কার্বনের প্রাগৈতিহাসিক গল্পের মতন একটি চমৎকার গোছানো বৈজ্ঞানিক আখ্যানের পূর্ণতা পেতে দশকের পর দশক সময় লাগে। এই সময়ে প্রস্তাবিত নানান প্রকল্পের (hypothesis) মধ্যে কোনটি বেশি গ্রহনযোগ্য তাই নিয়ে চলে তুমুল প্রতিযোগিতা। বিজ্ঞানিরা হন্যে হয়ে বিভিন্ন প্রকল্পের পক্ষে বিপক্ষে উপযুক্ত প্রমাণ খুঁজে বেড়ান। বিজ্ঞানিরাও মানুষ, তাদের জীবিকার চিন্তা করতে হয়, তারাও ভুল করেন, প্রভাবিত হন। কিন্তু আশার কথা হচ্ছে, বিশ্বজুড়ে শত শত বছর ধরে আমরা এমন এক বিজ্ঞানের চর্চা করছি যার লক্ষ্য হচ্ছে সমস্ত ব্যক্তিপ্রবণতা আর ভুলত্রুটি দূর করে কেবল বাস্তব প্রমাণ আর অকাট্য যুক্তিতর্কের উপর ভিত্তি করে একটি ক্রমবর্ধমান জ্ঞানের সমষ্টি গড়ে তোলা। পেশাদার বিজ্ঞানির দল শুধুমাত্র সম্ভাবনাময় চিন্তাধারাকে গ্রহন করেন। বাস্তবপ্রমাণহীন ধারণাগুলি সময়ের ভাগারে নিক্ষিপ্ত হয়।
[justify]কখনো কখনো পেশাদার লোকজনও আক্রান্তবোধ করতে পারেন। ১৯০০ সালে কিছু পদার্থবিদের মনে হলো, দুনিয়াতে ভাববার মতন সমস্যা তেমন আর নেই। মজার ব্যাপার, সূর্য কীভাবে জ্বলে সেটাই তারা জানতেন না। অবশ্য তাদের এই বোধটুকু ছিল যে সূর্য কোনো সাধারণ বাতি নয়। সেরকম হলে তো কবেই এর জ্বালানি শেষ হয়ে যেতো! নক্ষত্রের মধ্যে নিয়ত ঘটতে থাকা নিউক্লিয়ার ফিউশনের সাথে আসলে কোনো দহনেরই তুলনা হয় না। যদি এরকম কোনো চুলা বানানো হয় যেখানে একসঙ্গে কয়েক মিলিয়ন বিলিয়ন টন কয়লা পোড়ানো সম্ভব, তবুও সেই চুলার সাধ্য নেই যে সূর্যের মত করে দুই সেকেন্ড জ্বলবে। আর এত কয়লাই যদি থাকতো তাহলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মত দেশের অর্থনীতি চালাতে অন্তত আগামী ১.৫ মিলিয়ন বছর কোনো চিন্তা করতে হতো না।
নক্ষত্রগুলি কীভাবে কার্বন তৈরি করে সেই আবিষ্কার মহাবিশ্বের উৎপত্তি-রহস্য উন্মোচনে অনেক ভূমিকা রেখেছে। একটা বড় রহস্য হচ্ছে – মহাবিশ্বে যত মৌল পাওয়া যায় তাদের জন্ম আসলে কোথায় হয়েছিল? বয়সে বেড়ে গেলে নক্ষত্রেরা অপেক্ষাকৃত ভারী মৌলের জন্ম দিতে শুরু করে। আদতে, নক্ষত্রগুলির ভেতরে শক্তির সাথে সাথে সহজাতভাবেই ভারী মৌল তৈরি হতে পারে। তাই বিগ ব্যাং তত্ত্বটি যখন কেবলমাত্র একটি প্রকল্প হিসেবে আত্মপ্রকাশ করছিল, তখনই নিউক্লিয়ার ফিউশনে কার্বনের যে ভূমিকা সেটি খুব গুরুত্বপূর্ণ পর্যবেক্ষণ হিসেবে দেখা দিল।
