যেহেতু কৃষি আমাদের প্রধান অবলম্বন, তাকে শিল্পেরও প্রধান অবলম্বন বানাতে পারলে আমাদেরই লাভ। আমাদের রাসায়নিক শিল্পকে এগিয়ে নিয়ে যেতে কৃষি ও শিল্পের মধ্যে যোগসূত্র স্থাপন হতে পারে একটি উৎকৃষ্ট পন্থা। এই যোগসূত্র স্থাপন হয়তো সব শিল্পের ক্ষেত্রে সম্ভব নয়। কিন্তু আমাদের অন্যতম প্রধান যে শিল্প – ইউরিয়া সার – যার উপর আমাদের কৃষি এতটা নির্ভরশীল, সেই নির্ভরশীলতাকে যদি উভমুখী করা যায় তাহলেই কিন্তু আমরা সার শিল্পে অনেক এগিয়ে যেতে পারি। এই লেখা সেই সম্ভাবনাটি নিয়েই।
বাংলাদেশের এমন কোনো কৃষক নেই যিনি ইউরিয়া সারের নাম জানেন না। ইউরিয়া একটি দানাদার রাসায়নিক পদার্থ যেটি উৎপাদন করতে বাংলাদেশে কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহৃত হয় প্রাকৃতিক গ্যাস, পানি ও বাতাস। কৃষিতে ব্যবহার্য সার একটি শিল্পজাত পণ্য। অর্থাৎ, ইতিমধ্যেই বাংলাদেশের শিল্পখাত এবং কৃষিখাত ওতোপ্রতোভাবে জড়িয়ে গেছে সারের মাধ্যমে। সারের জন্য কৃষক যেমন শিল্পপ্রতিষ্ঠানের উপর নির্ভর করছে, আবার সঠিক উদ্যোগ নিলে কিন্ত শিল্পপ্রতিষ্ঠানো কৃষির উপর নির্ভর করতে পারে।
আমরা যদি কৃষিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে চাই, তাহলে আমাদেরকে সারশিল্পকেও এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। এর কোনো বিকল্প নেই। অনেকে হয়তো সার আমদানির কথা বলবেন। কিন্তু সেটা দীর্ঘমেয়াদি কোনো সমাধান নয়। তাছাড়া, প্রতিবছর বিপুল পরিমাণ সার আমদানি করতে যে অতিরিক্ত খরচ হবে সেটা দিয়ে আমাদের নিজস্ব সারশিল্পকেই এগিয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব। আমাদের মত কৃষির উপর নির্ভরশীল দেশের জন্য দীর্ঘমেয়াদে সার আমদানির ঝুঁকিও অনেক। যেহেতু আমাদের সার লাগবেই, সেহেতু সময় লাগলেও নিজেদের বন্দোবস্ত নিজেরা করাই ভালো। সারের আন্তর্জাতিক বাজার যে সবসময় আমাদের সুবিধাজনক থাকবে তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। অন্যদিকে যদি কাঁচামালের নিশ্চয়তা থাকে তাহলে একটি সার কারখানা ৩০-৪০ বছর ধরে সার উৎপাদন করে দেশের চাহিদা মেটাতে পারে।
কাঁচামাল হিসেবে প্রাকৃতিক গ্যাসকে ব্যবহার করার সমস্যা হলো প্রাকৃতিক গ্যাসের উপর আমরা ইতিমধ্যেই অনেক নির্ভরশীল হয়ে পড়েছি। বর্তমানে বাংলাদেশের যত সার কারখানা আছে তাদের সবাই প্রাকৃতিক গ্যাস ব্যবহার করছে। এছাড়াও, আমাদের উত্তোলিত প্রাকৃতিক গ্যাসের একটা বড় অংশ পুড়িয়ে দেশের বিদ্যুতচাহিদা মেটানো হয়। সুতরাং নতুন সার কারখানার জন্য গ্যাসের সরবরাহ করা কঠিন। এছাড়া, আমাদের প্রাকৃতিক গ্যাসের সঞ্চয়ও সীমিত। যখন গ্যাসের যোগান আরো সীমিত কিংবা শেষের দিকে চলে যাবে, তখন গ্যাসনির্ভর শিল্পও বিপদের মুখে পড়বে। তাহলে উপায় কি? উপায় আছে এবং সেই উপায়টা বাংলাদেশের জন্য যে কতটা অনুকূল সেটা চিন্তা করেই আমি শিহরিত হচ্ছি।
