মধ্যবিত্ত সমাচার : কী আনন্দ আত্মপ্রেমে

ফারুক ওয়াসিফ এর ছবি
লিখেছেন ফারুক ওয়াসিফ (তারিখ: রবি, ০৩/০৮/২০০৮ - ১:৫২অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

কারা মধ্যবিত্তকে গালি দেয়? উচ্চ-নিম্নরাই বেশি দেয়। মধ্যবিত্ত এমন চিজ, নিজেকে গালি না দিলে তারও ভাত রোচে না। ফলে সে গালি খায়। উচ্চদের এদের দিয়েই কাজ করাতে হয় আর নিম্নদের এদের মাধ্যমেই এবং এদের সঙ্গে কষাকষি করেই আদায় করতে হয়। কিন্তু মধ্য যেহেতু উচ্চগামী এবং মনের দিক থেকে উচ্চবাসী, সেহেতু সে উচ্চের দালালি করে আর নিম্নকে পায়ে ঠেলে সরিয়ে রাখে।

বহু বছর আগে বঙ্গিমচন্দ্র চট্টপাধ্যায় এদের সনাক্ত করেছিলেন এভাবে, যে টেবিলে খায়, চোঙ্গা পড়ে, কমোডে হাগে আর কাগজে মোছে; সে-ই বাবু। অন্যত্র বলেছিলেন, 'যে পিতার কাছে ভক্তিবাদী, ইয়ং বেঙ্গলের কাছে বিদ্রোহী, যে ভিখারির কাছে নাস্তিক বামুনের সামনে ধর্মচারি, যে স্ত্রীর কাছে বীর আর সাহেবের সামনে নতজানু...সেই বাবু। সেই বাবুরাই আজকের যুগে মধ্যবিত্ত। কাজে কাজেই এই লেখকও তাদেরই একজনা হয়ে আত্মচরিত ঘাঁটা মনস্থ করেছেন।
মধ্যবিত্তরাই শাসন-উতপাদনের প্রধান খুঁটি, এদের ছাড়া কোনো শাসনেই জনগণের সম্মতি (হেজিমনি) আদায়ে সমর্থ হয় না, উতপাদন ব্যবস্থা চলে না। এটা গালি নয়, এটাই মধ্যবিত্তের ঐতিহাসিক ভূমিকা। এই ভূমিকার সমালোচনা না করলে কি মধ্যশ্রেণীর ভাঙ্গনকে ত্বরান্বিত করে তার উত্তরণ ঘটানো যাবে? সেখান থেকে অগ্রসর মানুষ বেরিয়ে এসে যোগ দেবে নিম্নদের কাতারে?

কিন্তু আমরা জানি, সব বিপ্লবই আবার এদের মাধ্যমেই বিপথগামী হয়েছে। এরা নিজেদের সংস্কৃতির মধ্যে লুকিয়ে রাখা শ্রেণীবাসনা দিয়ে আবার নিজেদের আদুরে দশাকে ফিরিয়ে আনতে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। সেকারণেও তারা গালির লক্ষ্যবস্তু হয়েছে। বাংলাদেশে একাত্তরের পর স্বাধীনতার দুধ-মধু খেয়ে বিশ্বাসঘাতকতা কে করেছে? আ লীগ মধ্যবিত্তের দল হিসাবে মধ্যশ্রেণীরই তো ক্ষমতায়ন ঘটিয়েছিল। এরাই পরে সেনা আমলে করে-কর্মে খেয়েছে। এরাই তো যুদ্ধাপরাধীদের সমাজ-অর্থনীতি ও রাজনীতির অংশিতে পুনঃপ্রতিষ্ঠা দিয়েছে। এরাই তো নয়া উপনিবেশবাদ ও আধুনিক সাম্রাজ্যবাদের বাহন এনজিওগুলো তৈরি করেছে। এদের এই ভূমিকা সনাক্ত না করে আমাদের জাতীয় দুরবস্থার যথার্থ ডায়াগনসিস সম্ভব নয়।

হ্যাঁ এতদিন যে মধ্যবিত্তকে আমরা দেখতাম, জাতীয় রাষ্ট্রের অবসানের তালে তালে সেই আদর্শবাদী খোলসে ঢাকা সুবিধাবাদী জাতীয় মধ্যবিত্তের দিন শেষ। এদের নিয়ে বিশ্লেষণ যা পাওয়া যায়, তা ষাট দশকের বিম্লেষণ। নয়া সাম্রাজ্যবাদী আন্তর্জাতিকতা, লগ্নি পুঁজির অবাধ যাতায়াত, কর্পোরেট বিশ্বায়ন এবং গ্লোবাল মিডিয়ার কল্যাণে সে এখন আন্তর্জাতিকায়িত হয়েছে। এদের চালচলন ভিন্ন, এদের আচার-বিশ্বাস ভিন্ন। সাবেকি দৃষ্টিতে এরা অনেক প্রগতিশীল_এরা নারী বৈষম্যের বিরুদ্ধে, এরা প্রায় নাস্তিক, এরা অতি দেশীয়পনার গ্রাম্যতামুক্ত, এরা সমগ্র বিশ্বকেই নিজের বিহারস্থল মনে করে (পর্যটন ব্যবসা), এরা কোনো রাজনৈতিক কর্তৃপক্ষের প্রতি বিশ্বস্ততা দেখায় না (সিভিল সোসাইটি); এবং এরাই নারীর পণ্যায়ন এবং যৌনতাকে সামাজিক বলয়ে বিক্রিযোগ্য করে হাজির করে বা তা ভোগ করে। এরা ঈশ্বরের স্থানে কর্পোরেট পুঁজিকে বসায়, এরা দেশ-রাষ্ট্রের জায়গায় সাম্রাজ্যের নাগরিক হয়, এরা খাল কেটে গ্রামে কুমীর আনে (এনজিও-কর্পোরেট)। এটুকু যা বললাম এগুলো লক্ষণ, তবে গুণের দিক থেকে এর বাইরেও অনেকে আছেন দেশে ও বিদেশে। সেটা অন্য প্রসঙ্গ।

