ঢাকাই চলচ্চিত্রের টিকে থাকার লড়াই-১

ফিরোজ জামান চৌধুরী এর ছবি
লিখেছেন ফিরোজ জামান চৌধুরী [অতিথি] (তারিখ: শনি, ২২/০৮/২০০৯ - ৮:১৬অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

এক দশকেরও বেশি সময় ধরে আমাদের চলচ্চিত্রশিল্প গভীর সংকটের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। ব্যবসা ও শৈল্পিক মান, দুই ক্ষেত্রেই এর বেহাল দশা। নানমুখী বাস্তবতায় বিনোদনমাধ্যম হিসেবে বাংলাদেশের চলচ্চিত্র এর উপযোগিতা হারাতে বসেছে। অনেক নির্মাতাই বিচ্ছিন্নভাবে চেষ্টা করে যাচ্ছেন, কিন্তু চলচ্চিত্রের সুবর্ণ সময় ফিরিয়ে আনা যাচ্ছে না। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতসহ সারা বিশ্বেই যেখানে চলচ্চিত্রের জয়জয়কার, সেখানে আমাদের চলচ্চিত্রের দুরবস্থার কারণ খতিয়ে দেখা জরুরি।

সারা দেশে সিনেমা হলগুলোতে ভাঙাগড়ার খেলা চলছে। ঢাকার ঐতিহ্যবাহী গুলিস্তান এবং এলিফেন্ট রোডের মল্লিকা হল ভেঙে বহুতল শপিং সেন্টার হয়েছে। শ্যামলী হল ভেঙে শপিং কমপ্লেক্স নির্মাণের কাজ চলছে। এরপর কোনটি? খবর পেলাম খাগড়াছড়ি ও মেহেরপুর জেলার সবগুলো সিনেমা হল সাম্প্রতিক কালে বন্ধ হয়ে গেছে। বাংলাদেশ চলচ্চিত্র প্রদর্শক সমিতির ২০০৮ সালের হিসাব অনুযায়ী, মাত্র তিন বছরে চার শতাধিক সিনেমা হল বন্ধ হয়ে গেছে; বারো শ সিনেমা হল কমে এখন হয়েছে নয় শর মতো।

১৯৫৬ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত আবদুল জব্বার খানের মুখ ও মুখোশ ছবির মাধ্যমে ঢাকাই চলচ্চিত্রের যাত্রা শুরু। কিন্তু গত অর্ধশতাব্দীতেও ঢাকাই চলচ্চিত্র একটি মানসম্মত অবস্থানে পৌঁছাতে পারেনি। ব্যবসা হিসেবেও চলচ্চিত্রশিল্প তার মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়াতে পারেনি। `স্বাধীন পাকিস্তানের' পরাধীন সময় আর স্বাধীন বাংলাদেশের অস্থির সময়ে চলচ্চিত্রশিল্প কোনো দিকনির্দেশনা খুঁজে পেল না। যেকোনো শিল্পের বিকাশের জন্য ৫০ বছর খুব কম সময় নয়! সারা পৃথিবীতেই চলচ্চিত্র লাভজনক ও মানসম্পন্ন শিল্পমাধ্যম হিসেবে স্বীকৃত। তাহলে আমাদের দেশের গলদটা কোথায়? মেধাবী পরিচালকের অভাব, বিনিয়োগকারীর অভাব, নাকি ভালো ছবির দর্শকের অভাব? এসব তো প্রাচীন ও বহুল প্রচলিত বিতর্ক। কে না জানে, ভালো ছবির জন্য চাই দর্শক, আর ভালো দর্শক সৃষ্টির জন্য চাই ভালো ছবি- দুটোরই প্রয়োজন যুগপৎভাবে।

