মাঝে মাঝে সর্ষের তেল কি সাবান খুঁজে পাই না। রাজ্জাক ভাইকে বলতেও সংকোচ। রাইটার মানুষ। তার জিম্মায় থাকি। তার কাঠের বাক্সটার ভেতর একটা খাতায় সবার নাম লেখা। কেউ গেলে বা কেউ হারালে সেই খাতায় দাগ পড়ে। হিসাবে এদিক ওদিক হলে রাজ্জাক ভাইকে একদিন কাটিয়ে আসতে হয় দুরমুশ সেলে। ফিরে এলে কমপক্ষে তিনদিন লাগে আবার উঠে দাঁড়াতে।
সাবান-টাবান সিগারেট-টিগারেট এগুলা কিছু না। রাইটারের হেল্পার হিসেবে রাজু এগুলা নিতেই পারে। আবার রাতে তো সিদ্ধির যোগান ওই-ই সরবরাহ করে। ওর আর ডাকু রমজানের জন্যই রাতটা রঙ্গিন রঙ্গিন হয়। রমজান ডাকু ছিল আবার যাত্রার নায়কও ছিল। সারারাত রমজানের পাট দেখে শখানেক মুগ্ধ পুলিশ যখন ভোরবেলা ওকে হাতকড়া পরায়, তখন রমজান বলে, 'ওসি সাব, গানগুলান কিন্তু আমরারই, নাগছে ক্যামুন'? ওসিরা সাধারণত আহাম্মক হয়। কিন্তু ইনি অন্যরকম। সঙ্গে সঙ্গে ওর হাতকড়া খুলে গাড়িতে ওঠায়। সেই রমজান এখন যাবজ্জীবন নিয়ে ৩২ নং ওয়ার্ডের গায়েন কাম দারোয়ান। রাত্রে ও যখন, ওল্টানো থালিতে আঙ্গুল টুকে গান ধরে, 'যে আমারে আদর কইরে গো-ও-ও, নাম রাইখ্যাছে আদরিনী-ইই, আমি কী তার আদর জানি' গায়; দিলটা একেবারে ঠাণ্ডা হয়ে যায়। কোনা কাঞ্চি থেকে কেউ কেউ তখন ডুকরালে রমজান পাহারা আওয়াজ দ্যায়, 'মাঙ্গির পুত, শাউয়ার কাঠি ভাঙ্গুম নিহি'।
এদিক থেকে রাজু একটু ধান্ধাবাজ টাইপের। তখন আমীর খান হিট। ওরও আমীর খানের মতো চোহারাছবি। শুক্রবার সকালে নায়কটি সেজে মুখে স্নো-পাউডার মেখেটেখে আমাদের আমীর খান ডেটিংয়ে যান। চওড়া বারান্দা পেরিয়ে নামলে চত্বরের মধ্যিখানে বাঁধানো আম গাছ। সেখানে ছায়ায় দাঁড়িয়ে সেন্ডেলের ফিতা লাগায়, চুলে একটু হাতের তালু দিয়ে শান দিয়ে নেয়। আমরা বুঝি ও মেয়েদের ওয়ার্ডে বউকে দেখতে যাচ্ছে। সপ্তাহে এই একদিন; যেন ওর ঈদ।
দুপুরের পরে ঘন্টা খানেকের জন্য ছাড়া হয় সবাইকে। তখন পায়চারি করতে করতে ওই আমগাছটার তলয়া গিয়ে বসি খানিক সময়। বেশিক্ষণ বসা ভাল না। সারাদিন বসে বসে কাটানোর পর এই টুকু সুযোগ কেউ ছাড়তে চায় না। ওই সময়টায় বিড়িটিড়ি খাওয়ার মজাই আলাদা।