উপায়টা কি সে সম্পর্কে যাবার আগে আসুন- ইউরিয়া কীভাবে তৈরি হয় সেটা জেনে নেই। তেমন কঠিন কিছু নয়, সাধারণ বিজ্ঞানপড়ুয়া যে কেউ ইউরিয়ার রসায়নটুকু বুঝতে পারবেন। এই জ্ঞানটা জানা সহজ, কিন্তু অনেক কার্যকরী। তবে যারা রসায়নকে খুব খুব ভয় পান তাদের নিচের বাঁকা অংশটি না পড়লেও চলবে। আর যারা রসায়নকে ভালো পান, তারা পড়লে ঠকবেন না।
আমি যদি আপনাকে প্রশ্ন করি, কি কি উপায়ে ইউরিয়া উৎপন্ন করা যায়, তাহলে একজন বিজ্ঞানমনস্ক মানুষ হিসেবে আপনি শুরুতে যেটি করবেন সেটি হচ্ছে ইউরিয়া জিনিসটা আসলে কি কি পরমাণুর সমন্বয়ে তৈরি সেটা জানা। ইউরিয়া হচ্ছে একটি অণু যার রাসায়নিক সংকেত CO(NH2)2, অর্থাৎ একটি ইউরিয়াতে চার ধরণের পরমাণু থাকে – কার্বন (C), অক্সিজেন (O), নাইট্রোজেন ( N ) এবং হাইড্রোজেন (H)। তারমানে, ইউরিয়া তৈরির জন্য এই চার ধরণের পারমাণবিক কাঁচামাল দরকার। কিন্তু প্রকৃতিতে যেহেতু এই পরমাণুগুলি সহজে পরমাণু হিসেবে পাওয়া যায় না, তাই এদেরকে সংগ্রহ করা হয় যে সমস্ত অণুতে এই পরমাণুগুলি আছে তাদেরকে কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহার করে। যেমন, কর্ণফুলী ইউরিয়া সার কারখানা কিংবা আশুগঞ্জের জিয়া সার কারখানায় ইউরিয়া তৈরির C, O, N এবং H সংগ্রহ করা হয় প্রাকৃতিক গ্যাস (মূল উপাদান মিথেন বা CH4), পানি (H2O) এবং বাতাস (N2 ও O2) থেকে।
এই কাঁচামালগুলিকে একসাথে রাখলেই আপনাআপনি ইউরিয়া তৈরি হয় না। আসলে কেবলমাত্র কিছু নির্দিষ্ট রাসায়নিক রেসিপি বা ফর্মুলা অনুসরণ করেই কাঁচামাল থেকে ইউরিয়া তৈরি করা যায়। আমাদের সার কারখানাগুলি যে রেসিপি অনুসরণ করে তার কয়েকটি ধাপ আছে। প্রথম ধাপে প্রাকৃতিকগ্যাসকে পানির সাথে বিক্রিয়া (যাদেরকে কেতাবি ভাষায় বলে স্টিম রিফর্মিং (Steam Reforming) এবং শিফট বিক্রিয়া (Shift Reaction)) করে CO2 এবং H2তে রূপান্তরিত করা হয়। স্টিম রিফর্মিং করে আমরা পাবো সিনগ্যাস (CO এবং H2 এর মিশ্রণ)। আর সিনগ্যাস থেকে শিফট বিক্রিয়ার মাধ্যমে পাবো CO2 এবং H2 এর মিশ্রণ। জটিল মনে হচ্ছে? আরে তেমন কিছুই না। খেয়াল করলে দেখবেন, আমরা এখানে মাত্র তিনটি পরমাণু নিয়ে খেলছি। প্রাকৃতিক গ্যাসের C এবং H, আর পানির H এবং O - এরা স্পেনের ফুটবল টিমের মত পাসের পর পাস দিয়ে পরিশেষে দুইটি নতুন অণু তৈরি করলো – CO2 এবং H2। CO2 হচ্ছে কার্বন ডাইঅক্সাইড আর H2 হচ্ছে হাইড্রোজেনের অণু।
