যুদ্ধ পরিস্থিতি!

ফারুক ওয়াসিফ এর ছবি
লিখেছেন ফারুক ওয়াসিফ (তারিখ: বিষ্যুদ, ০৫/০৩/২০০৯ - ১২:০৩অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

''No man is an island. entire of itself; every man is a piece of the continent, a part of the main; ... any man's death diminishes me, because I am involved in mankind, and therefore never send to know for whom the bell tolls; it tolls for thee.'' John Donne, Meditation XVII

একটি গুহা। তার ভেতরে কাঠের আগুন জ্বালিয়ে তার দিকে পিঠ ফিরিয়ে বসে থাকা মানুষ। তারা আগুন দেখে না, দেখে কেবল নিজেদেরই ছায়া। ছায়াকেই তারা সত্য বলে জানে। ছায়াই আশা, মৃত্যু, ভয়। বিখ্যাত এই রূপকটা গ্রিক দার্শনিক প্লেটোর।

কয়েক হাজার বছর পর আরেকটি গুহা। পাহাড়ের ঢালে। তার ভেতরে একদল মানুষ আগুন ঘিরে বসে আছে সন্ধ্যাবেলায়। বাইরে থেকে খবর আসে, আসে বার্তাবাহক। সেসব খবরে উত্তেজনা, ভয়, রাগ, আশা এবং আর যা যা হওয়ার সব হয়। তারা গেরিলা যোদ্ধা। এই গুহার মধ্যেই যেন গোটা দেশ, পরিবার, দল, ব্যক্তি, নারী, পুরুষ, শিশু। ওই গুহার চৌহদ্দির মধ্যেই কারো কারো মধ্যে বাড়ে অবিশ্বাস, কারো কারো মধ্যে প্রেম হয়। নেতৃত্ব বদল হয়ে যায়। মানুষ বদলে যায়। যা জানা ছিল না তা জানা হয়, যা জানা তাতে সন্দেহ আসে। একটি যুদ্ধ ও তার মানবিক-অমানবিক দশা ফলিত হয়ে ওঠে ওই গুহার ভেতর। এই গল্প মার্কিন উপন্যাসিক আর্নেস্ট হেমিংওয়ের বিখ্যাত উপন্যাস ফর হোম দ্য বেল টোলস-এ বয়ে চলে। স্পেনের গৃহযুদ্ধের পরিস্থিতির সাহিত্যিক দলিল নয় কেবল, এটি যুদ্ধ পরিস্থিতিরই চিরায়ত বাস্তবতা।

যুদ্ধ পরিস্থিতির সামনে দাঁড়িয়ে আজ মনের মধ্যে এই দুই গুহা আর তার আশ্রিতদের একাকার হয়ে যেতে দেখছি। যুদ্ধ আমাদের যার যার গুহার মধ্যে ঢুকিয়ে দিয়েছে। সেই গুহায় বসে খবর ছাড়া যেন অন্ধকারে থাকি, কিন্তু খবরের উতস জানি না। ঠিক যেমন প্লেটোর গুহাবাসীরা আলোর উতসটাকে দেখে না, দেখে কেবল দেয়ালের ছায়া। সেটাই তাদের সত্যদর্শন। আজ আমরা গোটা দুনিয়ার মানুষ, গোটা দেশের মানুষ, কিংবা এই ঢাকা শহরের মানুষ কয়েকটা দিন যেন গুহাবাসি থেকেছি। সেই গুহার মধ্যে বসে একের পর এক ঘটনার ছায়াছবি টেলিভিশনের আয়নায় ভেসে যেতে দেখেছি। যতই দেখেছি, ততই আমাদের মধ্যে রাগ-অনুরাগের তেজষ্ক্রি য় বিকীরণ ঘটেছে। আমরা উত্তেজিত হয়েছি, কেঁদেছি, দলাদলি করেছি। এর মধ্যে দিয়ে আমাদের বিশ্বাস-আর অবিশ্বাস নতুন ছন্দ পেয়েছে। ধ্বংসস্তুপে এখন কেবল টিকে আছে অবিশ্বাস আর ভয়। কোনো আশা নাই। কেননা ছায়া পূর্ণ সত্য নয়, গুহাবাস জীবনের স্বাভাবিকতা নয়। কিন্তু যুদ্ধ পরিস্থিতি আমাদের সেখানেই এনে ফেলেছে। যুদ্ধের প্রথম শহীদ সত্য; এ আমরা জানি। সত্য মরলে যে অবিশ্বাস জেগে ওঠে, তা জানা ছিল না। এখন জানলাম। এও জানলাম, যুদ্ধে কেবল লোকক্ষয়, শক্তিক্ষয়ই হয় না, সম্পর্কের ক্ষয় হয়, সমাজ ধ্বংস হয়, সম্পর্ক বদলে যায়। বিশ্বে ও দেশে দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধ পরিস্থিতি মনুষ্যত্বের গড়নটাই বদলে দিচ্ছে। আমরা এখন খোলা মনে কথা বলতে পারছি না।
''The freedom of conversation is being lost....as if one were trapped in a theater and had to follow the events on the stage whether one wanted or not. '' ( Walter Benjamin, One Way Street in Reflections: Schocken Books, New York 1978)

