বড় মানুষ, ছোট মানুষ

ফাহিম এর ছবি
লিখেছেন ফাহিম [অতিথি] (তারিখ: বুধ, ০৩/০৩/২০১০ - ১১:১৪অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

পার্কের পাশে বড় রাস্তার ধারে কালামের চায়ের দোকানে বড় বড় দুই কেটলী পানি ফুটছে। সকালের আলো ঠিকমতো ফোটার আগেই কালামের রুটিন এই দিয়ে শুরু, প্রথমেই দুই কেটলীতে পানি চাপিয়ে দেয়া। তার পর টুকটাক ঝাঁড়-পোছ করে, রুটি-কলাগুলো ঝুলিয়ে দিয়ে বিস্কুটের কৌটাগুলো দেখে নেয় সে। খালি হয়ে যাওয়া টোস্ট-বিস্কিটের কৌটা পরিস্কার করে ওখানে প্যাকেট থেকে খুলে টোস্ট-বিস্কিট ভরে নেয়। ততক্ষণে পানি ফুটে যায়, কালাম তাতে চা-পাতা ছেড়ে দেয়। সস্তা পাতার কষা, তিতকুটে, কিন্তু স্নায়ূ-সতেজী গন্ধ ছড়িয়ে পড়ে।

প্রতিদিন এইভাবে একলা একলাই সে সকালটা শুরু করে, তার ছোট্ট টংয়ের দোকানে। সকালের দিকে তার হাতে বাধা কিছু খদ্দের আছে, বেশিরভাগই সকালে হাঁটতে আসা লোকজন। অবশ্য যেই শ্রেণীর লোকের পার্কে হাঁটাহাঁটি বা দৌড়াদৌড়ি করতে আসে, তাদের বেশিরভাগেরই টংয়ের দোকানে বসে চা খাবার রূচি হবার কথা না। তবে কালামের চা ভালো হয়, আর দোকানটাও বেশ পরিস্কার করে রাখে সে। তাই কিছু নিয়মিত খদ্দের তার জুটে গেছে। আলমগীর সাহেব তাদের একজন।

আজকে অবশ্য আলমগীর সাহেব একটু আগেই এসে গেছেন। লোকজন আসি আসি করছে, কী করেনি। চারদিক এখনো ঠিকমতো পরিস্কার হয়নি, এতো ভোরে আলমগীর সাহেব চলে এসেছেন? আর এসেই বা হাটাহাটি না করে এখানে কেন? কালাম ভাবলো।

“সালামালাইকুম স্যার, বহেন বহেন... চা হইয়া যাইব অক্ষনি”
“তাড়াহুড়ার কিছু নাই, আস্তে আস্তে হলেই হয়” আলমগীর সাহেব টুলের উপরে বসতে বসতে বললেন। আজকে মাফলার টাফলার লাগিয়ে একেবারে জুবুথুবু হয়ে এসেছেন তিনি। খুক খুক করে দু’ একবার কাশলেনও।
“স্যারের কী শরীরটা বালা নাই?”
“নাহ, শরীর ভালোই আছে।”
“তাইলে যে না হাইট্টাই চা খাইতে চইলা আইলেন”
“আর হাটাহাটি করে কী হবে? দুই দিনের দুনিয়া...” বলে আলমগীর সাহেব একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন। চুপচাপ জড়োসড়ো হয়ে বসে রইলেন টুলের উপরে। কেন যেন তাকে খুব বিমর্ষ লাগছে। হলোটা কী ভদ্রলোকের?

কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থাকলেন তিনি, তারপর একটু কেশে নিয়ে বললেন, “কালকের ঘটনায় তুই মন খারাপ করিস নারে কালাম”।

না, মন খারাপ করেনি কালাম। ছোটলোকের ঘরে জন্মেছে, এরকম দু’একটা চড়-থাপ্পড়ে তার কিছু আসে যায় না। তবে গালের চড়ের দাগ মিলিয়ে গেলেও মনের থেকে একেবারে মিলিয়ে যায় না। ছোটবেলা থেকে এই পর্যন্ত সব গালি-গালাজ, মার-ধোর – সব তার মনে আছে।

