয়েছেন তাঁর গল্পে, গদ্যে, নাটকে। একজন
লেখকের সত্তা যে লেখার সবক্ষেত্রে বিচরণ করতে পারে, রবীন্দ্রনাথ সে প্রমাণ টি করে গেছেন নিপুণহাতে। গানে তিনি দেখিয়েছেন তাঁর অভিনব শ্রেষ্টত্ব। তাঁর গানগুলো শুনলে মনে হয় ,আত্মা যেন প্রার্থনায় রত হচ্ছে বার বার প্রেমে কিংবা অন্নেষায়। ‘ আগুনের পরশমনি ছোঁয়াও প্রাণে’ , কিংবা ‘যে দিন পড়বে না মোর পায়ের চিহ¡ ’ - পংক্তিগুলো আমাদেরকে মনে করিয়ে দেয় আত্মান্নেষণের কথা। আমরা ক্ষণিকের জন্য হলেও ভুলে যাই এই জগতের মোহ।
‘‘পত্র সাহিত্য’’ যে কত সমৃদ্ধ ও ঐতিহাসিক হতে পারে তা তিনি প্রমান করে গেছেন বাংলা সাহিত্যে। বিভিন্ন ব্যক্তিবর্গকে লেখা তাঁর চিঠি সে সময়ের সাহিত্য , সমাজ, দর্শন, চিন্তা, এবং
চেতনাকে ধারণ করে রেখেছে। যা যে কোনো গবেষকের ভাবনার খোরাক হবে যুগে যুগে।
রবীন্দ্রনাথ ছিলেন প্রকৃত মৃত্তিকা প্রেমিক কবি। কোনো কবির লেখা সংগীত , দুটি রাষ্ট্রের জাতীয়
সংগীত হয়েছে - সে উদাহরণ তিনি। তাঁর সেই পংক্তি - ‘ গ্রাম ছাড়া ঐ রাঙামাটির পথ আমার
মন ভুলায় রে ’ গেয়ে যখন কোনো শিল্পী মঞ্চে দাঁড়ান , তখন মনে হয় সেই গ্রামটি ভেসে যাচ্ছে
সহস্র শ্রোতার বুকের পাঁজর চিরে।
বা-ালি সংস্কৃতির আভা ও বহমানতাকে জীবনের বাস্তবতার সাথে মিশিয়ে দিয়ে গেছেন কবিগুরু।
সকল সংকীর্ণতা ,সাম্প্রদায়িকতা, দীনতার বিরুদ্ধে তাঁর সোচ্চার লেখনী বিভিন্ন ভাবে শক্তি যুগিয়েছে
মানুষকে। একটি জাতিসত্তার পরিধি ব্যাপৃত হয় , সে জাতির লেখক-কবিদের শব্দপ্রেরণার মধ্য দিয়ে।
তিনি বৃটিশ শাসনাধীন উপমহাদেশের বাংলা ভাষাভাষিদের জন্য সেই সুবৃহৎ কাজটি করে গিয়েছেন
নির্দ্বিধায়।
রবীন্দ্রনাথ সবসময় ছিলেন নতুনের পূজারী। তাঁর ‘‘গীতাঞ্জলী’’ গ্রন্থটির প্রতিটি পংক্তি পড়েই আমার মনে হয়েছে তিনি এক অবিনাশী সত্তার সন্ধান করে গেছেন আজীবন। যে মানবতার আলো এই বিশ্বের
মানুষকে প্রেমময় করে তুলবে দিনরাত। করে তুলবে সমুদ্রের মতো উদার।
গল্পে তিনি অত্যন্ত কঠিন মমতা দিয়ে চিত্রায়ন করে গেছেন মানব জীবনচরিত। তাঁর বহুল পঠিত
‘‘ কাবুলিওয়ালা’’ ,‘‘ বলাই’’ প্রভৃতি গল্পগুলো আগামী প্রজন্মের কাছে দীপশিখা হয়েই থেকে যাবে।
যারা বিবর্তনের আলোরেখা খুঁজে গল্প লিখবে, তাদের কাছেও এসব গল্প থেকে যাবে ধ্রুব প্রতীক
হিসেবে।
তিন
তাঁর ভবিষ্যত দর্শন পাঠক- পাঠিকাকে মুগ্ধ করে যায় বার বার । এবং তা অব্যাহত থেকে যাবে