আজকের দুনিয়ায় যুদ্ধ পরিস্থিতিই প্রধান। কোনো না কোনো ভাবে যুদ্ধ পরিস্থিতি আমাদের ওপর আছড়ে পড়ে। হয় আমাদের জীবনে, নয়তো আমাদের সমাজেরই একটা অংশের মানুষের জীবনে অথবা অন্য কোনো মানুষের জীবনে। হয় সরাসরি গায়ের চামড়ায় নয়তো দূর থেকে সেইসব যুদ্ধ আমাদের মনে দাগ ফেলে। কারণ, যুদ্ধে জাতি, বর্ণ, পরিচয়, ধর্ম, সংষ্কৃতি ও শ্রেণী সকল কিছুই আক্রান্ত হয়। কারণ ঐসব চিহ্নের অংশীদার আমরাও। কারণ বিশ্ব-মানুষ দ্বীপের মতো নয়, বিরাট হ্রদের মতো। তার কোনো এক অংশে ঢেউ উঠলে গোটা হ্রদটাই তাতে কাঁপে। এই এখন আমরা যেমন কাঁপছি আমাদের বিপর্যয়ে। তার আগে কেঁপেছি ইরাক বা প্যালেস্টাইনের যুদ্ধ ও গণহত্যার কাঁপনে। ভারতের তাজ বা পাকিস্তানের ম্যারিয়ট হোটেলের বোমা-সন্ত্রাসের ধাক্কা আমাদের গায়েও এসে লেগেছে। মানুষ কোনো দ্বীপ নয় এই সত্যে আমাদের ইমান থাকা চাই। জীবনানন্দ দাশ যেমন বলেন,
''মহাপতনের দিনে আজ অবহিত হয়ে নিতে হয়।
যদিও অধীর লক্ষ্যের অন্ধকারে মানুষ চলেছে
ধ্বংস আশা বেদনায়
বন্য মরালের মত চেতনায় নীল কুয়াশায়,_
কুহেলি সরিয়ে তবু মানুষের কাহিনীর পথে
ভাস্বরতা এসে পড়ে মাঝে মাঝে_
স্বচ্ছ ক্রান্তিবলয়ের মতন জগতে।'' আজ/বেলা অবেলা কালবেলা
২.
কিন্তু এসব কার যুদ্ধ? দেশে দেশে কার যুদ্ধ লড়ে দিচ্ছে সাম্রাজ্যের সেনারা। দেশের সেনারা কাকে শত্রু বানিয়ে মৃত্যু মৃত্যু নাচছে? কার হয়ে লড়ছে জাতীয় যুদ্ধের গেরিলারা? পৃথিবীর যাবতীয় লোভী-পাপী-মিথ্যাবাদীদের হাতে যুদ্ধক্ষমতা ধ্বংসক্ষমতা দিয়ে বসিয়ে দেওয়া হয়েছে। তাদের পেছনে আছে ব্যবসায়িদের ঠাণ্ডা ছলনাময় শান্তি আর আমলাদের কূটবুদ্ধি। আমেরিকা পরদেশ দখল করতে গেলে স্বদেশের মানুষের জন্য কঠোর আইন বানায়, তাদের আয় কাটা পড়ে, নাগরিক স্বাধীনতায় হাত পড়ে। বিদেশের যুদ্ধে দেশের ভেতরে বিশ্বাসঘাতক খোঁজা হয়। প্রতিটি রাষ্ট্র আজ যুদ্ধের সাজে সজ্জিত হয়ে কারো না কারো যুদ্ধের অংশ। প্রতিটি সমাজের ভেতরে শত্রুর জুজু দেখিয়ে ঘৃণার সংস্কৃতি তৈরি করা হচ্ছে। ও মুসলিম তাই শত্রু। ও হিন্দু তাই ও শত্রু। ও এশিয় তাই সে কদর্য। ও আরব তাই সে সন্ত্রাসী। শুধু পরিচয়ই আক্রান্ত হচ্ছে না, আক্রান্ত হচ্ছে সম্পদ ও সম্ভাবনা। এভাবে যুদ্ধ জাতিতে জাতিতে আর সমাজের বুননের মধ্যে ঢুকিয়ে দিচ্ছে বিষ। যুদ্ধ দপ্তরের প্রকাশ্য নির্দেশ ছাড়াই চেতনার ভাইরাস আমাদের হিংসার মুখপত্র বানিয়ে তুলছে। পরদেশ দখল আর পরজাতি দলনের নিমিত্তে জাতীয় সেনাবাহিনী জাতিসংঘের ভাড়া খাটছে নানান রণাঙ্গনে। খাটতে খাটতে ভূমিকা বদলে যাচ্ছে। তারা নিজ দেশেই নামছে পরাশক্তির শান্তি মিশনে। জাতীয় রাষ্ট্র আর নাই। জাতির হয়ে কথা বলবারও কেউ নাই। নিউইয়র্ক থেকে ঢাকা সকলেই এক সুরে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অনন্ত যুদ্ধ করে যায়।