১৯০০ সালেই আবার জার্মান পদার্থবিদ ম্যাক্স প্লাংক (Max Planck) এমন একটি যুগান্তকারি ধারণা প্রস্তাব করলেন যার কারণে সব পদার্থবিজ্ঞানীদের নড়েচড়ে বসতে হলো। তিনি বললেন, শক্তির স্থানান্তর নিরবিচ্ছিন্নভাবে ঘটে না। সাবএটমিক কণাগুলি – এমনকি আলোর যে কণা সেও আসলে কোনো নিরবিচ্ছিন্ন রশ্মি নয়, এরা উড়ে বেড়ায় না, মৌমাছির মত ভনভনও করে না। একটি কণা স্পঞ্জের মত কিছু নয় যে সে শক্তিকে একবার পানির মত শুষে নেবে, আবার তাকে চিপলে শক্তি বের হবে। তবে হ্যা, শক্তির মাত্রাকে হয়তো একটা সিড়ির সাথে তুলনা করা যেতে পারে। আপনি হয় শক্তির সিড়ির এই ধাপে, না হয় অন্য ধাপে। যদি বলি, একটি কণা লাফিয়ে চলতে পারে, তাহলে ধরতে হবে যে সে তার অবস্থান এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় বদলে ফেলেছে কোনো ধরণের স্থানীক ভ্রমণ ছাড়াই। এই ধরণের ধাপ টপকানোকে বলে “কোয়ান্টা” (quanta)। কোয়ান্টাম একটি ল্যাটিন শব্দ যার বাংলা হচ্ছে “পরিমাণ” (quantity)।
প্রচন্ড সৃষ্টিশীলতা, ভালো-মন্দ নানান ব্যর্থতা, তাত্ত্বিক অন্তর্দৃষ্টি, চরম প্রতিযোগিতার মনোভাব, উচ্চতর গণিতের প্রয়োগ এবং বাস্তব পরীক্ষামূলক প্রমাণকে হাতিয়ার করে পরবর্তী চার দশকে কোয়ান্টাম পদার্থবিদ্যা দ্রুত প্রসারিত হলো। ১৯৩০ দশকের মধ্যভাগে কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানী হান্স বিটে (Hans Bethe) নিউক্লিয়ার পদার্থবিজ্ঞানের সেই বিকাশমান সময়কালকে গুছিয়ে কয়েকটি বিশালকায় প্রবন্ধে নথিবদ্ধ করেন, যেগুলি পরবর্তীকালে ‘বিটে’র বাইবেল’ নামে পরিচিত লাভ করে। এই কাজ তাকে পরবর্তীতে আরো অনেক কিছু অর্জনে সাহায্য করে। ১৯৩৮ সালে বিজ্ঞানিরা সূর্যের শক্তির ব্যাপারে বেশ গুরুতর কিছু প্রশ্ন উত্থাপন করেন। সেই বছরের শুরুতেই বিটে ও তার এক কনিষ্ঠ সহকর্মী মিলে একটি গবেষণা প্রবন্ধ প্রকাশ করেন যার বিষয়বস্তু ছিল সবচেয়ে মৌলিক নিউক্লিয়ার ফিউশন, যেটি ঘটে কেবলমাত্র দুইটি প্রোটন বা হাইড্রোজেন নিউক্লি’র মধ্যে। এই প্রবন্ধটি বিগত দশকের সব অর্জনকে ছাপিয়ে পদার্থবিজ্ঞান গবেষণার জগতে নতুন এক তাত্ত্বিক কাঠামো উন্মোচিত করে, যেটি পরবর্তী কয়েক দশক ধরে টিকে ছিল।
সেই বছর ওয়াশিংটনে অনুষ্ঠিত পদার্থবিদদের এক বাৎসরিক সম্মেলন শেষে বিটে বুঝতে পারেন যে নক্ষত্রের ভেতরে হাইড্রোজেন পুড়িয়ে হিলিয়াম তৈরির একটি দ্বিতীয় উপায় আছে – কিন্তু এর জন্য নক্ষত্রদের কার্বন থাকা অপরিহার্য। ব্যাখ্যা হিসেবে তিনি ‘কার্বন-নাইট্রোজেন-অক্সিজেন (CNO) চক্র’ নামে একটি চক্রের কথা পাড়লেন, যেটি কেবল সূর্যের চেয়ে বড় নক্ষত্রদের ক্ষেত্রে দেখা যায়। এই চক্রে একটি কার্বন নিউক্লিয়াস এবং চারটি হাইড্রোজেন নিউক্লি (অন্যভাষায়, চারটি প্রোটন) ক্রমান্বয়ে বেশ কিছু ফিউশন বিক্রিয়ার মাধ্যমে গলে গিয়ে একটি নতুন হিলিয়াম-৪ নিউক্লিয়াস তৈরি করে আর আদি কার্বনটির অবশিষ্ট হিসেবে থেকে যায় তার কার্বন-১২ নিউক্লিয়াস। ভিন্ন চারটি প্রোটন জোগাড় করে সেই কার্বনটি পুনরায় এই চক্রটিকে সচল রাখে।
