মানুষের জীবন কী কেবলই একটা দীর্ঘ সরলরেখা, নাকি অনেকগুলো চক্রের সমাহার?
অফিস থেকে ফিরে কাপড় না বদলিয়েই বারান্দায় চেয়ারটা টেনে নিয়ে এতদিন লুকিয়ে রাখা বেনসনে তীব্র একটা টান দিতে দিতে রফিক এই প্রশ্নটার উত্তর খুঁজছিল।
মাঝে মাঝে মনে হয় প্রতিটা দিনই এক একটা চক্র, ভোর ছ'টায় উঠে বাচ্চাকে স্কুলে দিয়ে আসা, তারপর নিজের চাকরি, মিটিং, এই ফাইল থেকে সেই ফাইল, লাঞ্চ, আবার মিটিং, ফাইল থেকে ফাইল, ভেন্ডিং মেশিনের কফিতে এক্সট্রা সুগার এক্সট্রা ক্রীম, আবার ফাইল, এরপর একসময় ছ'টা বাজলে বাড়ি ফেরা, বাচ্চাকে পড়ানো, ডিনার, টিভি, ঘুম, তারপর আবার ভোর ছ'টা, জীবনকে গোলকের গায়ে হেটে বেড়ানো পিপড়ার মত মনে হয় রফিকের।
তারপর আসে অবসাদ। মনে আছে রফিকের, প্রথম চাকরিতে ওরা ঢুকেছিল তিনজন, একসাথে। বছরের পর বছর জীর্ণ হতে থাকা বিগতযৌবনা পতিতার মত রুক্ষ কোনো এক সার কারখানায় ওরা তিনজন নবীন প্রকৌশলী, কী এক তীব্র আকাক্ষায় কাটিয়েছিল দুটি বছর! সিড়ি বেয়ে বারোতলা সমান উচ্চতার প্রিলিং টাওয়ারের ছাদে উঠে আবার নেমে এক দৌড়ে কন্ট্রোলরুমে পৌছতে ওদের আড়াই মিনিটের বেশি লাগতো না কখনই।
আর এখন? এই চৌদ্দতলা এপার্টমেন্টের বারান্দায় বসে প্রচন্ড ক্লান্ত রফিক, এবং স্মৃতিকাতর।
হাত দিয়ে মাছি সরানোর মত স্মৃতিগুলোকে দূরে সরিয়ে রাখতে চায় রফিক। চারদিক খুঁজেও ছাই ফেলার সুবিধামতন কোনো জায়গা নজড়ে পড়ে না তার। এ বাড়িতে কোনো ছাইদানি নেই, কারণ বিয়ের পর সিগারেট খাওয়া ছেড়ে দিয়েছে সে- নবপরিণিতার মুখের দিকে তাকিয়ে নয়, সিমেন্টের মত ক্রমশ জমতে থাকা বউয়ের মুখ শুষে নিয়েছে সকল তৃষ্ণা।
তৃষ্ণা! অনেক দিন পর মালতীর কথা মনে পড়ে যায় রফিকের। কি হয়েছিল মালতীর, আজ থেকে দশ, বারো, কিংবা চৌদ্দ বছর আগে? দুয়েকটা বই আর একটা লম্বা খাতা বুকে চেপে ধরে ঝরে পড়া পাতার মতন ধীরপায়ে হেটে আসতো মালতী, শাড়িপড়া মালতী, পথ দিয়ে নয়, পাশের ফুটপাত ধরে। মালতীকে দেখলেই প্রচন্ড তৃষ্ণা পেত রফিকের। দুনিয়ার কোনো ঝর্ণার জল কিংবা বরফকলও সেই তৃষ্ণা মেটাবার সাধ্য রাখে না। অথচ, রফিক অবাক হয়ে আবিষ্কার করে, এই পড়ন্ত বিকেলের ঢলে পড়া সূর্যের আলোয়, শাড়িপড়া মালতীর কোনো ছবি আর তার মনে পড়ে না।
ছাইয়ের দৈঘ্য আরেকটু বাড়ে।
এরকম কতবার রফিককে আধোছাই আধোজ্বলন্ত শিখা হাতে নিয়ে বসে থাকতে হয়েছে, দুপুররাতের নিস্তব্ধ হলের সংসদরুমে, মিছিলের শুরুতে আবার মিছিলের শেষে, তাজুলের চিলেকোঠায়, বস্তির হাইডআউটে। কি একটা সময় ছিল তখন! বুকের মধ্যে বারুদ নিয়ে ঘুরেছে সে, বিষ্ফোরিত হবার আশায়, ও আকাক্ষায়।
কে যেন ঢেলেছে জল, একটু একটু করে বারুদে।
কষে আরেকটা টান দেয় রফিক। দিনে দিনে সিগারেট ছাড়তে ছাড়তে আর নিঃসঙ্গতা ধরতে ধরতে রফিক বুঝেছে, নিঃসঙ্গতায় সিগারেটের চেয়ে বড় সঙ্গী কেউ নেই আর। রফিকের বউ গিয়েছে বাচ্চাকে নিয়ে সুইমিং ক্লাসে। বহুদিন ধরে লুকিয়ে রাখা ড্যাম সিগারেট তাই সে খেতেই পারে এখন।
এরকম ড্যাম সিগারেট খেত আনন্দ। ও বলতো, বাসি বিড়ি, বাসি ভাতের মতই তার স্বাদ।
আনন্দ রফিকের চেয়ে কম করে হলেও বছর চার পাঁচের বড় হতো। কিন্তু ভাই ডাকার অধিকার আনন্দ কাউকে দেয়নি কখনোই। ও বলতো, আরে পোলা, ভাই ডাকস ক্যান, আনন্দের সাথে ভাই মিলে না, আনন্দ কেবলই আনন্দ, আকাশে বাতাসে আনন্দ, হা হা হা ...
