কার্বন যুগ : অধ্যায় ১

ফারুক হাসান এর ছবি
লিখেছেন ফারুক হাসান (তারিখ: শনি, ০৯/০৪/২০১১ - ৭:৩৬অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

অর্ধেক দেবতা আর অর্ধেক মানুষ প্রমিথিউস বুঝতে পেরেছিলেন যে আগুন পেলে মানুষের অনেক উপকার হয়। তাই তিনি দেবতাদের দখল থেকে আগুনকে মুক্ত করলেন। আর এতে ক্রুদ্ধ্ব হলেন জিউস। আগুন চুরির অপরাধে প্রমিথিউসকে দিলেন এক অতুলনীয় নিষ্ঠুর শাস্তি। সবচেয়ে উঁচু পর্বতশৃঙ্গে শৃংখলাবদ্ধ হলেন প্রমিথিউস। প্রতিদিন শকুন এসে তার কলিজা ছিড়ে খায়, রাতে সেই ক্ষত সেরে যায়, এবং এভাবেই চলতে থাকে, অনন্তকাল।
====================================================


অধ্যায় ১| জ্বলন্ত কড়াই থেকে
বিগ ব্যাং পরবর্তী কার্বন

রোমান্টিক লোকজন নিজেদেরকে ভাবতে ভালোবাসে নক্ষত্রের ধূলোয় তৈরি বলে, আর যারা শুভনাস্তিক তারা নিজেদেরকে মনে করে আণবিক বর্জ্য। - সাইমন সিং

অর্ধেক দেবতা আর অর্ধেক মানুষ প্রমিথিউস বুঝতে পেরেছিলেন যে আগুন পেলে মানুষের অনেক উপকার হয়। তাই তিনি দেবতাদের দখল থেকে আগুনকে মুক্ত করলেন। আর এতে ক্রুদ্ধ্ব হলেন জিউস। আগুন চুরির অপরাধে প্রমিথিউসকে দিলেন এক অতুলনীয় নিষ্ঠুর শাস্তি। সবচেয়ে উঁচু পর্বতশৃঙ্গে শৃংখলাবদ্ধ হলেন প্রমিথিউস। প্রতিদিন শকুন এসে তার কলিজা ছিড়ে খায়, রাতে সেই ক্ষত সেরে যায়, এবং এভাবেই চলতে থাকে, অনন্তকাল।

প্রমিথিউসের এই পৌরাণিক কাহিনী কালকে জয় করেছে। আমাদের যুগে এই গল্প আরো বেশি সময়োপযোগী। আগুনের এই উপহার যেন জ্ঞানের আলোকবর্তিকা। আর এই শিখা, চোখ মুদে ভেবে দেখলে, দ্যুতিময় কার্বন ছাড়া আর কিছুই না। কীভাবে পৃথিবীতে এই কার্বনের আগমন ঘটলো, কী করে মানুষ কার্বনের আগুনকে নিয়ন্ত্রণ করতে শিখলো, পরে সেই নিয়ন্ত্রণ হারিয়েও ফেললো – সেই গল্প পুরাণকেও হার মানাবে। শত শত বছর ধরে হাজারো বিজ্ঞানী সেই গল্প বার বার লিখেছেন, এখনো লেখা চলছেই।

কার্বনের গল্পের শুরু অনেক অনেক আগে এবং অনেক অনেক দূরে। তখনো পৃথিবীর বুকে কারো নিঃশ্বাস পড়েনি। প্রমিথিউসের আগুনের চেয়েও প্রাগৈতিহাসিক এই কার্বন। দুটো অনুকূল পরিস্থিতির উদ্ভব না ঘটলে কার্বনের জন্ম হতো না কখনোই, আর আমাদের অস্তিত্বও থাকতো না। বিজ্ঞানীরা যাকে “অনুকূল পরিস্থিতি” বলেন, মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে আমরা তাকে দেখতে পারি মহাবিশ্বের কোনো সুনির্বাচিত মুদ্রাদোষ হিসেবে। এই মুদ্রাদোষের একটি হলো নক্ষত্রের কেন্দ্রে হালকা মৌল থেকে কার্বন সৃষ্টির প্রক্রিয়া, আরেকটি হলো আন্তঃনক্ষত্রীয় শূন্যস্থানে কার্বনের মুক্তি লাভ। এই আন্তঃনক্ষত্রীয় শূন্যস্থানেই মূলত কার্বনের রাজকীয়তার প্রথম প্রকাশ ঘটে। গল্পের শুরুটা হয়েছিল এভাবে – সে প্রায় অনেক মিলিয়ন বছর আগেকার কথা, তখনো মহাবিশ্ব কার্বন পরমাণুশোভিত হয়নি।