এমনিতেই এটি ছিল একটি উল্লেখযোগ্য আবিষ্কার, এক সহকর্মী আবেগ ধরে রাখতে না পেরে তার উপর কাব্যিক রঙ চড়ালেন। নিউক্লিয়ার পদার্থবিদদের পালের গোদা জর্জ ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক জর্জ গ্যামো (George Gamow) গুল মেরে বললেন যে, এই নায়কোচিত আবিষ্কার বিটে নাকি করেছিলেন ওয়াশিংটন সম্মেলন (গ্যামো সম্মেলনের সংগঠকদের একজন ছিলেন) শেষে নিউ ইয়র্কের ইথাকা থেকে ট্রেনে বসে বাড়ি ফেরার পথে। বিটে’র সহকর্মীরা বিটে’কে এত উঁচু নজড়ে দেখতেন যে তারা গ্যামো’র সেই গুলগপ্পো দিব্যি বিশ্বাস করে বসে ছিলেন বহুদিন (সহকর্মীদের এই ভুল ভাঙাতে বিটে’র কয়েক সপ্তাহ লেগেছিল)। ম্যাক্স প্লাংকের আবিষ্কারের ষাট বছর পর ১৯৫৭ সালে প্রথমবারের মত পূর্ণাঙ্গ গবেষণা সম্ভব হয় যার মাধ্যমে মানুষ বুঝতে পারে নক্ষত্ররা কীভাবে সকল মৌল সৃষ্টি করে। এই পুরোটা সময়ের মধ্যে বিটে’র গবেষণাটি ছিল এক মাহেন্দ্রক্ষণ।
পরবর্তী সত্তর বছরে কিছু পরিবর্তিত হয়েছে বটে, কিন্তু আজও বিটে প্রবর্তিত নক্ষত্রীয় কার্বন চক্রের ধারণাটি বহাল তবিয়তে টিকে আছে। তৎকালীন প্রচলিত সৌরপদার্থবিজ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে বিটে হিসেব কষে দেখিয়েছিলেন যে আমাদের সূর্যেও কার্বন পুড়ছে। নিজের হিসেব অনুযায়ী বিটে ধারণা করতেন যে সূর্যের নিজস্ব একটি কার্বন চক্র আছে। নিউ ইউর্ক টাইমসকে দেয়া এক সাক্ষাতকারে CNO চক্রের প্রকৃতি নিয়ে আলোচনার সময় বিটে স্বচ্ছন্দের সাথেই একবার বলেছিলেন, “সূর্য গিলে খায় তার কার্বন, যা তার আছেও।” এক অটল রহস্যময়তা ১৯৫০য়ের শুরুর দিকে বিরাজ করছিল, সূর্য আসলে কোন চক্রটি ব্যবহার করে – “প্রোটন-প্রোটন” শৃঙ্খল, নাকি কার্বন চক্র।
না বিটে না অন্য কেউ উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন যে, মহাবিশ্বের উৎপত্তি উদঘাটনের মুক্তমনা যুদ্ধে কার্বনের প্রশ্নটি গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু নির্ণায়ক কিছু নয়। বিটে’র কাজ সবার মনে প্রশ্ন জাগালো, “কার্বনের উৎপত্তি কীভাবে?” বিটে নিজে এর উত্তর দিতে চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু পারেন নি। হয়তো একটা কারণ ছিল যে পরবর্তী এক দশকেও নিউক্লিয়ার পদার্থবিজ্ঞানের মূল পরীক্ষাগুলি চালানো সম্ভবপর ছিল না। তিনি তিনটি হিলিয়াম-৪ গলে মুহূর্তে একটি কার্বন-১২তে পরিণত হওয়ার ধারণাটি তাই পরিত্যাগ করলেন।
