সিঙ্গাপুরে এখন চীনা নববর্ষের ছুটি চলছে। এই ছুটিতে আমরা কি নিয়ে ব্যস্ত সেটাতো বলেছি আগের পোষ্টেই। বৃহষ্পতি ও শুক্র এই দুই দিনের সরকারি ছুটির লেজে যোগ হয়েছে শনি ও রবিবারের সাপ্তাহিক ছুটিও। ছুটির আমেজে পুরো সিঙ্গাপুর এখন যেনো অলস কোনো দুপুরে ঘাট বাধানো পুকুরের শান্ত নীরব জল।
বাংলাদেশে পহেলা বৈশাখ অনেক রঙীন আর উচ্ছাসসমৃদ্ধ হলেও ঈদ আর পুঁজার সময়টাই বছরের সবচেয়ে বড় আলোড়ন। চীনাদের জন্য ব্যাপারটা তার উল্টো। 'চাইনিজ নিউ ইয়ার' বা চীনা নববর্ষই হচ্ছে চীনাদের প্রধান উত্ সব, প্রধান ঘরে ফেরার তাড়না, প্রধান ছুটি। অনেকে একে বসন্ত উত্ সবও বলে থাকে। সিঙ্গাপুরের মোট জনসংখ্যার শতকরা প্রায় ৭৭ ভাগই চীনা বংশোদ্ভুত কিংবা চীনা নাগরিক হওয়ায় চীনা নববর্ষই যে এখানকার সর্ববৃহত্ উত্ সব হবে সেটাই স্বাভাবিক। শুধু সিঙ্গাপুরেই নয়, এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় বিভিন্ন দেশে চীনারা ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকায় এই উত্ সব পূর্ব এশিয়ার অন্যতম বৃহত্ উত্ সব হিসেবে প্রতি বছর সারম্বরে পালিত হয়।
চীনা পঞ্জিকা মোতাবেক প্রতি বছর নববর্ষের দিনটি আসে চন্দ্রের হিসেবে। প্রথম চান্দ্র মাসের প্রথম দিনটিই হলো নববর্ষ উত্ সবের প্রথম এবং প্রধান দিন। সেই হিসেবে এবার ৭ই ফেব্রুয়ারী ছিল সেই মাহেন্দ্রক্ষণ।
বর্ষগণনা ছাড়াও (পঞ্জিকা মতে এবার ৪৭০৫ সাল!) প্রতিটি চীনা বছরেরই আলাদা করে একটা নাম থাকে। নতুন এই বছরকে বলা হচ্ছে ইঁদুরের বছর (the year of the rat)। গেলবছর ছিল শুকরছানার বছর (the year of the pig)। বছর ঘুরে এরকম মোট বারোটা প্রাণীর নামে বিভিন্ন বছরের নামকরণ করা হয়। নববর্ষের উত্ সব লেগে থাকে প্রায় দুহপ্তা এবং শেষ হয় পঞ্চদশ দিনে লন্ঠন উত্ সবের মধ্য দিয়ে।
এবার নববর্ষের আগের কয়েকদিন সিঙ্গাপুরের টিভি চ্যানেলগুলোয় প্রধান খবর ছিলো চীনের নববর্ষপূর্ব আবহাওয়া বিভ্রাট। আমাদের যেমন প্রতি ঈদে গ্রামেরবাড়িমুখী জনতার স্রোত একটা সাধারণ দৃশ্য, চীনেও নববর্ষ উপলক্ষে একই দৃশ্য। সবাই চায় আর কিছু হোক না হোক, নববর্ষের রাতে পরিবারের সকলে মিলে ভুঁড়িভোজটা যেন মিস না হয়! তাই যে কোনো মূল্যে দেশের যে কোনো প্রান্ত থেকে নববর্ষের দিনে পরিবারের কাছে ফেরা চাই। কিন্তু টিভির খবরে এবারে দুঃখজনক ব্যাপার দেখা গেল। দক্ষিণ চীনের প্রদেশগুলোয় গত পঞ্চাশ বছরের সবচেয়ে ভয়াবহ তুষারপাত হয়েছে। ওদিককার বাস-ট্রেন সহ সব ধরণের যোগাযোগ বন্ধ ঘোষণা করেছে কেন্দ্রীয় সরকার। স্টেশনগুলোয় আটকে পড়ে দুর্ভোগ পোহাচ্ছে লক্ষ মানুষ। এদের কষ্ট টিভিতে দেখে বার বার মনে পড়লো বাংলাদেশের ঈদপূর্ববর্তী গাবতলী, মহাখালী আর সদরঘাটের কথা। দক্ষিণ চীনে প্রচন্ড ঠান্ডায় জমে যাচ্ছে বাড়ি ঘরের হিটিং সিস্টেম। মন্ত্রী মিনিস্টাররা হন্তদন্ত হয়ে ছুটছেন কয়লার খনিগুলোয়, কালিঝুলি মাখা শ্রমিকদের সাথে ঘন্টায় ঘন্টায় হাত মিলাচ্ছেন, আরো বেশি করে যাতে কয়লা উত্তলিত হয়।
