নন রেসিডেন্ট সিনড্রোম?

ফকির লালন এর ছবি
লিখেছেন ফকির লালন (তারিখ: বিষ্যুদ, ৩০/০৪/২০০৯ - ৭:৪৩অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

আজকাল কেউ দাওয়াত দিলে যেতে চাইনা। যে সুধীসমাবেশ ঘটে সেখানে অবধারিত ভাবে দেশের কথা আলোচিত হয়, তর্ক বিতর্কের সুচনা হয়, লোভ সামলাতে না পেরে পার্টিসিপেট করি এবং পরে মন খারাপ হয়। পাছে ঝগড়াবাজ হিসেবে খ্যাতি হয় এবং হোস্টের ব্লাকলিস্টে অর্ন্তভুক্ত হই এই ভয়ে গিন্নী যাবার আগে শাসিয়ে নেয় – চুপ করে থাকবা, কোন বিপ্লবের দরকার নাই।

চুপ করেই থাকি। কেউ আমাকে দায়িত্ব দেয়নি দেশকে ডিফেন্ড করবার। জীবিকার কারনে বিদেশে থাকি, এক অর্থে শ্রমজীবি, যাবো, বিরিয়ানী রেজালা খেয়ে চলে আসবো; রথী, মহারথীদের অলস তর্কে আমার মাথা গলানোর কি কাম। ওরা মারে রাজা উজির, মারুক, আমার কি? কিন্তূ মাঝে মধ্যে সহ্য হয়না, বিশেষ করে বিদেশীদের সামনে যখন দেশের নিন্দা শুরু হয়।

আমার দেশ কোন বেহেশত না, জানি। তার উপর বিদেশে থাকলে দেশের প্রতি এটাচমেন্ট বাড়ে, মন কাঁদে, যেমন আশা ছিলো তার চেয়ে অনেক খারাপ করছে দেশ, তাই হতাশা, দুঃখ কষ্টবোধ থাকবে – এসবই স্বাভাবিক। আমারো আছে। আত্মসমালোচনা আমরা করতেই পারি। কিন্তু বিদেশীদের সামনে এগুলো বলাতে তো কোন লাভ আমি দেখিনা। তার যদি বাংলাদেশ সর্ম্পকে জানার আগ্রহ থাকে, ইন্টারনেট থেকে জেনে নিক, লুকানোর তো কোন উপায় নেই। আমি কেন আগ বাড়িয়ে নিজের দেশ সর্ম্পকে বাজে কথা বলতে যাবো?

অতটুকূ জায়গায় অতগূলো মানুষ খেয়ে পরে বেঁচে আছে তাই আমার কাছে এক আর্শীবাদ মনে হয়। ঘনবসতি বিবেচনায় নিলে আরো হানাহানি, মারামারি হবার কথা দেশে। আমরা যে নিজেদের খাবার নিজেরাই ফলাই, মোটামুটি শান্তিতে বাস করি, তাই আমার কাছে অর্জন মনে হয় - গত বিশ বছরে ধানের উতপাদন বেড়েছে প্রায় ১৫০% ভাগ, চাষাবাদের জমি বেড়েছে মাত্র ৫% ভাগ। দেশের আরো অনেক অর্জন আছে, আবার ব্যর্থতাও আছে, তা অস্বীকার করার উপায় নেই। কিন্তু প্রশ্ন হলো বিদেশীদের তা আমরা কেন স্বতোপ্রনোদিত হয়ে জানাবো? শেষপর্যন্ত দেশটাতো আমাদেরই, তাকে ছোট করে, তার মানুষকে ছোট করে আমরাতো বড় হতে পারবোনা।

তাছাড়া দেশটার দূরাবস্থার জন্য দায়ী কারা? গ্রামের কৃ্ষক, শহরের গরীব শ্রমিক তো না। দায়ী আমরাই; দেশের ৫% মাত্র, যারা শিক্ষা, সামাজিক অবস্থান, সম্পদ ও বিত্তের জোড়ে দেশের সম্পদ ও ক্ষমতায় access পাই। এটা ব্যাক্তি আমি না হতে পারি, কিন্তু আমারই বন্ধু, কাজিনই তো তা করে থাকে। এই অল্প লোকের কুকর্মের জন্য অমন সুন্দর একটা দেশ আর তার ৯৫% সহজ সরল গরীব লোককে গালি দেবো?

হ্যা, দেই গালি রাজনীতিবিদদের। কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো উচ্চশিক্ষিত এলাকায় একজন সঠিক মানুষ কি নির্বাচিত হতে পারবে, পেরেছে এ যাবত? আপনি আমিইতো ভোট দেই, নাকি?