যে সব খিলাড়ি বিগ ব্যাং প্রকল্প এবং নক্ষত্রে মৌল সংশ্লেষণের ধারণার সূচনা করেছিলেন তারা নানান বিষয়ে একইসাথে অবিশ্বাস্যরকমের সঠিক এবং ভ্রান্ত ধারণা পোষণ করতেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরের দশকে সৃষ্টিতত্ত্বের (cosmology) স্বর্ণযুগের আবির্ভাব ঘটে। জর্জ গ্যামো ছিলেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সোভিয়েত থেকে পালানো একজন আশ্রয়প্রার্থী, জাতে পাঁড়মাতাল। কিন্তু তার একটি বুদ্ধিদীপ্ত মন ছিল, ছিল দারুণ রসবোধ। সর্বোপরি, তার ছিল দূরদর্শিতা- একটি উদীয়মান গবেষণাক্ষেত্রকে পরিপক্কতা দেয়ার জন্য যা কিনা অপরিহার্য। ১৯৪৮ সালে গ্যামো এবং গ্র্যাজুয়েট ছাত্র রেফ আলফার (Ralph Alpher) মহাবিশ্বের উৎপত্তির উপর তাদের তত্ত্বটি গুছিয়ে আনেন। তারা ধরে নেন যে, মহাবিশ্বের প্রারম্ভিক বিস্তারের সময়ে ছড়িয়ে পড়া শক্তি, শুরুর দিকের ইপোকগুলিতে যা ছিল অনেক বিলিয়ন ডিগ্রি উত্তপ্ত, সেই শক্তি ক্রমশ ঠান্ডা হতে হতে ১৪ বিলিয়ন বছর পর বর্তমানে -২৬৮ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডে (প্রায় -৪৫৫ ডিগ্রি ফারেনহাইট) নেমে এসেছে। জ্যোতির্বিদদের পছন্দের পরম তাপমাত্রার স্কেলে যা মাত্র ৫ ডিগ্রি কেলভিন। ৫ ডিগ্রি কেলভিন, এই হিসাবটি ছিল একইসাথে বিস্ময়কর এবং দুঃসাহসিক একটি অনুমান, কারণ পরবর্তী দুই দশকের সমস্ত মহাকাশ পর্যবেক্ষণের সাথে এই হিসাবের মিল ছিল লক্ষ্যণীয়। কিন্তু গ্যামো যখন তার এই প্রকল্পটি বিজ্ঞান সমাজে পেশ করলেন, তখন অনেক বিশিষ্ট জোতির্বিদ ও নিউক্লিয়ার পদার্থবিদ একে তাচ্ছিল্যের সাথে গ্রহন করেছিলেন। কর্নেলের জোতির্বিদ এবং নাৎসি আমলের অস্ট্রীয় রিফিউজি এডউইন সালপিটারের ভাষ্য ছিল, “সেই সময় আমাদের অনেকেই, বিশেষ করে তাত্ত্বিক গবেষকরা বিস্ফোরণের ভেতর দিয়ে মহাবিশ্ব সৃষ্টি হবার ধারণাটিকে পছন্দ করার মত অতটা বিশ্বাসী মনের ছিলেন না”। গ্যামোর এক দুর্দান্ত প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন ফ্রেড হয়েল (Fred Hoyle)। প্রথাবিরোধী হিসেবে খ্যাত হয়েল একবার বিবিসি রেডিওর এক বিজ্ঞান শো’তে গ্যামো’র প্রস্তাবিত সৃষ্টির শুরুতে ঘটা বিস্ফোরণকে ব্যাঙ্গ করলেন “big bang” বলে। হয়েলের উপহাস করে বলা কথাটিই গ্যামো’র মনে ধরলো খুব এবং নামটি প্রচলিত হয়ে গেল।
গ্যামো এবং আলফার প্রস্তাব করলেন যে বিগ ব্যাংয়ের সময়ে ছোট নিউক্লিগুলি ফিউশন প্রতি একটি প্রোটনের সাথে জুড়ে গিয়ে বড় বড় নিউক্লিতে পরিণত হয়েছিল। কিন্তু মুশকিল হলো, নিউক্লিয়ার ফিউশন এক সময় থেমে যেতে বাধ্য। পরীক্ষালব্ধ সব পর্যবেক্ষণও ইতিমধ্যেই তাদের ধারণার ভিত্তিকে দুর্বল করে দিয়েছিল। ১৯৩৯ সালে মিনেসোটা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিদরা দেখালেন যে লিথিয়াম-৫ খুবই অস্থিরমতি এবং দ্রুত ভেঙ্গে যায়। এক দশক পরে, ক্যালিফোর্নিয়া ইন্সটিটিউট অফ টেকনোলজির (ক্যালটেক) উইলি ফাউলারের (Willy Fowler) ল্যাবে আবিষ্কৃত হলো যে ৮ ভরবিশিষ্ট বেরিলিয়াম আইসোটোপেরও কোনো স্থির (stable) নিউক্লিয়াস নেই। কার্বনের প্রধান আইসোটোপের ভর ১২। কিন্তু গ্যামো ও আলফারের প্রকল্প হিলিয়াম-৪য়ের চেয়ে ভারী কোনো নিউক্লির ব্যাখ্যা দিতে পারে নি।