শূন্যতা থেকে মুহূর্তের মধ্যে জন্মালো মহাবিশ্ব, এক তমসাঘেরা শক্তি উগ্র রোষে ফেটে পড়লো এক অচিন্ত্যনীয় তাপমাত্রায়। সূর্যের অভ্যন্তরের তাপমাত্রা ১৫ মিলিয়ন ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড, তার চেয়েও অনেক অনেক গুণ বেশি সেই তাপমাত্রা। মহাবিশ্বের জন্মের সময়কাল এতই ক্ষুদ্র যে তা আমাদের উপলব্ধির বাইরে, এক সেকেন্ডের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র ভাগের এক ভাগ- মহাবিশ্বতত্ত্ববিদরা যাকে বলেন “ইপোক” (epoch)। চারটি প্রাকৃতিক বল সকল পদার্থের কণার মধ্যেকার পারস্পরিক প্রভাবকে শাসন করে। মহাবিশ্বের জন্মের এক সেকেন্ডের এক হাজার ভাগের এক ভাগ সময় পেরোনোর আগেই সেই চারটি প্রাকৃতিক বল মুক্তি লাভ করলোঃ প্রথমে মহাকর্ষ, তারপর সেই বল যা নিউক্লি (একাধিক পরমাণুর নিউক্লিয়াস) কে দৃঢ়ভাবে ধরে রাখে, তারপর সেই বল যা বিকিরণকে শাসন করে, এবং সবশেষে তড়িৎচুম্বকত্ত্ব যা নিউক্লি ও ইলেকট্রনের মধ্যেকার সম্পর্ককে এবং আরো বাড়িয়ে বললে যা আমাদের অতি ক্ষুদ্র আর সদাস্পন্দিত কার্বনের যে জগত তার সকল জীবিত বস্তুর, মানবিক অভিজ্ঞতার পুরো বিশ্বকেই বাস্তবে রূপ দান করে।

শিশু মহাবিশ্ব বাড়তে লাগলো, কিন্তু যে শক্তি নিয়ে তার জন্ম তার কোনো পরিবর্তন হলো না। শক্তিকে সৃষ্টি কিংবা ধ্বংস করা যায় না। আজকের মহাবিশ্বের যে পরিমাণ শক্তি, তার জন্মের প্রথম ইয়োক্টোসেকেন্ডেও সেই পরিমাণ শক্তিই ছিল; এরপর মহাবিশ্ব কেবল আকারে বেড়েছে। জন্মের প্রথম ইপোকগুলিতে যখন সে আকারে বাড়ছিল, তখন তার শক্তি ছড়িয়ে পড়ে মহাশূন্যের বিস্তৃত অঞ্চলে। এর ফলে তাপমাত্রাও কমে আসে। শক্তি ঝমকে উঠে পরিণত হয় পদার্থে। একটি পরমাণুর তিনটি প্রধান উপাদান হচ্ছে ধনাত্মক চার্জসমৃদ্ধ প্রোটন, নিরপেক্ষ নিউট্রন, আর ঋণাত্মক চার্জসমৃদ্ধ ইলেকট্রন। সবচেয়ে হালকা নিউক্লিয়াসের মালিক হাইড্রোজেন, যার সম্বল একটিমাত্র প্রোটন। হাইড্রোজেনই প্রথম মৌল যার আবির্ভাব ঘটে যখন মহাবিশ্বের বয়স এক মিনিটের মত।

