সুতরাং নাসের ভাবতে শুরু করে। অহেতুক। মানুষ, দায়বদ্ধতা, পাপ, যন্ত্রণা, বিবেক, দায়িত্ব, ফেলে আসা যৌবন।
লাঞ্চে খাওয়া ফ্রুটজুস পেটে একটা গোলমাল লাগিয়েছে, আনারস ছিল বোধহয়। একটা অস্বস্তি, তেষ্টার চেয়ে একটা শুষ্ক কাশি গলায় আটকে আছে। তার চেয়ে বড় কথা, কিছু করার নেই নাসেরের আগামী তিন ঘন্টা, বসে থাকা ছাড়া।
লিফটম্যান আনোয়ারও বসে থাকার কাজ করে। সকাল নয়টা থেকে ছয়টা একটা টুলে বসে লিফটের বোতাম টিপে টিপে কীভাবে একঘেয়ে কাজটা করে সে সারাদিন? একতলায় নামো, লোকজন উঠলে বোতাম টিপো, তিন, পাঁচ, ছয়, দশ, তেরো, আঠারো, বাইশ। প্রতি তলায় ওপেন, আবার ক্লোজ। আবার উপরে উঠে নামার জন্য নয়, দুই, এক। ওপেন, ক্লোজ। গোয়িং আপ, গোয়িং ডাউন। আনোয়ার, তোর বিরক্ত লাগে না?
আনোয়ার এই উপরে উঠছে তো পরমিনিটেই নিচে নামছে, অন্যের ইশারায় অবশ্যই। মিনিটে মিনিটে চড়াই-উৎরাই, তাই বোধহয় ওর জীবনটাও দিনশেষে সবচেয়ে একঘেয়ে। নাসের এইসব ভাবে।
একটু ঘুম আসি আসি করছে। তবে চেয়ারে হেলান দিয়ে ঘুমানো সম্ভব নয়, নয় টেবিলে মাথা রেখেও। অবসাদ লাগে ওর। জিব দিয়ে ঠোট চাটে।
পাশের ডেস্কের মোস্তফা উঠে দাড়িয়ে বলে, যাবেন নাকি, সিগারেট খেয়ে আসি? ডেস্কে বসে ধুমপান করা যায় না, দিনে কয়েকবার খোলা বারান্দায় দাড়িয়ে নাসের আর মোস্তফা সিগারেট খায়। নাসের একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে, কিন্তু তখনি গা ঝাড়া দিয়ে উঠে বলে, চলো। আসলে ওর বসে থাকতে ভালো লাগছিল না। কাজহীন কাজের চেয়ারে বসে থাকা ক্লান্তিকর।
নাসের আর মোস্তফা বারান্দায় দাড়িয়ে একমনে সিগারেট টানে। বারোতলার উপর এই অফিস। বারান্দায় দাড়িয়ে ঢাকার বহুদূর পর্যন্ত দেখা যায়। এই অফিস, নিচে বিরক্তিকর গাড়িগুলো, রিক্সার টুনটুন শব্দ, দৃষ্টি দূরে সরাতে থাকলে কংক্রিট, টাওয়ার, বিলবোর্ড, তারপর আস্তে আস্তে আসে বস্তি, কচুরিপানাভর্তি একটা নিচু এলাকা, তারপর ফাকায় হঠা হঠা গজিয়ে উঠা বিল্ডিংগুলোর কংকাল। বাইরে বেলা আড়াইটার প্রচন্ড রোদ।
রেলিংয়ে দুহাত রেখে সামনে ঝুকে হেলান দিয়ে দাড়ায় নাসের। নিচে তাকাতেই আবার সেই রাস্তা, গাড়ি, বাস, রিক্সা, ফুটপাতে ভাতের দোকান, ডাস্টবিন, রাস্তার মাঝখানে খোলা ম্যানহোল, মাঝখানে একটা বাঁশ লম্বা করে পোঁতা, তাকে এড়িয়ে একটা সিএনজি ধোঁয়া উড়িয়ে চলে গেল।
এতক্ষণ এইসব নৈর্ব্যক্তিক পরিবেশে, ভাবনায় আর অবসরে ঝিম মেরে যাওয়া নাসেরের হঠাৎ মনে হয়, আচ্ছা, এখন যদি সে এই বারোতলার উপর থেকে লাফ দিয়ে নিচে পড়ে আত্মহত্যা করে তাহলে?