দেশের গরীব লোকের দেয়া পয়সায় আমাদের লেখাপড়া। পাব্লিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র প্রতি মাসে সরকারী ভর্তুকী প্রায় দু হাজার টাকার উপরে। অন্যদের কথা জানিনা, আমি সে ঋন শোধ করার চেষ্টা করিনি। নানা ব্যাক্তিগত, পারিপ্বার্শিক কারনে বিদেশে নিজের ভাগ্যান্বেষনে পড়ে রয়েছি। দেশের জন্য কাজ করার দায়টা আমিতো এড়িয়ে গেছি। শুধু রেমিট্যান্স পাঠানোর জন্য কোন দেশ সাবসিডি দিয়ে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, ইকোনমিস্ট তৈরী করেনা। প্রতিকুল অবস্থাতো আমার ফেস করার কথা ছিলো, অন্যায়, দুর্নীতি প্রতিবাদ করার কথা ছিলো, না করে দেশ ছেড়েছি। আমার কি দেশের নিন্দা করা শোভা পায়?

দেশ নিয়ে দুঃখ আছে, আমাদের সবারই আছে। কিন্তু তাকে যেন বিদেশীদের কাছে ছোট না করি। তাতে দেশের মর্যাদা আরো কমে, বাড়েনা। সেই সাথে আমারো, আমাদেরো।

পুনশ্চঃ দেশের সাফল্যের কথা দয়া করে নিয়মিত এ ব্লগে লিখবেন, দুষ্টু লোকদের সাথে আমার তর্ক করতে সাহায্য হবে, অবশ্য তখনো যদি দাওয়াত পেতে থাকি।


মন্তব্য

সিরাত এর ছবি

আমি অতিথি নাইলে এই লেখা স্টারাইতাম। আমারও আপনার মতই মতামত! এটিচুড ইজ এভরিথিং। পজিটিভ এটিচুড রাখা দরকার, বিশেষত দেশ নিয়ে। ঘ্যানঘ্যানানি আর কত?

তয় ভাই ডুইবা গেলে কিন্তু খেলুম না কইলাম!

মূলত পাঠক এর ছবি

আপনি আমার মনের কথাটা বললেন, ফকির লালন। আমার ক্লাসেও দু-একটি স্যাম্পেল আছে এই জাতীয়। দুর্নীতি নিয়ে কথা উঠলেই এরা দেশের কথা টেনে আনবে ক্লাসের আলোচনায়। জানতে ইচ্ছে হয় এরা কি ভালো কিছুই দেখতে পায় না? হায় আমাদের হতভাগ্য দেশ, এমন সন্তান পয়দা করেছে যারা বাপমায়ের মধ্যে কোনো গুণ দেখতে পায় না। আসল কথাটা কী জানেন, এই জন্তুগুলি আসলে সুখের কবুতর। আলোচনায় যা বললে সুবিধা হয় সেটাই বলবে। এই যে আজকাল স্লামডগ নিয়ে বিতর্ক, তাতে এরাও খাপ্পা এবং এখন এরা বলছে দেশের দারিদ্রকে বিশ্বকে দেখানো হবে কেন! যেহেতু এখন ওটা পাবলিক খাচ্ছে অতএব এরাও এখন পরম দেশভক্ত হয়ে উঠেছে। দেশের সব কিছুই এদের জন্য কনভারসেশন টপিক, তার বেশি কিছু নয়।

ফকির লালন এর ছবি

কেন আমরা এমন করি - এ নিয়ে ভাবা যেতে পারে। এর সাইকোলজি টা আসলে কি?
যে দেশে আমার ভাই বোন, বাবা মা, বন্ধু বান্ধব আছে; আমি নিজে অন্তত জীবনের তিনের এক ভাগ কাটিয়েছি, সে দেশ নিয়ে নিজেদের অসুন্দর মন্তব্য কি শুধুই হতাশাজাত?

এই প্রবাসেও যে দেশের মাছটা , সব্জীটা না খেলে আমাদের মন ভরেনা; ইলিশ মাছ পাওয়া যাচ্ছে শুনলে মাইল ত্রিশেক ড্রাইভ করতে রাজী, তিন-পাঁচজন একসাথে হলেই সে দেশ সর্ম্পকে কেন আমরা শুধু খারাপ কথাই বলি, ভাবি? এই অদ্ভুত বৈপরীত্যের কারনটা কি?