মধ্যবিত্ত দর্শকদের আমরা সিনেমা হলে টানতে পারছি না কেন? মূল সমস্যাটা কোথায়? আজ এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজে বের করা খুবই জরুরি। বিশিষ্ট চলচ্চিত্র নির্মাতা শেখ নিয়ামত আলী বলেছিলেন, `দেশে ভালো দর্শক তৈরি হয়নি, এ দায় থেকে আমরা পরিচালকেরা মুক্ত হতে পারি না' [ফিরোজ জামান চৌধুরীর সঙ্গে সাক্ষাৎকার, ভোরের কাগজ, ১৪ মে ১৯৯৯]। নিয়ামত আলীর এ বক্তব্য এখনো প্রাসঙ্গিক এবং তা অবশ্যই গুরুত্ব সহকারে বিবেচনার দাবি রাখে। ভালো ছবি তৈরি হলে যে দর্শকের অভাব হয় না, এর অনেক প্রমাণ রয়েছে। সত্তর-আশির দশকে প্রচুর ভালো ছবি হয়েছে।

খুব বেশি আগের কথা নয়, আমাদের টাটকা অভিজ্ঞতার মধ্যেই রয়েছে, নব্বইয়ের দশকের শুরুতে সালমান শাহ অভিনীত ছবিগুলো দেখতে সিনেমা হলে হুমড়ি খেয়ে পড়ত কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ছেলেমেয়েরা। ওই সময়ের শিক্ষার্থী-প্রজন্মের এমন কাউকে খুঁজে পাওয়া দুষ্কর, যিনি কেয়ামত থেকে কেয়ামত, অন্তরে অন্তরে, স্বপ্নের ঠিকানা ছবিগুলোর একটিও দেখেননি। গ্রামগঞ্জেও এসব ছবি দারুণ ব্যবসা করেছিল। ওই সময় বিনোদনমূলক অসংখ্য বাংলা ছবি তৈরি হয়েছে। সালমান শাহ'র মৃত্যুর পর সুস্থ বিনোদনমূলক চলচ্চিত্র নির্মাণে ভাটা পড়ে। এরপর দ্রুতই নির্মাতাদের দৃষ্টি বদলে যায়। তৈরি হতে থাকে অশ্লীলতার মিশেল দেওয়া চলচ্চিত্র। এ ধারার অল্প কিছু ছবি খুব ভালো ব্যবসা করলেও বেশির ভাগই ব্যর্থ হয়। বাংলাদেশের পুরুষতান্ত্রিক সামাজিক বাস্তবতায় নারী-দর্শকেরা সিনেমা হলে গিয়ে বিব্রতকর অবস্থায় পড়েন। এ পরিস্থিতিতে তাঁরা সম্পূর্ণভাবে সিনেমা হল থেকে মুখ ফিরিয়ে নেন। এরপর এক দশক ধরে নির্মল বিনোদনমূলক ছবি নির্মাণের চেষ্টা করে যাচ্ছেন অনেক পরিচালকই। কিন্তু কিছুতেই দর্শকদের আর হলমুখী করা যায়নি।

মধ্যবিত্ত দর্শক শেষ কত বছর আগে সিনেমা হলে গিয়েছিল তা খুঁজতে হয়-আমাদের চলচ্চিত্রের জন্য এর চেয়ে গ্লানির আর কী হতে পারে। চলচ্চিত্রশিল্পের এই আকালের সময়ে সম্প্রতি আমরা একটি ব্যতিক্রমী ঘটনার মুখোমুখি হয়েছি। মধ্য ফেব্রুয়ারিতে মুক্তি পাওয়া গিয়াসউদ্দিন সেলিম পরিচালিত মনপুরা ছবিটি দারুণভাবে দর্শকনন্দিত হয়েছে। সারা দেশে ৪৮-৫০টি হলে ছবিটি চলেছে একটানা তিন মাসেরও বেশি সময় ধরে। এর আগে বাসু চ্যাটার্জি পরিচালিত 'হঠাৎ বৃষ্টি' দেখতে মধ্যবিত্ত দর্শকেরা সিনেমা হলে ভিড় জমিয়েছিল। পরবর্তী সময়ে অনেক ভালো ছবি নির্মাণের চেষ্টা হয়েছে। কিন্তু কোনোটাই হলভর্তি দর্শক টানতে পারেনি। চলচ্চিত্র যেহেতু ব্যবসাও বটে; তাই তাকে টিকে থাকতে হবে লাভজনকভাবেই। আমাদের চলচ্চিত্রের প্রধান লড়াই এখন টিকে থাকার লড়াই।