১৯৫০য়ের গোড়ার দিকে ক্যালটেকের নিউক্লিয়ার পদার্থবিদরা বেরিলিয়াম-৮য়ের অস্থায়িত্বের যে সমস্যা তার গভীরে তলিয়ে দেখতে গিয়ে এমন একটা বিষয়ে কৌতূহলী হয়ে উঠলেন যার সাথে নক্ষত্রে কার্বন সৃষ্টির সম্পর্ক থাকতে পারে বলে এক সময় ভাবা হয়েছিল। ক্যালটেকের কেলোগ রেডিয়েশন ল্যাবরেটরিতে তখন কাজ করছিলেন বিশ্বের শ্রেষ্ঠ চিন্তাশীল মনের কিছু মানুষ। ফাউলারের তত্ত্বাবধানে এই ক্যালটেক বিজ্ঞানিরা ব্যাপক পরিসরে নিউক্লিয়ার পদার্থবিজ্ঞানের অন্যতম উল্লেখযোগ্য কিছু পরীক্ষা চালান। বিভিন্ন কণার গঠন বোঝার জন্য তারা ইলেকট্রোস্ট্যাটিক জেনারেটর দিয়ে কণাগুলিকে একে উপরের উপর বর্ষন করেন। এডউইন সালপিটার তখন কর্নেলের একজন নবীন অধ্যাপক এবং সেই সময় ক্যালটেকে ভিজিটিং হিসেবে কর্মরত। নক্ষত্র থেকে শক্তি নির্গমনের সময় তিনটি হিলিয়াম-৪য়ের নিউক্লি পুড়ে কীভাবে কার্বন-১২ তৈরি হতে পারে তাই নিয়ে হান্স বিটে নিজের গবেষণার কিছু স্মৃতি সালপিটারের কাছে রোমন্থন করতেই সালপিটারও আগ্রহী হয়ে উঠেন। হিলিয়াম-৪ নিউক্লিগুলিকে বলা হয় “আলফা কণা”। (ইউরোনিয়ামের তেজস্ক্রিয় বিকিরণ এবং একটি চালু স্মোক ডিটেকটরে থাকা আমেরিকামের করা তেজস্ক্রিয় বিকিরণের নেপথ্যেও থাকে এই আলফা কণা।)
ক্যালটেকে থাকতেই ১৯৪৯ সালে সালপিটার বেরিলিয়াম-৮ নিয়ে কাজ করতে গিয়ে একটা নতুন ব্যাপার খেয়াল করেন। বেরিলিয়াম-৮ আসলে দুইটি আলফা কণার সমষ্টি। তিনি বুঝতে পারলেন যে এই ক্ষণস্থায়ী নিউক্লিয়াসগুলিই আসলে কার্বনের চাবিকাঠি। এরাই সেই “কোয়ার্ক”গুলির একটি যা দিয়ে কার্বনের এত প্রাচুর্যতা ব্যাখ্যা করা সম্ভব, যে কার্বনের উপস্থিতির কারণেই আজকে আমাদের এই বেঁচে থাকা সম্ভবপর হয়েছে। ভেঙ্গে যাওয়ার পূর্বে গ্রাউন্ড স্টেটে এই বেরিলিয়াম-৮ নিউক্লিয়াসের স্থায়িত্ব মাত্র ০.০০০০০০০০০০০০০০০০৯৬৮ সেকেন্ড। কেবলমাত্র পদার্থবিজ্ঞানিদের পক্ষেই সম্ভব ০.০০০০০০০০০০০০০০০০৯৬৮ সেকেন্ড সময়কে “যথেষ্ট দীর্ঘ জীবন” বলা। বেরিলিয়াম-৮য়ের সাথে তৃতীয় আরেকটি আলফা কণা জোড়া লেগে কার্বন সৃষ্টির জন্য এটুকু সময়ই যথেষ্ট। যদি সেটা না ঘটে তাহলে বেরিলিয়াম ভেঙ্গে দুই খন্ড হয়ে যায়। নিউক্লিয়াসটির এত সংক্ষিপ্ত জীবন সত্ত্বেও নক্ষত্রগুলি এদেরকে প্রচুর পরিমাণে উৎপন্ন করে – প্রতি ১০ বিলিয়ন কণার একটি থাকে বেরিলিয়াম নিউক্লিয়াস – যা কিনা কার্বন-১২ তৈরির জন্য যথেষ্ট। বেরিলিয়াম-৮ এবং হিলিয়াম-৪ পুড়ে কার্বন-১২ তৈরির এই প্রক্রিয়াটি পরবর্তীতে “ত্রিআলফা পদ্ধতি” (triple-alpha process) বা “সালপিটার পদ্ধতি” নামে পরিচিতি লাভ করে।