প্রথম নক্ষত্রেরো জন্মের পূর্বে, কার্বন পরমাণুর নিউক্লি সৃষ্টিরো অনেক আগে, মহাবিশ্বে এক তাণ্ডবলীলা ঘটে যায়। এর কারণেই মূলত পরমাণুর নিউক্লিয়াসের আবির্ভাব ঘটে। বিগ ব্যাংয়ের এক মিনিট হয়েছে কি হয়নি, সাবএটমিক কণাগুলি প্রথমবারের মত নিজেদেরকে জোড়া লাগিয়ে তৈরি করে বৃহৎ নিউক্লি। প্রোটন আর নিউট্রনের মধ্যে সংঘর্ষে আর মিলনে এদের ভরের কিছু অংশ শক্তিতে রূপান্তরিত হয়। তাদের এই মিলনের ফসল হিসেবে জন্ম নেয় দুইটি প্রোটনসমৃদ্ধ নিউক্লি। ঠিক এই দরকার ছিল আরেক মৌল হিলিয়াম উৎপাদনের জন্য। এর সাথে তৃতীয় একটি প্রোটন এসে জড়ো হলে হিলিয়াম পরিণত হয় লিথিয়ামে। বিগ ব্যাংয়ের দুই মিনিট পর নিউক্লিয়ার ফিউশন ঘটার জন্য যে পরিমাণ তাপমাত্রা না থাকলেই নয় তার চেয়েও ঠান্ডা হয়ে যায় মহাবিশ্ব। যার কারণে তখন পর্যন্ত কেবল হাইড্রোজেন, কিছু হিলিয়াম, আর অতি সামান্য লিথিয়ামের নিউক্লি ছাড়া আর কোনো কিছুই সৃষ্টি হয় না। এর পর অনেক হাজার বছর কেটে যায়, কিন্তু প্রথম পরমাণুর আবির্ভাব ঘটে না। এই পুরোটা সময় জুড়ে মহাশূন্যে ভেসে বেড়ায় নিউক্লি আর মুক্ত ইলেকট্রন। মহাকাশঘটিত রসায়নবিদ এরিক হার্স্ট (Eric Herbst) একে নাম দিয়েছিলেন “অবিভক্ত পাঁক” বা কাদা (undifferentiated ooze)। বিগ ব্যাংয়ের প্রায় ৩৮০,০০০ বছর পরই কেবল প্রথম এবং স্বতন্ত্র পরমাণুর আবির্ভাব ঘটে। এতদিন পর এসে তাপমাত্রা কমে এমন হয় যার ফলে ধনাত্মক চার্জযুক্ত নিউক্লির পক্ষে ঋনাত্মক চার্জযুক্ত ইলেকট্রনকে আটকে ফেলা সম্ভবপর হয়ে উঠে। এই চার্জনিরপেক্ষ পরমাণুর ডেব্যুর ফলেই এতদিন ধরে মহাবিশ্বকে আচ্ছন্ন করে রাখা আয়নিক কুয়াশা দূর হয়ে যায়, প্রথমবারের মত মহাশূন্যের চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে আলোর ঝর্ণাধারা।

