এই লেখায় যুদ্ধাপরাধ বিচারের প্রশ্নে কৌশল ও আইনী বিষয়ে আলোকপাত করা হয়েছে। ড. আহমেদ জিয়াউদ্দীন: বেলজিয়ামের ব্রাসেলস-এ প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশ সেন্টার ফর জেনোসাইড স্টাডিজ এর প্রতিষ্ঠাতা প্রধান এবং আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ বিচার বিশেষজ্ঞ। এটি তাঁর ইংরেজিতে পাঠানো লেখার অনুবাদ। নিবন্ধটি ২০০৮ সালের ২৬ মার্চ প্রথম আলোর স্বাধীনতা দিবস সংখ্যার প্রধান লেখা হিসেবে প্রকাশিত হয়।
বাংলাদেশ এখনও অতীতের সঙ্গে ফয়সালা করে ওঠেনি আর অতীতও কখনোই তাকে ছেড়ে যায়নি। যে সমাজে মারাত্মক অপরাধ সংঘটিত হয়েছে এবং যেখানে বিরাটসংখ্যক মানুষ তার শিকার হয়েছে, এমন সন্ত্রস্ত সমাজে অতীতের বিষয় নিয়ে সুনির্দিষ্টভাবে কিছু করা এক জটিল ব্যাপার। অতীত সেখানে বর্তমান ও ভবিষ্যতকে তাড়া করে ফেরে। এরকম এক ক্ষতবিক্ষত সমাজের পক্ষে সম্ভব নয় অতীতের ক্ষত ভুলে যাওয়া বা যারা দায়ি তাদের ক্ষমা করা। তা তখনই সম্ভব যখন অতীতের সঙ্গে একটা বোঝাপড়ার পথ বের করা হয়। কিন্তু প্রায় চার দশকে পা দেয়া বাংলাদেশ তা করতে ব্যর্থ হয়েছে। একজন খ্যাতনামা বিশ্লেষকের ভাষায় বললে, এটাই বাংলাদেশের ‘আদি পাপ’।
সামাজিক নিপীড়নের কিছু অন্তর্নিহিত লক্ষণ রয়েছে। পরবর্তী প্রজন্মগুলোকেও তা পীড়িত করতে থাকে। খুবই ভুল হবে যদি ভাবি যে, সরাসরি নির্যাতিতদের বিদায়ের মধ্যে দিয়ে তাদের উত্তরসূরীদের মধ্যে আতঙ্কের ঘোর, যাতনা, দুঃখ কিংবা হাহাকার কমতে থাকবে। তা হয় না। একমাত্র অপরাধের ‘সুবিচারই’ যাতনার নিষ্কাশন ঘটানোর নিশ্চয়তা দেয় এবং বাংলাদেশের এখন সেটাই দরকার।
১৯৭১ এর অপরাধ
কীভাবে কেবল ‘যুদ্ধাপরাধ’ ও ‘যুদ্ধাপরাধীদের’ প্রসঙ্গই ১৯৭১ এর একমাত্র প্রসঙ্গ হয়ে উঠল তার অর্থোদ্ধার করা খুবই কঠিন। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারই হোক বা আর যাই হোক সকল সংগঠন, সংবাদপত্র, অন্য অন্য গণমাধ্যম এবং এ বিষয়ক আলোচনায় ‘বিশেষভাবে’ যুদ্ধাপরাধের ওপরই জোর দেওয়া হয়। ব্যাপারটা যেন এরকম যে, ১৯৭১ সালে কেবল যুদ্ধাপরাধ ছাড়া আর কোনো অপরাধের ঘটনা ঘটেনি! বাংলাদেশে এখন কেবল যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য রব ওঠা এবং কেবল এর ওপরই নজর থাকার ফলে অভিযুক্ত ও দোষীদের অনেকেই আইনের খুঁটিনাটির মধ্যে যুদ্ধাপরাধের সংজ্ঞা নিয়ে ঘোরপ্যাঁচ খেলার সুযোগ পাচ্ছে।
