=============================================
পৃথিবীর মোট কার্বনের মজুদ ৭৫ মিলিয়ন বিলিয়ন মেট্রিক টনের চেয়েও বেশি। ধরিত্রী, এর জল, মাটি, আর বায়ুমণ্ডলে নিয়ত চলছে এক বিপুল কার্বন লন্ডারিং প্রক্রিয়া। কার্বন চক্রে প্রত্যেকেরই নিজস্ব একটা স্থান আছে, যতক্ষণ পর্যন্ত না আরেকটা স্থান সে পায়। বাতাস এবং পানি, ব্যাকটেরিয়া, তরুর দল, এবং জীবজন্তু কার্বন চক্রে একে অপরের মধ্যে পথ খুঁজে নেয়, অনাদিকাল ধরে। অথচ, আমাদের কার্বন যুগে, অর্থনৈতিক কার্যক্রমের কারণে ভূতাত্ত্বিক সময় মাত্র এক জীবনে এসে ঠেকেছে। কী করে হলো কার্বন ও প্রাণের উদ্ভব? কীভাবে বিবর্তনীক সৃষ্টিশীলতা কার্বনের বাতাস, সমুদ্র আর ভূমিতে চক্র কাটার দিক পালটে দিল? আবার কীভাবেই বা শুধুমাত্র গত ১৫০ বছরে বৈজ্ঞানীক, শিল্পপতি, এবং ভোক্তার দল এক শিল্পঘটিত কার্বন চক্রের জন্ম দিলো – মিলিয়ন মিলিয়ন বছরের জমে থাকা ভূতাত্ত্বিক তলানিকে হঠাৎ উড়িয়ে দিলো বায়ুমণ্ডলে? কীভাবে বিবর্তন এবং মানব প্রযুক্তি একই রকম সমস্যাকে মোকাবিলা করে, বিবর্তনে প্রযুক্তির অবস্থান কোথায়, এবং কীভাবে কার্বনের এই জগত কাজ করে – এই সব প্রশ্নের উত্তর আর কিছু মৌলিক ধারণা দেবার জন্য এরিক রোস্টন লিখেছেন ‘কার্বন যুগ’ বইটি। সেই বইয়ের অনুবাদ চলছে। (গত পর্বের পর) আজকে থাকছে মুখবন্ধের বাকিটুকু।
=============================================
সমস্ত গবেষণা, সব বাগাড়ম্বরপূর্ণ কথাবার্তা, বৈশ্বিক উষ্ণায়নের উপর যত ক্রোধ – এদের সবকিছু দুইটি মৌলিক ধারণায় এসে ঠ্যাকে, যা এই বইয়ের প্রথম এবং দ্বিতীয় অংশের আলোচ্যের বিষয়।
প্রথমত, সব ভূতাত্ত্বিক সময় স্কেলেই পৃথিবীর তাপমাত্রা আর বায়ুমণ্ডলে কার্বনের পরিমাণ একে অপরের সাথে সংগতি রেখে চলে। তাপমাত্রা বাড়লে কার্বন বাড়ে। তাপমাত্রা কমলে কার্বন কমে। প্রথমে তাপমাত্রা, তারপরে কার্বন – এটাই ঘটনার সাধারণ পর্যায়ক্রম – শিল্পায়নের আগ পর্যন্ত তাই ছিল। তারপরই বিজ্ঞানীরা বুঝতে পারলেন যে আসলে পর্যায়ক্রমটা উলটে গেছে। (অর্থাৎ, এখন আগে বায়ুমণ্ডলে কার্বন বাড়ছে, আর ফলে বাড়ছে পৃথিবীর তাপমাত্রা – অনুবাদক)
ভূতাত্ত্বিক প্রমাণাদি থেকে প্রাপ্ত ধারণা এরকম যে প্রাণ সবসময়ই বায়ুমণ্ডলের কার্বন নিয়ন্র্বণে সাহায্য করেছে, যদিও কালের বিবেচনায় তার অবদানকে ছাড়িয়ে গেছে নানান ভূপ্রাকৃতিক শক্তি। প্রকৃতিকে সর্বোচ্চ হারে নিয়ন্ত্রণের জন্য দায়ী আজকের মানবসমাজ, জলবায়ুর সবচেয়ে আত্মবিধ্বংসী নিয়ন্ত্রকও সে-ই। কার্বনের বৈশ্বিক যে চক্র – যাকে প্রায়শই