পরবর্তী ২০০ থেকে ৪০০ মিলিয়ন বছর ধরে পারস্পরিক মহাকর্ষের টানে পরমাণুগুলি মেঘের মত জমতে থাকে। মেঘের ঘনত্ব যত বাড়ে, মহাকর্ষের আকর্ষণও তত বাড়তে থাকে, পরমাণুরা ততই ঘনিষ্ঠ হতে থাকে একে অপরের। আরো পরমাণু এসে এতে মিশতে থাকে। পরমাণুরা নিজেদের মধ্যে ব্যাপকহারে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়, ক্রমাগত সেই সংঘর্ষের তীব্রতা বাড়তে থাকে। এই সংঘর্ষ ইলেকট্রনকে আন্দোলিত করে, যার ফলে তাপমাত্রা আবার বেড়ে যায়। মেঘের মধ্যে তাপ জমতে শুরু করে, সেই তাপে সে ঘনীভূত হয়। নিউক্লিগুলি আর অদম্য ইলেকট্রনকে ধরে রাখতে পারে না, একে একে ছেড়ে দিতে শুরু করে। মেঘে আরো তাপ জমে, মেঘ আরো ঘনীভূত হয়। এরকম হতে হতে তাপমাত্রা বেড়ে কয়েক মিলিয়ন ডিগ্রি কেলভিন ছাড়িয়ে গিয়ে এক সংকটময় তাপমাত্রায় উন্নীত হয় যখন এতদিন ধরে সুপ্ত থাকা নিউক্লিয়ার ফিউশন প্রক্রিয়াটি আবার চালু হয়ে যায়। সেই প্রক্রিয়া, সৃষ্টির প্রারম্ভের কয়েক মিনিটের মধ্যেই যা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল, সেই প্রক্রিয়া যাতে মৌলিক পদার্থ উৎপন্ন হয়। জ্বলে উঠে আমাদের সূর্যের চেয়েও হাজারগুণ সূর্যকিরণ ঝরা নক্ষত্রেরা।

প্রথমদিকের সেই নক্ষত্র বা তারকাগুলি ছিল স্বল্পায়ুর এবং তারা বিপুলশব্দে সুপারনোভা হিসেবে মৃত্যুবরণ করে। এরা ছিল এক একটা স্বল্পস্থায়ী ঝলক মাত্র, মহাজাগতিক সময় স্কেলে পলক ফেলার চেয়েও কম সময় ছিল এদের টিকে থাকা, মাত্র কয়েক মিলিয়ন বছর। বিলিয়ন বিলিয়ন বছর পরে এসে বর্তমান সময়ে সেই সুপারনোভাগুলি খুবই দুর্লভ, কিছু বিরল বিস্ফোরণমাত্র। বিস্ফোরণের মধ্য দিয়ে নক্ষত্রের এই দর্শনীয় মৃত্যু ঘটে যখন অর্ধেক সেকেন্ডের মধ্যে কোনো নক্ষত্রের আকৃতি কমতে কমতে নিজেই নিজের কেন্দ্রে ধসে পড়তে থাকে। একটি বিস্ফোরণের সাথে সাথে যে পরিমাণ শক্তি নির্গত হয় তা অকল্পনীয়। আমাদের সূর্য তার পুরো ১০ বিলিয়ন বছরের জীবনে যত না শক্তি নির্গত করবে তার চেয়েও তিনশো গুণ বেশি তার পরিমাণ।

প্রথম প্রজন্মের তারাগুলি অস্বাভাবিক ছিল। বেশিরভাগ পরিণত তারা – যেমন আমাদের সূর্য – অনেক বেশি বাঁচে, এবং মরেও অনেক কম নাটকীয়ভাবে। প্রথম দিকের তারাদের আকস্মিক জীবনধারা আর শক্তিক্ষয়ী মৃত্যুবরণের কারণে মহাশূন্যে ছড়িয়ে যাওয়া এদের ছাইয়ের গুরুত্বকে সহজেই নগণ্য বলে ধরা যায়। মহাবিশ্বের প্রথম মৌলিক পদার্থের মধ্যে লিথিয়ামের চেয়ে ভারি যারা ছিল তারা হচ্ছে কার্বন, নাইট্রোজেন, অক্সিজেন, এবং অন্যান্য নগণ্য কিছু ভারি মৌল।

বিগ ব্যাংয়ের ফলে ছড়িয়ে পড়েছিলো মাত্র তিনটি সবচেয়ে ছোট মৌল, হাইড্রোজেন, হিলিয়াম, এবং লিথিয়াম। বিজ্ঞানীরা এদেরকে যথাক্রমে এক, দুই, এবং তিন – এই তিনটি পারমাণবিক সংখ্যায় ভূষিত করেছেন। এই সংখ্যাগুলি নিউক্লিয়াসে প্রোটনের সংখ্যাকে নির্দেশ করে এবং কোন পরমাণু দিয়ে কোন মৌলটি গঠিত তা বলে দেয়।