বাস্তবে ১৯৭১ এ যারা বাংলাদেশে সবচেয়ে বড় যে অপরাধটি ঘটেছিল সেটি যুদ্ধাপরাধ নয়; গণহত্যা ও মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ। পৃথিবীতে এর তুল্য জঘন্য অপরাধের কথা আর জানা নেই। ১৯৭১ সালে নাগরিকত্ব, জাতীয়তা, বর্ণ ও ধর্মপরিচয়ই যুদ্ধের শিকারদের ভাগ্য নির্ধারণ করে দিয়েছিল।
পাকিস্তানি সেনাবাহিনী এবং তাদের দেশীয় দোসরেরা অভিসন্ধিমূলকভাবেই বাঙালিদের নৃতাত্ত্বিক ও জাতিগত পরিচয়কে নিশানা করেছিল। তাদের ল্য ছিল আংশিক বা সম্পূর্ণভাবে বাঙালিদের ধ্বংস করা। আর ধর্মের জন্য বিশেষভাবে নজর ছিল হিন্দু বাঙালিদের প্রতি। কখনো যদি উন্মোচিত হয় তাহলে দেখা যাবে, এ অপরাধ ১৯৪৮ সালের জেনোসাইড কনভেনশন এবং ১৯৭৩ সালে ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইমস (ট্রাইব্যুনাল) অ্যাক্টে বর্ণিত গণহত্যার সংজ্ঞার সঙ্গে ভালোভাবেই মিলে যায়।
এর পরের স্তরের অপরাধটি সংঘটিত হয়েছিল অন্যান্য নির্যাতিতদের বিরাট একটি অংশের ওপর। এটি হলো মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ। সংক্ষেপে, আন্তর্জাতিক আইন অনুসারে এর অর্থ হলো, ব্যাপকবিস্তৃতভাবে অথবা একটানা ও সংগঠিতভাবে কোনো বেসামরিক জনগোষ্ঠীর ওপর সচেতনভাবে আক্রমণ করা। অন্য ভাষায় বললে, মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ হলো বড় আকারে নিরীহ বেসামরিক মানুষদের হত্যা করা কিংবা তাদের বিরুদ্ধে বড় আকারের আক্রমণ পরিচালনা ও অমানবিক কার্যকলাপ চালানো। ১৯৭১ সালে, বেশিরভাগ আক্রান্তরা ছিল নিরস্ত্র জনসাধারণ, সশস্ত্র যোদ্ধা নয়। যারা অস্ত্রবহন করতো তাদের বিরুদ্ধে অপরাধের জন্য অন্য আইন প্রযোজ্য কিন্তু কোনো অবস্থাতেই বেসামরিক জনসাধারণকে আক্রমণ করা যেতে পারে না।
সর্বোচ্চ অপরাধের দায়
ওপরে বলা অপরাধের কোনো একটিও যে করেছে বা আদেশ, উস্কানি, সহায়তা, প নেয়া, সাহায্য, ইন্ধন, মদদ অথবা তাতে অন্য কোনোভাবে অবদান রাখাসহ সজ্ঞানে এধরনের অপরাধ বিস্তারে ভূমিকা রাখা যে কাউকে ব্যক্তিগতভাবে এর জন্য দায়ি করা উচিত। তাহলেও, খেয়াল রাখতে হবে যাতে যারা পরিকল্পনা করেছিল বা সংগঠিত করেছিল অথবা আল বদর, আল শামস ও রাজাকার বাহিনীর মতো অপরাধী সংগঠন চালাতো, তাদের বিষয়েই বেশি নজর দেয়া হয়। কারণ, সংঘটিত অপরাধের সর্বোচ্চ দায়দায়িত্ব এদেরই। সুতরাং এদের শাস্তি দেয়ায় সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা থাকা উচিত এবং তা করা উচিত অগ্রাধিকার ভিত্তিতেই।
