কবিতার দৃশ্যান্তর, অন্তর্ভেদি দিগন্তের বিস্তার

ফকির ইলিয়াস এর ছবি
লিখেছেন ফকির ইলিয়াস (তারিখ: রবি, ২৫/০১/২০০৯ - ৮:৪৪অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

কবিতার দৃশ্যান্তর, অন্তর্ভেদি দিগন্তের বিস্তার
ফকির ইলিয়াস
-------------------------------------------------------
প্রতিটি দৃশ্যের অন্তরালে থাকে আরেকটি দৃশ্য। একজন চিত্রীর চিত্রকর্ম সবসময় সবকিছু স্পষ্ট করে বলতে পারে না হয়তোবা। কিন্তু চিত্রশিল্পী তার মগ্নচেতনার রূপায়ণ করে যান তুলির আঁচড়ে। আর্ট গ্যালারিতে তার সেই চিত্রকর্ম প্রদর্শিত হয়। নীরব দর্শকরা দেখে যান। কোনও কোনও রেখাদৃশ্য দর্শকের মনে ছায়াপাত করে। ভালোবাসার বলয় হয়ে থেকে যায় দীর্ঘ সময়।
একজন কবি যখন একটি কবিতা লেখেন, সেই কবিতারও একটি অন্তর্দৃশ্য থাকে। সে দৃশ্য সবাই দেখতে পারেন না। কেউ কেউ পারেন। একটি কবিতাও একটি চিত্র। সে চিত্র কথা বলে। ধারণ করে তার নিজস্ব সময়, সময়ের গতি, সময়ের নায়ক-নায়িকা এবং দৃশ্যায়িত চারপাশ। বস্তুত সময়, দৃশ্য, মানব-মানবী, বন-বনান্তরসহ তাবৎ প্রাণিকুল তথা সৃষ্টিকে ধারণ করার নামই কবিতা।
চলমান বিশ্বসাহিত্যে ‘দৃশ্যকবিতা’ বলে একটি পর্ব শুরু হয়েছে। বিভিন্ন ভাষার কবিরা লিখছেন দৃশ্যকবিতা। দৃশ্যকবিতাগুলো মূলত খুবই সারসংক্ষেপ। পংক্তি সংখ্যাও কম। দু’চার লাইন। লাইনগুলোর সাথে একটি চমৎকার চিত্রশিল্প। আর্টটি কবির নিজের হাতেই করা। শব্দগুলোর পাশাপাশি ছবি পাঠকের মন টানে। পাঠক-পাঠিকা ছবিগুলো দেখতে দেখতে আর পংক্তিগুলো পড়তে পড়তে হারিয়ে যান অন্য দৃশ্যান্তরে।
দৃশ্যকবিতাগুলো নিরীক্ষণ, চর্চা ও বিস্তারে এগিয়ে এসেছে কবিতার বিভিন্ন ওয়েবসাইট। আন্তর্জালে বাংলা কবিতাও চর্চিত হচ্ছে এসময়ে বেশ ব্যাপকভাবে। ওয়েবে কবিতা বিস্তারের সুবিধাটি হচ্ছে, বিশ্বের যে কোনও প্রান্ত থেকে একজন পাঠক পড়তে পারেন পংক্তিগুলো। এক মেরুতে বসে মিশে যেতে পারেন অন্য মেরুর একজন কবির রচিত ছায়াশব্দের গানে গানে। একই সমান্তুরাল ভালবাসা, একই বিরহের গতিবেগ এভাবেই বণ্টন হয়ে যায় প্রাণে প্রাণে।