ঢাকাই বাংলা ছবি এ রকম গভীর সংকটে পড়েছিল আমাদের চলচ্চিত্রশিল্পের বিকাশের শুরুতেই। ষাটের দশকে একের পর এক বাংলা চলচ্চিত্র ব্যর্থ হতে থাকে। নির্মাতারা ঝুঁকে পড়েন উর্দু ছবি নির্মাণের দিকে। ১৯৬২ সালে ১৬টি নির্মাণাধীন ছবির মধ্যে ১৩টিই ছিল উর্দু ছবি। জহির রায়হানের উর্দু ছবি সঙ্গম-এর সাফল্য এ প্রবণতাকে আরও বাড়িয়ে দেয়। এর পরই বিশাল এক পালাবদলের ঘটনা ঘটে তৎকালীন ঢাকাই চলচ্চিত্রে। সালাউদ্দিন পরিচালিত রূপবান (১৯৬৫) ঢাকার চলচ্চিত্রকে নতুন পথের দিশা দেয়। `রূপবান ছবির কাহিনীর অবাস্তবতা ও নির্মাণনৈপুণ্যের দুর্বলতা বা চিত্রায়ণের কৌশলগত ত্র“টি ঢাকা পড়ে যায় ছবিটির ব্যাপক জনপ্রিয়তার জন্য। এই জনপ্রিয়তার প্রধান কারণ ছিল ছবির গল্প ও গান। রূপবান ঢাকার চলচ্চিত্রকে নিশ্চিত ভরাডুবির হাত থেকে রা করে।' [বাংলাদেশের চলচ্চিত্র শিল্প, মির্জা তারেকুল কাদের, ১৯৯৩]।

সাম্প্রতিক সময়ের মনপুরা ছবির সাফল্যের পেছনে দৃষ্টি দিলে দেখা যায়, এখানেও কাজ করেছে ছবির গল্প ও গান। বাড়তি পাওয়া ছিল দৃষ্টিনন্দন ফটোগ্রাফি ও চমৎকার নির্মাণশৈলী। মনপুরা ব্যবসাসফল চলচ্চিত্র হিসেবে উতরে গেছে ঠিকই, কিন্তু ভবিষ্যতে সুস্থ চলচ্চিত্রের এ ধারা আদৌ বজায় থাকবে কি? মনপুরার ক্ষীণ স্রোত আমাদের চলচ্চিত্রশিল্পকে আমূল বদলে দেবে এমন আশা করা বাতুলতা। তবু এ কথা বলতে দ্বিধা নেই, মনপুরার মাধ্যমে আমাদের সামনে একটি সুযোগ ও সম্ভাবনা এসেছে। মধ্যবিত্ত দর্শক সিনেমা হলে ফিরেছে। এদের ধরে রাখার দায়িত্ব নির্মাতাদের। সুস্থ চলচ্চিত্রের বিকাশে ব্যবসায়ীদের বিনিয়োগের এখনই অনুকূল সময়।

ঢাকাই চলচ্চিত্রে টিকে থাকার লড়াইয়ে শামিল ইতিবাচক একটি প্রবণতা সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। এফডিসিকেন্দ্রিক চলচ্চিত্র নির্মাণের পাশাপাশি স্যাটেলাইট টিভি চ্যানেলনির্ভর কয়েকটি প্রতিষ্ঠান চলচ্চিত্র নির্মাণে অর্থ বিনিয়োগ করছে। এর মধ্যে ইমপ্রেস টেলিফিল্মের নাম উল্লেখযোগ্য। সংস্থাটি ইতিমধ্যে অনেকগুলো ভালো চলচ্চিত্র নির্মাণ করে প্রশংসা কুড়িয়েছে। তবে এ উদ্যোগের প্রধান দুর্বলতা হচ্ছে, এর মূল টার্গেট অডিয়েন্স হচ্ছে টিভি-দর্শক। ঈদে বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে প্রথম প্রদর্শনীর মাধ্যমে লগ্নিকৃত টাকার সিংহভাগ তুলে আনাই এ বিনিয়োগের মূল লক্ষ্য। টিভিতে প্রদর্শনের পর সেই ছবি হলে গিয়ে দেখার ব্যাপারে দর্শকদের আর তেমন একটা আগ্রহ দেখা যায় না। ফলে এ উদ্যোগ `টেলিছবি'র বৃত্ত ভাঙতে পারেনি। এ ধরনের উদ্যোগ চলচ্চিত্রশিল্পের সত্যিকার বিকাশে কতটা সহায়ক, এ নিয়েও রয়েছে মতভেদ। এ কথা তো সবাই মানবেন যে চলচ্চিত্রশিল্পকে মূল ধারাতেই টিকে থাকতে হবে এবং তা অবশ্যই সিনেমা হলকেন্দ্রিক। চলচ্চিত্রকে ড্রয়িং রুমে এনে চলচ্চিত্রের মুক্তি মিলবে না।