বিচারের দায়িত্ব
দেশীয় ও আন্তর্জাতিক আইন তথা আন্তর্জাতিক অপরাধ, গণহত্যার অপরাধ এবং মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ ইত্যাদির জন্য প্রণীত আইন অনুসারে তদন্ত ও বিচার রাষ্ট্রের ‘ঐচ্ছিক’ বিষয় নয়, ‘দায়িত্ব’। রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষ হিসাবে সরকারের পয়লা কর্তব্য হচ্ছে গণহত্যা তদন্তে কমিশন গঠন করা এবং তার প্রতি দায়বদ্ধ থেকে দায়ীদের তদন্ত করে বিচারের মুখোমুখি করার ব্যবস্থা করা।
১৯৭৩ সালের ১১ মে, বাংলাদেশের গণহত্যা প্রশ্নে পাকিস্তানী যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিষয়ে ভারতের বিরুদ্ধে ঠিক এ যুক্তিই পাকিস্তান সরকারের প থেকে তোলা হয়েছিল। ঐ তারিখে জাতিসংঘের সদস্য রাষ্ট্রের মধ্যে বিবাদ মীমাংসায় হল্যান্ডের হেগে অবস্থিত জাতিসংঘের বিচারিক সংস্থা আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে (আইসিজি) পাকিস্তান একটি মামলা করে। ভারতের হাতে আটক ১৯৫ জন অভিযুক্ত যুদ্ধাপরাধীকে গণহত্যা ও মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের বিচারের জন্য বাংলাদেশের কাছে হস্তান্তর ঠেকাতে এ মামলা করা হয়েছিল।
মামলার আরজিতে পাকিস্তানের বক্তব্য ছিল এই যে, ‘‘১৯৪৮ সালের ৯ ডিসেম্বরের ‘কনভেনশন অন দ্য প্রিভেনশন এন্ড পানিশমেন্ট অব জেনোসাইড’ এর আলোকে বর্তমানে ভারতের হেফাজতে থাকা এবং পাকিস্তানি ভূখণ্ডে যুদ্ধাপরাধ সংঘটিত করার দায়ে অভিযুক্ত ১৯৫ জন অথবা যেকোনো সংখ্যক পাকিস্তানি নাগরিকের বিচার করার সম্পূর্ণ অধিকার পাকিস্তানেরই রয়েছে। অন্য কোনো সরকার কিংবা কর্তৃপক্ষ এ ধরনের বিচারকার্য করার উপযুক্ত পক্ষ নয়।’’
পাকিস্তান এও বলে যে, ‘‘উপরোক্ত যুদ্ধবন্দীদের বিরুদ্ধে প্রযোজ্য গণহত্যার অভিযোগ, ‘মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ’ কিংবা ‘যুদ্ধাপরাধের’ ধারণা তাদের ওপর প্রযোজ্য নয়।’ অন্যভাবে বললে, পাকিস্তান স্বীকার করে নিল যে, বাংলাদেশে অবস্থানরত শীর্ষ সামরিক নের্তৃত্ব ঐ ১৯৫ জন যুদ্ধবন্দী ‘গণহত্যা চালিয়েছে’। এভাবে তারা বাংলাদেশ যে অভিযোগ করে আসছে তাতেই আরো জোর দিল। পাকিস্তানের এ প্রচেষ্টা কাজে লাগেনি কারণ, ভারত আইসিজি’র রায় স্বীকার করেনি।