কবি কমল চক্রবর্তীর সম্পাদনায় ‘কৌরব’ সাহিত্যপত্রটি ভারত থেকে বের হয় কয়েক দশক ধরে। ‘কৌরব’ এর সম্পাদক মণ্ডলীর সদস্যকবি আর্যনীল মুখোপাধ্যায়। তিনি যুক্তরাষ্ট্র অভিবাসী। কবিতার প্রতি তার ভালোবাসা এবং শ্রম রীতিমতো ঈর্ষণীয়। আর্যনীলের উদ্যোগে ‘কৌরব’ এ পর্যন্ত চৌদ্দটি ইন্টারনেট ইস্যু বের করেছে। ইন্টারনেট- ১২ সংখ্যাটিতে ব্যতিক্রমী একগুচ্ছ দৃশ্যকবিতা ছাপা হয়েছে। কবিতাগুলোর জনক কবি শান্তনু বন্দোপাধ্যায়। কবি শান্তনু তার সঙ্গীদের নিয়ে বেড়াতে গিয়েছিলেন হিমালয় উপত্যকায়। তারা হেঁটেছেন গাছ-মানবের পায়ে পায়ে ছায়া ফেলে। হিমালয়ের পাদদেশে ছোঁয়া দুটি নদী, সুন্দরডুঙা এবং পিণ্ডার।
শান্তনু ‘সুন্দরের উপত্যকায়’ শিরোনামে দীর্ঘ যে দৃশ্য কবিতাগুচ্ছ লিখেছেন এর সাথে ধারাবাহিক ছবি ছাপা হয়েছে পাঁচটি। ছবিগুলো ক্যামেরা দিয়ে তোলা। দীর্ঘ কবিতাটিকে ভাগ করা হয়েছে আটটি উপশিরোনামে। ভারারি, ঢাকুরি, ঢাকুরি পেরিয়ে, জাতোলি, কাঁঠালিয়া, মাইকতোলির পথে, কাঁঠালিয়া পেরিয়ে, এবং বালুনির পর।
দেখলেই বোঝা যায় ভ্রমণ সঞ্চালন পর্বে বিভিন্ন স্থানের নামেই লেখা হয়েছে কবিতার উপশিরোনাম।
পুরনো লক্ষ্ণৌ থেকে ক্যাসারোলে করে বিবিয়ানি আসে।
তারপর ট্রেনে চড়া, গভীর রাতের স্টেশন, নিভু চাঁদ
ছমছমে গাছপালা, আলোর আঁকিবুকি শেষে ভোর হয় ছোট্ট স্টেশনে
পিণ্ডারের পাশ দিয়ে যেতে যেতে আমাদের কেউ আনমনা হয়,
পাহাড়ের রঙ এসে পড়ে চোখে।
(ভারারি/ সুন্দরের উপত্যকায়)
এভাবেই বর্ণনামুখর চিত্রপট। কবি ও তার সঙ্গীদের কর্মযজ্ঞ। বহমান বর্তমান। বহুদিন নিভে থাকে ফায়ার প্লেসের পাশে আগুন জ্বালানো। পার হওয়া কনকনে ঝরনার ঢেউ। পংক্তিগুলোর সাথে স্থির চিত্রগুলো স্থান পেয়েছে উজ্জ্বল সঙ্গতি রেখে। এই ধারাবাহিকতায় এগিয়ে যায় কবির কাফেলা। তারা নিশব্দ হয়ে থাকার পরীক্ষায় মুখোমুখি হন। লিখে রাখেন, ‘শান্ত নদীটির পাশে গ্রাম’। পাহাড়ের ঢাল বেয়ে সন্ধ্যা নেমে আসে ক্রমশ।
তীব্র বরফের টুকরো, সাদা মেঘ ঢেকে দিয়েছে আমাদের।
প্লাস্টিকের চাদর ঢাকা দিয়ে বসে থাকি,
বন্ধুর হাতের তাুল হাতে নিয়ে উৎকণ্ঠা কাটে।
নির্জন দ্বীপের মতো এক টুকরো ঢালু জমি,
চারপাশে যেন কিছুই নেই, ছিল না কোনোদিন।
(বালুনির পর/ সুন্দরের উপত্যকায়)
আট টুকরো কবিতা এভাবেই শেষ হয়ে যায়। পংক্তির ঝংকার জেগে থাকে দৃশ্যের মতো, পাঠক-পাঠিকার মনে। দেখুন www.kaurab.com