জীবজগত, বায়ুমণ্ডল, সমুদ্র ও ভূমিতে এবং হাইড্রোকার্বন খনিজ থেকে প্রাপ্ত কার্বনের প্রবাহ হিসেবে ভাবা হয় – তার খুব সামান্যই বায়ুমণ্ডলে প্রবাহিত হয়। এই নানান প্রবাহ আদতে কোনো স্থির শ্রেণীভুক্ত নয়, এরা এক একটা আলাদা আলাদা “স্টোভ পাইপ”। এরা প্রাকৃতিক পরিবাহক যারা এক বিন্দুতে মিলিত হয়, নতুন গতিপথ খুঁজে নেয়, বদলে দেয় স্ব স্ব গতিকে। এদের মধ্যে বায়ুমণ্ডল (ভূতাত্ত্বিকভাবে) জীবন্ত টিস্যু, সমুদ্র কিংবা শুষ্ক জমি থেকে বের হওয়া কার্বন পরমাণুর জন্য ক্ষণস্থায়ী মধ্যবর্তী স্টেশন মাত্র।
পৃথিবীর জলবায়ু চক্রের স্মারকচিহ্ন এর গতিময়তা, কিন্তু স্থিরতা আমাদের পদে পদে – আমাদের চিন্তায়, সংগঠনে, এবং বৈজ্ঞানিক জ্ঞানের প্রয়োগে। আমাদের প্রতিষ্ঠানগুলি আমরা ভাগ করেছি প্রশাসনিক ও মেধাবী শ্রেণীতে– কংগ্রেস কমিটি, হাইস্কুলের বিজ্ঞান পাঠ্যসূচী, সংবাদপত্র বিভাগ – এরা আদতে কয়েক যুগ কিংবা কিছু কিছু ক্ষেত্রে শত বছরের পুরাতন, এবং আমরা যেভাবে জগতকে উপলব্ধি করি তার সাথে তাল রেখে চলতে তারা অপারগ। বিশ্ববিদ্যালয়গুলি দ্রুত তাদের শিক্ষার সীমানাকে পরিবর্তন ও পরিবর্ধন করছে, বিশেষ করে যেখানে স্বাস্থ্য এবং জীববিদ্যায় ব্যবহৃত হাতিয়ার বাড়ছে পদার্থ ও রসায়নবিদ্যার অগ্রগতির সাথে সাথে। রেনসিলিয়ার পলিটেকনিক ইন্সটিটিউটের প্রেসিডেন্ট শার্লি অ্যান জ্যাকসন বলেন, “অনেক গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন আছে যেগুলিকে প্রাণবিজ্ঞানের সাথে পদার্থ, গণনা এবং তথ্যবিজ্ঞানের মেলবন্ধনের জায়গা থেকে উত্তর দেয়া সম্ভব”।
যারা বিজ্ঞানের বাইরের মানুষ তারা জগতটাকে “জলবায়ু”, “ভূতত্ত্ব”, “জলজ রসায়ন”, কিংবা “জীববিদ্যা”র মত সেকেলে আর স্থির বিষয়শ্রেণীতে না ভেবে, বরং আণবিক পর্যায় থেকে আরম্ভ করে বিশ্ব পর্যায়ে কার্বনের চালচলন নিয়ে ভাবতে পারেন, “কার্বন বিজ্ঞান” হিসেবে। বিজ্ঞানের নানান বিষয়ের সীমানা ও বিভ্রান্তিকর ভেদাভেদের সন্ধান রাখার চাইতে এদেরকে এককথায় বাতিল করে দিন, আর কার্বনকে অনুসরণ করুন।
বিজ্ঞান হচ্ছে সমস্যার সমাধান খোঁজার এক কৌতুহলদীপ্ত কর্মপ্রচেষ্ঠা। বাস্তব প্রমাণ আর তীক্ষ্ম যুক্তিবিচার আমাদের জ্ঞান বাড়ায় এবং যে প্রযুক্তি আমাদের জীবনাচারণকে সমৃদ্ধ করে তাকে এগিয়ে নিয়ে যায়। মহৎ এবং উচ্চাকাঙ্ক্ষী বিজ্ঞানী বিশ্বকে দেখে “বৈজ্ঞানিক পহ্না”য়, স্কুলরুমের বাইরে তা হয়তো তেমন কোনো স্বীকৃতি পায় না, কিন্তু এটি এমন এক হাতিয়ার যা যৌক্তিক চিন্তাভাবনাকে কেবল ল্যাবরেটরির ভেতরে সীমাবদ্ধ রাখে