কিন্তু আমরা চাচ্ছি ইউরিয়া, মানে CO(NH2)2। তারমানে, রেসিপিতে এখনো N যোগ করা বাকি। N এর সবচেয়ে সহজলভ্য উৎস হচ্ছে বাতাস। বাতাসের ৭৯%ই নাইট্রোজেন অণু (N2)। মুশকিল হচ্ছে, বাকি যে ২১% অক্সিজেন (O2) সেটি থেকে N2কে তো আলাদা করতে হবে। ধরুন কোনো উপায়ে তাকে আলাদা করলাম, কিন্তু সেই N2কে ইউরিয়ার মধ্যে ঢুকাবো কীভাবে? (N ছাড়া ইউরিয়া আর টাকা ছাড়া ব্যাংক একাউন্ট একই কথা। ইউরিয়ার কাজই হচ্ছে গাছের প্রয়োজনীয় N যোগানো।)
আমরা প্রাকৃতিক গ্যাস, পানি আর বাতাসকে রান্না করে পেলাম CO2, N2 এবং H2। এই তিনটি অণু দিয়ে ইউরিয়া তৈরি করা যাবে। (তারমানে, আপনি যদি কোনোভাবে এই তিনটি জিনিসের যোগান দিতে পারেন, তাহলেই কেল্লা ফতে)। তবে আগে যেমন বলেছি, CO2, N2 আর H2কে একসাথে মিশিয়ে ঘুটা দিলেই ইউরিয়া তৈরি হবে না। প্রথমে N2 আর H2কে বিক্রিয়া করিয়ে তৈরি করতে হবে অ্যামোনিয়া (NH3)। প্রতি এক অণু N2 আর তিন অণু H2 মিলে তৈরি করবে দুই অণু NH3। অ্যামোনিয়াও কিন্তু এক জাঁদরেল রাসায়নিক পণ্য, হাজারটা কাজে লাগে। এই অ্যামোনিয়া (NH3) আর CO2 একসাথে মিশে তবেই উৎপন্ন হবে আমাদের অতি প্রিয় ইউরিয়া (CO(NH2)2)।
মোদ্দা কথা হলো, ইউরিয়ার মাঠে খেলোয়াড় হচ্ছে ওরা তিনজন - কার্বন ডাইঅক্সাইড (CO2), নাইট্রোজেন (N2) আর হাইড্রোজেন (H2)। এদেরকে চা-কফি খাইয়ে, মাথায় হাত বুলিয়ে (সিরিয়াসলি। অনুঘটক লাগবে, তাপ লাগবে, চাপ লাগবে, কত কি!) বলবেন- হিং টিং ছট। ব্যাস, ইউরিয়া তৈরি হয়ে যাবে!
এত কথা বলার পেছনের কারণটা নিশ্চয়ই বুঝে ফেলেছেন – আমি ইনিয়ে বিনিয়ে বলতে চাইছি যে বাতাসের তো আর অভাব নাই, তাই N2র অভাবও মাশাল্লাহ কখনো হবে না, শুধু CO2 এবং H2 যোগাড় করে দিলেই হবে। প্রাকৃতিক গ্যাস থেকে CO2 এবং H2 দুটোই পাওয়া যায়, খালি যদি একটু জলপান করানো হয়। প্রশ্ন হচ্ছে – প্রাকৃতিক গ্যাসের বিকল্প আর কী কী আছে যা থেকে CO2 আর H2 পাওয়া যাবে? একটা উত্তর হচ্ছে, কৃষি। ধানের তুষ, আখের ছোবড়া, খড়, ঘাস, কাঠ। এদেরকে একসাথে বলে বায়োমাস (বাংলায় সাধারণভাবে বললে বলা যায় কৃষি ও পরিবেশজাত জৈবপদার্থ)।
বায়োমাস হচ্ছে কার্বনের (C) উৎস। প্রাকৃতিক গ্যাসও কিন্তু কার্বনের উৎস হিসেবেই ইউরিয়া সার কারখানায় ব্যবহৃত হয়। তারমানে, বুঝতেই পারছেন। বাংলাদেশে কৃষিজাত বায়োমাসের অভাব নেই। এই বায়োমাসই হতে পারে প্রাকৃতিক গ্যাসের বিকল্প, বিশেষ করে ইউরিয়া সার কারখানায়। কেবল সার কারখানাতেই নয়- পেট্রোল, ডিজেল কিংবা কেরোসিন তৈরি করতেও ক্রুডঅয়েলের বিকল্প হিসেবে বায়োমাস ব্যবহার করার চিন্তা এখন জোরেসোরেই চলছে বিশ্বজুড়ে। বিদ্যুৎ উৎপাদনেও কিন্তু বায়োমাস ব্যবহার করা যায়।