নক্ষত্রগুলির কার্বন উৎপন্ন করার পেছনে মূল রহস্যটা লুকিয়ে আছে পারমাণবিক নিউক্লির ভরের মধ্যে। একটি মৌলের পরমাণুর প্রোটন সংখ্যা সবসময় সমান। নিউট্রনের সংখ্যার তারতম্য হতে পারে, এই তারতম্যের কারণেই বিভিন্ন আইসোটোপ দেখা যায়। প্রত্যেক মৌলেরই হরেক রকমের আইসোটোপ আছে, যা নির্ভর করে তার পরমাণুর নিউক্লিয়াসের মধ্যে প্রোটনগুলির সাথে কয়টি নিউট্রন আছে তার উপর। হাইড্রোজেনের প্রোটন মাত্র একটি, কিন্তু নিউট্রন থাকতে পারে শূন্যটি, একটি কিংবা দুটি। যার কারণে হাইড্রোজেনের তিনটি আইসোটোপ হতে পারেঃ হাইড্রোজেন-১ (একটি প্রোটন), হাইড্রোজেন-২ (একটি প্রোটন ও একটি নিউট্রন), কিংবা হাইড্রোজেন-৩ (একটি প্রোটন ও দুইটি নিউট্রন)। হিলিয়ামের প্রোটন আছে দুইটি, হিলিয়ামের নিউক্লিয়াসে সেই দুইটি প্রোটনের সাথে নিউট্রন থাকে একটি কিংবা দুটি। ফলে, হিলিয়ামের আইসোটোপ ৩ কিংবা ৪। কার্বনের সৃষ্টি হয়েছিল এই আইসোটোপ দিয়েই, পরোক্ষভাবে হাইড্রোজেনের আইসোটোপ থেকে, কিংবা সরাসরি হিলিয়ামের আইসোটোপ থেকে।

নক্ষত্রের কেন্দ্রে (stellar core) তাপ ও চাপের কারণে হাইড্রোজেন রূপান্তরিত হয় হিলিয়ামে। প্রতিটা ফিউশন বিক্রিয়ায় একটু একটু করে নক্ষত্রের গাঠনিক উপাদান বদলে যেতে থাকে। দুইটি হাইড্রোজেন-১ এর নিউক্লি গলে পুরোটা ভর যোগ হয়ে তৈরি হয় আরেকটি বড় আইসোটোপ (হাইড্রোজেন-২)। তৃতীয় একটি হাইড্রোজেন-১ এসে হাইড্রোজেন-২ এর সাথে জোড়া লেগে উৎপন্ন করে ডিউটেরিয়াম। প্রতিটা ফিউশন বিক্রিয়াই কিছু পরিমাণ শক্তি মুক্ত করে। এই শক্তির পরিমাণ যে দুইটি নিউক্লি থেকে নতুন আরেকটি সৃষ্টি হলো তাদের ভরের বিয়োগফলের সমান। শক্তি এবং পদার্থ – এই দুইকে একে অপরের টার্মে প্রকাশ করা যায়, ঠিক এটাই বলা আছে আলবার্ট আইনস্টাইনের বিখ্যাত সেই সূত্রে, E = mc2। শক্তির পরিমাণ ভর এবং আলোর গতিবেগের (সেকেন্ডে ১৮৬,০০০ মাইল) বর্গের গুণিতকের সমান।