গল্পের এখানেই শেষ নয়, অবশ্যই। এই গবেষণা একটা জরুরি প্রশ্নের উত্তর দিলেও নতুন আরেকটি প্রশ্ন তোলে। যদি তাই হয়, তাহলে নক্ষত্রে কার্বন উৎপাদনের গতি হবে খুবই ধীর, এবং বাস্তবের তুলনায় উৎপাদিত কার্বনের পরিমাণ হবে খুব নগণ্য। এরকম পরিস্থিতিতে রঙ্গমঞ্চে আবির্ভূত হলেন “বিগ ব্যাং” শব্দটির প্রচলক সেই ফ্রেড হয়েল, যিনি মহাবিশ্ব সৃষ্টির উপর প্রস্তাবিত অন্য আরেকটি প্রকল্পের সমর্থক ছিলেন। তিনি যুক্তি দিলেন যে মহাবিশ্বে কার্বনের আধিক্য এর নিউক্লিয়াসে সুপ্ত এক বৈশিষ্টের কারণে হয়েছে, যা আগে কেউ আবিস্কার করতে পারে নি। সেই বৈশিষ্টটি হচ্ছে নিউক্লিয়াসের শক্তিস্তর। হয়েল বললেন যে বেরিলিয়াম-৮ এবং হিলিয়াম-৪ এর শক্তিস্তরকে যোগ করলে সেই যোগফল হবে কার্বনের শক্তিস্তরের কাছাকাছি। তিনটি আলফা কণার শক্তি এই স্তরে পৌছাতে পারলে জোড়া লেগে কার্বন-১২ নিউক্লিয়াস তৈরি করা খুব সহজ এবং ঘটনার সেখানেই ইতি।
হয়েল প্রায় বছরখানেক ক্যালটেকে ছিলেন। এই সময়ে তিনি কেলোগ রেডিয়েশন ল্যাবকে খুব করে ধরলেন যাতে কিছু পরীক্ষা চালিয়ে কার্বন নিউক্লিয়াসের সেই শক্তিস্তরের অস্তিত্ব আসলেই আছে কিনা তা খতিয়ে দেখা যায়। হয়েল লিখেছিলেন, “আমার সম্পর্কে [উইলি] ফাউলারের প্রথম ধারণা ছিলো- আমি মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছি। ফাউলার নিজেই আমাকে সেটা বলেছিলেন।” কিন্তু পরীক্ষা চালানোর পর দেখা গেল যে হয়েলের অনুমানই সঠিক। ৭.৬৫ মিলিয়ন ইলেকট্রন ভোল্টে যখন হিলিয়াম-৪ এবং বেরিলিয়াম-৮ এর নিউক্লিরা একত্রিত হয় তখন সত্যি সত্যি তাদের সম্মিলিত শক্তি হয়েলের অনুমানকৃত কার্বন শক্তিস্তর থেকে ইনক্রিমেন্টালি কম। বেরিলিয়াম-হিলিয়ামের এই সম্মিলিত শক্তির সাথে নক্ষত্রের তাপ যোগ করে কার্বন-১২র অনুমানিক সেই শক্তিস্তরে পৌছানো সম্ভব। এরপর আর বিক্রিয়া অগ্রসর হতে পারে না। যদি চতুর্থ কোনো হিলিয়াম নিউক্লিয়াস নতুন কার্বন নিউক্লিয়াসের কাছে এসে জোড়া লেগে অক্সিজেন তৈরি করতে চায়, তাহলে নক্ষত্রের তাপশক্তিকে গগণায় না নিয়েও শুধুমাত্র বিক্রিয়ালব্ধ শক্তির পরিমাণই অক্সিজেনের নিকটতম শক্তিস্তরের চাইতে ইনক্রিমেন্টালি বেশি হবে। তাই সেই বিক্রিয়া ঘটতে ব্যর্থ হয়। কার্বন আর হিলিয়াম টিকে থাকে তাদের নিজস্ব পরিচয় নিয়ে।
ক্যালটেকের নিউক্লিয়ার পদার্থবিদরা ১৯৫৩ সালে দশ দিন ধরে পরীক্ষা চালিয়ে হয়েলের অনুমান করা কার্বনের সেই শক্তিস্তরকে নিশ্চিত করলেন। হয়েল সেই দেড়সপ্তাহ ধরে অস্থিরচিত্তে অপেক্ষায় ছিলেন, যেমন করে কোনো আসামি অভিযুক্ত হবার পর জুরিদের ফেরার অপেক্ষা করে। শুধু একটা পার্থক্য ছিল। আসামি নিজের মনে ঠিকই জানে যে সে দোষী নাকি নির্দোষ। “অন্যদিকে, পদার্থবিজ্ঞানের ক্ষেত্রে সমস্যা হলো যে আপনি নিজে জানেন না আপনি আদৌ নিষ্পাপ নাকি দোষী। কেবল পরীক্ষালব্ধ ফলাফলে বিশ্বাসী জুরিরা যে রায় দেবেন সেটাকেই সঠিক বলে ধরা হয়।” সব ফ্রন্ট থেকে সমর্থন আদায় করতে হয়েলের বেশ কয়েক বছর লেগেছিলো।