না। বিজ্ঞানীরা তাদের ফলাফলকে জ্ঞানের নানান ধাপে সাজান। নিশ্চিত পর্যবেক্ষণগুলি হচ্ছে “বাস্তবতা” (facts) – অকিঞ্চিতকর, কিন্তু বৃহত্তর নির্মাণের এক একটি ইট। এরকম অনেকগুলি সঞ্চিত বাস্তবতা প্রকৃতির কোনো বিস্তৃত প্যাটার্ণ বা ধাঁচকে নির্দেশ করতে পারে। আস্তে আস্তে যখন সবকিছু স্পষ্ট হয়ে উঠতে শুরু করে, তখন বিজ্ঞানীরা দাড় করাতে পারেন একটা “প্রকল্প” (hypothesis), যা দিয়ে কোনো প্রপঞ্চের (phenomenon) উপর সফলভাবে কিছু পরীক্ষাসাধ্য ভবিষ্যদ্বাণী করা সম্ভব হয়। যখন একটি প্রকল্প অনেকগুলি বাস্তব পরীক্ষায় পাশ করে তখন সে পরিগণিত হয় একটি বৈজ্ঞানিক “সূত্র” (law) হিসেবে, যা ঐ প্রপঞ্চের আচরণ সম্পর্কে নির্ভরযোগ্য ভবিষ্যদ্বাণী করতে পারে। আর একটি সূত্র তখনই বৈজ্ঞানিক জ্ঞানের সর্বোচ্চ সোপান – “তত্ত্ব” (theory) হয়ে উঠে যখন সে তার ব্যাখ্যা করার ক্ষমতা দিয়ে প্রকৃতির মৌলিক কার্যাবলীকে উন্মোচিত করে।
এই কাজটির পেছনে দ্বিতীয় যে পর্যবেক্ষণ কাজ করেছে তা হলো মানুষ ভূতাত্ত্বিক কার্বন চক্রের গতিকে স্বাভাবিকের তুলনায় অন্তত একশো গুণ বাড়িয়ে দিয়েছে, যার ফলে পৃথিবী বদলে এমন হয়েছে যে তাকে আর নিজেদের আপন বলে চেনা যাচ্ছে না। জলবায়ুর আকস্মিক পরিবর্তন এর আগেও হয়েছে, কাছাকাছি সময়ের মধ্যে ১২,০০০ বছর আগে, কিন্তু বিজ্ঞানীরা ইতিহাস ঘেটে কোনো তেমন কোনো সাদৃশ্যই খুঁজে পাচ্ছেন না যা থেকে বলা যাবে ভবিষ্যতের ঝুলিতে আর কত তীক্ষ্ম পরিবর্তন লুকিয়ে আছে, কিংবা কতটা “আকস্মিক”ই বা এই পরিবর্তন হতে পারে। মানব-সৃষ্ট বৈশ্বিক উষ্ণায়ন (global warming) একটি ভূতাত্ত্বিক বিচ্যুতি, যার গতি প্রায় উল্কাসম।
হোমো সেপিয়েনসই অস্থির সময়ে হোচট খাওয়া প্রথম প্রজাতি নয়। কিন্তু পৃথিবীর দিকে তাকালে দেখবো যে আমরা পৃথিবীকে বদলে দিচ্ছি এক অভূতপূর্ব গতিতে। বিজ্ঞানীরা স্বল্পমেয়াদি ও দীর্ঘমেয়াদি কার্বন চক্রের মধ্যে পার্থক্য করেন। স্বল্পমেয়াদি চক্রের স্থায়িত্ব ঘন্টা, বছর, অথবা মিলেনিয়া যা প্রাণ, পানি, মৃত্তিকা আর বায়ুর মধ্য দিয়ে কার্বনের পথকে নির্দেশ করে। দীর্ঘমেয়াদি কার্বন চক্র এই পথে আরেকটি পা যোগ করে, সেটি হলো ভূ-ত্বক। যখন কোনো পদার্থ মাটি কিংবা সমুদ্রবক্ষে থিতু হয়, এবং সেখানেই রয়ে যায়, তখন কার্বনের যাত্রা রহিত হয় মিলিয়ন মিলিয়ন বছর বা তারও বেশি সময়ের জন্য। কার্বন ভূগর্ভে ২০০ থেকে ৩০০ মিলিয়ন বা তারো বেশি বছর ধরে অবস্থান করতে পারে, যতক্ষণ পর্যন্ত না কোনো আগ্নেয়গিরি বা সাগরতলের কোনো নির্গমন-পথ দিয়ে বের হয়ে উপরে চলে আসতে পারে, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই কার্বন ডাইঅক্সাইড হিসেবে। ভূতাত্ত্বিক ব্যাপার হিসেবে দেখলে, মানব সভ্যতা দীর্ঘমেয়াদি ও স্বল্পমেয়াদি কার্বন চক্রের মধ্যে শর্ট-সার্কিট ঘটিয়েছে।