মাঝে মাঝে তাস খেলা হয়। তাস চালতে চালতে দাড়ির গোড়া পেঁচানো অরুণের মুদ্রাদোষ। আমি বলি, 'কী অরুণ সব কেশই কি পেঁচাও নাকি'। ওইটকু মানুষের ওত বড় দাড়ি আর ইয়া লম্বা চুল। সে এক কাণ্ড বটে! দাবা ভাল খেলে আরমান ভাই। মুখের সামনে শূণ্যে আঙুল দিয়ে আঁক কষে অব্যর্থ চাল দেয়। লোকটা কথা কয় না তেমন। শরিয়তপুর বাড়ি। ফলের ব্যবসা করতো। ভাইঝির ওপর কারা যেন বোমা মারে। পরের তিনদিন সে আগুন হয়া তামা তামা হয়া ঘোরে আর খোঁজে। চতুর্থ দিন রাতে বোমারুদের একজনকে পায়। মশারির মধ্যে ঘুমাচ্ছে। ঐ মশারি পেঁচিয়েই লোকটাকে কাঁধে করে মাঠে এনে ফেলে। তারপর খড়টড় যোগাড় করে আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দেয়। তারপর সোজা এখানে এই ৩২ নং খাতার বাসিন্দা।
দুই. কোথা থেকে যেন একটা গান ভেসে আসছে। কী যেন মনে করিয়ে দেয়া আর সুরে যেন পুলকের টান। গানটা আস্তে আস্তে আরো স্পষ্ট হয়। আমরা যেন এক চাপা গ্রহণ লাগা আলোর নীচে কোথায় চলেছি। একটা দীর্ঘ রজ্জুর মতো কী একটা আমাদের কাঁধে, গলা ঘেঁষে। একটা উতসবের গানের মধ্যে আমরা সার বেঁধে হেঁটে যাচ্ছি। কোথায় যেন আনন্দ লেগেছে। আর চাপা উজ্জল আলোর তলায় রাশি রাশি মেঘে ছাওয়া গানের পথ উঠে গেছে আকাশের দিকে। চারপাশে জ্যোতির্ময় কুয়াশার মত ঘোর আর সেই সুর তরলের মত ভিজিয়ে দিচ্ছে আমাদের। যত যাই, গানটা তত চেনা চেনা লাগে। হঠাত বুঝতে পারি এটা স্বপ্ন। চাইছি স্বপ্নটা চলুক। কিন্তু গানটা যেন আরো পরিষ্কার হতে থাকে। আরো কানে ঢুকে যেতে থাকে। আমাদের সবার ঘাড়ে গলা ঘেঁষে যাওয়া সেই রশিটা আরো ভারি হতে থাকে। দমবন্ধ হয়ে আসে যেন। একটা ঝাঁকুনি দিয়ে গান চলে যায়, সুর চলে যায়, আলো চলে যায় আর আর জেগে যাই।
বুকটা চেপে আছে। চাপা দমবন্ধ ভাব। তখনই বাইরে কোথাও বাজতে থাকা গানটা শেষ হলো। আহ্! কী গান জানা হলো না!
তিন.আমরা থাকি একটা দক্ষিণমুখী লাল প্রাচীন লম্বা দালানে। পুরো জেলখানাটা দুপুরের খাওয়ার পরে একটু শুনশান থাকে। ৩২ নং খাতার প্রাণীরা তখন যার যার ঘাম আর হাঁসফাঁসানিতে জারজার হতে হতে ঝিমায়। ঘামে কম্বল, জামা আর মেঝে ভেসে গেলে সেটাতে পিঠ ঠেকালে একটু ঠাণ্ডা লাগে। এরকম সময় টুপ করে দোতলার কয়েদিদের ওয়ার্ডে চলে যাই। নীচতলাটা হাজতিদের আর ওপরটায় দাগি কয়েদিরা ঘুমায়। দিনে ওরা কাজে যায়। জেলের ভেতরই নানানরকম খাঁটুনির ব্যবস্থা আছে। তখন মাঝে মাঝে লুকিয়ে তাদের কারো বিছানায় শুয়ে শুয়ে ভাবতাম। নীচতলায় এসবের কোনো বালাই নাই। এখানে এসে বিরাট শিকওয়ালা জানালা দিয়ে আকাশ দেখতে দেখতে ঘুমিয়ে যেতাম। আজ সেখানে শুয়ে আবার সেই স্বপ্নের কথা মনে হলো। ইস্স কোথায় যেন আনন্দ লেগেছে!