দুই.
কবিতার স্থলদৃশ্য থেকে নীল চিঠি লেখেন মার্কিন কবি ইউসেফ কমুন্ইয়াকা। এ সময়ের অত্যন্ত শক্তিশালী কবিদের একজন তিনি। ‘টকিং ডার্টি টু দ্যা গডস’ লিখে যুক্তরাষ্ট্র তথা বিশ্বসাহিত্যে সাড়া জাগিয়েছিলেন নতুন করে। আলোচনার কেন্দ্র বিন্দই শুধু নয় তার কাব্যআখ্যান বিবেচিত হয়েছিল নতুন দৃশ্য আঙ্গিকে। ২০০০ সালে নিউইয়র্ক থেকে বের হয় ১৩৪ পৃষ্ঠার এই সুদৃশ্য, সুপাঠ্য কাব্যগ্রন্থটি। ‘টকিং ডার্টি টু দ্যা গডস’। ঈশ্বরদের সাথে নষ্টামি।
কবি ইউসেফ কমুন্ইয়াকা ১৯৯৪ সালে পুলিৎজার পুরষ্কার পান তার ‘নিওন ভার্নাকুলার’ কাব্যগন্থের জন্য। তার আরেকটি কাব্যগ্রন্থ ‘থিভস অব প্যারাডাইস’ ছিল ১৯৯৯ সালে ন্যাশনাল বুক ক্রিটিকস্ সার্কেল এওয়ার্ড- এর ফাইনালিস্ট। সে বছরই তিনি ‘দ্যা একাডেমী অব আমেরিকান পয়েটস’ এর চ্যান্সেলর মনোনীত হন। তিনি প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটির ক্রিয়েটিভ রাইটিংস- এর অধ্যাপকের কাজও করেন।
মায়ের কাছে গল্প শুনে শুনেই মিথ আর নৈসর্গিক আবহের প্রতি আকৃষ্ট হন কবি ইউসেফ কমুন্ইয়াকা। ভিয়েতনাম যুদ্ধের তিনি ছিলেন একজন যোদ্ধা। ষাট দশকের শেষে ফিরে আসেন নিজ দেশে। অনুভবের অনুষঙ্গে মনোনিবেশ করেন কাব্যসাধনায়।
ইউসেফ নিজেকে কোন নির্দিষ্ট অঞ্চলের কবি বলে মনে করেন না। তিনি মনে করেন মানুষের মৌলিক সংস্কৃতি একই। আর তা হচ্ছে মানবতাবাদ। শিক্ষাকেই তিনি মনে করেন প্রধান শক্তি। কবিতা সম্পর্কে ইউসেফ বলেন, কবিতা কোনও আবেগের বিষয় নয়, নয় প্রচারেরও। কবিতায় বৈজ্ঞানিক দৃশ্যচেতনাকে কাজে লাগিয়ে সাহিত্যচর্চা করেন ইউসেফ। প্রশ্ন প্রশ্নের জন্ম দেয়। তারপর খুঁজে পাওয়া যায় উত্তর।
কবি ইউসেফের কল্পদৃশ্য অত্যন্ত সুক্ষ্ম। তার যে কোনও পংক্তিই ধারণ করে একটি স্বচ্ছ নেপথ্য চিত্র।
এখানেই তুমি স্থির হয়ে আছো
কাঁচের প্রতিদৃশ্যের আড়ালে
ঠিক একটা চিত্রকর্মের মতো, হ্যাঁ
যেন কোনও একাকীত্বের মহার্ঘ শরীর ...
(বডি অব এ ওম্যান/ ‘নারীদেহ’/ টকিং ডার্টি টু দ্যা গডস্)

