আশা ও সংকল্পের নামে যাকে চিনি তিনি কার্ল মার্কস। কলিকালে তাঁর তেমন প্রচলন নাই। আইয়ামে জাহেলিয়াতে নবীকে মনে হয় খল, খলকে মনে হয় অবতার, আর অবতার হয়া যান কর্পোরেটের ভাড়াটে সং। তাই এই কালে তাঁর নাম নেয়ায় বরকত নাই। তবুও নিতেছি; আজ ৫ মে তাঁর ১৯০তম জন্মদিন। আর কোনো ইউরোপীয় মনিষী বাংলাকে নিয়া তেমন ভাবেন নাই, অধিক এ কারণেও তাঁকে মনে রাখি। তিনি ভাবিত ছিলেন। প্রমাণ তাঁর 'এথনো নোট বুকস'। জীবনসায়াহ্নে তিনি আবিষ্কার করিয়াছিলেন মানবসমাজ তথা জাতিপুঞ্জ নিয়া কাজ বাকি রইল। তাই অন্য অন্য ভারতীয় ভাষার মধ্যে বিশেষ করে বাংলার প্রতি আগ্রহী হলেন। শিখলেন ৫ হাজারেরও বেশি বঙ্গীয় শব্দ। বাংলার গ্রামদেশ সম্পর্কে ইতিউতি নয়, সরাসরি মন্তব্য করলেন। ব্রিটিশের হাতে বিনষ্ট হওয়া বাংলার বস্ত্রশিল্পের তাঁতিদের জন্য বেদনায় লিখলেন, ব্রিটিশ সৃষ্ট দুর্ভিক্ষে 'বাংলার শ্যামল প্রান্তর তাঁতীদের হাড়গোড়ে শ্বেতশুভ্র হয়ে গেছে।'
সিপাহি যুদ্ধ তাঁকে আলোড়িত করে তুলেছিল। কোনো আধুনিক ভারতবর্ষীয় যা সেকালে ভাবে নাই তিনি তাই ভাবলেন। এ যুদ্ধ যে জাতীয় যুদ্ধ তার জ্ঞান টনটনা হওয়া মাত্র নাম দিলেন, 'প্রথম ভারতীয় স্বাধীনতা যুদ্ধ'। তিনি ও তাঁর দোস্ত এঙ্গেলস মিলে ইউরোপ-আমেরিকার সংবাদপত্রে ফাটাইয়া জানাইলেন, ইংরেজ কী নৃশংসতা ভারতবর্ষে চালাইতেছে!
জীবনের শেষ প্রান্তে কলকাতা থেকে কোনো এক যুবক বাংলার শ্রমিক শ্রেণীর দুর্দশার কথা জানাইয়া তাঁকে চিঠি লেখে। তিনি উত্তর দেন। পার্থ চট্টপাধ্যায়র জবানীতে পড়ি, মার্কস লিখেছেন, বাংলার 'মানুষ সরল রেখা আঁকতে জানে না। তাই এখানকার ঘরবাড়ি, সড়ক ও জমির আল বিশুদ্ধ সরলরৈখিক নয়।...একটি মাদুর, কয়েকটি মাটির বাসন আর কাঁথাই বেশিরভাগের সম্বল।' হা পরিহাস! দুইশত বছর পরও বেশিরভাগের তাও নাই। এখানকার ইতিহাস বারবার অবরুদ্ধ হয়েছে, এখনো আছে।
কন্যা জেনি কি লরা একবার তাদের বাবাকে জিজ্ঞেস করেছিল, কী তাঁর শেষ কথা। তিনি যা বলেছিলেন তা রাবীন্দ্রিক বাংলায় বললে এরকম শোনায়, 'আমার মন পড়ে রয় মানবের তরে' (নাথিং হিউম্যান ইজ অ্যালিয়েন টু মি'। মানুষ ছিল তাঁর কেন্দ্রিয় বিষয় এবং মানবজাতিও আধুনিক কালে আর কারো দ্বারা এমন আলোড়িত হয় নাই। তাঁর নাম আজ তেমন ওঠে না। যারা তাকে নবী এবং তাঁর মতবাদকে ধর্ম বানিয়েছিল তারাও তাঁকে ত্যাগ করেছে বা নিজেরাই নিঃসার হয়েছে। কিন্তু আজ শ্রমিক শ্রেণীর আকার মার্কসের ভবিষ্যদ্বাণী প্রমাণ করছে। প্রলেতারিয়েতের সঙ্গে সঙ্গে বাড়ছে