এসবের মধ্যে গতকাল যা ছিল বিদ্রোহ আজ তা ষড়যন্ত্রের চেহারা পায়। গতকালের নায়ক হয়ে যায় আজকের খলনায়ক। ঝানু বাজিকরের মতো যে মিডিয়া গতকাল হাতে ফুল দেখিয়েছিল, চোখের নিমিষেই আজ তাকে বোমা বানিয়ে দেখায়। আমাদের আর চক্ষু-কর্ণ-নাসিকা নাই, নাই ত্বকের সংবেদন, মনের বিশ্লেষণ। তথ্যের জোয়ার আমাদের বোবা-কালা-বর্ণান্ধ ও অসাড় করে দিয়েছে। মিডিয়াই এখন আমাদের ইন্দ্রিয় ও মস্তিষ্ক। তার ভুল আমাদের ভুল, তার সঠিকতার দোহাইয়ে আমরাও ওয়াকিবহালের বড়াই করি। আমরা বাস্তবতার অংশ মাত্র, যে বাস্তবতাকে ব্যাখ্যা ও পরিবর্তনের এখতিয়ার মিডিয়া ও বিশেষজ্ঞদের হাতে। ঠিক যেমন, আমাদের রাজনৈতিক ক্ষমতা নিয়ে নিয়েছে রাষ্ট্র, আমাদের আত্মরক্ষার অধিকার চলে গেছে বিশেষ বাহিনীগুলোর কাছে। যুদ্ধ কিছু মানুষের হাতে অন্য মানুষগুলোর জীবন-মরণের ভার তুলে দেয়। যুদ্ধ মানুষকে পোকা বানিয়ে ফেলে। তখন সেই পোকা-রূপ মানুষকে ঐশী লানতের মতো আকাশ থেকে আলোর রশ্মির মতো শ্বেত ফসফরাস দিয়ে_ যেন ক্ষেতের মাজরা পোকা মারতে ছেটানো কীটনাশক_ হত্যা করা হয় গাজায়। আজ,
''কোথাও শান্তির কথা নেই তার, উদ্দীপ্তিও নেই
একদিন মৃত্যু হবে, জন্ম হয়েছে;
সূর্য উদয়ের সাথে এসেছিল ক্ষেতে;
সূর্যাস্তের সাথে চলে গেছে।'' ক্ষেতে প্রান্তরে, সাতটি তারার তিমির
৩.
আমজাদ আলী রিকশা চালিয়ে খায়। খাওয়ার টাকা যদিবা যোগাড় হয়, চিকিতসার টাকা আর হয় না। তাই সকালে টাকা ধার করে শ্বাসকষ্টের ওষুধ কিনতে নিজের রিকশা নিয়েই বেরয়। কোথাও দেবতা তাকে কটাক্ষ করলেন, আর একটা গুলি এসে বিঁধল তার গায়ে। বিডিআর সদর দপ্তরের সামনের পথ দিয়ে যাচ্ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র খন্দকার তারিক আজিজ। নিয়তির পরিহাস তাকেও ছুঁলো। আহত এক পুলিশকে সাহায্য করতে গিয়ে গুলি খেয়ে ঘুরে পড়ে মরে রইল সেও। তাদের জন্য কেউ কাঁদেনি।
এ রকমই এক ক্রান্তিকাল চলছিল ষোল-সতের শতকের বঙ্গভূমিতে। দেশ ছোট ছোট সামন্ত আর সেনাপতিদের মধ্যে ভাগ হয়ে গিয়েছিল। কখন কে ক্ষমতায় তা জানাও কঠিন ছিল। বজরা নৌকাগুলো তখন একেক রাজাধিপতির নিশান নিয়ে চলাফেরা করত। অবস্থা ও এলাকা বুঝে নিশান উড়িয়ে অধিপতিদের কুর্ণিশ করে চলতে হতো তাদের। এসব দেখেই মুঘল ইতিহাসবিদ আবুল ফজল সে সময়ের বাংলাদেশের নাম দেন 'বুলঘাখানা'। এর অর্থ 'চির অশান্তির দেশ'। সে সময় নিয়ে লেখা মধুসাধু খাঁ উপন্যাসে অমিয়ভূষণ মজুমদার লেখেন, এ রকম দেশে 'পুরুষ জীয়ে না'।
যুদ্ধ পুরুষ-খাদক। যুদ্ধের বাস্তবতায় পুরুষরা 'জীয়ে না'। যেমন বাঁচেনি পুলিশ-বিডিআর-অফিসার-রিকশাচালক ও ছাত্র। স্মরণকালের সবকটি যুদ্ধ পুরুষালি দাপট আর পুরুষের অজস্র মৃত্যুর দৃশ্য দিয়ে ভরা। রাষ্ট্র অনুগত পুরুষ নাগরিকদের যুক্তি ও কল্পনার বাইরে নিয়ে গিয়ে দখল, খুন আর ধর্ষনের কারিগরে পরিণত করে। একাত্তরে পাকিস্তানী সৈন্যরা তাদের শিকারদের মানুষ না ভেবে ভাবতো 'অসহ্য হিন্দু বা বাঙালি'। ইরাক-আফগানিস্তান-সোমালিয়ায় মার্কিন সৈন্যরা স্থানীয় অধিবাসীদের কী ভাবতো, মানুষ না জন্তু? গুজরাটে হিন্দু ফ্যাসিবাদীরা মুসলিম নিধনের সময় কী ভেবেছিল তাদের, 'নোংরা কীট'? ইসরায়েলিরা গাজায় নারী-শিশুদের গণহত্যা করার সময় কি তাদের ও 'অসভ্য ও সন্ত্রাসী' আখ্যা দেয়নি?

