মহিউদ্দিন শীরুঃ নিভৃতচারী একজন শব্দ সৈনিকের চির বিদায়
ফকির ইলিয়াস
======================================
কী অভিধায় অভিষিক্ত করা যাবে তাঁকে ? কবি, সাংবাদিক, শিক্ষক, সংগঠক, সমাজসেবক ? বড় নিভৃতচারী মানুষ ছিলেন তিনি। কথা বলতেন খুব ভেবে। ছিলেন মহান মুক্তি সংগ্রামের চেতনার অন্যতম ধারক। না-তার কিছুই চাওয়ার ছিল না। সমাজকে, প্রজন্মকে দিয়ে যেতে চেয়েছেন সর্বদা। তিনি সব সময়ই থেকে যেতে চেয়েছেন মফস্বল শহরে।মহিউদ্দিন শীরু। সত্তরের দশকে সিলেট বিভাগ অঞ্চলকে সাহিত্যে, সাংবাদিকতায় সমৃদ্ধ করতে এগিয়ে এসেছিলেন যে ক’জন তরুণ, তিনি ছিরেন তাদের অগ্রসেনানী। তুখোড় প্রাণচাঞ্চল্য ছিল তার। বিশ্বাস করতেন কর্মে। লালন করতেন সমাজ সংস্কারের মেধাবীজ। সেই মানুষটি চলে গেলেন বড়ই অকালে। মাত্র ৫৪ বছর বয়সে। অনেক অসমাপ্ত কাজ রেখে।
গেল ২৪ সেপ্টেম্বর ২০০৯ বৃহস্পতিবার দিবাগত রাতে চিরবিদায় নিয়ে চলে গেলেন মহিউদ্দিন শীরু। অবসান হয়ে গেল একজন মননশীল কবির। যবনিকাপাত হয়ে গেল একজন সৃজনশীল সাংবাদিকের জীবনের। তিনি ১৯৫৫ সালের ২৫ জুলাই জন্মগ্রহণ করেন সিলেটের বালাগঞ্জ উপজেলার জামালপুর গ্রামে। সংবাদপত্রের সাথে সংশ্লিষ্ট হন সেই ১৯৭৩ সাল থেকে। বাংলাদেশের প্রাচীনতম সাপ্তাহিক যুগভেরী’র ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি হিসেবে যাত্রা শুরু হয়েছিল তার। ১৯৭৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গণসংযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগে এম এ পাশ করেন কৃতিত্বের সাথে।
স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে সিলেট বিভাগ অঞ্চলে সাহিত্য আন্দোলনকে এগিয়ে নিতে তার ভূমিকা ছিল অগ্রণী। বিভিন্ন সাময়িকী, স্মরণিকা, লিটন ম্যাগাজিনে তার কবিতা, গদ্য ছাপা হতো নিয়মিত। ১৯৮২ সাল সাথে বন্ধ হওয়া পর্যন্ত তিনি ছিলেন দৈনিক বাংলার বাণী’র সিলেট প্রতিনিধি।
মহিউদ্দিন শীরু’র প্রধান গুণ ছিল, তিনি সত্যের পক্ষে সবসময় ছিলেন সৃজনশীল। কোন অপধ্যান তাকে স্পর্শ করতে পারেনি আজীবন। তার জীবনের প্রধান প্রত্যয় ছিল, প্রজন্ম শিক্ষিত হয়ে গড়ে উঠুক। সেই তাগিদ নিয়ে তিনি কাজও করে গিয়েছেন আমৃত্যু পর্যন্ত।
মহিউদ্দিন শীরুর অভিবাসী বাঙালিদের কাছে ছিলেন অত্যন্ত সুহৃদ ব্যক্তিত্ব। কোনো প্রবাসী দেশে গিয়ে কোনো সমস্যা কবলিত হলে তিনি সব সময়ই বাড়িয়ে দিতেন তার উদার হাত। বিশেষ করে সিলেট প্রেসক্লাবের একজন কর্মকর্তা হিসেবে গণমানুষের প্রতি তার আন্তরিকতা ছিল আকাশচুম্বী। ১৯৯১-৯২, ৯৩-৯৪ সালে তিনি সিলেট প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন প্রখর যোগ্যতার সাথে।
কবি মহিউদ্দিন শীরু ছিলেন একজন কৃতি গীতিকারও। তার অনেক গান রেডিও-টিভিতে প্রচারিত হয়েছে। তার সক্রিয় উদ্যোগে “বঙ্গবন্ধু পরিষদ” সিলেট গঠিত হয়। তিনি ছিলেন প্রতিষ্ঠাতা আহবায়ক। এছাড়াও কেন্দ্রীয় মুসলিম সাহিত্য সংসদের আজীবন সদস্য, সিলেট শিল্পকলা একাডেমীর নির্বাহী সদস্যের দায়িত্ব পালন করেন তিনি।