হয়েলের অনুমান এবং এ সম্পর্কিত পরীক্ষানিরীক্ষাগুলি কার্বনের উৎপত্তির ত্রি-আলফা মডেলকেই প্রতিষ্ঠিত করলো। পরীক্ষাগারে হাতে-কলমে তিনটি আলফা কণাকে গলিয়ে কার্বন তৈরি করতে পারলে সেটা সোনায় সোহাগা হতো। কিন্তু মুশকিল হচ্ছে, কার্বন তৈরির প্রক্রিয়া পরীক্ষা করে দেখার মত কোনো অবস্থা বিজ্ঞানিদের পক্ষে এখন পর্যন্ত তৈরি করা সম্ভব নয়। এমনকি আমাদের সূর্যের কেন্দ্রও সেই পরীক্ষা চালানোর জন্য ততটা উত্তপ্ত নয়। প্রোটন জোড়া লাগায় যে হাইড্রোজেন বোমা সেই বোমা ফাটালেও তাপমাত্রা বাড়ে “মাত্র” কয়েক মিলিয়ন ডিগ্রি। তারপরেও অবশ্য নক্ষত্রের মধ্যে কীভাবে হিলিয়াম পুড়ে কার্বন উৎপন্ন হয় তার একের পর এক প্রমাণ পাওয়া সম্ভব হয়েছে। সম্প্রতি ইউরোপীয় পদার্থবিদদের একটি দল ১৯৫০য়ের গোড়ার দিকে শুরু হওয়া ত্রি-আলফা তদন্তে নতুন সংযোজন এনেছেন সুইজারল্যান্ড ও ফিনল্যান্ডে স্থাপিত দুইটি পার্টিকেল এক্সিলারেটর ব্যবহার করে। তারা নক্ষত্রদের মত করে তিনটি হিলিয়াম-৪ দিয়ে কার্বন তৈরি করেন নি ঠিকই, কিন্তু এর উল্টোটি করতে সক্ষম হয়েছেন। একটি কার্বন-১২ নিউক্লি ভেঙ্গে তারা তিনটি আলফা কণা তৈরি করেছেন। শুধু তাই নয়, তারা এর ফলশ্রুতিতে সকল কার্বনের জন্মতীর্থ সেই বৃহৎ নক্ষত্রদের ১০০ মিলিয়ন ডিগ্রি কেলভিন উত্তপ্ত কেন্দ্রের সমকক্ষ অবস্থা তৈরি করতে সক্ষম হয়েছেন।
জীবনের শেষদিকে, যেমন তার অনেক সহকর্মীই দাবি করেছেন, হয়েল সত্যিই “মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে” ফেলেন। তিনি চরম বিশ্বাসীর ন্যায় নাস্তিকতাকে আঁকড়ে ধরেন। তার অনেকগুলি পাগলামির একটি ছিলো – তিনি যেসব কণা নিয়ে গবেষণা করেছেন তাদের সৃষ্টির উদ্দেশ্য খোঁজা – যা কিনা একজন পেশাদার বিজ্ঞানির জন্য বেশ অস্বাভাবিক এবং দোদুল্যমান অবস্থান। তিনি বলে বেড়াতে লাগলেন যে কার্বন পরমাণুর এহেন গুণাগুণের একটাই বুদ্ধিদীপ্ত – আদতে “সুপারইন্টেলিজেন্ট” – ব্যাখ্যা থাকতে পারে আর সেটি হচ্ছে, কার্বনকে তৈরি করেছে সর্বদা শুদ্ধতা অর্জনে উন্মুখ কিছু শক্তি। তিনি লিখলেন, “তা না হলে, কেবলমাত্র সাধারণ প্রাকৃতিক শক্তিগুলিকে কাজে লাগিয়ে এরকম একটা পরমাণু পাবার সম্ভাবনা ১০^৪০,০০০ বারে ১ বারেরো কম। যে কোনো বোধবুদ্ধি সম্পন্ন মানুষই বুঝতে পারবেন যে কার্বন পরমাণু একটি পাতানো ঘটনা।”