তিন.
জীবদ্দশায় দুঃখবোধ এবং বিরহকে সাথী করে বেঁচেছিলেন এসময়ের একজন পরিশুদ্ধ মননশীল কবি ত্রিদিব দস্তিদার। চলে গেলেন আকস্মিক। মাত্র বাহান্ন বছর বয়সে। খুব নিভৃতে। বর্ণিল সংগ্রামী ছিল তার জীবন। একটি জাতির মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেবার সৌভাগ্য খুব কম মানুষেরই হয়। ত্রিদিব দস্তিদার ছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা। কিন্তু পরিতাপের কথা, জাতি ও সমাজ তার মূল্যায়ন করেনি। অথচ চিরকুমার এই কবির কাছে প্রিয়তম ছিল তার স্বদেশ তার কবিতা।
যে সড়কে তুমি আছো, শুধু তুমি
ভিন্ন এক রূপে, অমৃত স্বপ্নে
সেখানে দাঁড়িয়ে যাই আমি
ভিক্ষাপাত্র হাতে সজল ভিখারী যেন ...
(সবাই যে দিকে যায়/ ত্রিদিব দস্তিদার)
আসলে মানুষ মাত্রেই তো ভিখারি। কেউ প্রেমের কাছে, কেউ প্রকৃতির কাছে, কেউ বৈভবের কাছে, কেউ আলোর কাছে, কেউ আঁধারের কাছে। কিন্তু একজন কবি তার বর্ণনায় যে সত্য চিত্রটি তুলে ধরতে পারেন তা সবাই পারেন না। দেড় দশকেরও বেশি সময় আগে কবি ত্রিদিব দস্তিদার তার প্রিয়তম ‘বাংলাদেশ’ এর যে নিখুঁত চিত্র তুলে ধরেছিলেন কবিতায়, সেই চিত্রটিকে স্থায়ীরূপে দেখেই চিরবিদায় নিয়েছে ত্রিদিব।
হে আমার বাঙলাদেশ
দুগ্ধবতী গাভীর ওলান
রাত্রির অন্ধকারে
তোমাকে নিশ্চুপে আজ
কে পরায় অদৃশ্য শেকল?

দুপায়ে তোমার
নিবিড় জড়িয়ে আছে
যেন এক দুগ্ধচোষা
দুধরাজ সাপ!
(বাঙলাদেশ/ কবিতা গণআন্দোলন/ মুহম্মদ নুরুল হুদা সম্পাদিত)
কি এক অমোঘ নিয়তি বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটির। কবি ত্রিদিব দস্তিদারের স্বপ্নীল চোখ দিয়ে কোটি কোটি পাঠক কি একই দৃশ্য দেখতে পাচ্ছেন না? তারপরও রাষ্ট্র ও নাগরিকরা সবাই যেন চোখ থাকতেও অন্ধ। শ্রবণশক্তি থাকার পরও বধির। কবিতার দৃশ্যপট সেই অন্ধত্ব, সেই বধিরতার দরোজায় আঘাত করেই যায়।