এসব পুরুষালি সন্ত্রাস সম্ভব হয়েছে পুঁজিবাদ ও সাম্রাজ্যের চাহিদায়, তার সমরশক্তিতে। ''কিন্তু পুরুষালি সন্ত্রাস কি কেবল কিছু লোকের ব্যাক্তিগত সাময়িক অধঃপতন? নাকি দিনে দিনে সাবধানে পরিকল্পিতভাবে তাকে গড়ে তোলা হয় এবং ছেড়ে দেয়া হয় ধ্বংসের জন্য? এই পুরুষালি ক্ষমতার সঙ্গে রাষ্ট্রের কী সম্পর্ক?...এইসব নির্যাতকরা আমাদের একটা বিষয়ে 'জ্ঞান' দিতে পারে যে, মনুষ্যত্বের সীমা কোথায় লঙ্ঘিত হয়, কীভাবে আমাদের মধ্যেও এরকম নির্যাতক ঘাপটি মেরে লুকিয়ে থাকে। যদি এখনও মানুষের মধ্যে সহিংসতার আবাদ চলতে থাকে, এবং আমরা তার শিকার হতে থাকি, তাহলে কি উচিত নয় সকল মানুষের মধ্যে নির্ভরশীলতার সম্পর্ককে আবার পরীক্ষা করে দেখা? তখন কি ক্ষমতার সেইসব এলাকাগুলো উন্মোচিত করা দরকার নয়? যেখানে বসে ভয়াবহ সব কৌশল ফাঁদা হয়! যা এক মানুষকে দিয়ে অন্য মানুষের ওপর, পুরুষকে দিয়ে নারীর ওপর হত্যা, ধর্ষন এবং নৃশংসতা চালাবার মদদ যোগায়?''(Beyond the Archive of Silence: Narratives of Violence of the 1971 Liberation War of Bangladesh
History Workshop Journal - Issue 58, Autumn 2004, pp. 274-286)