অনন্তকাল। বুক উঁচু করে প্রজন্ম করে যাবে উচ্চারন ---
চিত্ত যেথা ভয়শুন্য, উচ্চ যেথা শির
জ্ঞান যেথা মুক্ত , যেথা গৃহের প্রাচীর
আপন প্রাঙ্গন তলে দিবস শর্বরী
বসুধারে রাখে নাই খন্ড ক্ষুদ্র করি
রবীন্দ্রনাথ ছিলেন একজন বৃক্ষপ্রেমিক ও। সবুজের সমারোহে বেঁচে থাকবে উত্তর প্রজন্ম ,সে স্বপ্ন
তিনি দেখে গেছেন নিরন্তর। তা প্রকাশ করেছেন লেখায় ও ।
বাংলা ভাষার মাঠ, বাংলা ভাষার সমকাল তাঁকে স্মরণ করবে , বরণ করবে প্রতিটি ঋতুতে।
দিনবদলের যে প্রত্যয় তিনি বাঙালি জাতিকে দেখিয়ে গেছেন ,তা শাণিত হয়েই থাকবে।
আমার একটি খুব প্রিয় কবিতার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আমি তাঁকে খুঁজি প্রতিদিন।
কে লইবে মোর কার্য ,কহে সন্ধ্যা রবি
শুনিয়া জগত রহে নিরুত্তর ছবি
মাটির প্রদীপ ছিল ,সে কহিল স্বামী
আমার যেটুকু সাধ্য করিব তা আমি ।
রবীন্দ্রনাথ আমার কাছে রবির মতোই । আহা ! আমি যদি সেই মাটির প্রদীপ হতে পারতাম !
মন্তব্য
ভাল-লাগলো। যেমন :
গ্রাম ছাড়া ঐ রাঙামাটির পথ আমার
মন ভুলায় রে ’ গেয়ে যখন কোনো শিল্পী মঞ্চে দাঁড়ান , তখন মনে হয় সেই গ্রামটি ভেসে যাচ্ছে
সহস্র শ্রোতার বুকের পাঁজর চিরে।
....................................
বোধহয় কারও জন্ম হয় না, জন্ম হয় মৃত্যুর !
....................................
বোধহয় কারও জন্ম হয় না, জন্ম হয় মৃত্যুর !
প্রেমে পড়তে গেলেও রবীন্দ্রনাথ লাগে, তার মতো এমন রোমান্টিকভাবে আর কে কবে বলতে পেরেছে ভালোবাসার কথা? আবার বিরহে পড়লেও রবীঠাকুরই ভরসা। তার মতো কেইবা বুঝেছে প্রেমে ব্যর্থ মানবের জ্বালা? সখি ভালোবাসা কারে কয়, সে কি কেবলই যাতনাময়, সে কি কেবলই চোখেরই জল, সে কি কেবলই দুঃখেরই শ্বাস, লোকে তবে করে কি সুখেরই তরে এমনও দুঃখের আশ? আর কে কবে বলতে পেরেছে এমনি করে?
বর্ষা নেমেছে? শরৎ এসেছে? এসেছে কি বসন্ত? অথবা শীতের কাঁপন? যে কোনও ঋতুতেই মন ভরিয়ে যাকে নিয়ে পড়ে থাকা যায়, তিনি রবীন্দ্রনাথ।
মন খারাপ? অথবা খুব আনন্দ? অভিমান? যাই কিছু হোক রবীন্দ্রনাথ ছাড়া ভাষাই ফোটে না।
স্বাদ ভরে চেটেপুটে ভাত খেয়েছেন? তখনও মনে হবে রবীঠাকুরেরই কথা- পিঁপিড়া কাঁদিয়া যায় পাতে। জয় গোস্বামীর মতো প্রশ্ন করতে হয়- এই লোকটি কি সব জানে? সব? সবকিছু? কিছুই কি অজানা নেই?