১৯৫৩ সালে হয়েল অনুপ্রাণিত হলেন জর্জ গ্যামোর বিগ ব্যাং প্রকল্পকে ভুল প্রমাণ করতে। প্রমাণ হিসেবে তিনি দেখাতে চাইলেন যে একটি করে প্রোটন যোগ হয়ে যে নিউক্লিয়ার ফিউশনের কথা বলা হচ্ছে সেটি সঠিক নয়। তিনি যুক্তি দিলেন যে সময়ের আদিতে বিগ ব্যাং বলে কিছু ঘটে নি। আমাদের মহাবিশ্ব সর্বদাই “সুস্থির অবস্থ্যায়” বিদ্যমান ছিল। আর নক্ষত্ররা নিজেরাই সকল মৌল সৃষ্টি করেছে। কার্বনের অস্তিত্ত্বের উপর হয়েল এবং সালপিটারের গবেষণা বলা যেতে পারে গ্যামোর মূল প্রকল্পের পা’কে হাটুর নিচ থেকে ছেটে ফেলে দিতে সক্ষম হয়েছিলো। তারা প্রমাণ করেছিলেন যে মহাবিশ্বের জন্মকালে নয়, বরং অনেক পরে নক্ষত্ররাই হাইড্রোজেন, হিলিয়াম এবং লিথিয়ামের মত ভারী মৌল তৈরি করেছে। ত্রি-আলফা পদ্ধতিতেই কার্বনের জন্ম হয়েছে বলে ধরে নেয়া যায়। কিন্তু জন্মপরবর্তী কার্বনের গল্প সীমাহীন শাখা-প্রশাখায় বিস্তৃত বললেও অত্যুক্তি হবে না। কার্বনের কথা বলতে গিয়ে প্রাইমো লিভাই (Primo Levi) একবার লিখেছিলেন, “এই পরমাণু সংখ্যায় এতই বেশি যে তাদের নিয়ে তৈরি যে কোনো গল্পই সত্যি হতে পারে।” গল্পের এই পর্যায়ে এসে কার্বন তার বৈশিষ্ট্যগুলিকে এমনভাবে মুক্ত করলো যাতে সে নিজের অর্জনকে সবার উপরে তুলে ধরার জন্য একটি অনুকূল পরিবেশ তৈরি করতে পারে। সেই অনুকূল পরিবেশকেই আমরা অনেক সময় বলি – মহাবিশ্বের কোয়ার্ক।
(চলবে)
মন্তব্য
গ্রেট।
এই পর্বটা পোস্ট করতে একটু দেরি হয়ে গেল। আশা করি, তাল কাটে নি।
গ্যাচাংএক একটি বিস্ম্য এক একটি কবিতার চাইতেও মূল্যবান।
------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
আমি এক গভীরভাবে অচল মানুষ
হয়তো এই নবীন শতাব্দীতে
নক্ষত্রের নিচে।
অসাধারণ লেখা। কয়েক জায়গায় খানিকটা শক্ত লাগলেও একেবারে গন্ধম ফল খাওয়ার আনন্দ নিয়ে গিললাম। কে না জানে জীববিজ্ঞানের ছাত্রদের কাছে পদার্থবিজ্ঞান একটা গন্ধম ফল!
পুনশ্চ: আমার মতো বিজ্ঞান মূর্খ পাঠকদের জন্য পদার্থ বিজ্ঞানের কঠিন শব্দগুলোর/টার্মগুলোর অর্থ সহ একটা ফুটনোট কি দেয়া যায়?
______________________
নিজের ভেতর কোথায় সে তীব্র মানুষ!
অক্ষর যাপন
অবশ্যই যায়। ঐ আলসেমির কারণে দেয়া হয় নি। অনুবাদ করতেই জান বেরিয়ে যায়। এরপরে আর ধৈর্য্যে কুলায় না। কিন্তু পরের পর্ব থেকে ফুটনোট দিতে চেষ্টা করবো।
আগেরগুলো আবার পড়তে হবে, তারপর এইটা। পরের পর্বগুলোও দেরি করলে প্রতিবারই এইরকম শুরু থেকে শুরু করতে হবে।
পরের পর্ব রেডি, দ্রুতই আসবে।
ফারুক হাসান, আপনাকে ধন্যবাদ দিচ্ছি, কারণ এই মাত্র আপনার এই লেখাটি আমাকে সত্যি সত্যি মুগ্ধ করল! চিন্তা স্পষ্ট বলেই ভাষা আপনাকে প্রশংসা করেছে... পাঠক হিসাবে আমরা কেবল আনন্দ পেলাম... একটু করে উপলব্ধি করলাম কার্বন মিয়ার জন্ম বিত্তান্ত! চালিয়ে যান ভাই!
আপনাকেও ধন্যবাদ পড়ার জন্য। শুভ কামনা।
নতুন মন্তব্য করুন