চার. এসময়টায় হাঁটুর ওপর থুতনি লাগিয়ে জগন্নাথ ঠাকুরের মতো না হয়ে উপায় খাকে না। এখন গুনতি হবে এবং গুনতিতে কোনো ঝাউলিমাউলি চলবে না। গুনতি ঠিক আছে তো সব ঠিক। ওই গুনতি দারোগা আসছে। পাহারা রমজানের পান্টির কয়েকটা বাড়ি পাছায় পড়ায় সবাই বেশ সিজিলমিছিল করে বসে। আর দুনিয়ার বদমাইশি শালা তখনই চাগান দেয়। এ ওর পাছায় কাঠি দেয়, ও একে কম্বল পালিশের জন্য জেঁকে ধরে। তারই মধ্যে একেকজনকে দেখা যায় সার বেঁধে লাইনের মধ্যে বসা অবস্থায় হাসির ঠেলায় হঠাত ছেড়ে দেয়া স্প্রিংয়ের মতো তড়পাচ্ছে।
কিন্তু আজ সব শুনশান। পাহারা রমজান পান্টি দিয়ে নিজের ঊরুতে বাড়ি মারতে মারতে ঘরপাক খাচ্ছে। চোখটা আর মানুষের নাই, কুকুরের মতো লাল। বুঝলাম ভর সন্ধ্যাতেই সিদ্ধি টেনে মেজাজ তিখা করে আছে। আমাদের কোণাটায় রাজ্জাক রাইটার তার কাঠের বাক্সের ওপর বসে গরাদের বাইরে তাকিয়ে আছে। তার পাতলা দাড়ি বাতাসে কাঁপে। ওদিকে সাত-আটজন দাবার বোর্ডের দিকে ঝিম মেরে তাকিয়ে আছে। যেন যে কোনো সেই বোর্ড থেকে বিষ্ফোরণ হবে। মুহূর্তে সেখানে খেয়াল করলাম কেউ কারো মুখের দিকে তাকাচ্ছে না। ধক করে উঠল। বুঝলাম, খবর চলে এসেছে। রাজুকে দেখলাম না। ওর আগেই কি খবরটা চলে এসেছে! আজ ছিল ওর রায়ের তারিখ। সকাল বেলা সেজেগুজে বেরিয়ে গেছে এক হাবিলদারের সাথে। ওদিকে মেয়েদের ওয়ার্ড থেকে সিরাতকেও বের করা হয়েছে। এক মামলার আসামি বিধায়, তুজনকে একসঙ্গেই কোর্টে তোলা হয়। একসঙ্গেই ওরা কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে দিনের পর দিন সওয়াল-জবাব শোনে। আজকেও শুনেছে নিশ্চয়।
পাঁচ. লকআপের ঘন্টা বাজিয়ে দিল ঘন্টি। এখনও ফিরল না রাজু। আমরা বসে আছি। শিকের ভেতর দিয়ে বাইরের চত্বর, চত্বর পেরিয়ে চৌবাচ্চা। তার পরে লোহার বেড়ার ওপারে রপ্তানির গুদামের মতো টিন শেড। সন্ধ্যার আলোর মধ্যে সেটাকে একটা মালবাহী জাহাজের মতো লাগে। প্রথম রাতটায় আমাদের সাতজনকে ওখানে রেখেছিল। পরদিন বিকালে যার যার ওয়ার্ড ভাগ হওয়ার সময় রাজ্জাক রাইটার আমাদের নিতে রাজি হয়। বিছানা-কম্বল-গোসলের পানি ইত্যাদি বাবদ সপ্তাহে জনপ্রতি পাঁচশ টাকা চুক্তি।
কয়েকটা সেন্ট্রি বারান্দায় এ মাথা ও মাথা করে । আমরা বলি ঠোঙ্গা। রাজুর বিয়ে হয়েছে এখানেই। কিংবা হয়তো ওরা আগেই বিয়ে করে রেখেছিল। কে জানে?
