সন্ধ্যার দিকে আমরা সেখানে পৌঁছলাম। বাড়িটায় যেতে একটা ডোবা পার হতে হয়। বাড়ি তো না, কয়েকটা টিনের ঘরের গলাগলি করে দাঁড়িয়ে থাকার চেষ্টা। ঘরগুলির সামনে একটা পেয়ারা গাছ। পড়ে আসা আলোয় পাতাগুলি কালো দেখায়। তলায় এক মধ্যবয়সী মহিলা মুখে সেই কালো মেখে দাঁড়িয়ে আছে। আমরা দেখা দিতেই ইশারা করে ঘরের ভেতর চলে গেলেন। তার পিছু পিছু আমরাও ঢুকলাম।
চৌকির ওপর বসে আছি অনেকক্ষণ হয়ে গেল। এর মধ্যে মলিন কাপে সাদা সাদা চা খাওয়া হল এক পাট। একটাই ঘর, মাঝখানে পার্টিশন দেয়া। ভেতরে কেমন সোঁদা আর পচা পান্তার মতো ঘ্রাণ। একজন সঙ্গে করে আনা পেপারটা পড়ছে, আরেকজন সিগারেট টানছে আর কাশছে। ক'দিন ধরে নাকি ঠাণ্ডা লেগেছে। একসময় কাশি অসহ্য লাগলে মনে হল মুখে ছিপি পুরে দিই। অবশেষে মেয়েটি এল। বুঝলাম ওকে বুঝিয়ে সুজিয়ে পরিপাটি করে আনা হয়েছে। ১৮/১৯ হবে বয়স। গায়ে খয়েরি সাদা ফুটিফুটি কামিজ আর নীল সালোয়ার।
রেকর্ডার হাতে কথা শুরু করলো সাংবাদিকটি :ওই রাতে তুমি ওখানে ছিলা?
মেয়েটি মাথা নাড়ল।
আবার প্রশ্ন: ছিলা?
:হ
প্রথম থেকেই?
:হ
কী দেখলা?
মেয়েটি বলতে পারে না। একটা মোড়ায় বসা। পায়ের নখ দিয়ে মাটি খুঁটছে। বোধহয় মনে মনে ভেবে নিচ্ছে। কিংবা যা দেখেছে তার অর্থ খতিয়ে নিচ্ছে মনে মনে।
সাংবাদিকের মন একটু আর্দ্র হলো : বলো না কী দেখলা?ওরা নাকি ছুরি দিয়া জবাই করছে। এক মেয়ের মাথা নাকি ইট দিয়া থেতলে দিছে। বলে কিছু ছবি বের করে দেখাল।
ছবিগুলা দিছে স্থানীয় এক ছেলে। ঘটনার পরদিনের পরদিন ইপিজেডে ঢুকে ছবি তুলেছিল সে। আমরা ঢাকায় বসে ছবিগুলো নিয়া অনেক গবেষণা করেছি। একটাতে লাল হয়ে যাওয়া পুকুর। আরেকটা কারখানার সামনের রাস্তার দৃশ্য। ফায়ারব্রিগেড এসে ধুইয়ে দেয়ার পরেও ছোপ ছোপ রক্ত। একটা ছোপের মধ্যে কাটা দড়ি। এই মেয়েটাই পরে বলবে, গণ্ডগোলের মধ্যে ভেতরে আটকে পড়া ২৫/৩০ জন মেয়েকে সে নাকি দেখেছে। দেখেছে, একজনের মাথা কংক্রিটে ফেলে ইট দিয়ে গুঁড়িয়ে দিতে। দেখেছে এক শ্রমিকের পেট ছুরি দিয়ে ফালা ফালা করে দিতে।
মেয়েটা তখনো কিছু বলছে না। যেন নিঃশ্বাস বন্ধ করে একবার আমাদের দিকে তাকাল। মুখ-চোখ শীর্ণ। চোখের নীচে কাজল না কালি বোঝা যাচ্ছে না। এখন ওকে বয়সের থেকে কম মনে হচ্ছে।
আমি বললাম: বলবা কিছু? না পরে বলবা।
ঘটনার এক মাস পেরিয়ে গেছে। প্যানটেক্স সহ অন্যান্য গার্মেন্ট কারখানা এখন চালু। ওকে বলা হয়েছে কাজে না যেতে। তবে বেতন দেয়া হবে।
মধ্যবয়সী মহিলাটি এতক্ষণ ওর পাশেই দাঁড়িয়েছিল। সে আরো ঘন হয়ে এল মেয়েটার কাছে। ওর মাথায় হাত দিয়ে বলে, 'ক, মা কী দেখচস? ক'না। ওনারা ভালা মানু, ক'।"
অকষ্মাত মেয়েটা হু হু করে ভেঙ্গে পড়ল মহিলার গায়ে। পেছন থেকে মুখ দেখছি না, কেবল ওর পিঠের ফুলে ফূলে ওঠা দেখছি। দেখছি মানুষ কীভাবে কাঁদে, কেন কাঁদে কতবার কতক্ষণ কাঁদে। এর মধ্যে হারিকেন দিয়ে গেল।
মেয়েটা এবার মুখ তুলল। চুল এলোমেলো হয়ে ছড়িয়ে আছে। চোখের কাজল ধুয়ে ধূয়ে গালে আঁকাবাঁকা দুটো খাঁড়ির মতো লাগছে। এখন ও কথা বলবে। বলবে ইতিহাস। কিন্তু কত কী যে লেখা ছিল ঐ মুছে যাওয়া কাজলে কাজলে, তা কি আর জানা যাবে?