ফলে সাবেকি মধ্যবিত্ত না থাকলেও আরো প্রকট বিশ্বায়িত মধ্যবিত্ত রয়েছে প্রবলভাবেই। বাংলাদেশে এরা আর দেশ নিয়ে ভাবে না, বিদেশে স্থায়ি আবাস করা নিয়ে চিন্তা করে। এতে দোষ নাই, কিন্তু এটাই যখন তার সংস্কৃতি ও রাজনীতিকে নির্মাণ করে, তখন তা জাতীয় দুরবস্থার বিচারে দোষণীয় বৈকি। এরা ঠিক সেই ভূমিকাই পালন করছে, একদা যা তারা ইংরেজ শাসনের সুবিধাভোগী হিসাবে এবং কোলাবরেটরের ভূমিকায় পালন করেছিল। হালে কেবল নাম আর পদবিগুলো পাল্টেছে।

আর তলায় যারা সাবেকি মধ্যবিত্তের মানসিকতা নিয়ে স্ববিরোধী সংষ্কৃতির (বিত্তে নিম্ন কিন্তু আকাঙক্ষায় মধ্য) মধ্যে আটক তারা ক্ষয়িষ্ণু। এই স্ববিরোধীতা জন্ম নিচ্ছে বাসনার দিগন্তে। যা বিশ্বায়িত মধ্যবিত্তের মধ্যেও দেখা যাবে। সে মধ্য হলেও উচ্চের মত হওয়ার সাধনা করে যায়, কেউ কেউ হয়ও। এই কেউ কেউ একটা ছদ্মচেতনার জন্ম দেয় যে, শ্রেণী উত্তরণ সম্ভব। কিন্তু শ্রেণীগতভাবে নিম্ন মধ্য আর মধ্যের উচ্চে পরিণত হতে হলে গোটা ব্যবস্থাকেই বদলে ফেলতে হয়। তা তো সম্ভব নয়, ফলে একটা ফ্যালাসি মধ্যবিত্তের স্বপ্নকে গাইড করে তার প্রতিক্রিয়াশীলতাকেই আরো বাড়ায়।
এখন নতুন একটা ব্যাপার দেখা যাচ্ছে, শ্রেণীর সীমান্ত আবছা হচ্ছে এবং কে যে কোন বর্গে তার ভেদাভেদ একটা কুহেলিকায় পর্যবেশিত হচ্ছে। অনেকটা সুকুমার রায়ের গেছো দাদার মতো, সে যে কখন কোথায় থাকবে তার ঠিক নাই। আগে উপনিবেশিক শাসকশ্রেণীর আধিপত্য বজায় থাকতো বলপ্রয়োগের ক্ষমতায়, যাকে বলা হতো ডমিন্যান্স। শাসিতদের মধ্যে শাসকশ্রেণীর মতাদর্শ প্রোথিত করার সুযোগ তার ছিল না। বেশিরভাগ মানুষ শাসিত হলেও সাংস্কৃতিকভাবে শাসনব্যবস্থা থেকে দূরত্ব রাখতো এবং তাকে 'অপর' বলে ভাবতো। কিন্তু শিক্ষা-মিডিয়ার ওয়াজমাহফিল-এনজিওর প্রচারণা এবং সর্বোপরি কালচার ইন্ডাস্ট্রির পণ্যবাহিত আদর্শিক বটিকা সেবনে (ফেয়ার এন্ড লাভলি থেকে শুরু করে মোবাইলের স্বাধীনতা আর ক্ষুদ্রঋণে মুক্তির যুক্তি) তার মধ্যে মতাদর্শিক আধিপত্য বিস্তার করা সম্ভব হয়েছে। ইতিহাসে এই প্রথম আমাদের মতো উপনিবেশিক দেশে ডমিন্যান্স সাংস্কৃতিকভাবে নিজেকে গ্রহণীয় করার মতো ব্রেনওয়াশ করতে সক্ষম হয়েছে। ডমিন্যান্স এখন হেজমিনি দিয়ে কাজ সারছে।

এ অবস্থায় যদি বস্তিবাসী কানিজ আলমাসের বিউটি পার্লারে না গিয়েও ফেয়ার অ্যান্ড লাভলি মেখে কিংবা ছোকরা শ্রমিক জিন্স পরে, কিংবা সিনেমায় দেখা কায়দায় প্রেমের বাসনা রেখে নব্য-বাহারি সংষ্কৃতির খাতক হয়, তাহলে কি তার শ্রেণী চরিত্রই বদলে যায়? বা তার শ্রেণী উত্তরণ ঘটে? ঘটে না, বরং সে যে আরো বশীভূত হলো অর্থাত তার ওপর হেজিমনি আরোপ করা গেল, তারই প্রমাণ মেলে।
ট্রানজিশনের সময় শ্রেণীর গাঠনিক সীমানা আর সাংস্কৃতিক সীমানা যে আবছা হয়ে যায় এবং তা যে ওভারল্যাপ করে তা খেয়াল করা জরুরি। নইলে আন্ধারে ঢিল ছোঁড়ার ব্যাপার ঘটতে পারে, এ বিষয়ে আমি একমত। এবং নিজেদের ভূমিকা নিয়েও বিভ্রান্তি আসতে পারে।

এটা উপনিবেশিক দেশে আরো বেশি করে সত্য। রাষ্ট্র ও অর্থনীতি যখন উপনিবেশিক গড়নে চলে, তখন তার ভেতরকার সকল সম্পর্কই আসলে উপেনেবিশিক হায়ারার্কির সম্পর্ক। জাতির সঙ্গে শ্রেণীর বিচ্ছিন্নতা এবং শ্রেণীর সঙ্গে গোষ্ঠীর দূরত্বের সম্পর্ক মোটা দাগে সমান নাগরিকদের মধ্যে সম্পর্ক না, বরং আধিপত্য বনাম বশ্যতার সম্পর্ক। মধ্যবিত্ত এই সম্পর্কের পূজারি ও পুনরুতপাদক। কিন্তু একটি রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে আত্মসক্ষম দেশের মধ্যবিত্তবে এরকম পরজীবীতা করতে হয় না, ইউরোপে তেমন দৃষ্ঠান্ত রয়েছে, রুশ বা চিন বিপ্লবেও তা দেখা গেছে। খেয়াল করলে দেখা যাবে, উপনিবেশিক দেশে এরকমটা ঘটেনি এবং এরকম কোথাও বিপ্লবও আসেনি মধ্যবিত্তের প্রতিবিপ্লবী চরিত্রের কারণে। আমরা বোধহয় সেই দলে পড়ি। ফলে আমাদের শ্রেণীবিশ্লেষণ আসলে আত্মবিশ্লেষণ। এবং তার মাধ্যমে যদি আমরা আমাদের চেতনার উপনিবেশায়ন ঘটাতে না পারি, তাহলে জাতীয় মুক্তির লড়াইয়ে আমাদের দেখা যাবে গণশত্রুদের কাতারে। অনেক ভাল মানুষেরও এমন পরিণতি হয়েছে। অথচ তাদের জনগণের লোকই হবার কথা।