বায়োমাস থেকে সার কিংবা জ্বালানি তেল তৈরির প্রধান ও প্রথম ধাপ হচ্ছে বায়োমাসকে গ্যাসীকরণ। এর ফলে আমরা পাবো সেই সিনগ্যাস (CO2 এবং H2) যা আমরা প্রাকৃতিক গ্যাসকে স্টিম রিফর্মিং করে পেয়েছিলাম। তারপরের কাহিনী তো আপনাদের জানাই আছে। বাতাস থেকে N2 কে পাকড়াও করুন। N2 আর H2 মিলে আমোনিয়া বানান। আমোনিয়া আর CO2 কে চা-চু খাইয়ে বানিয়ে ফেলুন ইউরিয়া।
এভাবেই আমরা পারি আমাদের কৃষি ও শিল্পকে সমন্বিত করতে। ধান উৎপাদনের জন্য যে ইউরিয়া সার লাগবে সেটা উৎপাদিত হবে ধানের তুষ আর খড় থেকেই। কৃষকের লাভ এখানে দুই দিক থেকেই। একেতো তাকে প্রাকৃতিকগ্যাসভিত্তিক সার কিনতে হচ্ছে না, দ্বিতীয়ত চাল ছাড়াও ধানের তুষ ও খড়কে সে কাঁচামাল হিসেবে বিক্রি করতে পারছে। আর সামগ্রিকভাবে দেশের কথাও চিন্তা করুন। প্রাকৃতিক গ্যাসের মত সোনালি সম্পদের ব্যবহার না করেই যদি আমরা সার তৈরি করতে পারি, তাহলে সেই গ্যাসকে অন্য কাজে লাগানো যাবে। দূষণ কমে যাবে। কাঁচামালের খরচও অনেক কম পড়বে। তাই সারের উৎপাদন খরচ আর দামও কমবে। আর বায়োমাসের একটা অংশ পুড়িয়ে যেহেতু কারখানার প্রয়োজনীয় বিদ্যুৎ উৎপাদন করা সম্ভব, তাই আলাদা করে গ্যাসগ্রীড ও বিদ্যুৎগ্রীড কোনোটার উপরই আলাদা কোনো চাপ পড়বে না। আরো মজার ব্যাপার হচ্ছে, কেবল কৃষিজাত উচ্ছিষ্টই না, ঢাকা শহরের এতো যে গৃহস্থালি বর্জ্য, উচ্ছিষ্ট আর আবর্জনা, যাকে বলে মিউনিসিপ্যাল সলিড অয়েস্ট (Municipal Solid Waste), সেগুলোও কিন্তু বায়োমাসের অন্যতম উৎস হতে পারে। এই MSW ব্যবহার করতে পারলে তো লাভই-লাভ।
এত ভালো দিকের একটা মন্দ দিক হচ্ছে বায়োমাস ব্যবহারের প্রযুক্তি এখনো ততটা পরিপক্ক হয়ে উঠতে পারে নি। কিন্তু তাই বলে গবেষণা কিন্তু থেমে নেই। আমার নিজের সহকর্মীরাই কাজ করে যাচ্ছেন কয়লা আর প্রাকৃতিক গ্যাসের সাথে বায়োমাস মিলিয়ে কীভাবে সমগ্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের যে পরিবহন জ্বালানি (পেট্রোল, ডিজেল আর কেরোসিন) তাকে ক্রুডঅয়েলের নির্ভরতার হাত থেকে বাঁচানো যায় সেটি নিয়ে। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে বায়োমাসের এরকম ব্যবহার হতে পারে সার উৎপাদনে। আসলে, এখনই সময় বায়োমাস খাতে সময় এবং জনবল কাজে লাগাবার, আমাদের বিজ্ঞানী, প্রকৌশলী আর প্রযুক্তিবিদদের এখনই কাজে লেগে পড়া প্রয়োজন যদি আমরা কৃষিজাত কাঁচামাল ব্যবহার করে আমাদের শিল্পকে এগিয়ে নিয়ে যেতে চাই। ইতিমধ্যেই বায়োমাস থেকে সার বানানোর প্রযুক্তির পেটেন্ট নিয়ে কামড়াকামড়ি শুরু হয়ে গেছে। নিচের ভিডিওটি দেখতে পারেন - ভিডিওটি বায়োমাস থেকে ইউরিয়া উৎপাদনের কয়েকটি পেটেন্টধারী এক নব্য কোম্পানির। তারা যদি পারে, আমরা কেন পারব না?