এই বিক্রিয়াগুলি সম্পন্ন হবার পর আণবিক সংযোগস্থাপন কিছুটা থমকে যায়। হাইড্রোজেন-৩ (ট্রিটিয়াম) নিউক্লি আর হাইড্রোজেন-৪ হতে পারে না। ফলে তারা যেটা করে সেটা হচ্ছে- একে অপরের দিকে ঝাপিয়ে পড়া এবং ভেঙ্গে পড়া। এরকম দুইটি হাইড্রোজেন-৩ নিউক্লি বিক্রিয়া করতে কাছাকাছি আসলে দুইজনই একসাথে ভেঙ্গে গিয়ে এক নতুন ধরণের হিলিয়াম-৪ উৎপন্ন করে। অবশ্য এতে দুইটি হাইড্রোজেন-১ নিউক্লিও ফেরত পাওয়া যায়। নক্ষত্রের কেন্দ্রে ঠিক এই বিক্রিয়াই ঘটে। আমরা যখন তারাগুলিকে জ্বলজ্বল করতে দেখি তখন তারাগুলিতে ঠিক এই ঘটনাই ঘটে। নিয়ত হিলিয়াম-৪ উৎপন্ন হওয়া – যা কিনা কার্বন তৈরির সরাসরি উপাদান।

তারারা এতই বড় আর এদের ঘনত্ব এতই বেশি যে এদের কেন্দ্রে নির্গত শক্তি উপরিভাগে পৌছুতেই সময় লাগে প্রায় ২০০,০০০ বছর। পথিমধ্যে আবার অসংখ্য কণায় সেই শক্তির নিয়ত শোষন আর নির্গমন ঘটতে থাকে, যতক্ষণ পর্যন্ত না সেই শক্তি মিলিয়ন মাইল উঁচু লেলিহান শিখা ছাড়িয়ে একেবারে পরিচলন স্তরে মানে সারফেসে পৌছায় এবং মহাশূন্যে আছড়ে পড়ে। হাইড্রোজেন থেকে ডিউটোরিয়াম, আবার ডিউটোরিয়াম থেকে হিলিয়াম – উপাদানের এই পরিবর্তন আনতে একটি নক্ষত্রের বিলিয়ন বছর ধরে জ্বলতে হয়। হিলিয়ামের ভর হাইড্রোজেনের ভরের চাইতে বেশি। এর অপেক্ষাকৃত ভারী নিউক্লির মধ্যাকর্ষন শক্তিও বেশি। সূর্যের ইতিহাসে সবসময় হাইড্রোজেনের ফিউশনজনিত বহির্মুখী ধাক্কা আর হিলিয়ামের মধ্যাকর্ষণজনিত অন্তর্মুখী টানের মধ্যে একটা সুন্দর সামঞ্জস্য ছিল। এর ফলে এই জ্যোতিষ্কটি ক্রমশ সংকুচিত হতে এবং বেশি তাপ উৎপন্ন করতে পেরেছে। প্রায় ৪ বিলিয়ন বছর পূর্বে, যখন পৃথিবীর বুকে প্রাণের আবির্ভাব ঘটেছিল, তখন সূর্য এখনকার থেকে প্রায় ৩০ শতাংশ বেশি ঠান্ডা ছিল। প্রাণ সৃষ্টির আদি পরিস্থিতি কেমন হতে পারে সেই চিন্তার দিক থেকে এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ পর্যবেক্ষন।

হিলিয়ামের চেয়ে একটু বড় মৌল – যেমন, লিথিয়াম, বেরিলিয়াম এবং বোরন – এরা মহাবিশ্বে বলতে গেলে খুবই দুর্লভ, যার কারণে নক্ষত্রের শক্তি উৎপাদন প্রক্রিয়ায় এদের গুরুত্ব নিতান্তই অল্প। অতএব, একদম সঠিক পরিস্থিতিতে, যখন তারাগুলির যতটুকু বড় হওয়া দরকার ঠিক ততটুকু বড় হলো, এর কেন্দ্রের যতটুকু উত্তপ্ত থাকা প্রয়োজন সে ততটাই উত্তপ্ত হলো, ঠিক সেই মুহূর্তে হিলিয়াম জ্বলে পরিণত হলো পরবর্তী বৃহৎ মৌলে।
সেটি আর কেউ নয় - কার্বন।

(প্রথম অধ্যায়ের বাকিটুকু
চলবে)