এই মুক্ত হবার প্রক্রিয়াকে আমি বলতে চাই ডিকলোনাইজেশন। ফ্রাঞ্জ ফ্যানো এটা বলেছিলেন, মার্কস যাকে ডিক্লাসমেন্ট বলেছেন, আমাদের এখানে তা ডিকলোনাইজেশনের ধাপে আছে। আমি মনে করি, মাওলানা ভাসানী, সুলতান, আহমদ ছফা, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, আরজ আলী মাতুব্বর এরকম ডিকলোনাইজড হওয়ার সংগ্রাম চালিয়েছিলেন যার যার ক্ষেত্রে। আর লালনের তা করার প্রয়োজন ছিল না, কারণ রবীন্দ্রনাথের মতো তাঁকে কালোনাইজেশনের খপ্পরে পড়তে হয়নি। কলোনির ঘাঁটি তখনো নদীয়ায় হানা দেয়নি, কৃষক সংস্কৃতিকে তখনও তা পরাভূত করেনি। লালন সেই কৃষক সমাজের শেষ দার্শনিক বিপ্লবী। তার সমস্যা অন্য, তিনি আধুনিক বস্তবিশ্ব এবং তার রাজনীতিকে চৈতন্যের সংকট দিয়ে বুঝেছিলেন, অর্থনীতি-রাজনীতি দিয়ে বোঝেননি। কিন্তু যতটা বুঝেছেন ,তাও আমাদের পথ দেখায়।

কলোনাইজেশন যদি মানি, তাহলে এ থেকে মুক্ত হতে ডিকলোনাইজেশনও মানতে হয়। এই ডিকলোনাইজেশনকে এভাবে বলা যায়, যে শিক্ষা-সংস্কৃতি-মূল্যবোধ ও অর্থনৈতিক জীবনে আমাদের স্ক্রুর মতো পেঁচিয়ে ঢোকানো হয়েছে সিস্টেমের তক্তায়, তাকে আবার উল্টা পেঁচে খুলে এনে অন্য জায়াগায় প্রোথিত করা। সেটা দেশের ইতিহাস--ভাষা-সংষ্কৃতি ও অর্থনীতি এবং জনস্বার্থের পাটাতনে দাঁড়ানো বৈশ্বিকতা। আমরা যতটা বৈশ্বিক হতে চাই ততটাই দেশের হৃদয়ে প্রবেশ করতে যে চাই না, একে পরজীবীতা ছাড়া আর কি বলা যায়? আমরা মধ্যবিত্তরা আধুনিকতার নামে, বিপ্লবের নামে, প্রগতির নামে আর এখন উন্নয়নের নামে যতবারই জনগণকে মুক্ত করার নামে যতবারই ডাক দিয়েছি, আমরা ততবারই ভুলে গেছি আমাদের নিজেদেরই মুক্ত করা হয়েছে কিনা চৈতন্যের মধ্যে, স্বার্থবোধের মধ্যে। মার্কস বলেছিলেন, যে মুক্তি অপরকে মুক্তি দেবে, সে নিজেই মুক্ত কিনা তা আগে দেখা দরকার। আমরা যদি জনগণকে মুক্ত করতে চাই-ই (যদিও আমি বিশ্বাস করি, কেউ কাউকে মুক্ত করে না, মুক্তির সহযাত্রী হয় মাত্র) তাহলে তার আগে আমাদেরকেই চেতনার দাসত্ব আর গণবিরোধী প্রবণতা থেকে মুক্ত হতে হবে। নচেত, ইতিহাসে আমরা দালালের ভূমিকায় নিজেদের সনাক্ত হতে দেখব, যেভাবে চিরস্থায়ি বন্দোবস্তের জমিদারি পুষ্ট মধ্যশ্রেণীকে আজ দেখা হয়।

ফকির লালন সাঁই তাই আমাদের জানান,
শব্দের ঘরে নৈঃশব্দ করে, সদাই তারা আছে জুইড়ে
দিয়ে জীবের নজরে ঘোর টাটি, ও মিছে ঘোর টাটি
পরের হাতে কলকাঠি।।

আপন ঘরে পরের সংসার,
আমি দেখলাম না রে তার বাড়িঘর।
আমি বেহুশ মুটে, তার মোট বাহি,
ও তার মোট বাহি
পরের হাতে কলকাঠি।।

আত্মপ্রেমের অবসানে আমরা তাই সত্যকে পাই। আর সত্য যে কঠিন এবং তাকে ভাল না বেসে উপায় কি?


মন্তব্য

কীর্তিনাশা এর ছবি

এক নিঃশ্বাসে পড়লাম এবং আরো পড়ার আগ্রহ জাগলো।
-------------------------------
আকালের স্রোতে ভেসে চলি নিশাচর।

-------------------------------
আকালের স্রোতে ভেসে চলি নিশাচর।

জুলিয়ান সিদ্দিকী এর ছবি

উদ্ধৃতি
আমাদের শ্রেণীবিশ্লেষণ আসলে আত্মবিশ্লেষণ।
ঠিক!
তবে আমি কোনো বিত্তের দলে পড়ি না। আমার টিচার নাজমা আপা বলেছিলেন যে, আমি বিত্তহীনের দলে পড়ি। দেঁতো হাসি
____________________________________
ব্যাকুল প্রত্যাশা উর্ধমুখী; হয়তো বা কেটে যাবে মেঘ।
দূর হবে শকুনের ছাঁয়া। কাটাবে আঁধার আমাদের ঘোলা চোখ
আলোকের উদ্ভাসনে; হবে পুন: পল্লবীত বিশুষ্ক বৃক্ষের ডাল।

___________________________
লাইগ্যা থাকিস, ছাড়িস না!

ফারুক ওয়াসিফ এর ছবি

হ্যাঁ, বেচারা মধ্যবিত্ত! দিনে চঁওতিরিশবার আয়নায় মুখ দেখার পরও সে টের পায় না যে, সে বেচারা মধ্যবিত্ত!