...............................................................................
পুনশ্চ: শ্রমিক শ্রেণীর মহান মে দিবসে আজ শ্রমিক ছাড়া সবার ছুটি। কারণ তারা মহান হইতে পারে নাই। বড়লোকের দলাদলির মীমাংসা আর পরাশক্তির আগ্রহের এই সরকারের আমলে সবারই রাজপথ কাঁপাবার আর সভা সমিতি নাচাবার অনুমতি আছে; না খেয়ে মরলেও, মালিকের অত্যাচারে জীবন গেলেও, ছাঁটাই হলেও তাদের প্রতিবাদের অনুমতি নাই। এই বড়লোকি মে দিবসের ছুটির কল্যাণে এই লেখা ঘরে বসে অলস দুপুরে।
এটা কোনো গল্প নয়। ২০০৫ হবে হয়তো, নারায়ণগঞ্জে বিরাট এক শ্রমিক অভ্যুত্থান হয়েছিল। সরকারিভাষ্যে পুলিশের গুলিতে ৪/৫ জন মারা যায়, আমার অনুসন্ধানমতে কমপক্ষে বার। এবং তাদের বেশিরভাগকেই জবাই করা হয়। ঘটনাক্রমে আমি দ্বিতীয় দিন থেকেই আন্দোলনের নেতৃত্ব দেয়া শ্রমিকদের সঙ্গে জড়িত হয়ে যাই। মধ্যবিত্ত কতিপয় নেতা যখন ড. কামাল হোসেনকে নিয়ে গিয়ে আপস আপস খেলছেন, ভুয়া চুক্তি করছেন, তখনও ওরা লড়াই চালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছিল। তিন দিন নারায়ণগঞ্জ শ্রমিকদের নিয়ন্ত্রণে ছিল। গার্মেন্ট শ্রমিকদের সঙ্গে যোগ দিচ্ছিল আশেপাশের অন্য শিল্পশ্রমিকরা। এরই মধ্যে বামফ্রন্ট নেতারা তাদের শ্রমিকদের দিয়ে কামাল হোসেনকে নিয়ে গিয়ে আন্দোলনের জানাজা পড়ান। এক স্থানীয় নেতা আমাকে হুমকি দেন পুলিশে ধরিয়ে দেয়ার। ওরই একটা পর্যায়ে আমি ঢাকা থেকে বেশ কয়েকজন সাংবাদিককে নিয়ে গিয়ে শ্রমিক হত্যার প্রমাণাদি দেখিয়ে বিষয়টা মিডিয়ায় আনার চেষ্টা করি এবং ব্যর্থ হই। পরে আমরা ১২ কি ১৪ জন তরুণ লেখক-কর্মী মিলে একটা প্রতিবেদন ও প্রতিবাদ পাঠাই সব পত্রিকায়। কেবল যুগান্তর তা প্রকাশ করে এবং কিছুটা আলোড়ন হয়। আমরা কৃতার্থ হই। শ্রমিকদের কোনো লাভ হয় না। সে অন্য কথা। সেখানে এক মেয়ের কাছে ওরা আমাকে নিয়ে যায়। এই কাহিনীর অবলম্বন সে-ই।
মন্তব্য
শ্রমিক আন্দোলন আর ড.কামাল হোসেন!
শেক্ষপীর বলেছিলেন, স্বর্গ আর ধরিত্রিতে অনেক কিছু আছে....