ধরিত্রী, এর জল, মাটি, আর বায়ুমণ্ডল এক বিপুল কার্বন লন্ডারিং প্রক্রিয়া। যেভাবে জীবন্ত কোষের মধ্যে চলমান সাধারণ রাসায়নিক চক্রগুলির মধ্যে কার্বন পরমাণু প্রবাহিত হয়, ঠিক সেই একইভাবে তারা প্রবাহিত হয় প্রকৃতির প্রধান প্রধান ভূরাসায়নিক চক্রের মধ্য দিয়ে। ভূতত্ত্ববিদরা আন্দাজের পর আন্দাজ করেন, পৃথিবীর মোট কার্বনের মজুদ ৭৫ মিলিয়ন বিলিয়ন মেট্রিক টনের চেয়েও বেশি, যাদের বেশিরভাগ লাইমস্টোন, ডলোমাইট, কেরোজেন নামক অনমনীয় চটচটে তরল, কয়লা, তেল, আর প্রাকৃতিক গ্যাসের মধ্যে সুপ্ত। পৃথিবীর কার্বনের মজুদ এই পরিমাণই, এর জন্ম থেকেই এই পরিমাণে ছিল এবং আছে। পৃথিবীতে বস্তুর নিত্যতা রক্ষিত হয়, নতুন করে বস্তু সৃষ্টি বা ধ্বংস হয় না। কেবল চক্রে আবর্তিত হয়। বায়ুমণ্ডলে কার্বনের পরিমাণ প্রায় ৯০০ গিগাটন (বিলিয়ন টন)। পরিমাণটা স্থলজ উদ্ভিদে থাকা কার্বন, যার পরিমাণ প্রায় ৬০০ গিগাটন, তার চেয়েও বেশি। মাটি শোষণ করে এর চেয়ে তিনগুণ বেশি পরিমাণে। পৃথিবীর বাসযোগ্যতার উপর কার্বনের প্রভাব অসমানুপাতিক, যার কারণে বায়ুমণ্ডলে কার্বনের পরিমাণ পৃথিবীর মোট মজুদের এক লক্ষতম ভাগের এক ভাগ মাত্র। মোট উত্তোলনযোগ্য জীবাশ্ম জ্বালানিতে কার্বনের পরিমাণ ৫,৫০০ থেকে ১১,০০০ হাজার গিগাটনের মত। স্বল্পমেয়াদি কার্বন প্রবাহের বেশিরভাগই সামুদ্রিক, যার পরিমাণ প্রায় ৪২,০০০ গিগাটন – বায়ুমণ্ডলীয় কার্বনের চেয়ে যা প্রায় পঞ্চাশ গুণের মত বেশি। এদের সিংহভাগই আবার মধ্যবর্তী এবং গভীর পানিতে থাকে। জীবাশ্ম জ্বালানি পুড়িয়ে মানুষ যে পরিমাণ কার্বন বাতাসে ছেড়ে দেয় তার প্রায় অর্ধেকই সমুদ্র শোষণ করে নেয়। কিন্তু আজীবন একই রকম চলবে না, এবং এ প্রক্রিয়া যে ক্রমশ গতি হারাচ্ছে তার অনেক নির্দশনই এখন দেখা যাচ্ছে।
বাতাস এবং পানি, ব্যাকটেরিয়া, তরুর দল, এবং জন্তু জানোয়ার কার্বন চক্রে একে অপরের মধ্যে পথ খুঁজে নেয়, অনাদিকাল ধরে। কার্বন পরমাণু পাজরে অক্সিজেনের গুতো খেয়ে বায়ুমণ্ডলে হয়তো এক শতাব্দী বা তার কিছু বেশি সময় ঝুলে থাকে, কার্বন ডাইঅক্সাইড (CO2) হিসেবে। CO2 অণুগুলি বাতাসের অন্যান্য অণুর অভিঘাতে প্রতিক্ষিপ্ত হয়, কনুই দিয়ে গুতোগুতি করে, কাঁপতে থাকে, এবং বায়ুমণ্ডলের এদিক সেদিক ঘোরাঘুরি করে। উদ্ভিদ বাতাস থেকে