মন্তব্য
ভালো বিশ্লেষন।
কস্ট এফিসিয়েন্সিটা সম্ভবত বড় ব্যাপার। তাই প্রশ্ন হচ্ছে গ্যাস থেকে যে খরচে পার ইউনিট C পাওয়া যাচ্ছে, বায়োমাস থেকে সমান বা কাছাকাছি খরচে সেটা পাওয়া যাবে কি-না।
সার কারখানায় গ্যাস অনেক সস্তায় দেয়া হয়। গ্যাসের অপরচুনিটি কস্ট যোগ করে হিসাব করতে হবে সেক্ষেত্রে।
গ্যাসের অপুরচুনিটি কস্ট আসলেই গুরুত্বপূর্ণ। যদি গ্যাসের সাথে বায়োমাস কম্পেটেটিভ নাও হয়, কিন্তু সার আমদানি করতে যে খরচ তার সাথে বায়োমাস-ভিত্তিক সারের উৎপাদন খরচ যদি কম্পেটেটিভ হয়, তাহলেও কিন্তু হয়।
গ্যাসের তুলনায় কম্পেটিটিভ না হলেও এটা যদি সিডিএম প্রজেক্ট হিসেবে কোয়ালিফাই করে তাহলে কিয়োটো'র আওতায় বাইরের ইনভেস্টমেন্ট খোঁজা যেতে পারে।
বায়োমাসের চ্যালেঞ্জগুলি নিয়ে আরেকটা পর্ব লিখবো ভাবছি।
আমাদের দেশে গ্যাসগ্রিড যমুনা-মেঘনার পূর্বদিকে বেশি কনসেনট্রেটেড, আর যমুনা-মেঘনার পশ্চিমদিকে কৃষিকাজ বেশি ইনটেনসিভ। বায়োম্যাস থেকে ইউরিয়া তৈরি করা গেলে গ্যাসগ্রিড থেকে দূরে এবং কৃষিক্ষেত্রের কাছাকাছি (অর্থাৎ বায়োম্যাসের উৎসের কাছাকাছি) ডিসেন্ট্রালাইজড ছোটো ছোটো সার কারখানা গড়ে উঠতে পারে। এতে করে বিতরণব্যয় অনেক কমে আসতে পারে। বায়োম্যাস সারের কাঁচামাল হলে কৃষক তার কৃষি কার্যক্রমের বাইপ্রোডাক্টেও মূল্য সংযোজন করতে পারবেন।
কেবল গ্যাসগ্রীডই নয়, বিদ্যুতগ্রীড থেকে দূরেও বায়োমাসভিত্তিক সার কারখানা তৈরি সম্ভব। বায়োমাসের একটা অংশ ব্যয় করে নিজস্ব বিদ্যুৎ উৎপাদন করলে তাহলে আর জাতীয় গ্রীডের উপর কোনো চাপ না ফেলেই নতুন সার কারখানা বানিয়ে ফেলা যাবে।
ভালো লাগলো। পরের লেখার অপেক্ষায় থাকলাম।
-রু
আমাদের গ্যাস না থাকা সত্তেও আমরা গ্যাসনির্ভর হয়েছি দূরদর্শিতার অভাবে। এখন যখন আমাদের ইরি ধানগাছের নিজস্ব নাইট্রোজেন শোষন ক্ষমতা অনেক বেশী হয়েছে, দানাদার ইউরিয়ার বদলে দ্রবীভূত ইউরিয়া ব্যাবহারে যেখানে আমাদের এক দশমাংশ বা তার চেয়েও কম ইউরিয়া প্রয়োগের সুযোগ তৈরী হচ্ছে, তখন ইউরিয়ার পেছনে শক্তি খরচের কোন কারন দেখিনা।
কৃষিজ/শহুরে জীবাশ্ম থেকে ইউরিয়াই কেন বানাতে হবে? আমরা তো বায়োগ্যাস জ্বালানি হিসাবে ব্যাবহার করতে পারি ও তারপরে যে কম্পোস্ট রয়ে যাবে সেটাতে ক্ষুদ্র-পুষ্টিদ্রব্য মিশিয়ে সেটাকেও সার হিসাবে ব্যাবহার করতে পারি।