কেবল বিয়েই। সেই সুবাদে শুক্রবার সকাল করে ওদের দেখা করতে দিত। মুখোমুখি শিকের এপার ওপার বসে ওরা কী কথা বলতো। গরাদের দুদিক থেকে দুটো হাত এসে কী তখন একটা জায়গায় মিলত? ওরা কি পরস্পরকে অভয় দিত? তবে আমাদের ভাগের সাবান চুরি হয়ে রাজু মারফত সিরাতের কাছে যে চলে যেত, সেটা নিশ্চিত। এজন্যই রাজু কিছু নিলে আমরা কিছু মনে করতাম না। বরং চোখ টিপি দিয়ে হাঁসতাম।
খুনটা ওরা দুজন মিলেই করেছিল। আদালতেও সেটা প্রমাণিত হয়েছে। কিংবা ওরা করেনি। কে জানে? রাজু এ নিয়ে মুখ খোলে না। তবে আজকে আর ছাড়ব না। বলতেই হবে, যে মরেছে সে কেন মরেছে? কিংবা এসব প্রশ্ন আজ অবান্তর। ৩২ নং খাতার মানুষেরা কখনো এসব প্রশ্ন করে না। যা হবার তা হয়, আর যখন হয় তখন নাকি কেউ ঠেকাতে পারে না। আরমান কি জানতো না, মশারির মধ্যে পেঁচিয়ে একজনকে জ্যান্ত পুড়িয়ে মারলে কী হয়? কিংবা শেরআলী কি জানে না, মাকে খুন না করেও মায়ের ঘাতক হিসাবেই ওর বিচার হবে? ৩২ নং খাতায় এসব প্রশ্ন তোলা আহাম্মকি।
আমরা বসে আছি। আমগাছটা থেকে ঝুরঝুর করে অন্ধকার পড়ে সবকিছু কালিকালি করে দিচ্ছে। সবগুলো ওয়ার্ডে তালা পড়বে এখনই। দূরের একটা দালানে শিকের সঙ্গে কেউ টিনের থালি বাজাচ্ছে। রাজুর আসার সময় হলো।
আহ স্বপ্নে আসা গানটা কী ছিল যদি জানা যেত!
মন্তব্য
- কঠিন
_________________________________
<সযতনে বেখেয়াল>
ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর কর্মকাণ্ড । বিএসএফ ক্রনিক্যালস ব্লগ
-----------------------------------
... করি বাংলায় চিৎকার ...
-----------------------------------
বই,আর্ট, নানা কিছু এবং বইদ্বীপ ।
জ্বি, আংশিক রঙ্গিন সম্পূর্ণ সত্য ঘটনা অবলম্বনে।
...........................................................................................
মনে হয় তবু স্বপ্ন থেকে জেগে, মানুষের মুখচ্ছবি দেখি বাতি জ্বেলে
হাঁটাপথে আমরা এসেছি তোমার কিনারে। হে সভ্যতা! আমরা সাতভাই হাঁটার নীচে চোখ ফেলে ফেলে খুঁজতে এসেছি চম্পাকে। মাতৃকাচিহ্ন কপালে নিয়ে আমরা এসেছি এই বিপাকে_পরিণামে।
আমগাছটা থেকে ঝুরঝুর করে অন্ধকার পড়ে সবকিছু কালিকালি করে দিচ্ছে।
সুন্দর লাইন.....। খুব সুন্দর!
**********************************
যাহা বলিব সত্য বলিব
**********************************
যাহা বলিব, সত্য বলিব
ভালো লেগেছে ।
আমি জেল থেকে বেরিয়ে আসার পর ছয়/সাত বছর হয়ে গেল, এতদিনে বোধহয় ওদের দুজনের ফাঁসি হয়েও গেছে। জানি না...
......................................................................................
মনে হয় তবু স্বপ্ন থেকে জেগে
মানুষের মুখচ্ছবি দেখি বাতি জ্বেলে
হাঁটাপথে আমরা এসেছি তোমার কিনারে। হে সভ্যতা! আমরা সাতভাই হাঁটার নীচে চোখ ফেলে ফেলে খুঁজতে এসেছি চম্পাকে। মাতৃকাচিহ্ন কপালে নিয়ে আমরা এসেছি এই বিপাকে_পরিণামে।
নতুন মন্তব্য করুন