হাঁটাপথে আমরা এসেছি তোমার কিনারে। হে সভ্যতা! আমরা সাতভাই হাঁটার নীচে চোখ ফেলে ফেলে খুঁজতে এসেছি চম্পাকে। মাতৃকাচিহ্ন কপালে নিয়ে আমরা এসেছি এই বিপাকে_পরিণামে।

কীর্তিনাশা এর ছবি

আপনার এই মন্তব্যেও আপনি পাঁচতারার দাবিদার। খুব খাঁটি কথা বলেছেন, বড় নির্দয়ভাবে।
-------------------------------
আকালের স্রোতে ভেসে চলি নিশাচর।

-------------------------------
আকালের স্রোতে ভেসে চলি নিশাচর।

ফারুক ওয়াসিফ এর ছবি

নিজেদের ছাড়া আর কার প্রতি নির্দয় হবার অধিকার রেখেছে মধ্যবিত্ত? রাখেনি! তাই তাকে এটা সইতেই হয়। সে সয় এবং অক্ষত রয়।

হাঁটাপথে আমরা এসেছি তোমার কিনারে। হে সভ্যতা! আমরা সাতভাই হাঁটার নীচে চোখ ফেলে ফেলে খুঁজতে এসেছি চম্পাকে। মাতৃকাচিহ্ন কপালে নিয়ে আমরা এসেছি এই বিপাকে_পরিণামে।

মাহবুব লীলেন এর ছবি

মধ্যে মধ্যে যে বিত্তবান হবার স্বপ্ন দেখে আর মধ্যে মধ্যে যে বিত্তহীনতার আশংকায় ভোগে
সেই মধ্যবিত্ত

বাঘ নাই বনে শিয়াল রাজা
আর সুন্দরবনে লেজগুটানো খাটাস

ফারুক ওয়াসিফ এর ছবি

এইটা সুন্দর বলেছেন, বাংলাদেশে ধনিক শ্রেণী ছিল না বলে মধ্যবিত্তই নিজেকে শাসক ভেবে শুরু করে এখন ধনিকের জায়গা নিয়েছে। ততদিনে আরকেদল লাইনে এসে দাঁড়িয়েছে।

হাঁটাপথে আমরা এসেছি তোমার কিনারে। হে সভ্যতা! আমরা সাতভাই হাঁটার নীচে চোখ ফেলে ফেলে খুঁজতে এসেছি চম্পাকে। মাতৃকাচিহ্ন কপালে নিয়ে আমরা এসেছি এই বিপাকে_পরিণামে।

স্নিগ্ধা এর ছবি

ফলে সাবেকি মধ্যবিত্ত না থাকলেও আরো প্রকট বিশ্বায়িত মধ্যবিত্ত রয়েছে প্রবলভাবেই।

এত গুছিয়ে বলতে পারি নি, কিন্তু ঠিক এটাই বলতে চেয়েছিলাম!

ফারুক ওয়াসিফ এর ছবি

আমি তো এক টানে বলে ফেললাম, কিন্তু বিষয়টার যথাযথ বিশ্লেষণের একটা নির্যাস আলোচনা এগিয়ে নেয়ার স্বার্থেই হাজির করা দরকার।
যেমন কেউ এই বিশ্বায়িত মধ্যবিত্তকে মোবাইল সিটিজেন বলেছেন। আবার অরূন্ধতি রায় ও আশীষ নন্দী এদেরকে ভোগতাড়িত ফ্যাসিস্ট মনোভাবান্নও বলতে কসুর করেননি। এরা নিজেদের অনেক ক্ষেত্রে সিভিল সোসাইটি বলে থাকে। এসবাই পলেমিকাল ভাষা, কিন্তু বিশ্লেষণের ভাষায় কী বলবো?

৩০-৬০ এর মধ্যবিত্ত অনেক বড় সামাজিক আন্দোলন করেছিল। ৫২-৭১ পর্যন্ত এদের একটা বিকাশ দেখা গিয়েছিল বাংলাদেশে। নব্বই-এর পর এরা সব অর্থেই নির্বীর্য হয়ে সাম্রাজ্যবাদের খপ্পরে ঢুকেছে। এটা করতে গিয়ে এরা বদলে নাম নিয়েছে সিভিল সোসাইটি। ১/১১ এর আগে পরে এদের পঞ্চম বাহিনীগিরি করতে দেখা গেল। অথচ তাদের আগের ধারা যারা প্রকৃতই নাগরিক সমাজ ছিল এবং যারা রাজনৈতিক দলগুলোর থেকে এগিয়ে ৫২-৬৯-৭১ এ ভূমিকা রেখেছিল, এরা আবার কীভাবে পরাশক্তির দোসর হলো সেই প্রক্রিয়ার মধ্যেই আজকের বাংলাদেশি মধ্যবিত্তের উদ্ভব ও বিলয়ের কাহিনী পাওয়া যাবে আশা করি।
ধন্যবাদ আপনাকে।

হাঁটাপথে আমরা এসেছি তোমার কিনারে। হে সভ্যতা! আমরা সাতভাই হাঁটার নীচে চোখ ফেলে ফেলে খুঁজতে এসেছি চম্পাকে। মাতৃকাচিহ্ন কপালে নিয়ে আমরা এসেছি এই বিপাকে_পরিণামে।

রাফি এর ছবি

এই আলোচনায় ঢুকার আগে সিদ্ধান্ত নিতে হবে আমি কোন বিত্ত?
চিন্তায় পড়ে গেলাম...।

---------------------------------------
আমি সব দেবতারে ছেড়ে
আমার প্রাণের কাছে চলে আসি,
বলি আমি এই হৃদয়েরে;
সে কেন জলের মতন ঘুরে ঘুরে একা কথা কয়!

---------------------------------------
আমি সব দেবতারে ছেড়ে
আমার প্রাণের কাছে চলে আসি,
বলি আমি এই হৃদয়েরে;
সে কেন জলের মতন ঘুরে ঘুরে একা কথা কয়!