যুদ্ধ নারীকেও নিঃশেষ করে দেয়। 'সন্ত্রাসী বোমা' আর মিলিটারি হামলা, আততায়ীর গুলি আর র‌্যাবের ক্রসফায়ার, মার্কিনী হামলা আর তালেবানের প্রতিশোধ, সেনাকর্মকর্তা আর বিডিআরদের মর্মান্তিক মৃত্যুর পর একদিকে পড়ে থাকে কিছু লাশ আর অন্যদিকে অজস্র বিধবা আর এতিম। তাদের কান্নার জলোচ্ছাসে দেশ ভেসেছে। সেই সব নারী ও শিশুদের কান্না ও হাহাকারের কি সাদা কালো আছে? তাদের কেউ সেনা পরিবারের, কেউ বিডিআরের, কেউ সাধারণ পরিবারের সদস্য। তাহলে কারো কান্না মহিমান্বিত আর আর কারো শোক চোরের মতো লুকিয়ে রাখা কেন? কোনো অশ্রু মিষ্টি আর কোনো অশ্রু তো তিতা নয়, সকল কান্নাই নোনা ব্যথার। সব মৃত্যুই মানবতার মৃত্যু। ইংরেজ কবি জন ডানের কথায়,
''...any man's death diminishes me, because I am involved in mankind, and therefore never send to know for whom the bell tolls; it tolls for thee.'

৪.
সমাজ গঠিত হয়েছিল 'অন্যের' বাইরে 'নিজেদের' এক রাখার জন্য। রাষ্ট্র গঠিত হয়েছিল 'অপরের' বিপরীতে 'আমাদের' রক্ষার নিমিত্তে। এক রাখা উতপাদনের স্বার্থে, আত্মরক্ষা যুদ্ধের দরকারে। সমাজ-রাষ্ট্র উতপাদন ও প্রতিরক্ষার সংগঠন। কিন্তু এ দুই পরিসরেই বলপ্রয়োগ ছাড়া কাজ চালাবার কোনো ব্যবস্থা নাই। ফলত ঐক্য ও আত্মরক্ষা বলপ্রয়োগ তথা যুদ্ধশক্তির অধীন। ফল এখানে কারণকে নির্ধারণ করে দিচ্ছে। সেই ফল হলো হিংসা ও আধিপত্য। আজকের রাষ্ট্র ও সমাজ তাই হিংসা ও আধিপত্যের ফসল এবং সেগুলো টিকিয়ে রাখবার যন্ত্র। সাধারণ মানুষ, যারা উতপাদনের শ্রমিক যারা যুদ্ধের সৈনিক এবং যারা সমাজ-রাষ্ট্রের সাধারণ সদস্য যুদ্ধক্ষমতা তার বাইরে বিরাজ করে। যাদের হাতে তা জমা, তারা ব্যক্তিতে ব্যক্তিতে, গোষ্ঠীতে গোষ্ঠীতে যে সম্পর্ক তারা তার বাইরে উঠে এসে ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত করে। আমলা-মন্ত্রী আর সেনাপতিদের কাজ কারবার আর বসবাস তাই জনসমতলের বাইরে রাখা হয়। ক্রমশ তারা পরিণত হয় বিশেষ রাষ্ট্রীয় সুবিধাভোগী গোষ্ঠীতে। এসবের ফলে, ফরাসি দার্শনিক মিশেল ফুকো বলেন,
''War tends to become the proffessional and technical prerogative of a carefully defined and controlled military apparatus. In short, a society pervaded by warlike relations was slowly replaced by a state equipped with military institutions.'' . (Society Must Be Deffended in Ethics, Michael Foucault, Penguin Books, 1994)