মন্তব্য

হিমু এর ছবি

যে টেলিফিল্মগুলি নির্মিত হয়, সেগুলি কি হলে একেবারেই চলে না?



হাঁটুপানির জলদস্যু আলো দিয়ে লিখি

ফিরোজ জামান চৌধুরী এর ছবি

ধন্যবাদ হিমু।
টেলিফিল্মগুলি হলে মুক্তি পায় ঠিকই, কিন্তু সেগুলি মোটেও চলে না। কারণ এগুলো টেলিভিশনে আগেই দর্শকরা দেখে ফেলে।

ঝিনুক নীরবে সহো, নীরবে সয়ে যাও
ঝিনুক নীরবে সহো, মুখ বুঁজে মুক্তো ফলাও।

রেনেসাঁ [অতিথি] এর ছবি

thanks for ur nice write up. তবে কোথায় যেন ঘাড়তি থেকে গেল। আর একটু হলে ভালো হত।

ফিরোজ জামান চৌধুরী এর ছবি

ধন্যবাদ রেনেসাঁ।

ঝিনুক নীরবে সহো, নীরবে সয়ে যাও
ঝিনুক নীরবে সহো, মুখ বুঁজে মুক্তো ফলাও।

আহমেদুর রশীদ এর ছবি

পথেবসা প্রযোজকদের নিয়ে একটা লেখা দেন।

---------------------------------------------------------

ঘাস তুমি ঘাসের মতো থাকো মাটি ছুঁয়ে
যে দেখার সে নতজানু হয়ে ছুঁবে তোমার আঙুল
অবরুদ্ধ মাঠ থেকে তুমি লাফিয়ে নেমোনা প্লিজ পাথরের পথে

---------------------------------------------------------

ঘাস তুমি ঘাসের মতো থাকো মাটি ছুঁয়ে
যে দেখার সে নতজানু হয়ে ছুঁবে তোমার আঙুল
অবরুদ্ধ মাঠ থেকে তুমি লাফিয়ে নেমোনা প্লিজ পাথরের পথে
________________________________________
http://ahmedurrashid.

ফিরোজ জামান চৌধুরী এর ছবি

ধন্যবাদ রশীদ।
পথে বসা প্রযোজকদের একটা তালিকা দেন। দেখি কী করা যায়!!!!