এই পরমাণুত্রয়ীকে চুষে নেয় এবং পাতায় সঞ্চয় করে রাখে সাময়িকভাবে। কোনো এক এপাটোসরাস (নিরীহ প্রজাতির এক ডাইনোসর) এসে সেই পাতা খেয়ে নেয়। কোত্থেকে এক টাইরানোসরাস ঝাপিয়ে পড়ে সেই এপাটোসরাসের উপর, তাকে গিলে খায়। টাইরানোসরাসটি শেষবারের মত যখন তার ফুসফুস থেকে কার্বন ডাইঅক্সাইড ত্যাগ করে, তখন তার বয়স আটাশ হয় হয়। প্রকৃতির ধাঙড় আর ব্যাকটেরিয়া এসে তার মৃতদেহকে পচিয়ে আরো কার্বন ডাইঅক্সাইড আর নাইট্রোজেন এবং দুই ডজন অন্যান্য মৌল যা সে নিজের অজ্ঞাতসারে বয়ে বেড়াচ্ছিলো তাদেরকে মুক্ত করে। বৃষ্টি এসে তার ক্ষয়িষ্ণু শরীরের কিছু সমুদ্রে ধুয়ে নিয়ে যায়, অতঃপর যেখানে তার কার্বনগুলি ১০০,০০০ বছর ধরে সঞ্চালিত হয়, ঘুরে বেড়াতে থাকে। কার্বন চক্রে প্রত্যেকেরই নিজস্ব একটা স্থান আছে, যতক্ষণ পর্যন্ত না আরেকটা স্থান সে পায়।
কেবল প্রাচ্যের সাধু আর পশ্চিমের স্বয়ম্ভর গুরুরাই এটা প্রচার করে বেড়ান না যে সবকিছুই কোনো এক উন্নত স্তরে বিরাজ করে যেখান থেকে সে রূপান্তরিত হয় অন্য কিছুতে। রাসায়নিক এবং জৈবিকভাবেও এটা সত্যি। জীবন এবং বায়ুমণ্ডল, সমুদ্র, এবং ভূমি বিলিয়ন-বর্ষী এক নৃত্যে আটকে আছে। সেই নাচ চলতে থাকবে, চলতেই থাকবে যতদিন না পৃথিবীর অন্তঃস্থ উদগীরণ বন্ধ হয়ে যায়, কিংবা স্থিমিত হয়ে যায় সূর্য, যেটাই আগে হোক। যতদিন পর্যন্ত তা না হচ্ছে, ততদিন পর্যন্ত ভৌগলিক জগতে নিয়ত শক্তির প্রবাহ পরমাণু আর অণুকে ঠেলতে থাকবে এক চিরবর্ধনশীল জটিলতার দিকে।
আমাদের কার্বন যুগে, অর্থনৈতিক কার্যক্রমের কারণে ভূতাত্ত্বিক সময় মাত্র এক জীবনে এসে ঠেকেছে। এই বইয়ের প্রথম অংশে তুলে ধরা হবে কার্বন ও প্রাণের উদ্ভব, এবং বিবর্তনীক সৃষ্টিশীলতা যেভাবে কার্বনের বাতাস, সমুদ্র আর ভূমিতে চক্র কাটার দিক পালটে দেয়ার কিছু নমুনা। দ্বিতীয় অংশে থাকবে শুধু গত ১৫০ বছরের এক প্রতিবেদন, এবং ব্যাখ্যা করা হবে কীভাবে বৈজ্ঞানীক, শিল্পপতি, এবং ভোক্তার দল এক শিল্পঘটিত কার্বন চক্রের জন্ম দিয়েছে – মিলিয়ন মিলিয়ন বছরের জমে থাকা ভূতাত্ত্বিক তলানিকে হঠাৎ উড়িয়ে দিয়েছে বায়ুমণ্ডলে। দ্বিতীয় অংশের ছয়টি অধ্যায় প্রথম অংশের অধ্যায়গুলিরই প্রতিফলন, এক ধরণের তুলনার চেষ্টা কীভাবে বিবর্তন এবং মানব প্রযুক্তি একই রকম সমস্যাকে মোকাবিলা করে, বিবর্তনে প্রযুক্তির অবস্থান কোথায়, এবং কীভাবে কার্বনের এই জগত কাজ করে তার উপর মৌলিক ধারণা দেয়া।
(মুখবন্ধ এখানেই শেষ, পরের পর্বে থাকছে প্রথম অধ্যায়, মূল বইটা শুরু হবে তখনই)
মন্তব্য
চলুক..........