আরো অনেক কিছুই বলতো আনন্দ। ছাত্র ইউনিয়ন করতো সে। আর করতো পরিচিতের মধ্যে রাতুল। ঝাড়া ছয়ফুট লম্বা, ফ্রেঞ্চকাট, ফর্সা, চশমাপড়া রাতুল ওর রুমমেট ছিল, সাড়েপাঁচ বছর।
আগুনঝরা সময়গুলোতে রাতুল ছিল কৃষ্ণচূড়ার ছায়ার মতন। আর আনন্দ ছিল খড়ের গাদায় লাগা উচ্চাকাক্ষী আগুন- তার গরম বাতাসের হলকায় পাশেই কচিলতার মত কাঁপতো রফিক। কী রকম বিষন্ন বৈপরীত্য নিয়ে থাকত ওরা তিনজন, একে অপরের মৌন হন্তারকের মত হয়ে ঘনিষ্ঠ হয়ে। আনন্দ ভালোবাসতো সংঘাত, কিংবা সংঘাতই তাকে ঠেলে দিয়েছিল ঘরের বাইরে, জানা হয়নি কখনো রফিকের। সে তুলনায় রাতুল ছিল ঋৃষির মত সংযত, শুধু বুকের ভেতর লুকিয়ে রাখতো শীতল ইস্পাত। কেন ওমনটা ছিল রাতুল, সেটাও রফিক কিংবা আনন্দ জানতে চায় নি।
তবু পুরোটা বিশ্ববিদ্যালয়জীবন ওরা জমাট বেধেছিল একটা ভাস্কর্যের মতন।
গরুর মত মার খেয়েছিল আনন্দ একদিন, পুলিশের হাতে। একটু ভারসাম্যহীন মিছিলের সামনে থাকলে যা হয়, তুলে নিয়ে গিয়ে রামধোলাই। রাতুল কীভাবে সবকিছু ব্যবস্থা করেছিল রফিক জানে না, পরদিন থানা থেকে ছাড়িয়ে আনন্দকে নিয়ে রিকশায় হলের গেটে নেমে রাতুল নীচ থেকে রফিককে ডাকতেই চারতলা রুমের বারান্দায় ছুটে গিয়েছিল রফিক। ওকে দেখে সেই বিখ্যাত হাসিদুটো দিয়েছিল রাতুল ও আনন্দ, যার যার মত করে, স্নিগ্ধ বনাম শানিত, পরিপাটি বনাম ধারালো।
এই সময় বেজে উঠে কলিংবেল। বেলের শব্দেই হয়ত হঠাত তড়িতাহতের মত কেঁপে উঠে রফিক। সেই কাঁপুনিতেই কিনা ফিল্টারের মুখ পর্যন্ত জমে উঠা ছাই ভেঙ্গে পড়ে যায় বারান্দার মেঝেতে। মুহুর্তের জন্য রফিক বুঝে উঠতে পারেনা কিছু, একবার ভাবে ফুঁ দিয়ে দূরের কোণায় সরিয়ে দেয়া যায় ছাইটাকে, আবার ভাবে কাগজ দিয়ে তুলে বাইরে ফেলে দেয়া যায়, বাইরে না হলেও নেহাত গোলাপ গাছের গোড়ায়, কেউ দেখবে না।
আনন্দ বলে, আরে ব্যাটা, দে ফুঁ। ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে দে সব, ছাইয়ের মতন উড়ে যাক জগত্.সংসার। ব্যাটা আইলস্যা, ফুঁ দে, ফুঁ।
রাতুল কিছু বলে না, কখনো বলতো না কিছুই। চোখে চশমা নিয়ে কেবল পুড়ে যাওয়া দেখতো ও।
রফিকের মনে হয়, কি দরকার! কত ছাই তো ওভাবেই পড়েছিল দুপুররাতের নিস্তব্ধ হলের সংসদরুমে, মিছিলের শুরুতে আবার মিছিলের শেষে, তাজুলের চিলেকোঠায়, বস্তির হাইডআউটে। কেউ কিছু বলে নি। তবে আজ এই চৌদ্দতলা ফ্ল্যাটের ঝুল বারান্দায় বসে ভয়ের চক্র ভেঙ্গে বেরিয়ে আসার ভয় কেন রফিকের?