***
কৃষিজাত/শহুরে জীবস্ম (বায়োমাস?) থেকে গ্যাস উতপাদনের পরে তাকে স্টীম রিফরমারে দিতে বলছেন। রিফর্মের স্টীম উচু চাপের হতে হবে, যার ক্যালরিক মানের পুরোটা সম্ভবত এই বায়োগ্যাস থেকে যোগানো সম্ভব হবেনা, সুতরাং কিছু গতানুগতিক জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যাবহার তো হয়েই যাবে। তখন হাত ঘুরিয়ে নাক ধরার মত ব্যাপার হতে পারে। নাকি আপনার তাপ-ভর ভারসাম্য গণনা অন্য কথা বলে?
***
শহুরে হোক আর গ্রামীন, আমাদের জীবাস্মের দুটি বড় সমস্যা হল এর আর্দ্রতা (সম্ভত >৫০%), এবং তৃণমূলে এর উতপাদন বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই নগন্য আকারে। এই জিনিসের একটন এসপারওসপার করা মানে আধ টন পানি খামাখা বয়ে বেড়ানো, যার কোন ক্যালরিক উপকার নেই। যেহেতু আমাদের কৃষি এখনো ক্ষুদ্র আকারে ঘটে, সেখানেও সংগ্রহ ও প্রাক-প্রক্রিয়াজাতকরনের কাজটা গ্যাস-ইউরিয়া উদ্যোক্তার গাইটে পয়সাই শুধু নয়, অনেকটা সময় ও জনবল খেয়ে নেবে। এই বিষয়গুলো পাইপ-লাইন ও চলমানপ্রক্রিয়ার ভারী সারশিল্পের সাথে টেক্কা দেবার রাস্তাটা পিচ্ছিল করে ফেলে।
***
"আমার নিজের সহকর্মীরাই কাজ করে যাচ্ছেন কয়লা আর প্রাকৃতিক গ্যাসের সাথে বায়োমাস মিলিয়ে কীভাবে সমগ্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের যে পরিবহন জ্বালানি (পেট্রোল, ডিজেল আর কেরোসিন) তাকে ক্রুডঅয়েলের নির্ভরতার হাত থেকে বাঁচানো যায় সেটি নিয়ে।"
এটা সম্ভত আমেরিকার শেল-গ্যাস (কোম্পানি শেল নয়) শিল্পের উদ্ভবের আগের ঘটনা।
বাংলাদেশে ইউরিয়ার চাহিদা কম হলে গাঁটের টাকা খরচ করে ইউরিয়া আমদানি করা হচ্ছে কেন? শুধু গত বছর ইউরিয়া আমদানি করতে খরচ হয়েছে ৩ হাজার ৩০০ কোটি টাকা। আমি বলছি না যে শুধু বায়োমাস থেকেই ইউরিয়া বানাতে হবে, কিংবা আমাদের শুধু ইউরিয়াই লাগবে। জমিতে আপনি ইউরিয়া ব্যবহার করবেন নাকি গোবর ব্যবহার করবেন সেটা আলাদা প্রসঙ্গ। আমার পারস্পেক্টিভ হচ্ছে ইউরিয়ার চাহিদা, যেটা একটা বাস্তব সত্য।
আমরা গ্যাসনির্ভর হয়েছি আমাদের দূরদর্শিতার অভাবে - ভালো কথা, কিন্তু প্রাকৃতিক গ্যাস ছাড়া আর কি দিয়ে আমরা ইউরিয়া তৈরি করতে পারতাম? আমাদের হাতে আর কি অপশন ছিলো?