ফারুক ওয়াসিফ এর ছবি

আমি নিজেরে মধ্যবিত্ত সনাক্ত করার পরই লিখতে বসছি।
চিন্তা তো আছেই...তবে আপাতত ব্লগবিত্ত ভাবতে পারেন। এখানে আমরা সবাই সমান, মানে মধ্যবিত্তরা। যাদের ব্লগাকসেস আছে।

হাঁটাপথে আমরা এসেছি তোমার কিনারে। হে সভ্যতা! আমরা সাতভাই হাঁটার নীচে চোখ ফেলে ফেলে খুঁজতে এসেছি চম্পাকে। মাতৃকাচিহ্ন কপালে নিয়ে আমরা এসেছি এই বিপাকে_পরিণামে।

সুলতানা পারভীন শিমুল এর ছবি

আমিও যে মধ্যবিত্ত !
আমি কি "হায়" বলবো?

...........................

সংশোধনহীন স্বপ্ন দেখার স্বপ্ন দেখি একদিন

...........................

একটি নিমেষ ধরতে চেয়ে আমার এমন কাঙালপনা

ইশতিয়াক রউফ এর ছবি

মধ্যবিত্ত আমিও। মধ্যপন্থাটুকু রেখে বিত্তের অংশটুকু বাড়ানোর স্বপ্ন দেখি আমিও। লেখাটা ভাল লেগেছে। সহমত দেখেই হয়তো বলার মত কথা কম। বিশেষ করে ভাল লেগেছে বৈশ্বিক মধ্যবিত্ত আর ডিক্লাসমেন্ট-ডিকলোনাইজেশন এর অংশ দুটো। ৯০'এর পর থেকে বাঙালি মধ্যবিত্তের নিম্নগতির পেছনে কারণ কী কী, সেটা আমার কাছেও চিন্তার বিষয়।


রাজাকার রাজা কার?
এক ভাগ তুমি আর তিন ভাগ আমার!

মুজিব মেহদী এর ছবি

বেশি বেশি স্বপ্নওয়ালা অবদমনের ভারে কাবুরাই মধ্যবিত্ত।
এরা চুরি করলেও ধরা খায়, ধর্ষণ করলেও। সামলাতে পারে না।
এঁরা অনেক নিলাজের মতো কাজ করে, আবার লজ্জার ভাণও করে বেশি।
এঁরা ঝাঁপ দেবে বলে নদীর কাছে যায়, আবার এদিক-ওদিক তাকিয়ে ফিরে আসে।
এঁরা কোনো জাতেরই না (না-জাত)।

আচ্ছা ফারুক ভাই, বাংলাদেশের মিডিয়ায় যাঁরা ডাকসাইটে সংবাদকর্মী হিসেবে কাজ করেন, তাঁরা তো আমার-আপনার মতোই মধ্যবিত্ত জানি, কিন্তু এখানকার মিডিয়ার মালিকরা কি সবাই উচ্চবিত্তদের জাতে পড়ে, নাকি এঁরাও এখনো আমাদের দলেরই? সুনির্দিষ্টভাবে আমার প্রশ্ন হলো, টাকার মাপে যদি হিসেব করা যায় তাহলে কত টাকার মালিক হলে বা মাসে কত টাকা উপার্জন করলে তাঁকে আপনি উচ্চবিত্ত ক্লাসে প্রমোশন দেবেন?
প্রশ্নের ধরন দেখে হাসবেন না প্লিজ! স্রেফ জানার আগ্রহ থেকেই প্রশ্নটা করা।
................................................................
জেতা মৎস্য গিলে বকে মনুষ্য খায় বাঘ-ভালুকে
রহস্য বোঝে না লোকে কেবল বলে জয়।
(দীন দ্বিজদাস)

... ... ... ... ... ... ... ... ... ... ... ... ... ... ... ... ... ...
কচুরিপানার নিচে জেগে থাকে ক্রন্দনশীলা সব নদী

সবজান্তা এর ছবি

ফারুক ভাই এই চমৎকার লেখাটা আমার লেখার সূত্র ধরেই লিখলেন ? যদি তাই হয়ে থাকে তবে তো একটা চমৎকার লেখার পেছনে আমার নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে চোখ টিপি

লেখাটা দারুন হয়েছে, মনের কথা সব বলে দিয়েছেন।


অলমিতি বিস্তারেণ

ফারুক ওয়াসিফ এর ছবি

জ্বি, ভাই আপনার উত্থাপনেই নিদ্রা ভঙ্গ হইয়াছে, এই অর্থে আপনি উদগাতা, অর্থাত যিনি যজ্ঞে হোম দিয়ে মন্ত্রকে জাগান। অতএব আপনি পুরোহিত মহাশয়!

হাঁটাপথে আমরা এসেছি তোমার কিনারে। হে সভ্যতা! আমরা সাতভাই হাঁটার নীচে চোখ ফেলে ফেলে খুঁজতে এসেছি চম্পাকে। মাতৃকাচিহ্ন কপালে নিয়ে আমরা এসেছি এই বিপাকে_পরিণামে।

স্নিগ্ধা এর ছবি

ফারুক ওয়াসিফ - আমার মুশকিলটা কি জানেন? এখন আমার কাছে সব সীমানাই এত ব্লাড়ড বা আবছা হয়ে গ্যাছে, যে ইদানিং কোন কিছু নিশ্চিত করে নির্দেশ করতে গেলে কেমন যেন দ্বিধায় ভুগি। মধ্যবিত্তের কথাই ধরি - সাম্রাজ্যবাদ বা কর্পোরেট বিধাতার প্রতিনিধিত্ব করার বেলায় মধ্যবিত্তের সিংহভাগ সেটা করে সত্যি, আবার তার প্রতিবাদও উঠে আসে সেখান থেকেই। এমনকি নিম্নবিত্তের ক্ষেত্রেও এই প্রতিনিধিত্ব কিন্তু সমানভাবে সক্রিয়। নিম্নবিত্তের এক অংশ এন জি ও বা ক্ষুদ্র পূঁজিবাদীত্বের আঁচে নিজেদের সেঁকে নেয় তো। আসলে বোধহয় পাওয়ার স্পেক্ট্রামের যেখানে যার অবস্থান, সেখান থেকে সে তার নিকট ভবিষ্যতকে মসৃণ করার জন্য যা যা করা দরকার করে যায়। এটাই আজকের পৃথিবীর বাস্তবতা। আর সুদূর ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে বর্তমানকে আকার দিতে চাইলে অর্থাৎ ভিশনারী হতে গেলে যে মনন ক্ষমতা আর চিন্তাশীলতা দরকার, তা নিম্নবিত্তের মধ্যে এখন কি আর থাকা সম্ভব? তৃণমূল পর্যায়ে সচেতনতার যে সংস্কৃতি বছর বিশেক আগেও ছিলো, কোথায় গেলো তা?