কাল খুব ছোট ঘটনা দিয়ে শুরু, যথারীতি হাঁটা শেষে আলমগীর সাহেবসহ কয়েকজন বসে চা খাচ্ছিলেন। এর মধ্যে শহীদ সাহেবও ছিলেন। সবাই বসে রাজনীতি নিয়ে আলাপ করছিলেন। নানান ধরণের কথা হচ্ছিল, বাঙ্গালীদের আড্ডায় যেমনটা হয় আর কি। কালামের এইসব আলাপ শুনতে খারাপ লাগেনা, লেখাপড়া করতে পারেনি, তবু উৎসুক মনটা নানান বিষয়ে জানতে চায়। এইসব জ্ঞানীগুণী লোকের কথা থেকেও অনেক শেখার আছে। এদের মধ্যে শহীদ সাহেব একটু কেউকেটা গোছের, অনেক পড়ালেখাজানা শিক্ষিত লোক, অনেক উচু চাকরী করেছেন, রাজনীতি নিয়েও অনেক জানেন, ভাবেন। তার গলাটা বরাবরই একটু উচু তারে বাধা থাকে। সে বেশ মনোযোগ দিয়েই কথা শুনছিলো।

আলোচনার এক পর্যায়ে শহীদ সাহেব তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কাজ-কাম নিয়ে কথা বলা শুরু করেন। বোঝাই যাচ্ছে কোন একটা কারণে তিনি খুবই ক্ষুব্ধ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপরে। কী মনে করে কালাম স্যারদের কথার মাঝখানে বলে বসলো, “যত যাই কন স্যার, আর্মি কিন্তু ফাইন জিনিষ, যেই কয়দিন ছিলো, হেই কয়দিন মোড়ের মাস্তানগুলারে চান্দা-মান্দা দেওয়া লাগে নাই, সব যাইয়া লুকাইসিলো গত্তের মইধ্যে”।

শিক্ষিত লোকজনের আলাপে চা-ওয়ালার এই অনুপ্রবেশ অনেকেরই ভালো লাগেনি। কয়েকজনের ভ্রূ একটু কুচকে গেল। শহীদ সাহেব বললেন, “যেটা বোঝ না, সেটা নিয়ে কথা বলো না, তুমি জান আর্মি কী করেছে?...” এই বলে তিনি লম্বা ফিরিস্তি শুরু করলেন।

কালাম সামান্য টংয়ের দোকানদার, সে এতো জটিল করে ভাবতে পারে না। কিছুক্ষন শহীদ সাহেবের বক্তৃতা শুনেটুনে আবার বললো, “যাই কন স্যার, আ’মি লীগ আর বিম্পির সময় আমাগোর বহুত লোকসান হয়, আর্মি আইলে একটু শান্তিতে থাকবার পারি”

এবার শহীদ সাহেব রেগে গেলেন। “এই সাধারণ পাবলিককে নিয়ে এক সমস্যা, লেখাপড়া জানে না, কালচার নাই, শুধু নিজেদের লাভ-ক্ষতি নিয়েই আছে...”। বেশ এক তরফা বকে গেলেন কিছুক্ষণ। কালাম তারপর বলে বসলো, “লেহাপড়া জানি না, তো কী হইসে, ভোট আপনেরও একটা, আমারও একটা”।

শহীদ সাহেব এবার রাগে বিস্ফোরিত হয়ে গেলেন, “এতো বড় কথা, ছোটলোকের বাচ্চা, ভোট একটা বলে তুই আর আমি সমান?” বলে সজোরে এক চড় বসিয়ে দিলেন কালামের গালে। আশেপাশের অন্যান্য স্যারেরাও বেশ কষে কালামকে বকে গেলেন, ছোটলোক হয়ে কথা বলতে আসার জন্য। সে তো পড়ালেখা করেনি, সে তো বস্তিতে জন্মেছে, তার বাপ রিকশা চালিয়েছে, মা ঝিঁ-গিরি করেছে, তার কালচার নেই। তার এতো বড় সাহস কেন হবে? কেন সে শিক্ষিত লোকেদের মাঝে কথা বলতে গেছে? কেন সে তার মত প্রকাশ করতে গেছে? সে তো মানুষ নয়, শিক্ষিত মানুষদের কাছে সে একজন ঊন-মানুষ।