আমার হাতে বায়োগ্যাস ও কম্পোস্ট সারের কোনো ডাটা নেই, তাই বলতে পারছি না যে পুরো বোরো মৌসুম চালিয়ে নেবার জন্য আমাদের যথেষ্ট কম্পোস্ট সার আছে কি না, কিংবা সেটার সরবরাহই কোত্থেকে হবে। যদি কম্পোস্ট সারের পর্যাপ্ত সরবরাহ থাকে তাহলে আমি আর বায়োমাস কেন প্রাকৃতিকগ্যাস থেকেও ইউরিয়া তৈরির কোনো যুক্তি দেখি না। অথচ, প্রতিবছর দেখা যায় ইউরিয়ার জন্য কৃষক হন্যে হয়ে ঘুরছে। কম্পোস্ট ব্যবহার করছে না কেন?
বায়োমাস ব্যবহার করে সিনগ্যাস তৈরিতে স্টিম রিফর্মার লাগবে না, লাগবে গ্যাসিফায়ার। পার্থক্যটা এখানেই। তবে গ্যাসিফায়ারের সমস্যাও আছে। প্রথমত, কমার্শিয়াল স্কেলে এখনো বায়োমাস গ্যাসিফায়ারের পারফর্মেন্স ততটা নিশ্চিত না, যেহেতু এটি এখনো গবেষণা-পাইলট স্কেলেই সীমাবদ্ধ আছে। তাছাড়া, গ্যাসিফায়ারেরও তাপমাত্রা বেশি (ক্যাটালিস্ট ব্যবহারের পরও) এবং এরও স্টীম কঞ্জাম্পশন আছে।
আর্দ্রতার ব্যাপারে আপনার আশংকা সঠিক। বায়োমাসের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জগুলির এটি একটি। বাংলাদেশে যত ধরণের বায়োমাস আছে তাদের কম্পোজিশনের উপর নির্ভর করবে সেই আর্দ্রতা দূর করতে কাঁচামাল বায়োমাসের কত অংশ খরচ হয়ে যাবে। সেটি ৫০%ও হতে পারে।
***
"আমার নিজের সহকর্মীরাই কাজ করে যাচ্ছেন কয়লা আর প্রাকৃতিক গ্যাসের সাথে বায়োমাস মিলিয়ে কীভাবে সমগ্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের যে পরিবহন জ্বালানি (পেট্রোল, ডিজেল আর কেরোসিন) তাকে ক্রুডঅয়েলের নির্ভরতার হাত থেকে বাঁচানো যায় সেটি নিয়ে।" - এটা বর্তমানে চলমান কাজের কথাই বলছি। বিস্তারিত জানতে চাইলে দেখতে পারেন এখানে, এখানে, এখানে, এখানে।
ইউরিয়া নির্ভর কৃষি মানেই গ্য়াস নির্ভরতা।
আমাদের ইউরিয়া উতপাদন ক্ষমতা ৩.৫ মিলিয়্ন টন, জাতীয় চাহিদা ২.৫ মিলিয়্ন টন, তারপরেও আমরা প্রতিবছর ১.৭ মিলিয়ন টন ইউরিয়া আমদানি করি। দেশিয় চাহিদা মেটাতে আমাদের বছরে ২.৫-৩ মিলিয়্ন এমএমসিএফ গ্য়াসের দরকার, যার যোগান দেয়া কষ্ট্সাধ্য় - কিন্তু অসম্ভব নয়। এটা করা হয়না কারন এটা করলে ঢাকা ও চট্তগ্রামের এম্পি সাহেবদের রান্নাঘরের চুলায় ও তাদের গারমেন্ট্স ফ্য়াক্টরির বয়লারে গ্য়াসের চাপ কমে যাবে।