ভোগবাদী ফ্যাসী মনোভাবাপন্ন তো বটেই, কিন্তু আমার কথা হচ্ছে সেটা এখন আর কেবল উচ্চ আর মধ্যবিত্তের বৈশিষ্ট্য হয়ে নেই, "সে আগুন ছড়িয়ে গেলো সবখানে"!

এমনকি জাতীয়তাবাদের কথাই ধরুন না, অথবা ভাষা? সেগুলোও কিন্তু হতে পারে একধরনের রিগ্রেসিভ ফোর্স - যেমন ধর্ম, যেমন চামড়ার রঙ। অথচ একসময় আমাদের সামনে দেশ আর ভাষাকে ভালোবাসার মত চালিকাশক্তি না থাকলে, আজকে ডাব্‌ল কলোনাইযেশন এর যাঁতাকলেই আমরা আটকা থাকতাম। আমাদের এত গর্বের ৫২, ৭১ কিছুই থাকতো না! তাহলে?

তাহলে কি এটাই যে, কোন বিশ্বাস বা মূল্যবোধ কি ভাবে ইতিহাসে কি ভূমিকা রাখবে - নির্যাতনের না নির্যাতিতের, সেটা নির্ভর করে সে বিশ্বাসগুলো 'কোন সময়ে', 'কোন প্রেক্ষাপটে', বিশ্ব রাজনীতির 'কোন পর্যায়ে' আমাদের প্রভাবিত করছে?

আর, তাই যদি হবে - তাহলে এবসল্যুট বলে তো আর কিছুই থাকে না। মধ্যবিত্ত মূল্যবোধও না, ফ্যাসিবাদের সহকারী হওয়াও না, সংগ্রামও না, বিপ্লবও না! তাহলে অতঃ কিম??

তবে, এ ব্যাপারে আপনার পড়াশোনা আমার চাইতে বেশী - অতএব আপনিই আমার এই ডাইলেমার ভালো উত্তর দিতে পারবেন বলে মনে হয়।

ফারুক ওয়াসিফ এর ছবি

ইতির সঙ্গেই নেতির জন্ম, তেমনি মধ্যবিত্তের যে নেতিবাচক রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ভূমিকা বৃহত্তর জনগণের সাপেক্ষে তার ইতিবাচক দিকটাও চুলের বেণীর মতো জড়াজড়ি করে থাকে। এই দুই এক দেহ এক অঙ্গ হয়ে থাকে বলে প্রবণতায় এদের পৃথক দেখা গেলেও, বাস্তবে এক সময়ে একটা ধারাই প্রাধান্য পায়। অতীতে যদি ইতি প্রাধান্য পেয়ে থাকে, তার মধ্যেও নেতির বীজ ছিল এবং এখন তা মহীরুহে পরিণত হয়েছে।

মধ্যবিত্ত মানসিকতা যদি থিসিস হয়, তার অ্যান্টিথিসিস হয়তো শ্রেণী উত্তরণের মানসিকতাজাত আত্মসমালোচনা, কিন্তু ইতিহাস এ দুইকে ট্রানসেন্ড করে নিয়ে নতুন শ্রেণীগঠন ঘটাতে পারে। সমালোচনার পরে তাই আবারো আলোচনা শুরু হয়। কিন্তু আমাদের দেশে বা বিশ্বে তার ইঙ্গিত খুবই ক্ষীণ।

সমাজে শ্রেণীর প্রান্তদেশ সবসময়ই কিছুটা ফিকেই থাকে। সেকারণে শ্রেণীবিচার সুষ্ঠু ভাবে করা কঠিন। আমি যে পুরো বুঝেছি তা নয়। লেখাটা হালকা চালেই শুরু করেছিলাম। এখন ভাবিত হচ্ছি। প্রথমত ইকনমিক অবস্থান আর কালচারাল ভ্যালুজের ডাইকোটমির মধ্যে একটা সুরাহা করা যায় যদি দুটোকেই গুরুত্ব দিই। কেবল বিত্ত নয়, কেবল চেতনা নয়। তবে বিত্ত উচ্চকে উচ্চবিত্ত করার পাশাপাশি তার মানসিকতারও পরিবর্তন ঘটাতে থাকে। বাংলাদেশে গত এক দশকে বিপুল সংখ্যক লোক নিম্নবিত্ত থেকে উচ্চবিত্তে পরিণত হয়েছে আবার তার থেকে বেশি লোক নিচে নেমে গেছে। আবার সাবেকি জাতীয় মধ্যবিত্ত যে আগের জায়গায় নাই তা স্পষ্ট। একসময় যে ভাষা-দেশ-সংস্কৃতি নিয়ে তারা গর্ব বোধ করতো বা এসবের জন্য লড়াই করতো, সেই জায়গা থেকে তারা সরে যাওয়ায়, তাদের দ্বারা ওরকম লড়াই আর সম্ভব নয়। সে কারণে মধ্যবিত্ত জাতীয়তাবাদ যদি একসময় সুফল দিয়েও থাকে, এখন তা অকেজো। অনেকটা ঔষধি বৃক্ষের মতো, একবার ফল দিয়েই মরে গেছে।
তাই ঠিকই বলেছেন, অ্যাবসলিউট বলে কিছু থাকতে পারে না। মধ্যবিত্তের অবস্থানও অ্যাবসলিউট নয়, কিন্তু শ্রেণীকাঠামোর বর্তমান বিন্যাসে তার শাসকের সহযোগির ভূমিকাটা সাপেক্ষ সম্পর্কের মধ্যে ধ্র“ব। হয় সে নিজে শাসক হয়ে উঠতে চায় (যেমন পাকিস্তান আমলে) নয়তো সে শাসকের সহযোগিতা করে অবস্থান পাকা করতে চায় (এখন)। একভাবে মধ্যশ্রেণী সাবেকি রাজতন্ত্রে যে যাজকশ্রেণীর ভূমিকা সে ভূমিকায় অবতীর্ণ। গ্রামসিও এমনধারা কথাই জানিয়েছেন। এখন এই মধ্যবিত্ত যদি জনগণকে সঙ্গে নিয়ে জনগণের মুক্তির পথে যাত্রা করে (সেটা করার আশু সম্ভাবনা দেখি না বৈষয়িক কারণেই), তখন হয়তো সে আবার নিজেকে নূতন ভূমিকা গড়ে নেবে। জীবনানন্দ দাশ যেমন বলেন, নিজেকে না গড়ে তুমি নতুন সময় আনবে কীভাবে। এরকম একটা কথা বোধহয় ছিল তাঁর ইতিহাসযান কবিতায়। তাই অ্যাবসলিউট না বলেই তাকে নতুন ভূমিকা খুঁজে নেয়ার চাপ দেয়া যায়; মানে নিজেকেও। কেননা, এই শ্রেণীর সমর্থন ছাড়া কোনো মতাকাক্সী শ্রেণী (তা বুর্জোয় বা প্রলেতারিয়েত, যে-ই হোক) জয়ী হতে পারবে না।