মন্তব্য

শামীম এর ছবি

পুরাপুরি বিশ্বাস না করেও পড়ে ফেললাম। চমৎকার গতিময় বর্ণনা। চলুক।

________________________________
সমস্যা জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ; পালিয়ে লাভ নাই।

ফারুক হাসান এর ছবি

অবিশ্বাসের জায়গাগুলি নিয়ে আলোচনা হতে পারে। রোস্টন এখন পর্যন্ত মহাবিশ্বের যে মডেলটি সর্বাধিক সমাদৃত সেটাই তুলে ধরেছেন।

তারাপ কোয়াস এর ছবি

ঝরঝরে অনুবাদ হয়েছে। পরের পর্বের জন্য অপেক্ষা করছি।


love the life you live. live the life you love.

ফারুক হাসান এর ছবি

আগামী সপ্তাহ নাগাদ নামাতে পারবো। প্রথম অধ্যায়ের বাকিটুকু দিয়ে দেবো একেবারে খাইছে

বিবাগিনী এর ছবি

অসাধারণ! খুব আপন আপন লাগলো লেখাটা।অনেক ধন্যবাদ। কত্তদিন পর কার্বন নি‌য়ে ভাবলাম কে জানে! এত দুরে চলে গেছি এইসব থেকে ভুলেই যাচ্ছি সব।
কার্বনই তো জীবন হাসি

‌‌::একাকিত্বের বিলাস আমার অনেকদিনের সাধ::

ফারুক হাসান এর ছবি

হ্যা, কার্বনই জীবন। হাসি

 শুভাশীষ মনি এর ছবি

অসাধারণ!অনেক ধন্যবাদ..চলুক

ফারুক হাসান এর ছবি

ধন্যবাদ পড়ার জন্য

মাহবুব রানা এর ছবি

এবার অনেক খাটুনি গেছে বোঝা যাচ্ছে হাসি
চলুক

ফারুক হাসান এর ছবি

তার আর বলতে!হাসি

ফারুক হাসান এর ছবি

আপনাকেও ধন্যবাদ পড়ার জন্য হাসি

ডুব এর ছবি

লেখাটা অনেক ভালো হয়েছে। মহাবিশ্ব সৃষ্টির নান্দনিক বর্ণনা একটা। দি ফার্স্ট থ্রী মিনিটসের কথা মনে পড়ে গেল।

অতিথি লেখক এর ছবি

ভাল লিখছেন।

ফারুক হাসান এর ছবি

ধন্যবাদ!

ফারুক হাসান এর ছবি

ভালো লেগেছে জেনে খুশী হলাম।

অনার্য সঙ্গীত এর ছবি

বিজ্ঞানের লেখা হলে আমি সময় করে বসে আয়েশ করে পড়ি। এজন্যেই পড়তে আর কমেন্ট করতে দেরি হল।

দারুণ লেখা। ছোট্ট একটি ব্যপার ভেবে দেখতে বলি, কিছু লাইন বেশ বড়। মূল লেখায় যেটা এক বাক্যে আছে অনুবাদেও তা এক বাক্যেই রাখতে হবে এরকম বাধ্যবাধকতা নেই বলে জানি। ছোট ছোট লাইনে কথা বললে বুঝতে সুবিধা হয়। অথবা হয়তো আমার ছোট ছোট লাইনে পড়তে ভালো লাগে বলেই এরকম মনে হচ্ছে।

______________________
নিজের ভেতর কোথায় সে তীব্র মানুষ!
অক্ষর যাপন

ফারুক হাসান এর ছবি

ধন্যবাদ অনার্য। আমার নিজেরো ছোট ছোট লাইনই পছন্দ। পরের পর্বগুলোতে তাই করবো।

রোমেল চৌধুরী এর ছবি

অনেক আগ্রহ ও বিস্ময় নিয়ে পড়লাম।

------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
আমি এক গভীরভাবে অচল মানুষ
হয়তো এই নবীন শতাব্দীতে
নক্ষত্রের নিচে।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।