ব্লূ কলার আইটি জানা তরুণ প্রিক্যারেয়িত শ্রেণী। যে পুঁজিকে তিনি আবিষ্কার ও পরিচিত করেছিলেন তাও তাঁর দাগের বাইরে যেতে পারে নাই। তাঁর মতবাদের ভবিষ্যত তাই তন্ত্রের সাফল্য বা ব্যর্থতার ওপর নয়, অনেক বেশি নির্ভরশীল পুঁজির সংকটের ওপর। বিশ্বব্যাপী যে বিরাট মন্দা হানা দিচ্ছে, মানবজাতির ইতিহাসের যে সর্ববৃহত দুর্ভিক্ষ আজ হা হা করে আসছে, তা আরেক বার ইতিহাসকে মার্কস এর কাছে ফেরাবে বলে মনে হয়। কিন্তু যা গেছে তা গেছে, যা আসবে তা আরো অভিনব, আরো মানবিক। তাই পোপ ষোড়শ বেনেডিক্টও বলতে বাধ্য হন 'ঊনিশ শতকে মানব জাতি নতুন আশার উত্থান দেখেছিল। তখন থেকে যুক্তি ও জ্ঞান মানুষের আশাবাদী চলনের পথে ধ্রুবতারা হয়ে ফুটল। ...দরকার হয়ে পড়েছিল বিপ্লবী উল্লম্ফন। মার্কস তার ডাক দিলেন। এবং তাঁর অন্তর্ভেদী ভাষায় তিনি মুক্তির পথে মানুষকে জড়ো করলেন।... স্বর্গের সমালোচনাকে পরিণত করলেন বাস্তবতার সমালোচনায়।'
হ্যাঁ মার্কস যা কিছু বিদ্যমান তার সবকিছুর নির্মম ও নাছোড় সমালোচনার ব্রত নিয়েছিলেন। তার ধার আজো জায়মান।
ইতিহাসকে মাপা এক জীবনের কাজ নয়। মার্কস আবার জয়ী হবেন কিনা সে তর্ক তাই সরিয়ে রেখে ভাবি, জ্ঞানই কি তাঁকে অশেষ দারিদ্র্য ও বঞ্চনার মধ্যেও লড়াইয়ের প্রেরণা যুগিয়েছিল। নাকি মর্মের মধ্যে ইতিহাসের ডাক আর জগতের লাঞ্ছিত ভাগ্যহতদের মুক্তির দায় বলক দিয়েছিল বলেই তিনি যা, তা হয়েছিলেন? আমার সায় পরের উত্তরে। মুক্তির এই ব্রত এদেশেও অসংখ্য মানুষকে সব বিসর্জন দেয়ার তোড়ে টেনেছিল।
ষাট দশকের কথা। গোপন পার্টি মিটিং বসেছে যশোরের এক দরিদ্র কমিউনিষ্টের বাড়ীতে। মিটিং শেষ করে সবাই চলে যাবে, হঠাত বাড়ির ভেতর থেকে কান্নার শব্দ শুনে যার বাড়ি সেই কমরেডকে জিজ্ঞাসা করা হল, কী হয়েছে। লোকটি বলে, কিছু না। পরে জানা গেল পাশের ঘরে ছেলের সদ্যমৃত দেহ শুইয়ে রেখে পিতা বসেছেন পার্টি মিটিংয়ে। তাঁরা পারতেন। যেমন তাঁদের গুরু মার্কসও পারতেন। বিনা চিকিতসায় পুত্রের মৃত্যু দেখা, দাফনের টাকা যোগাড় করতে না পারা ব্যর্থ পিতা; বিশ্বের শ্রমজীবী মানুষের মহান পিতা কার্ল মার্কস।
জন্মদিনে তাঁকে স্মরি।
মন্তব্য
সশ্রদ্ধচিত্তে স্মরণ করছি। কলেজে থাকতে মার্ক্সের বই পড়া ছিল জীবনের সবচেয়ে উত্তেজক সময়। একটা বই একরাতে মানুষের মনকে কীভাবে বদলে দিতে পারে! ভাবলে আজও লোম খাড়া হয়ে যায়।
শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করলাম।
গুরুর পদে প্রেম ভক্তি হলো না মোর হবার কালে.....