চার.
‘কবিতা লেখে জীবনকে। আর জীবন লেখে তার প্রাপ্তি এবং অপ্রাপ্তিকে।’ কথাগুলো বলেন যুক্তরাষ্ট্রের আলোচিত কবি আমীরি বারাকা। জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে যে পরিপূর্ণ সংস্কৃতির সাম্পানে চড়ে কবিরা বিশ্ব ভ্রমণ করেন তার নাম হচ্ছে কবিতা। একাকিত্বও এক ধরনের প্রশান্তির জন্ম দেয়। একজন কবি যখন মুক্ত জানালার পাশে বসে জাগ্রত আঁধারকে খুব ঘনিষ্ট হয়ে দেখেন, তখন অন্ধকারই হয়ে ওঠে তার প্রেমের প্রতিভূ। অথচ অন্ধকারকে আমরা অনেকেই ভয় পাই। অন্ধকার কবর কিংবা ভূতুড়ে নির্জন শ্মশানের কথা ভেবে শংকিত হয়ে পড়ি। ত্রিকোণ সূর্য কিংবা চতুষ্কোণ চাঁদের প্রতিবেশী যে মানুষ জেগে আছে যুগ যুগ ধরে তারা কিন্তু শুধুমাত্র উত্তরাধিকারই বহন করছে। হাত বদল হচ্ছে সময়ের। মন বদল হচ্ছে মানবিক পরিভাষায়।
সেই পরিভাষাকে মনের পরমাসনে তুলে আনেন কবি ওবায়েদ আকাশ। তার কালাভিভূতি আমাদেরকে শুন্যের অন্তর্দৃশ্য দেখায়।
‘পরম শূন্যের ভেতর বিবস্ত্র শরীরে খুব নিশ্চিত হওয়া যায়
কখনো বালুকাবেলায় ঢেউয়ের গর্জনগুলো পরম শূন্য হতে পাওয়া
মানু- জন্মের ভেতর পরিত্যক্ত আবাসন একক শূন্যের মানচিত্র
অথবা প্রস্থানবেলায় হিম ঘরে মুছে দেয় ঝুলকালি চিত্রমেলা ...
যতটা পথিক থাকে, প্রতিবেশ সমারোহে ভুলে থাকা আরোগ্যের ভাষা
বিবমিষা শরীরে, স্নানের পরিধিব্যাপে ফ্যাকাসে রোদ্দুর জ্বলে স্যাঁতসেঁতে ওমে

ভাষাহীন বৃষ্টিতে যাওয়া-আসা নীলাময় এ ভুবন-সংসারে
প্রকৃত মানুষ সকল গুহাময় পৃথিবীটা এফোঁড়-ওফোঁড় করে
মরে থাকে পরম শূন্যের গভীরে’
(পরম শূন্যের ভেতর/ মঙ্গল সন্ধ্যা সিরিজ-২০০৩/ নাশতার টেবিলে প্রজাপতিগণ/ ওবায়েদ আকাশ)
প্রতীক প্রবাহে মানুষই পারে গুহাময় পৃথিবীটা এফোঁড়-ওফোঁড় করতে। সেই চেতনা ও চয়নে অন্তর্দীপ্ত হতে হতে, তারপর মানুষ সম্পন্ন করে নিসর্গের একান্ত পাঠ। আর সেই পাঠই সঞ্চিত থাকে পাঠকের জন্য, পাঠিকার জন্য। যুগ থেকে মহাযুগে।

পাঁচ.
না পাওয়া এবং বিরহ সমার্থক শব্দযুগল। ‘না পাওয়া’টা হচ্ছে সাময়িক, আর বিরহটি হচ্ছে স্থায়ী। দৃশ্যগুলো সবসময়ই বিরহবাদি। বিগত হলেই স্মৃতি হয়। মধুর স্মৃতি কিংবা মিলনদৃশ্যগুলোর জন্যও প্রাণ হু হু করে ওঠে।
‘ছত্রখান ঘরদোর। হাওয়ায় কঠিন গন্ধ ওড়ে।
তোমরা কি ভেবেছ জানি। আমিও অনেকটা তাই
ভেতরে ভেতরে কিছু পোড়ে।