ঋণম্ কৃত্বাহ ঘৃতম্ পীবেৎ যাবৎ জীবেৎ সুখম্ জীবেৎ
অজ্ঞাতবাস
তবে উনি এখন খোলস ছাড়তেছেন। অচিরেই ওনাকে স্বরূপে দেখা যাবে। এর মধ্যে তো শেখ হাসিনা কামাল ডাক্তারের রোজগারের পরিমাণ নিয়ে বোমা ফাটিয়ে বেচারার ভাবমূর্তির বেলুন চুপসে দিয়েছেন। বেটিকে ধন্যবাদ।
মনে হয় তবু স্বপ্ন থেকে জেগে
মানুষের মুখচ্ছবি দেখি বাতি জ্বেলে
হাঁটাপথে আমরা এসেছি তোমার কিনারে। হে সভ্যতা! আমরা সাতভাই হাঁটার নীচে চোখ ফেলে ফেলে খুঁজতে এসেছি চম্পাকে। মাতৃকাচিহ্ন কপালে নিয়ে আমরা এসেছি এই বিপাকে_পরিণামে।
শ্রমিক শ্রেণীর মহান মে দিবসে আজ শ্রমিক ছাড়া সবার ছুটি। কারণ তারা মহান হইতে পারে নাই। - দু'মুঠো ভাতের নিশ্চয়তা নাই এতই সস্তা যেখানে ঘাম এবং জীবনের দাম, মহান হবার সময় কই? তার চাইতে ড. কামালেরা মহান থাকুক। এই তকমা তাদের কাজে লাগবে। বুকে ঠুকে দেখিয়ে দিতে পারবে - দ্যাখ্ ব্যাটারা আমি কত মহান। তোরা সব অচ্ছ্যুতের দল, লাইনে আয় - নইলে দূরে গিয়া মর্।
_________________________________
ভরসা থাকুক টেলিগ্রাফের তারে বসা ফিঙের ল্যাজে
_________________________________
ভরসা থাকুক টেলিগ্রাফের তারে বসা ফিঙের ল্যাজে
ঐ ঘটনার বিবরণ আর প্রতিবাদ লিপিটা দেখতে চাই।
স্মৃতি থেকে যতটুকু উদ্ধার করে আনা সম্ভব। এলোমেলো হলেও ক্ষতি নেই আসলে।
-------------------------------------------------------
বাংলায় হাগি, মুতি, বাঁচি
------------------------------------
আমি তো গণে নেই বিচ্ছিন্ন একা
সঙ্ঘে সমুহে নেই সঙ্ঘমিতা।
যুগান্তরের লেখাটার কপি আছে। আর আন্দোলনে প্রতারণা ও স্বতঃষ্ফূর্ততার দোহাই, পরিস্থিতি পরিপক্ক হয়ে ওঠে নাই ইত্যাকার বুলি দেয়া আমাদের (নিজেকেও বাদ দিচ্ছি না) বাম পার্টিগুলোর ত্রুটি নিয়ে বিরাট করে লিখেছিলাম নতুন পাঠ ও সংহতি পত্রিকায়। সেগুলো স্ক্যান করে আপনাকে দিতে পারি। অথবা মেইল করতে পারি যদি ঠিকানা পাই। এ আন্দোলন নিয়ে বাসদের ভ্যানগার্ড আর সিপিবির একতার সঙ্গে বিতর্ক জারি ছিল কিছুদিন। আর আমার নিজের ধারার সঙ্গে কিছুটা সাবভার্সিভ বিতর্ক চলে থেমে যায়।
যাই হোক যা মাওএর হুনান আমাদের এরকম কত হুনান কানসাট ফুলবাড়ী নারায়ণগঞ্জে আসে আর হারিয়ে যায়। নেতারা চিনতে পারেন না।
মনে হয় তবু স্বপ্ন থেকে জেগে
মানুষের মুখচ্ছবি দেখি বাতি জ্বেলে
হাঁটাপথে আমরা এসেছি তোমার কিনারে। হে সভ্যতা! আমরা সাতভাই হাঁটার নীচে চোখ ফেলে ফেলে খুঁজতে এসেছি চম্পাকে। মাতৃকাচিহ্ন কপালে নিয়ে আমরা এসেছি এই বিপাকে_পরিণামে।
- কপিটা বরং এইখানে তুলে দিন।
কম্পোজ হলে ভালো না হলে স্ক্যান কপিই সই।
_________________________________
<সযতনে বেখেয়াল>
ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর কর্মকাণ্ড । বিএসএফ ক্রনিক্যালস ব্লগ
অসম্ভব রকম ছুঁয়ে দিল লেখাটা। বিশেষ করে শেষ লাইনটা।
চারপাশে শ্রমিকদের দুরবস্থা দেখলে খুব অসহায় লাগে। হায় রে 'মহান' মে দিবস!