সাধু এর ছবি

ভাই ফকির লালন, আপনার লেখাটা অন্তর ছু্য়ে যায় । আপনার লেখায় প্রচুর যুক্তি এবং মানবিক উপাদান রয়েছে । অপ্রয়জনে স্বদেশকে খিস্তি খেউড় করা এক ধরনের মনস্তাত্তিক অধপতন । ধন্যবাদ ।

ধুসর গোধূলি এর ছবি

- আমার দেশের সবচাইতে বড় সাফল্য হলো আমার মতো একটা অপদার্থ জন্ম দিতে পেরেছে সাফল্যের সাথে। আত্মসমালোচনা আমিও করি, করবোও, কিন্তু কথা হলো দিনের শেষে কি আমি দেশে ফিরে যাবো বা যাবার চিন্তা করবো? করবো না! তাহলে আমি যে দেশকে নিয়ে গর্ব করবো সেই অধিকারটাই বা আমার কোথায়! আমার অবস্থাতো তাদের চাইতেও বরং খারাপ যারা জনসন্মুখে দেশকে বিদেশীদের কাছে গালি দিতে স্বচ্ছন্দবোধ করে। তাদেরতো তাও একটা অবস্থান আছে, আমার অবস্থানটা তাহলে কী? কেবল দেশকে ভালোবাসি, এইটা মুখে মুখে বলা?
___________
চাপা মারা চলিবে
কিন্তু চাপায় মারা বিপজ্জনক

ফকির লালন এর ছবি

ভাই গোধুলী,

আপনার মন্তব্য নিয়ে ভাবলাম। খুব যে সদুত্তর দিতে পারবো এমন সবজান্তা নই। যা করার কথা ছিলো, করিনি, পালিয়েছি - দায়িত্ব এড়িয়েছি, সবই ঠিক আছে। তাই, গর্ব না করতে পারি, নিন্দাও না হয় না করি। তাতেতো অসুবিধে নেই, আমার আপত্তি আগ বাড়িয়ে অন্য দেশের নাগরিকের সামনে নিন্দাতেই। নিজের দেশের লোক প্রশাংসা করলে লোকে ভাবে তা বোধ হয় মিথ্যা, নিজের দেশ - ভালো কথাতো বলবেই। কিন্তু নিন্দা করলে ভাবে, সবি সঠিক, নতুবা খামোখা নিজেদের বদনাম করবে কেন?

ডায়াসপোরা, আমরাই প্রথম না, আরো অনেক আছে, অন্যান্য দেশের্‌, অনেক দিন ধরেই। লেবাননেতো শুনেছি দেশের ভেতরের চাইতে বাইরেই লোক বেশী। এমন সব ক্ষেত্রে অন্যান্য দেশের ডায়াসপোরা কি করে সেটা দেখা যেতে পারে।

তানবীরা এর ছবি

ফকির লালন ভাইয়ের অনুভূতি আমার অনুভূতি এক। দেশকে ছোটকরা মানে নিজেকে ছোটকরা, আত্মসম্মানহীন লোকেরাই এই সব করতে পারে।

তানবীরা
---------------------------------------------------------
চাই না কিছুই কিন্তু পেলে ভালো লাগে

*******************************************
পদে পদে ভুলভ্রান্তি অথচ জীবন তারচেয়ে বড় ঢের ঢের বড়

বাবুই এর ছবি

অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে ধন্যবাদ কথাগুলি বলার জন্যে। অসএইড এর বৃত্তি নিয়ে পড়তে এসে চলে যাবার আগে এবং সময় অস্ট্রেলিয়ান দের কাছে "ওহ তোমাদের দেশ স্বর্গ, বাজে দেশ বাংলাদেশে আমি ফিরে যেতে চাইনা" (হুবহু উদ্ধৃতি বাংলায়, বারংবার, সর্বত্র)বলে যে আচরণ দেখেছি সেদিন প্রানপণে ইচ্ছে হয়েছে এই বিকৃতমস্তিস্ক/হতভাগী/কু-আত্মা এখানেই থেকে যাক। (বেচারীকে দেশে ফিরে যেতে হয়েছে)। সেদিন এক ভিনদেশি বলছিল, "আমার বাংলাদেশী বন্ধু তো কখনও বলেনি তোমার দেশ এত সুন্দর আর সে এই দেশে থাকতে চায়না। তারকাছে শুনে তো আমার ধারণা হয়েছে এত হরিবল আর কোন দেশ থাকতে পারে না।এতকিছুর পরও তুমি তোমার দেশ এত ভালবাসো?" (হে হে ঢোল পিটাই নিলাম নিজের একটু)

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।