তার চেয়ে বরং চক্রের বাইরের মালতীর কথা ভাবা যাক। কি হয়েছিল মালতীর, আজ থেকে দশ, বারো, কিংবা চৌদ্দ বছর আগে?
এইসব অহেতুক ভাবনা ভাবতে ভাবতে দরজাটা আর খোলা হয় না রফিকের। বোকা কলিংবেলটা কেবল বাজতেই থাকে।
© ফারুক হাসান
মন্তব্য
মাঝে মাঝে মনে হয় প্রতিটা দিনই এক একটা চক্র, ভোর ছ'টায় উঠে বাচ্চাকে স্কুলে দিয়ে আসা, তারপর নিজের চাকরি, মিটিং, এই ফাইল থেকে সেই ফাইল, লাঞ্চ, আবার মিটিং, ফাইল থেকে ফাইল, ভেন্ডিং মেশিনের কফিতে এক্সট্রা সুগার এক্সট্রা ক্রীম, আবার ফাইল, এরপর একসময় ছ'টা বাজলে বাড়ি ফেরা, বাচ্চাকে পড়ানো, ডিনার, টিভি, ঘুম, তারপর আবার ভোর ছ'টা, জীবনকে গোলকের গায়ে হেটে বেড়ানো পিপড়ার মত মনে হয় রফিকের।
আমারো তাই মনে হয়রে রফিক, জীবনটা তাইই হয়ে গেলো শেষ পর্যন্ত।
তানবীরা
---------------------------------------------------------
চাই না কিছুই কিন্তু পেলে ভালো লাগে
*******************************************
পদে পদে ভুলভ্রান্তি অথচ জীবন তারচেয়ে বড় ঢের ঢের বড়
এমনি করেই বিভিন্ন চক্রের কবলে বশীভুত হয়ে ম্যাড়ম্যাড়ে হয়ে যায় দিন আর সময়!
আপনার বাচনভঙ্গী প্রশংসার দাবীদার। খুব ভালো লাগলো গল্পটি।
**********************************
কৌনিক দুরত্ব মাপে পৌরাণিক ঘোড়া!
**********************************
যাহা বলিব, সত্য বলিব
আপনার ভালো লেগেছে জেনে অনুপ্রাণিত হলাম খুব।
-----------------------------
আমাকে নিঃশব্দে অনুসরণ করে একটা নদী,
সাথে নিয়ে একটা পাহাড় আর একটা নিঃসঙ্গ মেঘ।
এসব কিছুর পরও জীবন যে কেন এতো টানে...টানুক... চলুক...
লেখার জন্য (তালিয়া)
------------------------------------------------
দুঃখ তোমায় দিলেম ছুটি...
বুক পাঁজর আজ ফাঁকা।
দুঃখ বিদায় নিলেও সেথায়...
দুঃখের ছবি আঁকা।
দৃশা
জীবনের টানই আসলে শেষ কথা... তাই আমিও বলি, চলুক...
-----------------------------
আমাকে নিঃশব্দে অনুসরণ করে একটা নদী,
সাথে নিয়ে একটা পাহাড় আর একটা নিঃসঙ্গ মেঘ।
চলুক, চলুক, অবশ্যই চলুক !
গল্পে
-------------------------------
আকালের স্রোতে ভেসে চলি নিশাচর।
-------------------------------
আকালের স্রোতে ভেসে চলি নিশাচর।
ভাইরে খুবই বড়ো একটা চক্র আছি। সকালে ঘুম ভেঙ্গে চোখ কচলাতে কচলাতে অফিসে আসি, আবার অফিস থেকে বের ঠেলে বাসায়। সারাদিনের ক্লান্ত প্রাণ এক। মনে হয় সব ছেড়ে ছুঁড়ে য়াই। কিন্তু কোথাও যাই না। বেঁচে থাকি প্রতিদিন। কিসের যে টানে কে তা জানে!