দুর্ভাগ্যজনকভাবে, আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে (আইসিজি) পাকিস্তান গণহত্যার দায়ের বিষয়টি স্বীকার করে নেয়া সত্ত্বেও পাকিস্তান তার অভিযুক্ত নাগরিকদের বিরুদ্ধে তদন্ত ও বিচারের প্রতিশ্র“তি ভঙ্গ করেছে। একই কাজ বাংলাদেশও করেছে, অথচ গণহত্যাটি সংঘটিত হয়েছিল তার ভূখণ্ডে তার নাগরিকদের ওপর। পরিণামে, বঞ্চিত হয়েছে নিযুত লক্ষ ক্ষতিগ্রস্থ মানুষ।
তাই বাংলাদেশ সরকার কোনো অজুহাতেই ১৯৭১ এর অপরাধের তদন্ত ও বিচারের দায় এড়াতেই পারে না। আগের সরকারগুলোর ব্যর্থতা কিংবা বর্তমান সরকারের সময়স্বল্পতা অথবা অন্য কোনো কিছুর ওজর তোলা উচিত নয়। সরকারের এভাবে দায়িত্ব এড়ানোর অর্থ বাংলাদেশে অপরাধের দায়মুক্তির যে সংস্কৃতি মহামারির মতো ছড়িয়ে পড়েছে, প্রতিরোধের বদলে তাকে বরং অমরত্ব দেয়া।
এক অপরাধ, দুই আইন
এটা এখনও এক রহস্য যে, এ ধরনের অপরাধের জন্য কেন বাংলাদেশ দুই ধরনের আইন প্রণয়ন করল। স্বাধীনতা অর্জনের কয়েক সপ্তাহের মাথায়, ১৯৭২ সালের ২৪ জানুয়ারি, প্রেসিডেন্টের আট নং অধ্যাদেশে ‘বাংলাদেশ দালাল (বিশেষ ট্রাইব্যুনাল) আইন নামে একটি আইন প্রণীত হয়। এটি করা হয়েছিল মূলত ‘‘কতিপয় ব্যক্তি, ব্যক্তিবর্গ অথবা কোনো সংগঠনের সদস্য হিসেবে যারা প্রত্যক্ষ বা অপ্রত্যক্ষভাবে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর দালালি করেছিল, যে সেনাবাহিনী বেআইনীভাবে এবং নৃশংস শক্তি দিয়ে বাংলাদেশে দখলদারিত্ব কায়েম করেছিল এবং যেসব ব্যক্তি গণহত্যা ও মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ সংঘটনে সাহায্য ও সমর্থন যুগিয়েছিল,’’ তাদের বিচারের উদ্দেশ্যে। অন্যভাবে বললে এই আইনের উদ্দেশ্য ছিল দালালদের বিচার।
অন্য আইনটি পাশ হয় এর প্রায় দেড় বছর পর, ১৯৭৩ সালের ২০ জুলাই তারিখে। এটি ছিল আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) আইন, ১৯৭৩। এর উদ্দেশ্য ছিল ‘সশস্ত্রবাহিনী, প্রতিরক্ষা অথবা তাদের সহযোগী বাহিনীর’ সদস্যদের জন্য, যারা সাতটি বড় ধরনের অপরাধ করেছিল। এর মধ্যে আছে: মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ, গণহত্যা ও যুদ্ধাপরাধ। এটা অনেককে দ্বিধায় ফেলে দিয়েছিল এজন্য যে, ঐসব অপরাধের মূল হোতাদের বিচারে এ আইনটি করতে কেন দীর্ঘসময় লেগে গেল আর কেনইবা দখলদারিত্ব উচ্ছেদের মাত্র পাঁচ সপ্তাহের মধ্যেই স্থানীয়দের বিচারের জন্য আইন তৈরি হয়ে গেল!