শিরোনামটি কিশোর কুমারের গান 'নয়ন সরষী কেন' গান থেকে নেয়া। কথাটা ছিল 'কত কী রয়েছে লেখা কাজলে কাজলে'। গতকাল আবার শোনার পর থেকে খালি এটাই মাথায় ঘুরছিল। কাজলে লেখা তো মুছেও যায়। বাংলাদেশের অসংখ্য দরিদ্র নারীদের জীবনের প্রতীক মনে হয়েছিল রূপকল্পটি। কিন্তু লিখে তৃপ্তি পায়নি। ঐ উচ্চতা ছোঁয়নি লেখাটা।
যাহোক, আপনার মন্তব্য ভাল লাগালো।
মনে হয় তবু স্বপ্ন থেকে জেগে
মানুষের মুখচ্ছবি দেখি বাতি জ্বেলে
হাঁটাপথে আমরা এসেছি তোমার কিনারে। হে সভ্যতা! আমরা সাতভাই হাঁটার নীচে চোখ ফেলে ফেলে খুঁজতে এসেছি চম্পাকে। মাতৃকাচিহ্ন কপালে নিয়ে আমরা এসেছি এই বিপাকে_পরিণামে।
এমন কিছুর অপেক্ষায়ই ছিলাম । জানতাম , কে লিখলে , আর লিখতে সাহস হবে না কোনও গল্প । কারা লিখলে রক্তমাংসমগজনাড়ীতে স্রোত উঠবে , উঠে আর থামতেই চাইবে না ।
হায় , তবু তারা লিখবে না সহসা !!
---------------------------------------------------------
নীল সার্ট নেই বলে কেউ আমাকে নাবিক বলেনি !
অথচ সমুদ্রে-ই ছিলাম আমি
---------------------------------------------------------
তুমি এসো অন্যদিন,অন্য লোক লিখবে সব
আমি তো সংসারবদ্ধ, আমি তো জীবিকাবদ্ধ শব !
পড়ে একটা অতৃপ্তি থেকে গেলো... গন্তব্য যতটা উঁচুতে ছিলো ততটা যেতে পারেনি... মনে হয় একটু তাড়াহাড়ায় লেখা... গল্পের চেয়ে শাণে নজুলটাই গুরুত্বপূর্ণ হয়া উঠছে...
তবে শানে নজুলটা বেশ গুরুত্বপূর্ণই আসলে... আবার ইহাও সত্য যে এইরকম অনেক অনেক আন্দোলনের একই পরিণতি হইছে... অনেক অনেক লাশ দেখে দেখে যেমন ডোমের আর মৃত্তুবিষয়ক অনুভূতি জাগে না... সেইরকম হইছে আমাদের হৃদয়। এখন আমাদের মনেই হয় এইরকমই আসলে হওনের কথা ছিলো বোধহয়...
সুন্দরবনে এক চাঁদের রাত্রে পুকুর পাড়ে বইসা কিশোর কুমারের এই গানটা শুনছিলাম শাহাদুজ্জামানের কণ্ঠে... অপূর্ব লাগছিলো... তার সিং মাছ, লাল জেল, এইসব গল্পটা মনে পরলো একই সাথে...
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
যুগে যুগে ড. কামালের মতো নেতারা আপোষ করে। অধিকাংশ সংবাদপত্রও আসল ঘটনা চেপে যায়। জানা হয় না এরকম শ্রমিকদের এরকম হৃদয়বিদারক পরিনতি!
..লেখাটা সাংবাদিকতা ছাড়িয়ে হৃদয় ছুঁয়ে যাওয়া এক করুণ কাহিনী। খুব খারাপ হয়ে গেলো মনটা।
যতবার তাকে পাই মৃত্যুর শীতল ঢেউ এসে থামে বুকে
আমার জীবন নিয়ে সে থাকে আনন্দ ও স্পর্শের সুখে!
..লেখাটা সাংবাদিকতা ছাড়িয়ে হৃদয় ছুঁয়ে যাওয়া এক করুণ কাহিনী। (কপিরাইট শেখ জলিল )
নুরুজ্জামান মানিক
*******************************************
বলে এক আর করে আর এক যারা
তারাই প্রচণ্ড বাঁচা বেঁচে আছে দাপটে হরষে
এই প্রতারক কালে (মুজিব মেহদী)
আমি তখন (১৯৮৫-৮৬) কুমিল্লার সাপ্তাহিক আমোদ-এর ইলিয়টগঞ্জ সংবাদদাতা। ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানোর মত উৎসাহ। স্বপ্ন দেখতাম একদিন বড় সাংবাদিক হবো। মানুষের কথা বলবো হৃদয় মথিত করে।
আমি কিন্তু সাংবাদিক এর স এর ধারে কাছেও নেই। কিন্তু আমার চাওয়ার স্ফুরণ দেখলাম আপনার লেখাতেই। এক ধরনের ভালো লাগা আর কষ্ট ছুঁয়ে আছে পরস্পর। দেরিতে পড়লেও অনুভব করছি লেখনীর তীক্ষ্নতা। ধন্যবাদ ফারুক ওয়াসিফ ।
-জুলিয়ান সিদ্দিকী
নতুন মন্তব্য করুন