একজন লেখকের পক্ষে অনেকসময়ই নিরপেক্ষভাবে গল্পের গতিপ্রকৃতি অনুসরণ করে নামকরণ করা নাও হয়ে উঠতে পারে। এটা বিশেষকরে আমার ক্ষেত্রে অনেকাংশেই সত্যি। স্বার্থকতাহীন নামকরণে আমার জুড়ি নেই। কিন্তু ব্লগ মাধ্যমের এই বড় একটা সুবিধা। পাঠকের সাথে গরমগরম প্রতিক্রিয়ার চালাচালি করা যায়, এবং অনেককিছুই শোধরানো যায়।
এই পোষ্টের কমেন্ট পড়ে মনে হচ্ছে গল্পের নামটা পাল্টে দেই। তাই 'ছাই' বদলে দিলাম 'চক্র'।
*********************************
আমাকে নিঃশব্দে অনুসরণ করে একটা নদী,
সাথে নিয়ে একটা পাহাড় আর একটা নিঃসঙ্গ মেঘ।
চক্রটা আছে বলেই কিন্তু চক্রের বাইরের জন্য আকুলতা। যত আকুলতা তত স্পন্দন। পিঁপড়ের জীবনেও আছে জীবনের সঞ্চয়। চক্র না থাকলে বাইরেটাই চক্র হয়ে পড়তো একসময়। তাই, ফুঁ দিয়ে ওড়ানো অথবা পুড়তে থাকা সত্বেও ঘেরাটোপের জানালা দিয়েই ঐ আকাশ আর জীবনের চলচ্ছবি। তাই চলতেই হয়, চরৈবতি।
*********************************
আমাকে নিঃশব্দে অনুসরণ করে একটা নদী,
সাথে নিয়ে একটা পাহাড় আর একটা নিঃসঙ্গ মেঘ।
ইস্, এতো দ্রুত শেষ করে দিলেন।
পড়তে দারুণ লাগছিলো...
আমারো মনে হয়েছে আরো বড় করা যেত, অনেক সম্ভাবনা ছিল গল্পটার, কিন্তু আর লিখতে ইচ্ছে করছিলো না। গল্প লেখা আমাকে দিয়া হবে না, সেই ধৈর্য্য নাই
গল্পটি পড়ে আপনার মতামত জানিয়েছেন বলে কৃতজ্ঞতা!
*********************************
আমাকে নিঃশব্দে অনুসরণ করে একটা নদী,
সাথে নিয়ে একটা পাহাড় আর একটা নিঃসঙ্গ মেঘ।
ছাই-এর চেয়ে চক্র নামটিই বেশি মানাচ্ছে গল্পটিকে।
~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
যৌনদুর্বলতায় ভুগছি দীর্ঘকাল। দুর্বল হয়ে পড়ি রূপময়ী নারী দেখলেই...
~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
টাকা দিয়ে যা কেনা যায় না, তার পেছনেই সবচেয়ে বেশি অর্থ ব্যয় করতে হয় কেনু, কেনু, কেনু?
*********************************
আমাকে নিঃশব্দে অনুসরণ করে একটা নদী,
সাথে নিয়ে একটা পাহাড় আর একটা নিঃসঙ্গ মেঘ।
যে কথাগুলো বলতে চাচ্ছিলাম, শিমুল ভাই ও সন্ন্যাসী দাদার মন্তব্যে বলা হয়ে গেছে।
আরো লিখুন, সিরাজী ভাই
আপনার লেখার কিংবা বলার ভঙ্গীটা স্বতন্ত্র।
অসাধারণ লেগেছে চিত্রকল্পটা।
নিজের ফুলদানীতে যারা পৃথিবীর সব ফুলকে আঁটাতে চায় তারা মুদি; কবি নয়। কবির কাজ ফুল ফুটিয়ে যাওয়া তার চলার পথে পথে। সে ফুল কাকে গন্ধ দিলো, কার খোঁপায় বা ফুলদানীতে উঠলো তা দেখা তার কাজ নয়।
___________________________ [বুদ্ধদেব গুহ]
বিকিয়ে যাওয়া মানুষ তুমি, আসল মানুষ চিনে নাও
আসল মানুষ ধরবে সে হাত, যদি হাত বাড়িয়ে দাও।
আররে ফলেন ভাইজান যে! আপনার গল্প কিন্তু এখনো দেন নাই সচলে!
*********************************
বলে এক আর করে আর এক যারা
তারাই প্রচণ্ড বাঁচা বেঁচে আছে দাপটে হরষে
এই প্রতারক কালে (মুজিব মেহদী)
নতুন মন্তব্য করুন