কার্যত একই অপরাধের জন্য দালাল এবং সশস্ত্রবাহিনীর সদস্যদের জন্য আলাদা আলাদা আইন করা হয়েছিল। যদিও বাস্তবে সশস্ত্র বাহিনীর একজন সদস্যকেও আন্তর্জাতিক অপরাধ দমন আইন ১৯৭৩-এর আওতায় আনা না গেলেও কয়েক হাজার দালালকে ঠিকই ধরা হয়েছিল। (সেসময় আটক করা হয়েছিল প্রায় ৩৭ হাজার। এর মধ্যে সাধারণ ক্ষমায় ছাড়া পায় ২৬ হাজার। বাকি ১১ হাজার পলাতক ও আটক অবস্থায় ছিল। এদের মধ্যে ৭৫২ জনকে দণ্ডও দেয়া হয়েছিল। এই দণ্ডিতদের ছেড়ে দেওয়ার কোনো আইনী সুযোগ তখনও ছিল না এখনও নাই। তার অর্থ কিছু বিচার হলেও রায় বাস্তবায়ন হয়নি রাজনৈতিক কারণে- অনুবাদক)
কোনো যৌক্তিক কারণ ছাড়াই এই দ্বিচারিতা আইনের অধীনে সকলের মর্যাদা সমান, আইনের এই মৌল প্রপঞ্চের বিরুদ্ধে চলে গিয়েছিল। এবং পরিণামে, বিশেষ করে যাদের জন্য আন্তর্জাতিক অপরাধ আইন ১৯৭৩ প্রণয়ন করা হয়েছিল, যুদ্ধাপরাধীদের শেষ দল হিসাবে সেই ১৯৫ জনকে পাকিস্তানে ফেরত যেতে দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে দালাল আইনের ধারও কিছুটা কমে গেল। ১৯৭১ সালে সংঘটিত অপরাধের জন্য যদি একটি মাত্র আইন থাকত এবং তার জন্য পর্যাপ্ত সাংবিধানিক সুরা দেয়া হতো, তাহলে হয়তো ঐ আইনের আরো তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা আমরা দেখতে পেতাম।
বিচার না করা কিংবা নমনীয়তা
দালাল আইনে সেসময় বেশ কয়েকটি ট্রাইবুনাল গঠন করা হয়েছিল। এসবের মাধ্যমে ডা. এম এ মালেকের নের্তৃত্বাধীন পূর্ব পাকিস্তান সরকারের মুখ্য সদস্যদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়। অপরাধে লিপ্ত হওয়া এবং সহযোতিার জন্য শীর্ষ জামায়াত নেতাদেরও এ আইনে দোষী সাব্যস্ত করা হয়। আরো অনেকের বিরুদ্ধে তদন্ত চলে এবং অন্য কয়েক হাজার লোককে আটক করা হয়।
সরকার প্রথমবারের মতো ১৯৭৩ সালের ১৬ মে দালাল আইনের অধীনে সাজাপ্রাপ্ত এবং অভিযুক্ত সুনির্দিষ্ট কিছু লোককে সাধারণ ক্ষমা প্রদান করে। ১৯৭৩ সালের ৩০ নভেম্বর, আরেক দফা সাধারণ ক্ষমায় যাদের বিরুদ্ধে হত্যা, ধর্ষণ ও আগুন লাগানোর অভিযোগ নেই এমন অভিযুক্ত ও সাজাপ্রাপ্তদের ক্ষমা প্রদর্শন করা হয়। এরকম গণহারে মুক্তি দেয়ার উদ্দেশ্য ছিল বিবাদ মিটিয়ে ফেলা কিন্তু এর ফল হয় ঠিক বিপরীত।
এ কাজে ১৯৭১ সংঘটিত অপরাধের জন্য যারা সবথেকে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছিল সেইসব ভুক্তভোগীদের সঙ্গে কোনো আলাপ-পরামর্শ করা হলো না। এভাবে একতরফা সিদ্ধান্তের মাধ্যমে রোপিত হলো প্রবাদ কথিত ‘আদি পাপের’ বীজ। দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি এবং মতার অপব্যবহারের জন্য কেবলমাত্র পুঁটি মাছেরাই নয় রাঘব বোয়ালরাও কারাগার থেকে ছাড়া পেয়ে গেল।