ঋণম্ কৃত্বাহ ঘৃতম্ পীবেৎ যাবৎ জীবেৎ সুখম্ জীবেৎ
অজ্ঞাতবাস
অসাধারণ...
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করি গুরুরে । মার্কসের কাজের সাথে আমার ভালমত পরিচয় হয় ভার্সিটিতে একটা অপশনাল সাবজেক্ট করতে গিয়ে, অ্যানথ্রোপোলোজি নিয়েছিলাম, এমন মজার সাবজেক্ট , পড়তে গিয়ে এত উৎসাহ পেতাম তা বলার মত না, ওইখানেই আমাদের করতে হয়েছিল মার্কস আর এঙ্গেলস এর কমিউনিস্ট মেনিফেস্টোর কিছু বিষয়ের সাথে অমর্ত্য সেনের দারিদ্র বিষয়ক তত্ত্বের তুলনা, বৈষম্য আর সমাধানের একটা রিসার্চ । মাথার পোকা নড়ে গিয়েছিল, তবে অনেক মজা পেয়েছিলাম ।
-----------------------------------------
রাজামশাই বলে উঠলেন, 'পক্ষীরাজ যদি হবে, তা হলে ন্যাজ নেই কেন?'
-----------------------------------------------
'..দ্রিমুই য্রখ্রন ত্রখ্রন স্রবট্রাত্রেই দ্রিমু!'
অ্যানথ্রোপলজি পড়তে পারি নাই আফসোস!
মনে হয় তবু স্বপ্ন থেকে জেগে
মানুষের মুখচ্ছবি দেখি বাতি জ্বেলে
হাঁটাপথে আমরা এসেছি তোমার কিনারে। হে সভ্যতা! আমরা সাতভাই হাঁটার নীচে চোখ ফেলে ফেলে খুঁজতে এসেছি চম্পাকে। মাতৃকাচিহ্ন কপালে নিয়ে আমরা এসেছি এই বিপাকে_পরিণামে।
শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করছি কার্ল মার্কসকে।শুভ জন্মদিন।
-নিরিবিলি
' It sure rains on our parade
But the wind will change the clouds will fade
A change will come eventually
So says Karl Marx and history '
----x----
...অথবা সময় ছিলো;আমারই অস্তিত্ব ছিলোনা
-------------------------------------
জীবনযাপনে আজ যতো ক্লান্তি থাক,
বেঁচে থাকা শ্লাঘনীয় তবু ।।
বিনা চিকিতসায় পুত্রের মৃত্যু দেখা, দাফনের টাকা যোগাড় করতে না পারা ব্যর্থ পিতা; বিশ্বের শ্রমজীবী মানুষের মহান পিতা কার্ল মার্কস। জন্মদিনে তাঁকে স্মরি। (কপিরাইট @ফারুক )
নুরুজ্জামান মানিক
*******************************************
বলে এক আর করে আর এক যারা
তারাই প্রচণ্ড বাঁচা বেঁচে আছে দাপটে হরষে
এই প্রতারক কালে (মুজিব মেহদী)
শ্রদ্ধা
ঠিকাসে।
আবার লিখবো হয়তো কোন দিন
নিলে কিন্তু অশেষ ফজিলত আছে....
মনে হয় তবু স্বপ্ন থেকে জেগে
মানুষের মুখচ্ছবি দেখি বাতি জ্বেলে
হাঁটাপথে আমরা এসেছি তোমার কিনারে। হে সভ্যতা! আমরা সাতভাই হাঁটার নীচে চোখ ফেলে ফেলে খুঁজতে এসেছি চম্পাকে। মাতৃকাচিহ্ন কপালে নিয়ে আমরা এসেছি এই বিপাকে_পরিণামে।
.
বিস্ময় আজো গেলো না আমার,
স্বপ্নে এখনো যৌথ খামার।...
আমাদের চিন্তাই আমাদের আগামী: গৌতম বুদ্ধ
একটা ঘাড় ভাঙা ঘোড়া, উঠে দাঁড়ালো
একটা পাখ ভাঙা পাখি, উড়াল দিলো...
নতুন মন্তব্য করুন