এতক্ষণে ভাবার মত একটা বিষয় পেয়ে নাসেরের মনটা চঞ্চল হয়ে উঠে। কাল থেকে চাকরিটা আর থাকছে না, মিটিংয়ে এটা শোনার পর এই প্রথম অবসরটাকে তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে হয় নাসেরের কাছে।
মন্তব্য
- আরে, এটা পড়ার পরেও মন্তব্য করা হয় নি।
সিসেশানের যুগ শেষ হয় নাই এখনো?
কার গল্পে যেনো পড়েছিলাম লেখকের সহকর্মী ভদ্রলোক হঠাৎ চাকরি ছেড়ে চলে গিয়েছিলো নিজের স্বপ্নের বাস্তবায়নে। একটা ছোট্ট ফিশিং বোটে করে গিয়ে কোনো এক লেইকের পানিতে বসেছিলো। লেখকের সঙ্গে যখন তার দেখা হয় পরে, তখন তাকে লেখক আবিষ্কার করেন মহাসুখী একজন হিসেবে।
নাসেরকেও অমন করে পাঠিয়ে দিন কোথাও। যান্ত্রিক জীবনের এইসব ফাউল যান্ত্রিকতা সবার জন্য না।
___________
চাপা মারা চলিবে
কিন্তু চাপায় মারা বিপজ্জনক
ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর কর্মকাণ্ড । বিএসএফ ক্রনিক্যালস ব্লগ
চাকরি ছেড়ে নিজের স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য লেকের মাঝখানে বসে পড়তে যে সাহস লাগে সেই সাহস আমাদের নাই রে ভাই, তার চেয়ে পলায়নপর মনোবৃত্তির ফসল আত্মহত্যা করাই নাসেরের জন্য সহজ।
যদিও আত্মহত্যা কোনো কাজের কথা নয়, কিন্তু কাহিনীর প্রয়োজনে এর উল্লেখ অনেক নাটকীয়তা নিয়ে আসে। ফিকশনাল কারণেই হোক বা অন্য কোনো কারণে, এর উল্লেখ এই লেখায় অন্য মাত্রা এনেছে। আপনার লেখায় একটা নৈর্ব্যক্তিকতা আছে, গ্রীষ্মের অলস দুপুরের মতো, সেই মেজাজের সাথে এই উল্লেখে একটা চমৎকার বৈপরীত্যভাব এসেছে। পরের পর্বের আশায় রইলাম।
@ধূগো: নাসেরকে বিয়ে করতে বললেন না? এমন সর্বরোগহর বটিকার কথা আপনার মন্তব্যে বড়োই মিস করলাম।
আপনার মন্তব্যটা খুব ভালো লাগলো। আপনি ঠিক ধরেছেন।
পর্বে নিয়ে বলি। আসলে কোন সিরিজ লেখা নয় এটা। দুপুর নামে আমার আরেকটা পোস্ট ছিল। তাই এই পোস্টের নামে ২ লাগিয়েছি। কোন সিরিজ-টিরিজের ব্যাপার নয়। অনেক আগে একবার সকাল-দুপুর-রাত্রি নিয়ে আলাদা আলাদা নৈর্ব্যক্তিক গল্প লেখার একটা শখ মাথায় গেঁথে গিয়েছিল, সেটার জের হিসেবেই লিখেছিলাম 'সকাল', এবং পরে 'দুপুর'। এই পোস্টটাও অনেকটা সেই মেজাজের হয়ে যাওয়ায় তাই আবার দুপুর নাম দিলাম।
তবে এখন মনে হচ্ছে প্রতিটা লেখা আলাদা করে লিখেও অনেকগুলো হয়ে গেলে পরে একটা সেতুবন্ধ তৈরি করা গেলে পূর্ণাঙ্গ একটা লেখা হিসেবে একে দাড় করানো গেলেও যেতে পারে। তবে সেটা নির্ভর করছে ভবিষ্যতে আদৌ এরকম লিখবো কিনা। হয়ত লেখা হবে, হয়ত না।
গল্পটা পড়ে কেমন একটা অস্বস্তি তৈরি হল।
লেখক মনে হয় সেটাই চেয়েছেন
পরের পর্ব?
পড়ার জন্য ধন্যবাদ। পর্বের ব্যাপারে উপরে পাঠক দা'র প্রতি মন্তব্যে বলেছি।
নতুন মন্তব্য করুন