ভাল উদ্যোগ সন্দেহ নেই। কার্বন বিতর্কে সবাই একটি পক্ষ নিয়েই নেয়। এরিক এখনো যে নৈর্বক্তিকতা নিয়ে লিখে যাচ্ছে, সেটা লক্ষনীয়। জানিনা টাইম ম্যাগাজিনের প্রভাব থেকে সে নিজেকে কতদিন মুক্ত রাখতে পারবে।
আমি অনুবাদক নই। কিভাবে ভাল অনুবাদ করতে হবে, সেটা আমি কিছুই জানিনা। বইটি পড়তে গিয়ে যে 'মজা' পেয়েছি, লেখার এই কিস্তি পড়ার সময়ে কিছু কিছু জায়গায় এসে সেই মজাটা থাকেনি। রস্টনের কাব্যিক আমেজ এতটাই সুক্ষ্ণ, সেটা অনুবাদের ফাকফোঁকর গলে সহযেই বেরিয়ে যায়। যেমন ধরুন রস্টনের" science is a curiosity-lead puzzle-solving enterprise' এই কথাগুলো আপনার জবানে আমরা পাচ্ছি "বিজ্ঞান হচ্ছে সমস্যার সমাধান খোঁজার এক কৌতুহলদীপ্ত কর্মপ্রচেষ্ঠা"। এখানে রস্টনের 'পাজল' এর চপলতা, সমস্যা কথাতির গম্ভীর্যে চাপা পড়ে গেছে। আবার 'এন্টারপ্রাইজ' এর উদ্যোগী, স্বাধীনচেতা ও ঝুঁকিনেবার সাহস 'কর্মপ্রচেষ্টা'য় স্থবিরতার কাছে হার মেনে গেছে।
তারপরেও আমি যেটা করলাম সেটা সমালোচনার অনায়াস। আর আপনি করেছেন সুন্দর এই অনুবাদটি আমাদের সবাইকে উপহার দেবার মত কঠিন ও পরিশ্রমের কাজটি।
সাবাশ। ধন্যবাদ। চলুক।
বিজ্ঞান লেখক হিসেবে এরিকের নিরপেক্ষতা আমার খুব ভাল লাগে। আমরা সবাই কার্বন কার্বন করছি, কিন্তু গ্লোবাল ওয়ার্মিং নিয়ে আমাদের অনেকেরই ধারণা সেরকম স্বচ্ছ নয়। নীতিনির্ধারক পর্যায়েও আমরা এখনো পরিস্কার ধারণাওয়ালা কোনো মাথা দেখি না। এ প্রসঙ্গে গত পর্বে করা হাসিব ভাইয়ের মন্তব্য দ্রস্টব্য। অন্যদিকে, যারা এই ব্যাপারগুলো বোঝেন তাদের বেশিরভাগই, আপনি যেমনটা বলেছেন, কোনো না কোনো পক্ষ নিয়ে তর্ক করেন। সাধারণ মানুষের কাছে জীবাশ্ম জ্বালানি, কার্বন, গ্লোবাল ওয়ার্মিং, জলবায়ু পরিবর্তন, ইত্যাদি বিষয়গুলো সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা পৌছে দেয়া উচিত। আর এক্ষেত্রেই আমার প্রথম পছন্দ এরিক রস্টনের লেখাগুলি, চমৎকার ভাষায় বৈজ্ঞানিক ব্যাপারগুলি সহজপাচ্য করে লেখা।