***
জীবাশ্ম গ্য়াসিফাইয়ের আইডিয়া মন্দ না। কিন্তু প্রযুক্তি-ফাঁক এখনো বেশ চওড়া। আমার নিজসৃ মতামত হল নবা্যনযোগ্য় জৃালানি-কেমিকেল শিল্পের নতুন প্রযুক্তি অনুসন্ধান এখনো অনেকটাই যন্ত্রকুশলী ও কেমিকুশলীদের আধিপত্য় - এখানে মাইক্রোবায়োলজি ও এনজাইম বিশেষগ্গদের দেবার অনেককিছু আছে, যেখানে দরকারি বিনীয়োগ হচ্ছেনা।
বিজ্ঞান পড়ি নাই। কাজেই আপনার ইউরিয়া সার উৎপাদন প্রক্রিয়া নিয়ে মন্তব্য করা ধৃষ্টতা হবে। তবে অফ টপিকে একটা প্রশ্ন রাখার লোভ সামলাতে পারছিনা। (নিতান্তই কৌতূহল থেকে জানতে চাইছি)
ইউরিয়া সার উৎপাদন ও আমদানীতে সরকারকে প্রতি বছর প্রচুর ভর্তুকি দিতে হয়। দেশে কৃষকের ইউরিয়া নির্ভরতা খুব বেশি। বেশি বেশি ইউরিয়া ব্যবহারের ফলে মাটির জৈব অনুপাত কেমন বদলে যাচ্ছে, সে বিষয়ে ভালো গবেষণা হওয়া দরকার। এইভাবে ইউরিয়া নির্ভর ফসল কি আমাদের মাটিতে খুব বেশিদিন ফলানো যাবে?
ফসল ফলানোর জন্য একসময় জৈব সার ব্যবহার নিয়ে কিছু কথা শোনা যেত। ইউরিয়ার বিকল্প হিসেবে কেউ কেউ জীবাণু সার ব্যবহারের জন্যও পরীক্ষা চালাচ্ছেন। ইউরিয়া উৎপাদনের দিকে না গিয়ে বরং বায়োম্যাস থেকে সরাসরি কম্পোস্ট বা এধরনের সার তৈরি করে ব্যবহারযোগ্য করতে পারলে কেমন ফল হতে পারে, সে বিষয়ে কিছু জানেন কি?
আপনি বায়ম্যাস হিসেবে যে ছবিগুলো দিয়েছেন এর ভেতর বেশ কিছু কাঠ সদৃশ বস্তু আছে। এক খুলনা পেপার মিল চালানোর নামে সুন্দরবনের লক্ষ লক্ষ গাছ নিধন করে বাইরে পাচার করা হয়েছে। গাছ থেকে পাওয়া উড পার্টিকেল ব্যবহারযোগ্য প্রযুক্তি এদেশে ব্যবহার করতে গেলে- আমি ভয় পাচ্ছি যে- সব গাছ ঐ চুল্লির ভেতর না ঢুকে যায়!
ভাল আইডিয়া!!
যদি আমার ভুল না হয়ে থাকে তাহলে মনে হয় কিছু একটা পড়েছিলাম এরকম যে সমুদ্রের পানিতে কিছু ব্যাকটেরিয়া থাকে যারা কিনা ইউরিয়া তৈরী করতে পারে। ব্যাকটেরিয়া থেকে যদি আসলেই ইউরিয়া তৈরী করা যায় তাহলে কেল্লা ফতে!!
আমার তো ধারণা ছিল অনেক ধরনের বায়োমাস সরাসরি সার হিসাবে ব্যবহার করা যায় । ইউরিয়ার ওপর কতদিন আরো আমরা নির্ভর করব জানি না, তবে যথেচ্ছ ইউরিয়া ব্যবহার করার সমস্যাও আছে।
পথের দেবতা প্রসন্ন হাসিয়া বলেন, মূর্খ বালক, পথ তো আমার শেষ হয়নি তোমাদের গ্রামের বাঁশের বনে । পথ আমার চলে গেছে সামনে, সামনে, শুধুই সামনে...।
খুব তথ্য বহুল একটি পোস্ট।
tomalforex
নতুন মন্তব্য করুন