এই সাধারণ মার আদেশ আইনগত ভাবেও ছিল ক্রুটিপূর্ণ। আইনত, ৫৭ নং ধারা অনুসারে বিচারাধীনদের নয়; প্রেসিডেন্ট কেবলমাত্র তাদেরই ক্ষমা করতে পারেন যাদের বিচার সম্পন্ন হয়েছে। সাধারণ ক্ষমার এ বিকৃতির ফলে, সরকার কার্যত সকলরকম তদন্ত কাজ বন্ধ করে পরিস্থিতি শিথিল করে দেয় এবং অন্যদেরও ছেড়ে দেয়। শাস্তিপ্রাপ্তদের এভাবে ছেড়ে দেয়া ছিল বেআইনি।
বিচার বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে, অভিযোগের তদন্ত করতে অনিচ্ছার অর্থ সরকার অপরাধের দায়ে অভিযুক্তদের বিচারের মুখোমুখি করতে চায় না। একে নমনীয়তা বা সাধারণ ক্ষমা প্রদর্শন বলে না। এই সাধারন ক্ষমার আদেশের জন্য পরবর্তী সরকারগুলোর ওপরও বিচারের জন্য কোনো আইনী বাধ্যবাধকতা রইল না। তবে এই মুক্তি পাওয়া ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে নতুন করে তদন্ত চালানোয় সাধারণ মার আদেশ কোনো প্রতিবন্ধকতা নয়। কেবল তাই নয়, এই আদেশের জায়গায় নতুন আরেকটি আদেশ জারি করে দিলেই চলে।
দৃষ্টিভঙ্গির সমস্যা
এ গণহত্যা, যুদ্ধাপরাধ এবং মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ বাংলাদেশের জনগণের জীবন, সম্পদ ও ভবিষ্যতের ওপর যে কীরকম কম্পন-ক্রিয়া সৃষ্টি করতে পারে তার পরিমাপ কেউ করতে পারে না। এখনকার নতুন সরকারও যন্ত্রণা ও দুঃখের সুনামি থেকে নিজেদের দূরে সরিয়ে রাখতে পারে না। এ বিষয়ে সামাজিক স্তরে অনেক ব্যক্তিবর্গ ও সংগঠন সক্রিয় রয়েছে কিন্তু কেউই নির্যাতিতদের সংগঠিত করেনি, তাদের কথা শুনতে চায়নি। মুক্তিযুদ্ধ ও গণহত্যায় যারা ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে এবং এর প্রভাব যাদের ওপর পড়েছে, তাদের জন্য সরকারের তরফ থেকেও কোনো ‘পদক্ষেপই’ নেয়া হয়নি। কিন্তু তা না করা হলেও কোনো না কোনো ভাবে বাংলাদেশ ব্যক্তিগত প্রতিহিংসার কবল থেকে স্থানীয় দালালদের বাঁচাতে তাদের আটক করে। অনেকের বিরুদ্ধে স্পেশাল ট্রাইব্যুনালও গঠন করা হয়। কতিপয় মূল দালালের নাগরিকত্ব কেড়ে নেয়া হয়। এর পেছনে প্রাথমিক সমর্থন থাকলেও আইনগতভাবে এটা ছিল ত্র“টিপূর্ণ। এ ধরনের নাগরিকত্বহরণ কিন্তু আইনী প্রক্রিয়ায় শাস্তির অংশ হিসাবে করা হয়নি, করা হয়েছে নির্বাহী আদেশে। এর অবশ্যম্ভাবী কার্যফল হিসাবে পরে সকলের নাগরিকত্বই ফিরিয়ে দেয়া হয়।