একজন দীক্ষক হিসেবে প্রজন্মের খুব কাছে ভীড়তে পারতেন মহিউদ্দিন শীরু। শিক্ষার উন্নয়নে তার চিন্তা ধারা ছিল সুদৃঢ় প্রসারী। নিজ এলাকা বালাগঞ্জে, বালাগঞ্জ কলেজ -প্রতিষ্ঠার পর তিনিই প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষের দায়িত্ব নেন। সেই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের হাজারো আলোচিত প্রজন্ম এখন দেশ ও জাতির মুখ উজ্জ্বল করছে বিভিন্ন ক্ষেত্রে।
তিনি ১৯৮৬, ১৯৯১ ও ১৯৯৩ সালে যুক্তরাজ্য সফরকালে অভিবাসী বৃটেন বাসীর জীবন ও প্রজন্ম নিয়ে যে রিপোর্টগুলো করেন। তা দেশে বিদেশে ব্যাপক প্রশংসিত হয়। সে সব লেখায় তিনি প্রবাসীদের সমস্যা। সম্ভাবনা ও চাওয়া-পাওয়ার কথা তোলে ধরেন নিজ অভিজ্ঞতার আলোকে।
মহিউদ্দিন শীরু ছিলেন একজন সুদক্ষ সম্পাদক। তার সম্পাদনায় ‘সাপ্তাহিক গ্রাম সুমরা’ এবং ‘দৈনিক সুদিন’ সে সময়ে বেশ জনপ্রিয়তা পায়। যদিও পত্রিকা দুটি দীর্ঘায়ু লাভ করতে পারেনি নানা কারণে। এছাড়াও তিনি ইংল্যান্ড থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক সুরমা, সাপ্তাহিক পূর্বদেশ, সাপ্তাহিক পত্রিকা’র সিলেট প্রতিনিধির দায়িত্ব পালন করেছেন বিভিন্ন সময়ে।
তার সম্পাদিত গ্রন্থগুলোর মধ্যে অন্যতম গবেষণা গ্রন্থটি হচ্ছে, “সিলেটের শতবর্ষের সাংবাদিকতা”। ১৯৯৮ সালের মে মাসে গ্রন্থটি প্রকাশিত হয়। একটি দালিলিক গ্রন্থ হিসেবে এটি দেশে বিদেশে ব্যাপক প্রশংসা কুড়ায় বের হবার পরপরই। ১৮৪ পৃষ্ঠার এই গ্রন্থটিতে তিনি ১৮৩৯ সাল থেকে প্রকাশিত সংবাদপত্রের ইতিবৃত্ত তুলে ধরেন অত্যন্ত যত্নের সাথে। দেশে এবং প্রবাসে কর্মরত সিলেট বিভাগ অঞ্চলের সাংবাদিক, সংবাদপত্রের একটি আকর সংরক্ষণ করার প্রয়াসী হন তিনি এই গ্রন্থে। যা ভবিষ্যতের কোনো গবেষকের কাজে লাগবে তথ্যকোষ হিসেবে।
কবি মহিউদ্দিন শীরুর সাথে আড্ডার মুখোমুখি হয়েছি অনেকবার। সে সব স্মৃতি বলে শেষ করার মতো নয়। তার ধীশক্তি, সুচিন্তিত মতামত আর সাহিত্য-সংস্কৃতি বিষয়ে প্রাজ্ঞতা যে কাউকেই আলোকিত করতো। তিনি বলতেন কম, শুনতেন বেশি।
শীরু যে মেধা এবং মনন নিয়ে জন্মেছিলেন, তার বিকাশ আরো ব্যাপকতা পেতো যদি তিনি রাজধানীবাসী হতেন। সে কথা তাকে জিজ্ঞাসাও করেছি বিভিন্ন আড্ডায়। হেসে জবাব দিয়েছেন, আমি মফস্বলের সাংবাদিক। এখানেই থেকে যেতে চাই আজীবন। নিজ মাটির প্রতি তার মমত্ববোধ প্রজন্মের কাছে অনুসরণীয় হয়েই থেকে যাবে চির দিন।
সুরমা নদীর তীরে সুরমা মার্কেটেই তার অফিস ছিল এক সময়। মনে পড়ছে সেখানে আড্ডা দিতে দিতে আমরা সারদা স্মৃতি ভবনের পাশ দিয়ে হেঁটে যেতাম সুরমার তীরে। বসে দেখতাম সুরমার উথলা ঢেউ। কিংবা শিল্পকলা একাডেমীর আড্ডায় শুনতাম দরাজ কণ্ঠে কোনো শিল্পীর গান। শিকড় সন্ধানী এই মানুষটি সিলেটের সংস্কৃতি নিয়ে আরো ব্যাপক কাজ করার ইচ্ছে ব্যক্ত করেছিলেন। তা অসম্পূর্ণই থেকে গেল।