সিঙ্গাপুরে এই রকম কোনো ভোগান্তি নেই। সব ফিটফাট, ছিমছাম। এইটুকুন একটা দ্বীপদেশ, এক্সপ্রেসওয়ে ধরে ঘন্টাখানেক ট্যাক্সিতে অবিরাম ছুটলেই এ মাথা ওমাথা কাবার; সুতরাং বোসকা-পোটলা নিয়ে বাস-ট্রেনের ঝক্কি এখানে কাউকে পোহাতে হয় না। ট্রপিক্যাল আবহাওয়া, তাই একটু আধটু বৃষ্টি ছাড়া কোনো সমস্যা নেই। নববর্ষের আগের রাতেই যার যার কেনাকাটা শেষ হয়ে গেছে, অন্তর্মুখী সিঙ্গাপুরিয়ানরা ছুটি পেয়ে আরো গর্তে ঢুকে গেছে, দিনের বেলা হয়তো কোথায়ো ড্রাগন নৃত্য হচ্ছে কিন্তু তা এতই মার্জিত যে অল্পক্ষণ দেখলেই একঘেয়ে লাগছে। এরপরও টানা চারদিনের ছুটি চাইনীজ অধ্যুষিত, দ্রুত ধাবমান এই শহরে এনে দিয়েছে অন্য আরেক স্বাদ, একটু ঢিলেঢালা হবার আর অনেক ছুটে চলার পর একটু স্লথ হয়ে দম নেবার। আর তাইতো বছর জুড়ে এপার্টমেন্টের যে চায়নিজ প্রতিবেশিটার সাথে শুধু ইউনিভার্সটি বাসস্টপেই দেখা হতো, নববর্ষে আমার ব্লকের নীচতলায় লিফটের গোড়ায় তার সাথে দেখা হয়ে গেলে বাত্ সরিক কুশল বিনিময়টা হয়ে যায়, হলদে দাঁতের পাটিজোড়া বের করে ব্যাটা বিগলিত হাসি দিয়ে বলে উঠে,'গোয়াঙশি ফা চাই'- ধনে মানে সমৃদ্ধ হও।
আমিও মৃদু হেসে 'সেম টু ইউ' বলি ।
মন্তব্য
ভালো লাগল! মজার অনেক তথ্য পেলাম
___________________________
বুড়োরা সবাই সমস্বরে বললো, "নবজন্ম", আমি চাইলাম "একটা রিওয়াইন্ড বাটন"
চীনা নববর্ষ নিয়ে আরো অনেক মজার মজার ব্যাপার আছে। সময় না থাকায় পোষ্টে উল্লেখ করতে পারি নি। যেমন, নববর্ষ নিয়ে কিছু সুন্দর মিথ প্রচলিত আছে। একটা মিথ হলো, প্রাচীন চীনদেশে নিয়ান নামের এক জন্তু বাস করতো পর্বতে (অনেকের মতে সমুদ্রে)। সেই নিয়ান প্রতি নববর্ষের রাতে লোকালয়ে এসে লোকজনকে হামলা করতো,ধরে নিয়ে যেত ফুটফুটে শিশুদের। চীনারা বিশ্বাস করতো যে নিয়ান উচ্চশব্দ আর লালরং- এই দুই জিনিস সহ্য করতে পারে না। সেই থেকে নববর্ষে যোগ হয়েছে আঁতশবাজি, ড্রাম, ড্রাগন ড্যান্স আর লাল রং দিয়ে ঘর সাজানো, উপহার দেয়া, পোষাক বানানো ইত্যাদি।
নববর্ষে কেউ যদি জুতো কিনে, সেটাকে দেখা হয় মারাত্মক অশুভ হিসেবে। জুতো হচ্ছে অশুভ আত্মার প্রতীক।
----------------------------------------------
আমাকে নিঃশব্দে অনুসরণ করে একটা নদী-
সাথে নিয়ে একটা পাহাড় আর একটা নিঃসঙ্গ মেঘ।
আমি মালয়শিয়াতে একবার চীনা নববর্ষ পেয়েছিলাম । সুরিয়া কে.এল.সি.সি -র (শপিং মল) লোয়ার গ্রাউন্ড এ খুব সুন্দর করে সাজানো হয়েছিল...রাতের বেলা হোস্টেল বারান্দায় মেয়েরা ছুটোছুটি শুরু করে দিতাম; কারন হলো অসাধারন আতশবাজী....আসলেই দারুন ছিল.....