আলমগীর সাহেবও ছিলেন সেই জটলায়, তবে তিনি কোন কথা বলেননি। সামাজিকতার দায়ে, লোকলজ্জার ভয়ে হয়তোবা। তবে ঘটনাটা তিনি মেনে নিতে পারেননি। তাই সকাল না হতেই চলে এসেছেন কালামের দোকানে, তার সাথে কথা বার্তা বলে একটু স্বান্তনা দেওয়ার জন্য। হাজার হোক, প্রতিদিন সকালে যেই ছেলেটার হাতের চা খেয়ে দিন শুরু হয়, তাকে এই রকম না-হক মারপিট করাটা তিনি হজম করতে পারছিলেন না। কিন্তু সবার সামনে কিছু বলতেও তো পারেন নি, অন্যেরা কী ভাববে?

“নেন স্যার, চা নেন” কালাম চায়ের কাপ এগিয়ে দেয় আলমগীর স্যারের দিকে। আলমগীর সাহেব আরেকটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ডান হাত বাড়িয়ে চা’টা নিলেন।

কালাম বোঝে, সে জানে আলমগীর সাহেবের এই সহমর্মীতা আন্তরিক। বজলুর গ্যারেজে কাজ করতো সে একসময়, বজলু কারিগর ছিলো তার ওস্তাদ। হুজুর টাইপের সেই মেকানিক তাকে গাড়ি সারাইয়ের সাথে সাথে জীবনের অনেক বিষয়ে তত্ত্বকথা শোনাতো, তার সব মনে আছে। একদিন দাড়িতে হাত বুলাতে বুলাতে বজলু কারিগর বলেছিলো, “বুচ্ছোস কালাইম্মা, মানুষ চিনার ওউগগা সহজ রাস্তা আসে। খিয়াল কইরা দেখবি মানুষ হ্যার চাইয়া ছুড মানুষের লগে কেমনে কথা কয়, ব্যাভার করে। যেই মানুষডা হ্যার চাইয়া ছুড মানুষের লগে বালা ব্যাভার করে, হ্যাই আসলে খাডি মানুষ, বাকি হগগলে নামেই মানুষ, কামে না”। কালামের সব মনে আছে।

সে কারণেই, তার সামনে টুলের উপরে জুবুথুবু হয়ে বসে থাকা আলমগীর স্যারকে তার বড় মানুষ মানুষ মনে হতে থাকে।


মন্তব্য

মামদো ভূত এর ছবি

খুব ভালো লাগল।খুবই।

ফাহিম এর ছবি

ধন্যবাদ!

=======================
কোথাও হরিণ আজ হতেছে শিকার;

=======================
কোথাও হরিণ আজ হতেছে শিকার;

বাউলিয়ানা এর ছবি

চমতকার লাগল। গল্পের জন্যও দারুন প্লট।

আরও চাই।

ফাহিম এর ছবি

ধন্যবাদ!

=======================
যদি আমি চলে যাই নক্ষত্রের পারে —
জানি আমি, তুমি আর আসিবে না খুঁজিতে আমারে!

=======================
কোথাও হরিণ আজ হতেছে শিকার;

সুহান রিজওয়ান এর ছবি

"লাগে রাহো মুন্না ভাই" দেখেছেন নাকি ?? ওটার একটা দৃশ্যের কথা মনে পড়ে গেলো...

_________________________________________

সেরিওজা

ফাহিম এর ছবি

একেবারে বুলস আই! তবে এই কথাটা মুরুব্বীদের মুখেও অনেক শুনেছি। ধন্যবাদ!

=======================
কোথাও হরিণ আজ হতেছে শিকার;

=======================
কোথাও হরিণ আজ হতেছে শিকার;

নাশতারান এর ছবি


লেখা্ ভালো লেগেছে।


প্রতিদিন সকালে যেই ছেলেটার হাতের চা খেয়ে দিন শুরু হয়, তাকে এই রকম না-হক মারপিট করাটা তিনি হজম করতে পারছিলেন না।

প্রতিদিন সকালে কালামের চা না খেলে কি আলমগীর সাহেব ক্ষমাপ্রার্থনা করতেন না?
আমার ধারণা, করতেন। না করলে আমি তাঁকে বড় মানুষ বলতে নারাজ।