আমি বিশেষ করে আজকের দুনিয়ায়, উন্নয়ন সন্ত্রাস আর নব্য সাম্রাজ্যবাদী আধিপত্যের জোয়াল বওয়ায় অকুণ্ঠ আনন্দ, তার ভয়াবহতার দিকে নির্দেশ করার চেষ্টা করেছি। এর সঙ্গী হিসাবে সে যদি নতুন করে বর্ণবাদ ও সাম্প্রদায়িকতা (ভারতে), ধর্মীয় উগ্রতা (বাংলাদেশ-পাকিস্তান-ইন্দোনেশিয়ায়), জাতবিদ্বেষী সন্ত্রাসের পূজারি (আমেরিকা ও ইউরোপে) হয়ে ওঠে, তাতে বিষ্ময়ের কিছু নেই।

আপনার বিনয় আমাকে আবারো লজ্জিত করলো।
এ নিয়ে একটা পদ্ধতি মোতাবেক আলোচনা করা গেলে বেশ হয়। সময়াভাবে আর গুছিয়ে কিছু বলা গেল না, ভুল বোঝার অবকাশও রয়ে গেল মেলা।

হাঁটাপথে আমরা এসেছি তোমার কিনারে। হে সভ্যতা! আমরা সাতভাই হাঁটার নীচে চোখ ফেলে ফেলে খুঁজতে এসেছি চম্পাকে। মাতৃকাচিহ্ন কপালে নিয়ে আমরা এসেছি এই বিপাকে_পরিণামে।

মনজুরাউল এর ছবি

যে ঐতিহাসিক সন্ধিক্ষনে এগুলি ঘটছে তার প্রকৃতি অনুধাবন করতে না পারলে জনসংগ্রামের এই পর্বান্তর দুর্বোধ্য মনে হবে। প্রথম ও প্রধান কারণ হলো,গত সোয়াশ'বছরের মধ্যে নিপীড়িত মানুষের একমাত্র অবলম্বন ও অনুপ্রাণনার উত্স বৈপ্লবিক মার্কসীয় চিন্তাধারার পরিপার্শ্বের পয়োনালী থেকে রাশি রাশি আবর্জনা এসে ঢুকেছে এবং তার ফলে মানব ইতিহাসের সবচেয়ে বেগবতি বলিষ্ঠ চিন্তাপ্রবাহের পথে অনেক পংকিল আবর্ত,অনেক বদ্ধ সংস্কারের ডোবা,। অনেক বিকার বিভ্রান্তি দেখা দিয়েছে। মর্মান্তিক হলো যে দেশ ছিল সারা পৃথিবীর শাসিত-শোষিতের শ্রেষ্ঠ আশাভরসাস্থল, সেই সোভিয়েত আজ মার্কসীয় চিন্তাবিকৃতির প্রধান নায়ক, এবং বিকৃতির শেষে ভেঙ্গে টুকরো টুকরো। কেন সোভিয়েত ভাংল বা কেন তারা চিন্তাবিকৃতির হোতা হলো সেটা অনেক বড় ব্যাখ্যার দাবি রাখে। অনেক কারণের মূল কারণ বোধহয় মার্কসীয় চিন্তধারায় মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্তের প্রাধান্য। মধ্যবিত্তসুলভ যাবতীয় গোঁড়ামি ,সংস্কার ,চিত্তদৌর্বল্য স্বর্থপরতা আত্মম্ভরিতা সুবিধাবাদ আজ মার্কসীয় চিন্তধারাকে পংকিল করে তুলেছে। এরই কারণে জেনারেশন গ্যাপও বেড়েছে। এখনকার নতুন এই বিশ্বায়নের জারাজ প্রজন্ম সেই গ্যাপের ফাঁকফোকোঁড়ের নির্যাস।

আলোচনা এগুক । পরে আরো কথা হবে।

.......................................................................................
আমাদের মাতৃগর্ভগুলি এই নষ্ট দেশে
চারদিকের নিষেধ আর কাঁটাতারের ভিতর
তবু প্রতিদিন রক্তের সমুদ্রে সাঁতার জানা
হাজার শিশুর জন্ম দেয় যারা মানুষ......

.......................................................................................
আমাদের মাতৃগর্ভগুলি এই নষ্ট দেশে
চারদিকের নিষেধ আর কাঁটাতারের ভিতর
তবু প্রতিদিন রক্তের সমুদ্রে সাঁতার জানা
হাজার শিশুর জন্ম দেয় যারা মানুষ......