অর্থাত যে সমাজে বিভিন্ন শ্রেণী ও গোষ্ঠীর মধ্যে যুদ্ধের মতো সহিংস বিরোধিতা বিরাজ করে, সেই সমাজকে সরিয়ে সেখানে যায়গা নেয় সামরিক প্রতিষ্ঠানে সজ্জিত রাষ্ট্র। সেই সমাজে আন্দোলন, বিদ্রোহ, বিপ্লব তাই পাল্টা সামরিক পথ বেছে নিতে বাধ্য হয়। যে কোনো যুদ্ধ, জরুরি অবস্থা, বিদ্রোহ ও গণঅভ্যুত্থানের সময় সেকারণেই গোটা সমাজ ও রাষ্ট্র মায় মানুষে মানুষে সকল সম্পর্ক পরিণত হয় যুদ্ধের সম্পর্কে।
তিন রকম যুদ্ধ: গৃহযুদ্ধ, বহিঃশক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধ এবং জনগণের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রের যুদ্ধঘোষণা তথা জরুরি অবস্থা। ১৯৭১ থেকে এখন অবধি এই তিন রকম যুদ্ধের স্বাদ বাংলাদেশের মানুষ পেয়েছে। তিন অবস্থাতেই প্রত্যেকের সঙ্গে প্রত্যেকের সম্পর্ক পরিণত হয়েছে বিশ্বাস-অবিশ্বাসের সম্পর্কে। শত্রু ও মিত্র শিবিরে ভাগ হয়ে গিয়েছে সমাজ ও পরিবার। এই রূপান্তর সম্ভব হয়, কারণ সকল রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষমতা ও তার দ্বারা নির্ধারিত সম্পর্কগুলো আসলে শেষ বিচারে যুদ্ধের সম্পর্ক। শান্তি কালের প্রতিষ্ঠানগুলো তাই সহসাই পরিণত হতে পারে যুদ্ধের প্রতিষ্ঠানে। হাসপাতাল, পুলিশ, বিদ্যালয়, গণমাধ্যম এবং সরকারের মতো সিভিল প্রতিষ্ঠানগুলো এভাবেই এই বিডিআর বিদ্রোহ/ষড়যন্ত্র বা সেই জরুরি অবস্থা/সেনা অভ্যুত্থান কিংবা ওই একাত্তরে যুদ্ধের অঙ্গ হয়ে গিয়েছিল। ঠিক এবারেও মিডিয়া প্রথম দিকে বিদ্রোহীদের মুখপত্র এবং এখন বিদ্রোহ ও ষড়যন্ত্র দমনের মুখপত্রে পরিণত হয়েছে। এই দোলাচল ক্ষমতার পেণ্ডুলামের দোলার সঙ্গে তাল রাখার খাতিরে। রাষ্ট্রের সার্বভৌম ক্ষমতা কিংবা সমাজে প্রতিষ্ঠিত নৈতিকতা যুদ্ধক্ষমতারই ভিত। শান্তির সময় তার ওপর মখমলের চাদোয়া টাঙানো থাকে বলে আমাদের বুঝতে ভুল হয়।