কী যে পোড়ে, যদিও তা খুঁজতে নেইনি তেমন উদ্যোগ,
তোমাদের কথামতো আরোগ্য বুঝিনি আমি,
সে আমার সর্বশ্রেষ্ঠ রোগ। ...’
(আগুন/ মন্দাক্রান্ত সেন/ কৃত্তিবাস, জানুয়ারী’০৪ সংখ্যা)
কোন কবিতাটি বহুল পঠিত হবে এবং কেন হবে, সে প্রশ্নটির উত্তর খোঁজেন অনেক পাঠক-পাঠিকা। এমনকি বোদ্ধা কবিও। একটি কবিতা যদি বৃহৎ গোষ্ঠীমানবের মনের কথা না বলতে পারে তবে তা বহু মানুষের হৃদয়ে স্থান পাবে কেন? শব্দ, চিত্রকল্প, উপমা, উৎপ্রেক্ষার ভাঙচুর আগে ছিল, এখনো আছে, ভবিষ্যতেও থাকবে। ওজনদার ব্যাকরণিক তর্কে না গিয়ে যে কথাটি সহজ কথায় বলা যায় তা হচ্ছে কবিতা হচ্ছে জলের সাথে মীনের খেলার মতো। গহীন জলরাশিতে ঘাঁই দিয়ে যায় রূপোলি ইলিশ-চিতল। কবিতার বুনন যদি ‘কবিতা’ হয় তবে এর দু’চারটি পংক্তি পাঠকের হৃদসাগরে ঘাই দেবেই।
আমার সমুখে এসে একবার খোলো তো কামিজ।
দেহ কি কেবল দেহ? নয়। সে তো গন্দমের বীজ।
আমি সেই বীজ নিয়ে ছড়াবো যে বৃষ্টিভেজা মাঠে
একজন কবি সেই মাঠ ভেঙে আজীবন হাঁটে।
(হাঁটা/ সৈয়দ শামসুল হক/ প্রেমের কবিতা)
এই দৃশ্যান্তরের গল্প এর চেয়ে আর কত চমৎকার হতে পারে! আর কত মর্মস্পর্শী হতে পারে হৃদয় মাঠ ভাঙার গান! সার্থক কবিরূপ স্রষ্টার হাত!
বলছিলাম দৃশ্যকবিতার কথা। দৃশ্যকবিতাগুলো আঙ্গিকে ছোট হলেও খুব সহজে প্রবেশ করতে পারছে মনের গহনে। সম্প্রতি পড়া একটি কবিতার উদ্ধৃতি দেবার লোভ সংবরণ করতে পারছি না।
‘চক্রব্যুহের ভিতরে ও বাইরে তখনও অস্তিত্ব সচেতন কিছু মানুষ বেছে নিচ্ছিল জনযুদ্ধের পথ’ (পথ/ সৌমিত্র সেনগুপ্ত)
একটি চমৎকার আর্টের সাথে মাত্র এক লাইনের এই পংক্তি। কবিতায় যে নিরীক্ষণ চলছে, দৃশ্যকবিতা এর নতুন সংযোজন। কবিতা পথ চলছে। পথও ধারণ করে রাখছে কবি ও কবিতার ছায়াচিত্র। অনেকে হেঁটে গেছেন। অনেকে যাচ্ছেন। অনেকে যাবেন। একটি ভালো, পরিশুদ্ধ কবিতা পাঠই পারে একজন পাঠকের মনকে সমৃদ্ধ করতে। যে কবিতার নেপথ্য আকাশে পাঠক চিহ্নায়ণ করতে পারেন তার একান্ত নিজস্ব দিগন্ত।


মন্তব্য

রণদীপম বসু এর ছবি

একটি ভালো, পরিশুদ্ধ কবিতা পাঠই পারে একজন পাঠকের মনকে সমৃদ্ধ করতে। যে কবিতার নেপথ্য আকাশে পাঠক চিহ্নায়ণ করতে পারেন তার একান্ত নিজস্ব দিগন্ত।

চমৎকার কথা ! ভালো লাগলো লেখাটা পড়ে।

-------------------------------------------
‘চিন্তারাজিকে লুকিয়ে রাখার মধ্যে কোন মাহাত্ম্য নেই।’

ফকির ইলিয়াস এর ছবি

ধন্যবাদ পড়ার জন্য ।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।