এটাই আমার প্রথম অনুবাদ প্রচেষ্টা। রস্টনের ভাষা সারল্যময়, সেই সারল্যকে ফুটিয়ে তোলা খুবই জরুরী। আপনি একদম ঠিক পয়েন্টটাই তুলেছেন। আমি নিজেও বুঝতে পারছি যে আমার অনুবাদ খুব আড়ষ্ট, সেটা মূল অধ্যায়গুলি অনুবাদের সময় কাটানোর আপ্রাণ চেষ্টা করবো। যেহেতু পূর্বাভিজ্ঞতা তেমন নেই, আমি এই পর্যায়ে ঠিক বুঝে উঠতে পারছি না যে কতটা স্বাধীনতা আমার নেয়া উচিত অনুবাদের ক্ষেত্রে। আপাতত, বক্তব্যকে গুরুত্ব দিচ্ছি, বৈজ্ঞানিক অনুবাদে সেটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে হয় আমার কাছে। তবে, এর ফলে যদি পাঠকের আগ্রহ কমে যায়, সেটাও চিন্তার বিষয়। যেখানে এরিক রস্টন সাফল্যের দাবিদার, সেখানে অনুবাদের দোষে ভাষার দক্ষতা না ফুটে উঠলে সে দায় নিতান্তই আমার।
অনেক বাক্য আছে যাকে ভেঙ্গে একাধিক বাক্য করতে হচ্ছে। অনেক সময় বৈজ্ঞানিক টার্মের ভালো বাংলা খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। আমার হাতে আপাতত google translatorই ভরসা, এতে আবার সব কিছু সবসময় পাওয়া যায় না। এ সব কিছু মেনে নিয়েও অনুবাদটা করছি, এর গুরুত্বকে মাথায় রেখে। যদি শেষ করতে পারি, এরপর একটা বিশাল ঘষামাজা করার ইচ্ছে আছে। আর এ জন্যই পাঠকের ফিডব্যাক খুব জরুরী।
প্রথমে অনুবাদের কথা অবশ্য মাথায় ছিল না। ভেবেছিলাম, নানান প্রাসঙ্গিক বিষয় ধরে রিভিউ কিংবা আলোচনা জাতীয় ব্লগ লিখবো। এতে শুধু রস্টন না, আরো অনেকের আরো অনেক বিষয়ে সহজ আলাপ করা যেত। কিন্তু পরে দেখলাম, এর চাইতে অনুবাদ করাটাই ভালো। বইটার একটা ভালো দিক হচ্ছে, এর পরিমিত বয়ান। কিন্তু পুরো বয়ানই ইন্টারেস্টিং।
যেহেতু বইটা আপনার পড়া আছে, আপনার কাছ থেকে নিয়মিত ফিডব্যাক চাইছি।
puzzle এর বাংলা একবার করেছিলাম ধাঁধা। কিন্তু পরে বাদ দিয়েছি। তবে এটাও ঠিক যে, সমস্যা কথাটির ভারে 'পাজল' শব্দের উচ্ছ্বাস চাপা পড়ে গেছে। enterprise এর বাংলা এই বাক্যের জন্য কি 'কর্ম উদ্যোগ' করা যায়?
ভাল লাগলো !!
গুল্লা সাঃ
খুবই ভালো লাগলো এই পর্বটাও| আচ্ছা শব্দটা কি সয়ম্ভর নাকি সয়ম্ভু হবে?