৫.
যুদ্ধের মধ্যে গুহাই পৃথিবী হয়ে ওঠে আর পৃথিবীকে মনে হয় যেন এক গুহা। এই দেয়াল ভেঙ্গে বেরুতে হবে। যুদ্ধের ইতিহাস ঠেলে মানুষের ইতিহাস সৃষ্টি করতে হবে। আজ ইউরোপ-আমেরিকায় কত কত বিজ্ঞান, শিল্প-দর্শন-ইতিহাস, কত কত ক্রীড়া আর যৌনতার মুক্ত লীলা। তাদের সেইসব সুখ কেনা হয়েছে এশিয়া-আফ্রিকা আর ল্যাটিন আমেরিকাকে গুহাবাসী করে যুদ্ধের মুখে ফেলে। আমাদের হারানো সুখ কিনে নিতে হলে, তাদের ছাপিয়ে যেতে হবে। যেতে হবে সেখানে যেখানে ঈগল থাকবে না, কিন্তু মানুষ থাকবে। সেই মানুষকেই আজ আমরা দেখেছি, শোকার্ত জানাজায়, সেনা পরিবারের কান্নার সহমর্মিতায়। সেই মানুষকেই দেখছি বিডিআর গেটে, আবাহনী মাঠে। ছত্রভঙ্গ সৈন্যদলের মতো তারা জড়ো হয়েছে আবার। তারা সাধারণ মানুষ, উর্দির নীচে তারা প্রত্যেকে কৃষক সন্তান। কিন্তু গুহাময় পৃথিবীতে যুদ্ধের প্রতিষ্ঠান ছাড়া তাদের কোনো অস্তিত্ব নাই বলে আবার তারা এসেছে। আসতে হয়েছে। এসেছে ষড়যন্ত্রকারী ও 'কাপুরষের' কলঙ্ক গা থেকে মুছে ফেলতে। তারা ভেবেছে এটাই বোধহয় তাদের শেষ যাত্রা। তাই সঙ্গে এনেছে তাদের স্ত্রী-পুত্র-কন্যাকে। দেখলাম, এক বউ তার জওয়ান স্বামীকে হাতে তুলে খাইয়ে দিচ্ছে রাস্তার পাশে বসে। তার ভয়, ওটাই হয়তো তার শেষ খাওয়া। তারপর লোকটি বাচ্চাকে কোলে নিয়ে চুমু খেয়ে ঢুকে গেল গুহার ভেতরে, হয়তোবা শেষযাত্রায়।

সমাজ ও রাষ্ট্রের যুদ্ধ পরিস্থিতি মুক্ত মানুষকে গুহাবাসী করে। কিন্তু যুদ্ধ ছাড়া সেই গুহা ভেঙ্গে আকাশের নীচে দাঁড়ানো যাবে কি?

*এই লেখাটি কাল অর্থাত শুক্রবারে সমকালের সাহিত্য সাময়িকী কালের খেয়ায় প্রকাশিত হবে। শিরোনামটি নেওয়া হয়েছে নবারুণ ভট্টাচার্যের একটি উপন্যাসের নাম থেকে।


মন্তব্য

নুরুজ্জামান মানিক এর ছবি

পাঁচ তারা ।

যুদ্ধের প্রথম শহীদ সত্য; এ আমরা জানি। সত্য মরলে যে অবিশ্বাস জেগে ওঠে, তা জানা ছিল না।
বিশ্ব-মানুষ দ্বীপের মতো নয়, বিরাট হ্রদের মতো। তার কোনো এক অংশে ঢেউ উঠলে গোটা হ্রদটাই তাতে কাঁপে। এই এখন আমরা যেমন কাঁপছি আমাদের বিপর্যয়ে। তার আগে কেঁপেছি ইরাক বা প্যালেস্টাইনের যুদ্ধ ও গণহত্যার কাঁপনে। ভারতের তাজ বা পাকিস্তানের ম্যারিয়ট হোটেলের বোমা-সন্ত্রাসের ধাক্কা আমাদের গায়েও এসে লেগেছে। মানুষ কোনো দ্বীপ নয় এই সত্যে আমাদের ইমান থাকা চাই।
যুদ্ধ দপ্তরের প্রকাশ্য নির্দেশ ছাড়াই চেতনার ভাইরাস আমাদের হিংসার মুখপত্র বানিয়ে তুলছে।
পরদেশ দখল আর পরজাতি দলনের নিমিত্তে জাতীয় সেনাবাহিনী জাতিসংঘের ভাড়া খাটছে নানান রণাঙ্গনে। খাটতে খাটতে ভূমিকা বদলে যাচ্ছে। তারা নিজ দেশেই নামছে পরাশক্তির শান্তি মিশনে।
মিডিয়াই এখন আমাদের ইন্দ্রিয় ও মস্তিষ্ক।
তিন রকম যুদ্ধ: গৃহযুদ্ধ, বহিঃশক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধ এবং জনগণের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রের যুদ্ধঘোষণা তথা জরুরি অবস্থা। ১৯৭১ থেকে এখন অবধি এই তিন রকম যুদ্ধের স্বাদ বাংলাদেশের মানুষ পেয়েছে।
সমাজ ও রাষ্ট্রের যুদ্ধ পরিস্থিতি মুক্ত মানুষকে গুহাবাসী করে। কিন্তু যুদ্ধ ছাড়া সেই গুহা ভেঙ্গে আকাশের নীচে দাঁড়ানো যাবে কি?

