নিউইয়র্কে কবি
ফকির ইলিয়াস
=======================
বাংলাদেশ লীগ অব আমেরিকা কবিকে সংবর্ধনা দেবে, সে কথা আমাকে জানালেন লীগ অব আমেরিকার সভাপতি সাঈদ-উর-রব। বললেন, আড্ডা হবে সাহিত্য বিষয়ে। ভীষণ আগ্রহী হয়ে গেলাম সে সন্ধ্যায়। ১৯৯০-এর গ্রীষ্মের চমৎকার বিকাল। আমেরিকান সামারের খ্যাতি বিশ্বজোড়া। তার ওপর আবার নিউইয়র্ক শহরে। বলা হয় বিশ্বের রাজধানী নিউইয়র্ক। বাংলা ভাষার অন্যতম প্রধান কবিকে পেয়ে নিউইয়র্ক যেন আরও মেতেছিল আনন্দে সেদিন।
লং আইল্যান্ড সিটির স্কাইলান রেস্টুরেন্ট মিলনায়তনটি মুখরিত হয়ে উঠেছিল বিভিন্ন অঙ্গরাজ্য থেকে আসা কবির শুভানুধ্যায়ীদের পদচারণায়। কবি এলেন। বাংলা কবিতার জীবন্ত কিংবদন্তি- শামসুর রাহমানকে তরুণ প্রজন্মেরর শিশু-কিশোর-কিশোরীরা পুষ্প পাপড়ি ছিটিয়ে বরণ করে নিল। তার সম্মানে বক্তব্য রাখবেন প্রবাসের বিশিষ্টজনরা। বিনয়ী মানুষ শামসুর রাহমান খুব সংক্ষিপ্ত বক্তব্যই রাখলেন। বললেন, এই উত্তর আমেরিকায় বাঙালি প্রজন্ম যে বাংলা ভাষা বাংলা কবিতার পঙ্ক্তি বুকে লালন করে বেড়ে উঠছে তা আমাকে আনন্দ দিচ্ছে। আমি নতুন সূর্যরেখা দেখতে পাচ্ছি এই প্রবাস প্রজন্মের চোখেমুখে।
সংবর্ধনা সভা শেষ হলে আমরা ক’জন আড্ডায় বসলাম কবির সঙ্গে। জিজ্ঞাসা করলাম সমসাময়িক বিশ্ব কবিতার সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাংলা কবিতার উৎকর্ষতা কতটা সাধিত হচ্ছে? মুচকি হেসে কবি বললেন তা তো আপনারাই ভালো বলতে পারবেন যারা অভিবাসে আছেন। আমি বিনয়ের সঙ্গে বললাম, প্লিজ আপনি বলুন। কবি আবারও হেসে বললেন, বাংলা কবিতা অবশ্যই নিজস্ব শস্য ভাণ্ডারে সমৃদ্ধ পঙ্ক্তিমালা। কবি বললেন, আমাদের কবিতার যদি ব্যাপক এবং পরিশুদ্ধ অনুবাদ হতো তবে তা বিশ্ব কবিতা ভুবনে আরও বেশি আলোচিত, সমাদৃত হতো।
কবি গ্লুকোমা রোগে আক্রাìত হওয়ার পর ১৯৯৬ সালে যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী কবির সুহৃদরা তাকে চিকিৎসার জন্য নিউইয়র্কে নিয়ে আসেন। আবারও গ্রীষ্মকাল। আগস্টের দুপুর। এক বিকেলে আমরা বেরিয়ে পড়ি কবিকে নিয়ে ক’জন। হাডসন নদীর তীরে যেতেই কবি বললেন, সূর্যাস্ত দেখব। আমরা তার সঙ্গে সূর্যাস্ত দেখতেই ব্যস্ত হয়ে পড়ি। ভর চোখে কবি তাকিয়ে রইলেন আকাশের দিকে। সূর্যটা যেন যুবে গেল আটলান্টিক মহাসাগরে তার চোখের ওপর দিয়ে। কবি আমাদের জিজ্ঞেস করলেন, এখন বাংলাদেশে ভোর হচ্ছে তাই না? আমি হ্যাঁ বললেই তিনি বললেন, আমি একদিন সূর্যোদয়ের অপেক্ষায় থাকি। মনে পড়ছে হাডসনের তীরে বসেই পেস্তা-বাদাম চিবুতে চিবুতে ‘গেরিলা’ এবং ‘সফেদ পাঞ্জাবী’ কবিতা দুটি পড়েছিলেন কবি শামসুর রাহমান।
তাঁর, প্রবাসীদের এক ভালবাসা ছিল অসীম। বলতেন, আপনারা প্রবাসীরা বিদেশে বাংলার মুখ। ম্যানহাটনে ড. জ্যোতিপ্রকাশ দত্তের বাসায় সাহিত্য আড্ডা হয়েছিল। সে আড্ডযায় সলিমুলাহ খান কবিকে প্রশ্নবাণে বিদ্ধ করেছিলেন বারবার। তার ‘স্বাধীনতা তুমি’ কবিতার সঙ্গে একজন ফরাসী কবির ‘দ্য লিবার্টি’ কবিতার মিল খুঁজে তুলনামূলক আলোচনাও করেছিলেন ড. সলিমল্লাহ খান। কবি শুধু বলেছিলেন, আমি এই ফরাসি কবির কটিতাটি কখনও পড়িইনি।
শামসুর রাহমান ছিলেন মহান মৃত্তিকার মতো। মাটি কোদাল দিয়ে কোপালে কোনও ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া জানা-বোঝা যায় না। শামসুর রাহমান তেমনি শুধু দিয়েই গেছেন। চাননি কিছুই। তাকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদা দেয়া হয়নি। তাতে কী? লাখো মানুষ তাকে শেষ প্রণাম-ভালবাসা জানিয়েছে। ষড়ঋতু যতদিন থাকবে, বাংলা ভাষা, বাংলা অক্ষর যতদিন থাকবে ততদিনই বেঁচে থাকবেন শামসুর রাহমান প্রাণে প্রাণে। তার আত্মা অবিনাশী। তার চেতনা কালে কালে বহমান থেকে যাবে সমুদ্রের মতো।
=========================================
মন্তব্য
সুন্দর একটি স্মৃতিচারাণমূলক গদ্য। শামসুর রাহমানের প্রবাসকালীন অক্ষরচিত্র। কবির পাশে মশার ভনভনও আছে। যেমন সলিমুল্লাহ খান। জীবনানন্দের পাশেও সজনীকান্ত ছিলেন।
____________________________
বন্ধুত্ব মানেই তুমি বিচ্ছেদের চুক্তি মেনে নিলে
[আবু হাসান শাহরিয়ার]
নতুন মন্তব্য করুন