সাধারণ মার মধ্যে বিবাদমীমাংসার যে উচ্চাশা ছিল তা ভেঙ্গে পড়ে অ-বিচারের চাপের কাছে। বিচার না হওয়ায় কিংবা মার কারণে যারা ছাড় পেয়েছে তারা আবার সংগঠিত হয় এবং এক পর্যায়ে বাংলাদেশের অস্তিত্বের মূলে যে উদার ধর্মনিরপেক্ষ চেতনা ছিল তার বিরোধিতা দাঁড় করায়। আজকের ইসলামপন্থিরা হলো সেইসব ব্যক্তিবর্গ যারা সাধারণ ক্ষমার দ্বারা লাভবান হয়েছে। তারা এখনও তাদের পুরাতন সংগঠনগুলোরই নের্তৃত্ব দেয় এবং বিশ্বাস রাখে সেই একই মতাদর্শে।
কার্যত গণহত্যা ও নির্যাতনের শিকার কেউই কোনো ধরনের ক্ষতিপূরণ বা সান্তুনা পাননি। এমনকি হারানো সম্পত্তিও অনেক ক্ষেত্রে ফিরে আসেনি। নির্যাতিতদের বাধ্য করা হয় নিজে থেকেই উঠে দাঁড়াতে এবং জীবন চালিয়ে যেতে। সংগ্রাম ও দুর্ভোগের স্মারক হিসাবে কিছু স্মৃতিসৌধ অবশ্য নির্মিত হয়েছে। এমনকি নিহদের মধ্যেও বিভাজন করা হয় প্রতিবছর ১৪ ডিসেম্বর বুদ্ধিজীবী হত্যা দিবস পালনের মাধ্যমে। অথচ ল ল অন্য শহীদদের জন্য জাতীয় শোক ও স্মরণে কোনো একক দিবস নেই। আজতক বাংলাদেশ নির্যাতনবিরোধী দিবস বা গণহত্যা দিবস বলে কোনো কিছু ঘোষণা করেনি।
উপসংহার
যারা ভেবেছিলেন, নিহতদের গায়েব হয়ে যাওয়া এবং নির্যাতিতদের কণ্ঠ বিলীন হয়ে যাওয়ার পর বিচারের দাবিও মরে যাবে। তারা ভুল ভেবেছিলেন। জাতি এখন আবার ১৯৭১ এর গণহত্যার বিচারের দাবিতে ঐক্যবদ্ধ। যে অতীতকে অনেকে পাশ কাটাতে চেয়েছে, সেই অতীত আবার বড় শক্তি নিয়ে ফিরে এসেছে।
অতীতের সঙ্গে বর্তমানে বোঝাপড়া এখনও বাকি আছে বাংলাদেশের। নইলে ১৯৭১ প্রশ্নে যে উত্তেজনা ও সংঘাতের ফাটল রয়েছে অন্য কোনো সময় তা আরো বিস্তৃত হতে পারে। একাত্তরের ত এতই গভীর যে সুবিচার ছাড়া তা সহসা শুকাবার নয়। নির্যাতিত ও তিগ্রস্থদের মনে করিয়ে দিতে হবে যে, তাদের যন্ত্রণা অন্যরাও বোধ করে এবং অন্যরাও তার অংশীদার। এ বিষয়ে যাবতীয় কার্যকলাপ তাদের ল্য করে এবং তাদের কেন্দ্র করেই হওয়া উচিত।
একাত্তরের অপরাধের বিচার ছাড়া কোনো প্রতিকারই যথেষ্ঠ নয়। সংঘাত-পরবর্তী সমাজে শান্তি আসার একমাত্র শর্তই হলো বিচার। সরকার যদি একটি গণতান্ত্রিক, শান্তিপূর্ণ ও উন্নত বাংলাদেশ চায় তাহলে তাদের অবশ্যই দায়িত্ব এড়ানোর পথ পরিহার করতে হবে। তাদের উচিত অতীতের দায় মেটানো। নচেত সকল উদ্যোগই বিভ্রম বলে গণ্য হবে।
সারা দুনিয়ার অভিজ্ঞতা আমাদের বলছে, বিচারই উত্তম সান্তনা এবং বলছে যে, বিচার ছাড়া শান্তি হয় না।
মন্তব্য
প্রকাশিত লিখা ফারুক ওয়াসিফের নিজের নয়, কিন্তু ফারুক ওয়াসিফের ব্লগে
প্রকাশিত বলে কী ধরে নেয়া যায় এটাই ফারুক ওয়াসিফের মতামতের প্রতিফলন?