Gong Xi Fa Chai
----------------------------------
আইরিন সুলতানা
চীনা নববর্ষের আঁতশবাজি আসলেই সুন্দর। সিঙ্গাপুরে অবশ্য থার্টি ফার্ষ্ট নাইটে যে আঁতশবাজি হয় তার কাছে অন্যসব দিনের আঁতশবাজি নস্যি।
----------------------------------------------
আমাকে নিঃশব্দে অনুসরণ করে একটা নদী-
সাথে নিয়ে একটা পাহাড় আর একটা নিঃসঙ্গ মেঘ।
চীনেও ঘরমুখী মানুষের স্রোত, ঘর ছাড়া মানুষের আর কিই বা আছে। পড়ে ভাল লাগলো। নতুন একটা চাইনিজ লিখলাম, "গোয়াঙশি ফা চাই"।
মুহাম্মদ২০১৭
----------------------------------------------
আমাকে নিঃশব্দে অনুসরণ করে একটা নদী-
সাথে নিয়ে একটা পাহাড় আর একটা নিঃসঙ্গ মেঘ।
'গোয়াঙশি ফা চাই'- ধনে মানে সমৃদ্ধ হও।
গোয়াঙশি ফা চাই। আপনার পরবর্তী সিনে-মারি-ভিউ কবে পড়ছি?
----------------------------------------------
আমাকে নিঃশব্দে অনুসরণ করে একটা নদী-
সাথে নিয়ে একটা পাহাড় আর একটা নিঃসঙ্গ মেঘ।
সিঙ্গাপুরের আরো দুটি উৎসবের কথা মনে আছে। ক্ষুধার্ত ভূতের উৎসব (Hungry Ghost Festival) আর অন্যটা দুরিয়ান উৎসব। ক্ষুধার্ত ভূত উৎসবের ব্যাপারটা ভালো করে মনে নেই, সম্ভবত অগাস্ট-সেপ্টেম্বরের দিকে হয়। জানলে এ বিষয়ে একটা পোস্ট দিতে পারেন। দুরিয়ান নামের কাঁঠাল-সদৃশ ফলটি এতোই তীব্রগন্ধী যে কাছে ঘেঁষা যায় না। এখনো আছে কি না জানি না, একসময় দুরিয়ান নিয়ে পাবলিক ট্রান্সপোর্টে ওঠা নিষিদ্ধ ছিলো।
-----------------------------------------------
ছি ছি এত্তা জঞ্জাল!
বস্, অবশ্যই পোষ্ট দিবো। চীনাদের হরেক রকম উত্ সবের প্রতি আমার আগ্রহ আগে থেকেই। আর ডুরিয়ান সম্পর্কিত আপনার অভিজ্ঞতা আমার সাথে মিলে যায়। শুধু ডুরিয়ান না, কোনো খাদ্যদ্রব্য নিয়েই এখন আর কোনো ট্রান্সপোর্টে উঠা যায় না। জানেনি তো, সিঙ্গাপুর হচ্ছে 'ফাইন সিটি'।
আরেকটা পোষ্টে বিস্তারিত বলা যাবে তাহলে।
----------------------------------------------
আমাকে নিঃশব্দে অনুসরণ করে একটা নদী-
সাথে নিয়ে একটা পাহাড় আর একটা নিঃসঙ্গ মেঘ।
ভাল লাগল। লন্ঠন উত্ সব নিয়া কিসু লেখেন।
৫ দিয়ে রাখলাম।
---------
অনেক সময় নীরবতা
বলে দেয় অনেক কথা। (সুইস প্রবাদ)
------------
...অনেক সময় নীরবতা
বলে দেয় অনেক কথা...
অনেক ধন্যবাদ। অবশ্যই লিখবো।
----------------------------------------------
আমাকে নিঃশব্দে অনুসরণ করে একটা নদী-
সাথে নিয়ে একটা পাহাড় আর একটা নিঃসঙ্গ মেঘ।
মজা পেলাম।
অনেক কিছু জানতে পারলাম..
---------------------------------
মহিব
ভাবসাব দেখে মনে হইল "উনি একজন মানুষ"
---------------------------------------------
আমাকে নিঃশব্দে অনুসরণ করে একটা নদী-
সাথে নিয়ে একটা পাহাড় আর একটা নিঃসঙ্গ মেঘ।
নতুন মন্তব্য করুন