নুরুজ্জামান মানিক
*******************************************
বলে এক আর করে আর এক যারা
তারাই প্রচণ্ড বাঁচা বেঁচে আছে দাপটে হরষে
এই প্রতারক কালে (মুজিব মেহদী)

নুরুজ্জামান মানিক
*******************************************
বলে এক আর করে আর এক যারা
তারাই প্রচণ্ড বাঁচা বেঁচে আছে দাপটে হরষে
এই প্রতারক কালে (মুজিব মেহদী)

অপ্রিয় এর ছবি

যুদ্ধের ব্যবসা সবচেয়ে বড় ব্যবসা;
ঘৃণার আবেগ সবচেয়ে শক্তিশালী,
নিরাপত্তার জুজু সবচেয়ে কার্য়করী,
সৈনিকের বেতন সবচেয়ে বেশী।

কিন্তু এ সবই শয়তানের খেলা;
নিরস্ত্র মানুষ কখনই ততটা দুর্বল নয়
যতটা তাকে দেখে মনে হয়।
আসুন যুদ্ধের বিরুদ্ধে ঘোষনা করি যুদ্ধ!

+++++++++++++++++++++++++++++
ঈশ্বরে বিশ্বাস নেই এই পাপীর, তবে বিশ্বাস করি এই আমি বিশ্বাসীদেরই প্রার্থনার ফসল

+++++++++++++++++++++++++++++
ঈশ্বরে বিশ্বাস নেই এই পাপীর, তবে বিশ্বাস করি এই আমি বিশ্বাসীদেরই প্রার্থনার ফসল

রণদীপম বসু এর ছবি

ক্লাসিক লেখা....!!!

-------------------------------------------
‘চিন্তারাজিকে লুকিয়ে রাখার মধ্যে কোন মাহাত্ম্য নেই।’

শিবলী নোমান এর ছবি

গুহার সুনিশ্চিত পরিণতির এই সংবাদ কি সব সময় আমাদের কানে পৌঁছায়?
অসাধারণ লেখা। কালের খেয়ায় পড়ে ফোন দিতে চেয়েছিলাম। কিন্তু সময়ের কারণে পারি নি। এখন মত জানালাম।

তানসেন নিকলী [অতিথি] এর ছবি

চমতকার!!!! এই বিশ্লেষণ চাইছিলাম ... মনেপ্রাণে ... কিন্তু কোথাও পচ্ছিলাম না... পড়ে ভালো লাগলো, এখনো কেউ তাহলে আছে ...আমাদের ভাবনাকে প্রকাশ করার!

ফারুক ওয়াসিফ এর ছবি

ধন্যবাদ। এটি হঠাত লেখা। আর কোথাও যখন পারিনি, তখন সাহিত্যের ছদ্মবেশে লেখাটা কালের খেয়ায় দিই। তবে এই চিন্তাটাকে প্রসারিত করে বড় করে লেখার ইচ্ছা আছে। ধন্যবাদ।

হাঁটাপথে আমরা এসেছি তোমার কিনারে। হে সভ্যতা! আমরা সাতভাই হাঁটার নীচে চোখ ফেলে ফেলে খুঁজতে এসেছি চম্পাকে। মাতৃকাচিহ্ন কপালে নিয়ে আমরা এসেছি এই বিপাকে_পরিণামে।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।