'''''''''''
তৃপ্তি আমার অতৃপ্তি মোর
মুক্তি আমার বন্ধনডোর
'''''''''''
তৃপ্তি আমার অতৃপ্তি মোর
মুক্তি আমার বন্ধনডোর
প্রতিফলন যতটা মূলকে বহন করে এটা ততটাই প্রতিফলন। এ লেখার ফোকাস যুদ্ধাপরাধের বিচারের আইনগত দিকের ওপর। এ বিষয়ে আমি বিশেষজ্ঞ নই, ফলে মনের মাধুরী বা মেজাজের বিষ গ্যালন গ্যালন ঢেলেও আমি এর সুরাহা করতে পারবো না। আমাকে নির্ভর করতে হবে বিশেষজ্ঞদের ওপর। খেয়াল করেছেন, বিশ্বে হলোকস্ট বিশেষজ্ঞ হাজার হাজার। কিন্তু বাংলাদেশের গণহত্যা ও যুদ্ধাপরাধ বিশেষজ্ঞ হিসেবে কেউ সার্বক্ষণিক কাজ করে যাচ্ছেন, এমন দেখি না।
আসলে আমি এক অর্থে নিজের অবস্থান নির্মাণ প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে আগের ও এ লেখাটা দিয়েছি। আমি খুঁজে খুঁজে ভদ্রলোককে বের করেছি, তারপর অনুরোধ করে এ লেখাটা লিখিয়েছি। এবং ইংরেজি থেকে এটা অনুবাদ করেছি। এতক্ষণ ভদ্রলোকের সঙ্গেই ছিলাম। ঘটনাক্রমে কাকতালীয়ভাবে তিনি বাংলাদেশে এসেছেন। আজ তার বিরাট সাক্ষাতকার নিয়েছি। প্রথম আলোতে এটার প্রকাশ হবে।
আশা করি আগামি কিস্তিতে আমি এ বিষয়ে আমার নিজস্ব কর্মকৌশল জানাতে পারবো। বিচার হতেই হবে, কিন্তু কি প্রক্রিয়ায় এবং কীসের ভিত্তিতে সেটাই হবে আমার বিষয়। আশা করি তখন আপনার মতামত পাব। শুভেচ্ছা।
..............................................................................................................
আঙুল তুলে আমি দেখাই চাঁদ, বন্ধু তুমি চেয়ে থাকলে আমার অসংশোধিত আঙুলেরই দিকে। ওদিকে চাঁদ যে ডুবে যায়।
হাঁটাপথে আমরা এসেছি তোমার কিনারে। হে সভ্যতা! আমরা সাতভাই হাঁটার নীচে চোখ ফেলে ফেলে খুঁজতে এসেছি চম্পাকে। মাতৃকাচিহ্ন কপালে নিয়ে আমরা এসেছি এই বিপাকে_পরিণামে।
ধন্যবাদ।
@@@@@@@@@@@@@@@@@@@@@@@@
যে জন বঙ্গেতে জন্মি হিংসে বঙ্গ বাণী
সে জন কাহার জন্ম নির্ণয় ন জানি।।
যে জন বঙ্গেতে জন্মি হিংসে বঙ্গ বাণী
সে জন কাহার জন্ম নির্ণয় ন জানি।।
ধন্যবাদ, আবু রেজা ভাই।
................................
আঙুল তুলে আমি দেখাই চাঁদ, বন্ধু তুমি চেয়ে থাকলে আমার অসংশোধিত আঙুলেরই দিকে। ওদিকে চাঁদ যে ডুবে যায়।
হাঁটাপথে আমরা এসেছি তোমার কিনারে। হে সভ্যতা! আমরা সাতভাই হাঁটার নীচে চোখ ফেলে ফেলে খুঁজতে এসেছি চম্পাকে। মাতৃকাচিহ্ন কপালে নিয়ে আমরা এসেছি এই বিপাকে_পরিণামে।
আর বিচার..........
প্রাসংগিক হইতে পারেঃ
http://www.somewhereinblog.net/blog/mishulaw/28932431
ফারুক ভাই
লেখা টা ইনফরমেটিভ। ভাল লাগল। আমাকে চিনতে পারছেন? মনে হয় না ...
নতুন মন্তব্য করুন