তার সাহিত্য কর্মগুলো মানবত্মার প্রেরণা হয়েই থাকবে অনন্তকাল। সম্পাদিত গ্রন্থ ‘তোমার আসন শূন্য আছি (২০০২)’, ‘জীবনী গ্রন্থ- সিরাজ উদ্দিন আহমদ, ‘প্রবাসে বালাগঞ্জবাসী’, ‘কবিতাপত্র’, ‘শব্দদ্রুম’ রয়ে যাবে তার স্মৃতি বহন করে। তার মৌলিক দুটি কাব্যগ্রন্থ' ‘পাখির স্বজন নেই’ (২০০৮), ক্লান্ত রাতের ধ্রুবতারা (২০০৯) উজ্জ্বল জ্যোতি ছড়াবে বাংলা সাহিত্যাঙ্গনে।
সংশ্লিষ্ট সবাইকে বিনীত অনুরোধ করি, তার অপ্রকাশিত লেখাগুলো প্রকাশে এগিয়ে আসুন। তার চেতনা ছড়িয়ে দিন মানুষের প্রাণে প্রাণে। আর তাই হবে তার প্রতি শ্রেষ্ঠ সম্মান। তার আত্মার চির শান্তি লাভ করুক।
নিউইয়র্ক, ২৭ সেপ্টেম্বর, ২০০৯
----------------------------------------------------------------------
দৈনিক উত্তরপূর্ব । সিলেট । ২৮ সেপ্টেম্বর ২০০৯ সোমবার প্রকাশিত
ছবিতে - আব্দুল গাফফার চৌধুরীর সাথে স্বস্ত্রীক মহিউদ্দীন শীরু
মন্তব্য
বছর তিনেক আগে 'সিতারা পারভীন স্মৃতিগ্রন্থে'র প্রকাশন অনুষ্ঠানে সিলেট থেকে ঢাকা এসেছিলেন মহিউদ্দিন শীরু। ওই অনুষ্ঠান শেষে শীরু ভাই সিলেট অথবা বালাগঞ্জে যাওয়ার আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। 'যাবো' বলে কথাও দিয়েছিলাম। কিন্তু নাগরিক ব্যস্ততায় আর হয় ওঠেনি। ভবিষ্যতে হয়তো যাবো। কিন্তু শীরু ভাইয়ের সঙ্গে আর দেখা হবে না।
শীরু ভাইয়ের আত্মা শান্তি লাভ করুক।
ঝিনুক নীরবে সহো, নীরবে সয়ে যাও
ঝিনুক নীরবে সহো, মুখ বুঁজে মুক্তো ফলাও।
শীরু ভাইয়ের আত্মা শান্তি লাভ করুক।
শ্রদ্ধা............
---------------------------------------------------------
ঘাস তুমি ঘাসের মতো থাকো মাটি ছুঁয়ে
যে দেখার সে নতজানু হয়ে ছুঁবে তোমার আঙুল
অবরুদ্ধ মাঠ থেকে তুমি লাফিয়ে নেমোনা প্লিজ পাথরের পথে
---------------------------------------------------------
ঘাস তুমি ঘাসের মতো থাকো মাটি ছুঁয়ে
যে দেখার সে নতজানু হয়ে ছুঁবে তোমার আঙুল
অবরুদ্ধ মাঠ থেকে তুমি লাফিয়ে নেমোনা প্লিজ পাথরের পথে
________________________________________
http://ahmedurrashid.
তিনি ছিলেন গণমানুষের সুহৃদ ।
কবি আহমদ ময়েজ এসএমএস করলেন - 'প্রায় আধাঘন্টা আগে শীরু ভাই মারা গেছেন' মনটা খারাপ হয়ে গেলো। যে কোন মৃতূ্যই শোক বয়ে আনে। যাদের চিনি -চিনতাম তাদের চলে যাওয়া কষ্ট দেয়। 'গ্রাম সুরমা'র অফিসে গিয়েছি অনেকবার। ছড়া-কবিতা ছাপা হয়েছে তার পত্রিকায়। শিল্পকলায়, রেডিওতে মাঝে-মধ্যেই দেখা হয়ে যেতো। খুব স্মার্ট লোক ছিলেন। তার আত্মার শান্তি কামনা করছি।
-----------------------------------------------------
আমার জীবন থেকে আধেক সময় যায় যে হয়ে চুরি
অবুঝ আমি তবু হাতের মুঠোয় কাব্য নিয়ে ঘুরি।
আমার জীবন থেকে আধেক সময় যায় যে হয়ে চুরি
অবুঝ আমি তবু হাতের মুঠোয় কব্য নিয়ে ঘুরি।
বড় বেদনাদায়ক।
ভালো থাকুন
শীরু ভাইয়ের এই মৃত্যু অকাল মৃতয়ুই বলা চলে।ভদ্র,সজ্জন মানুষটির এই চলে যাওয়া,অকালে চলে যাওয়া মেনে নিতে খুব কষ্ট হয়।তবু এই অমোঘ নিয়তি মেনে না নিয়েও উপায় নেই।
শীরু ভাইয়ের আত্মা শান্তি লাভ করুক অন্তিমে এই প্রার্থনা।
তমিজ উদদীন লোদী
শীরু ভাইয়ের আত্মা শান্তি লাভ করুক অন্তিমে এই প্রার্থনা।
নতুন মন্তব্য করুন