তানবীরা এর ছবি

সমস্ত গন আন্দোলন, পরিবর্তন, সংস্কৃতি, চেতনার ধারক আর বাহকও কিন্তু এই মধ্যবিত্তরাই।

তানবীরা
---------------------------------------------------------
চাই না কিছুই কিন্তু পেলে ভালো লাগে

*******************************************
পদে পদে ভুলভ্রান্তি অথচ জীবন তারচেয়ে বড় ঢের ঢের বড়

ফারুক ওয়াসিফ এর ছবি

হ্যাঁ, তাদের হাতেই যেহেতু রয়েছে ভুবনের ভার, তারাই যেহেতু শিক্ষা-বিত্ত ও যোগাযোগে ওপরের দিকে অবস্থান করে, এবং স্বার্থগতকারণেই তারা সংগঠনপটু হওয়ায় তাদের নের্তৃত্বেই বেশিরভাগ আন্দোলন-সংগ্রাম হয়েছে। এবং ঊনিশ শতকী রেঁনেসার নামে এরা গণবিরোধী সংষ্কৃতি নির্মাণ করেছে (শরত থেকে বঙ্কিম কেউই কিন্তু গণশিক্ষার পে ছিলেন না), শিল্পায়নের বদলে চিরস্থায়ি বন্দোবস্তের জমিদারি ভোগের পথ নিয়েছে (ঠাকুর পরিবার কিন্তু ব্যবসায়ি ও নবীন শিল্পোদ্যোক্তা থেকে জমিদার হয়েছে ইউরোপে হয়েছে এর উল্টোটা), তারা ধর্মসংস্কারের নামে ধর্মকে আরো বেশি করে রা করেছে, জাতীয়তাবাদ করতে গিয়ে তাকে হিন্দু-মুসলিম ভাগে ভাগ করে সাম্প্রদায়িকতাকে পোক্ত করেছে। স্বাধীনতার পথে যে দেশপ্রেমিক আধুনিক বিপ্লব হওয়ার কথা ছিল, তাকে দাঙ্গার পথে প্রতিবিপ্লবী দেশভাগে পর্যবসিত করেছে, জাতীয় সাহিত্যের নামে এরা বহুকাল ইউরোপীয় সাহিত্যের নকল করে তারকা হয়েছে, এরা সাঁওতাল বিদ্রোহ থেকে শুরু করে তেভাগা পর্যন্ত প্রতিবারই শাসকের দালালি করে বিদ্রোহ দমনে শরীর ও মন দিয়েছে। প্রথম ভারতীয় স্বাধীনতা যুদ্ধ বলে খ্যাত সিপাহি যুদ্ধে এরা ইংরেজকে অর্থ ও বল দিয়ে সাহায্য করেছে।
বাংলাদেশে এরা স্বাধীনতাকে সমাজ সংষ্কার ও অর্থনৈতিক জাগরণের দিকে না নিয়ে নিজেদের শ্রেণীগত স্বার্থে বিকিয়ে দিয়েছে। আজকে তাদের রূপ তো বলাই হলো।
কিন্তু এও সত্য যে, এই শ্রেণী থেকে বেরিয়ে আসা লোকেরাই আবার সমাজ ও রাষ্ট্রের প্রগতির আন্দোলন করেছে। কিন্তু সেটা করেছে ব্যক্তিগতভাবে বেরিয়ে এসে, জনগণের কাতারে নেমে এবং কমিউনিষ্ট আন্দোলনে সামিল হয়ে; মধ্যবিত্ত হিসাবে নয়। নিজ শ্রেণীর প্রতি ঘৃণা ছাড়া তারা এটা করতে পারতেন না। এমনকি জীবনানন্দ দাশের মতো কবিও, এই শ্রেণীর মধ্যে টিকতে পারেননি এবং এদের ভূঁইফোঁড় আধুনিকতার সঙ্গি হতে পারেননি।
মধ্যশ্রেণীর পিতৃপুরুষ বিদ্যাসাগর এদের কার্যকলাপে হতাশ হয়ে শেষ জীবনে কলকাতা ছেড়ে সাঁওতাল পল্লিতে আশ্রয় নিয়েছিলেন। অয় দত্তও এদের দ্বারা বর্জিত হয় অশেষ কষ্ট স্বীকার করেছেন।
যে দেশে কৃষকই জনগণের বিরাট অংশ, সে দেশে জমিদার পুত্রদের নিয়ে গঠিত এবং ইংরেজের কেরানিগিরি করা বাবুদের কৃষকের উত্থানের ভয়ে বারবারই প্রতিক্রিয়াশীল চিন্তা ও শক্তির কোলে আশ্রয় নিতে হয়েছে। আজো কি তাই নয়?

তাই, বন্দনার পাশাপাশি নিন্দাও তো তাদেরই প্রাপ্য।
'''''''''''''''''''''''''''''''''''''''''''''''''''''''''''''''''''''''''
হাঁটাপথে আমরা এসেছি তোমার কিনারে। হে সভ্যতা! আমরা সাতভাই হাঁটার নীচে চোখ ফেলে ফেলে খুঁজতে এসেছি চম্পাকে। মাতৃকাচিহ্ন কপালে নিয়ে আমরা এসেছি এই বিপাকে_পরিণামে।

হাঁটাপথে আমরা এসেছি তোমার কিনারে। হে সভ্যতা! আমরা সাতভাই হাঁটার নীচে চোখ ফেলে ফেলে খুঁজতে এসেছি চম্পাকে। মাতৃকাচিহ্ন কপালে নিয়ে আমরা এসেছি এই বিপাকে_পরিণামে।

তানবীরা এর ছবি

তাই, বন্দনার পাশাপাশি নিন্দাও তো তাদেরই প্রাপ্য।

ঠিক আছে বন্দনাটা আমি রাখলাম (কমটা), নিন্দাটা আপনি রাখেন (বেশীটা)

তানবীরা
---------------------------------------------------------
চাই না কিছুই কিন্তু পেলে ভালো লাগে

*******************************************
পদে পদে ভুলভ্রান্তি অথচ জীবন তারচেয়ে বড় ঢের ঢের বড়

ফারুক ওয়াসিফ এর ছবি

বন্দনার ব্যাপারটা আন্তরিকভাবেই বলেছিলাম। সীমার মধ্যেও যেভাবে অসীমের দিশা মেলে, সেরকম মধ্যবিত্তের মধ্যেও অনেক উত্তীর্ণ হাবার আকাঙ্ক্ষা দেখা যায়।

আচ্ছা ঠিক আছে, বন্দনা (থিসিস), নিন্দা (অ্যান্টি থিসিস); তবে সিন্থেসিস টা কী?
এখানে সেটাই করা আমার উদ্দেশ্য ছিল।

হাঁটাপথে আমরা এসেছি তোমার কিনারে। হে সভ্যতা! আমরা সাতভাই হাঁটার নীচে চোখ ফেলে ফেলে খুঁজতে এসেছি চম্পাকে। মাতৃকাচিহ্ন কপালে নিয়ে আমরা এসেছি এই বিপাকে_পরিণামে।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।