আমাদের জীবনের সবগুলো আশা, আকাঙ্খা, প্রেম, ভালোবাসা, ঘৃণা, প্রতিবাদ, প্রার্থনা, শ্রদ্ধা, ভক্তি, দেশপ্রেম- সবকিছুতেই ছড়িয়ে আছে রবীন্দ্রনাথ। বাঙ্গালির সবকিছু ছাড়া চলে, কিন্তু রবীন্দ্রনাথ ছাড়া? অসম্ভব।
তার মতো বিশ্বজনীন কে আছে আর? গোটা বিশ্বে বাঙ্গালীকে তার মতো করে আর কে চিনিয়েছে? নোবেল দেওয়ার পরে সাহেবদের হাতে এরচেয়ে বড় যে আর কিছু ছিলো না, নইলে তাঁর আর যা যা কীর্তি তাতে তো তার জন্যই বরাদ্ধ ছিলো পৃথিবীর সব পুরষ্কার আর শ্রদ্ধার্ঘ্য।
তাই কি শুধু? এমন দীর্ঘদেহী সুপুরুষই বা আর কতজনা জন্মেছেন এই বঙ্গে? পৌরুষদীপ্ত চেহারা আর প্রচণ্ড ব্যক্তিত্বের জ্যোতি তাকে দিয়েছে ভিন্নমাত্রা। তার পোশাক আশাক চাল চলন কথা বার্তা- সবকিছুই ভীষণরকম স্টাইলিশ। আর বাঙালি মহিলারা তো ব্লাউজ পরতেই শিখলো ঠাকুরবাড়ির অন্দরমহল থেকে।
রবীন্দ্রনাথ এই বাংলার মানুষদের দিয়েছেন নতুন ভাষা, আধুনিকতা, স্টাইল। তিনি শুধু তার সময়েরই আধুনিক ছিলেন না, তিনি এখনও আধুনিক- এই শতবর্ষ পরেও। আরো কত শত বছর তার মুগ্ধতাতেই কেট যাবে আমাদের, তা কে জানে?
_________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
চিত্ত যেথা ভয়শুন্য, উচ্চ যেথা শির
যতবার তাকে পাই মৃত্যুর শীতল ঢেউ এসে থামে বুকে
আমার জীবন নিয়ে সে থাকে আনন্দ ও স্পর্শের সুখে!
“তুমি কি কেবলই ছবি?”
আজ (ইতোমধ্যেগত হয়ে গেছে) কবিগুরুর জন্মদিন। আমার ঘরে 'রাখা তাঁর ছবির দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করি।
উত্তরটাও পেয়ে যাই সাথে সাথেই - না তিনি শুধু ছবি নন; তিনি রবি- দিবাকর,
শক্তির উৎস; আর উৎস প্রেরণার।
- রহমান আতা
-
তোমার দ্বারে কেন আসি ভুলেই যে যাই, কতই কী চাই-
দিনের শেষে ঘরে এসে লজ্জা যে পাই।
.......................................
আমার মাথা নত করে দাও হে তোমার চরণধূলার তলে।
সকল অহংকার হে আমার ডুবাও চোখের জলে।।
নিজেরে করিতে গৌরব দান, নিজেরে কেবলই করি অপমান,
আপনারে শুধু ঘেরিয়া ঘেরিয়া ঘুরে মরি পলে পলে।
সকল অহংকার হে আমার ডুবাও চোখের জলে।।
......................................
এত চমৎকার করে আর কে এভাবে বলতে পারেন?ভাবা যায়?
নতুন মন্তব্য করুন