চন্দ্রবিন্দু ব্যবহার করুন।

_____________________

আমরা মানুষ, তোমরা মানুষ
তফাত শুধু শিরদাঁড়ায়।

ধুসর গোধূলি এর ছবি

চন্দ্রবিন্দু ব্যবহার করুন।
আপনার কথা রাখতে গিয়েই বোধ করি লেখক এক জায়গায় অতিরিক্ত "চন্দ্রবিন্দু" ব্যবহার করে ফেলেছেন! এই দায়ভার কে নিবে এখন? সরকারী দল নাকি বিরোধী দল? চিন্তিত
___________
চাপা মারা চলিবে
কিন্তু চাপায় মারা বিপজ্জনক

ফাহিম এর ছবি

স্পিকারের দোষ সব! চলেন দৌড়ানি দেই একটা...

=======================
যদি আমি চলে যাই নক্ষত্রের পারে —
জানি আমি, তুমি আর আসিবে না খুঁজিতে আমারে!

=======================
কোথাও হরিণ আজ হতেছে শিকার;

ফাহিম এর ছবি

# ধন্যবাদ!

#

না করলে আমি তাঁকে বড় মানুষ বলতে নারাজ।

আমারও সেই মত।

# বানান ভূলই মেরে দিচ্ছে লেখাগুলো মন খারাপ

=======================
যদি আমি চলে যাই নক্ষত্রের পারে —
জানি আমি, তুমি আর আসিবে না খুঁজিতে আমারে!

=======================
কোথাও হরিণ আজ হতেছে শিকার;

বোহেমিয়ান এর ছবি

চমৎকার লাগল ।
বজলু কারিগরের কথাটা আমিও শুনেছি অনেকবার ই ।
কিন্তু প্রয়োগ কি করেছি?!

__________________________
হৃদয় আমার সুকান্তময়
আচরণে নাজরুলিক !
নাম বলি বোহেমিয়ান
অদ্ভুতুড়ে ভাবগতিক !

_________________________________________
ওরে! কত কথা বলে রে!

ফাহিম এর ছবি

ধন্যবাদ!

প্রয়োগ খুব কম মানুষই করে, এটাই বাস্তবতা।

=======================
যদি আমি চলে যাই নক্ষত্রের পারে —
জানি আমি, তুমি আর আসিবে না খুঁজিতে আমারে!

=======================
কোথাও হরিণ আজ হতেছে শিকার;

ধুসর গোধূলি এর ছবি

- আলমগীর সাহেবের সাথে বাকীদের সম্পর্ক কীরূপ, সেটা বলা যাচ্ছে না। যদি বন্ধুসুলভ হয় তাহলে বন্ধুর অন্যায়ের তাৎক্ষণিক প্রতিবাদ না করে আলমগীর সাহেব "বড় মানুষ"-এর পরিচয়টা ধরে রাখতে পারেন নি।
___________
চাপা মারা চলিবে
কিন্তু চাপায় মারা বিপজ্জনক

ফাহিম এর ছবি

পুরোপুরি একমত। এটাই বলতে চেয়েছি। লোকলজ্জার ভয়ে অনেক সময়ই অনেকে ঠিক কাজটা করেনা।

=======================
যদি আমি চলে যাই নক্ষত্রের পারে —
জানি আমি, তুমি আর আসিবে না খুঁজিতে আমারে!

=======================
কোথাও হরিণ আজ হতেছে শিকার;

অতিথি লেখক এর ছবি

সুন্দর! ভালো লাগলো

ফাহিম এর ছবি

ধন্যবাদ!

=======================
যদি আমি চলে যাই নক্ষত্রের পারে —
জানি আমি, তুমি আর আসিবে না খুঁজিতে আমারে!

=======================
কোথাও হরিণ আজ হতেছে শিকার;

রিয়াজ উদ্দীন এর ছবি

ভাল্লাগলো গল্প

ফাহিম এর ছবি

ধন্যবাদ!

=======================
যদি আমি চলে যাই নক্ষত্রের পারে —
জানি আমি, তুমি আর আসিবে না খুঁজিতে আমারে!

=======================
কোথাও হরিণ আজ হতেছে শিকার;

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।