সম্ভবত সয়ম্ভুই সঠিক। এটা আমি লিখেছিলাম self-helf guruর বিপরীতে।
তাহলে সয়ম্ভু ই হবে| সয়ম্বর একটা শব্দ আছে যার মানে নিজে নিজের বর বাছাই করে নেয়া| যদিও আমি self-helf মানে জানি না| কিন্তু এর মানে যদি নিজে নিজে উদ্ভব হওয়া বোঝায় তাহলে সয়ম্ভু ঠিক হবে|
আমার তো মনে হয় তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে আসলে সামগ্রিক ভাবে পৃথিবির কোন কোন বিষয়ের তেমন কোন পরিবর্তন হবে না । কারন তাপমাত্রা বেড়ে বিষুবিয় অঞ্চলের উপকুল ভাগ ডুবে গেলেও মেরু অঞ্চলে কাছাকাছি ঠান্ডা এলাকায় আবার চাষ-বাস যোগ্য এলাকা বাড়বে ।
উপকুল ভাগ ডুবে যাওয়া, আবার মেরু অঞ্চলে চাষ-বাস যোগ্য এলাকার আবির্ভাব - এই সব পরিবর্তনই তো ব্যাপক আকারের। দেখুন, পৃথিবীতে যে এ ধরণের পরিবর্তন ঘটে না তা নয়, কিন্তু এর গতি খুব শ্লথ, যার কারণে এর প্রভাবও হঠাৎ করে বোঝা যায় না, পৃথিবীর বাস্তুসংস্থান, জলবায়ুর পরিবর্তনো সেই মত হয়, এর সাথে খাপ খাইয়ে নেয়। কার্বন, পানি, আবহাওয়া ইত্যাদির নানান চক্রগুলিই এই পরিবর্তনে অংশ নেয়, ঘটায়। কিন্তু এরিক রস্টন যেটা বলেছেন, আমাদের স্বেচ্ছাচারিতা, কার্বন জ্বালানির তুমুল ব্যবহার এই পরিবর্তনের গতিকে বাড়িয়ে দিয়েছে শতগুণ। মিলিয়ন বছর ধরে যে কার্বন মাটির নিচে চাপা পড়েছিল সেটা আমরা বাতাসে ছেড়েছি মাত্র দুইশো বছরে। এর যে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া সেটা আস্বাভাবিক হতে বাধ্য।
আপনার প্রশ্নটি খুবই প্রাসঙ্গিক। কার্বন দিয়েই এরিক রস্টন সেটা বুঝিয়েছেন। মূল ব্যাপারটাই হচ্ছে - একটা প্রাকৃতিক পরিবর্তন, আরেকটা অপ্রাকৃতিক পরিবর্তন। সাথে থাকলে দেখবেন, এরিক রস্টনের বইটাও মূল দুই খন্ডে বিভক্ত- প্রাকৃতিক, এবং অপ্রাকৃতিক।
পড়া শুরুর আগেই ভালো লাগছে এই ভেবে, অনেক কিছু জানতে পারবো আপনার অনুবাদ আর প্রাসংগিক আলোচনা থেকে।
কিছু মনে না করলে অনুবাদটুকু আরেকটু সরল করার জন্য অনুরোধ জানিয়ে গেলাম।
কিছু কিছু শব্দ আরো প্রচলিত প্রতিশব্দ দিয়ে প্রতিস্থাপন করলে আরেকটু আরামে পড়া যাবে, যেমন: গণনা এবং তথ্যবিজ্ঞান=গণিত এবং তথ্যবিজ্ঞান, তরুর দল=গাছপালা, ধরিত্রী=পৃথিবী
চলুক।
আমি নিজেও বুঝতে পেরেছি যে অনুবাদ কঠিন হয়ে যাচ্ছে। চেষ্টা করছি মূল অধ্যায়গুলো যত সহজে অনুবাদ করা যায় সেটা করার। আপনার আগ্রহ ও ফিডব্যাক জেনে ভালো লাগছে।
গণনা শব্দটি ব্যবহার করেছি computing এর বাংলা হিসেবে। সেই হিসেবে এটি সবসময় কি গণিত?
না না, computing এর বাংলা ঠিক আছে। আমিই বুঝতে ভুল করেছিলাম।
এ পর্ব পড়ে আগ্রহ আরো বাড়লো। সত্যিই দারুণ একটা কাজে হাত দিয়েছেন
আর অনুবাদের সময়। খুব বেশি মূলানুগ থাকলে কিন্তু প্রাঞ্জলতা হারাবে। ইংরেজীতে সুখপাঠ্যভাবে বলার যে ধাচ, বাংলার সুখপাঠ্যের ধাচ তার সাথে মেলে না। তাই আমার মতে একেকটা প্যারা পড়ার পরে সেটা কীভাবে বাংলায় বললে পাঠক আগ্রহ ভরে পড়বে এবং একই সঙ্গে মূল ব্যাপারটা ভালো ভাবে বুঝতে পারবে সেটা ভেবে অনুবাদ লিখলেই ভালো। এটা করতে গিয়ে অন্তত আপনার হাতে যে বৈজ্ঞানিক তথ্যবিভ্রাট হবে না সেটা আমি জানি আর একই সঙ্গে পাঠককে সুন্দর একটা গল্প উপহার দেওয়ার ক্ষমতাও আপনার আছে।
পরের পর্বের অপেক্ষায় রইলাম।
ইচ্ছার আগুনে জ্বলছি...
অনুবাদ দ্রুত গতিতে চলতে থাকুক।
love the life you live. live the life you love.
নতুন মন্তব্য করুন