ঝিনুক নীরবে সহো, নীরবে সয়ে যাও
ঝিনুক নীরবে সহো, মুখ বুঁজে মুক্তো ফলাও।

মুস্তাফিজ এর ছবি

ঢাকার চলচিত্র কখনও ঠিকমত দাঁড়াতেই পারেনি, টিকে থাকার প্রশ্নতো আরো পরের কথা।

...........................
Every Picture Tells a Story

ফিরোজ জামান চৌধুরী এর ছবি

ওয়াকওভার তো দেওয়া যায় না।
কী করতে হবে, কিছু একটা বলেন মোস্তাফিজ।

ঝিনুক নীরবে সহো, নীরবে সয়ে যাও
ঝিনুক নীরবে সহো, মুখ বুঁজে মুক্তো ফলাও।

হাসিব এর ছবি

পোস্ট মোটাদাগে ঠিকাছে মনে হৈলো । তবে একটা বিষয় ছাড়া । আপনার বক্তব্য পৈড়া আমার কাছে এইটা মনে হৈছে যে সালমান শাহের মরার আগ পর্যন্ত সিনেমায় সত্যযুগ চলতেছিলো । কারন তখন "ছবিগুলো দেখতে সিনেমা হলে হুমড়ি খেয়ে পড়ত কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ছেলেমেয়েরা" । কেয়ামত থেকে কেয়ামত আমি যদ্দুর জানি সালমান শাহের সবচেয়ে হিট সিনেমা । প্রচুর লোক দেখতে গেছে । ব্যবসা সফল হৈছে । এবং এই থিকা আমাগো প্রযোজকগো মনে দৃঢ় ধারনা হৈছে যে নকলবাজিই সিনেমায় সাফল্য লাভের মূল উপায় । বর্তমানে ঢাকাই সিনেমার নামে যা চলে সেইগুলা ঐ ধারনাগুলারই একটা ধারাবাহিকতার পরিণতি । অতএব ব্যবসা সফল হৈছে, প্রচুর পুলাপান সেইটা দেখতে গেছে এইটা সিনেমা শিল্পের রূপ কি হওয়া উচিত সেই বিষয়ে ভালো ইন্ডিকেটর না ।

ফিরোজ জামান চৌধুরী এর ছবি

এটা একটা বিচ্ছিন্ন উদাহরণ মাত্র।
আপনার মতামতের জন্য ধন্যবাদ হাসিব।

ঝিনুক নীরবে সহো, নীরবে সয়ে যাও
ঝিনুক নীরবে সহো, মুখ বুঁজে মুক্তো ফলাও।

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

আমাকে সিনেমার মুর্খ দর্শক বলা যেতে পারে। তবে আমি এটুকু বুঝি এটা এমন একটা মাধ্যম যেখানে শিল্পের (সাহিত্যেরও) সব শাখার সম্মিলিত ব্যবহার হয়েছে। তারসাথে যুক্ত হয়েছে উচ্চ কারিগরী বিষয়। এমন একটা জটিল ও উঁচুদরের বিষয় আমাদের দেশে প্রায় ষাট বৎসর ধরে চলছে কোন প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছাড়া। চিত্রগ্রহন, আলোকসম্পাত, শব্দ, সম্পাদনা, চিত্রনাট্য, সেট নির্মান এমনও হাজারোটা বিষয় এমনকি পরিবেশনা বা প্রদর্শন পর্যন্ত এখনো পর্যন্ত এখানে গুরুমুখী বিদ্যা হিসেবে রয়ে গেছে। অশিক্ষিত গুরু তার শিষ্যের মধ্য দিয়ে অশিক্ষাকেই প্রবাহিত করতে পারে। টেলিভিশন, ঘরে বসে ভিডিও দেখা বা স্যাটেলাইট টিভি দেখা দুনিয়ার সব দেশেই আছে কিন্তু তাই বলে তাদের সবার সিনেমার অবস্থা এমন হাল হয়নি। চলচিত্র সংশ্লিষ্ট প্রতিটি বিষয়ে শিক্ষিত, মেধাবী, আন্তরিক ব্যক্তিদের পদচারণা সম্ভব করা না গেলে এই শিল্পটি স্বাভাবিক মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাবে।

অফটপিকঃ সচল ফিরোজ জামান চৌধুরীর সাথে প্রখ্যাত সাংবাদিক আহমেদ জামান চৌধুরীর কোন সম্পর্ক আছে কি? এই প্রশ্নটির উত্তর ইচ্ছে হলে দিতে পারেন।



তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

ফিরোজ জামান চৌধুরী এর ছবি

'চলচিত্র সংশ্লিষ্ট প্রতিটি বিষয়ে শিক্ষিত, মেধাবী, আন্তরিক ব্যক্তিদের পদচারণা সম্ভব করা না গেলে এই শিল্পটি স্বাভাবিক মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাবে।'

ষষ্ঠ পাণ্ডব, আপনার এই মন্তব্যের সঙ্গে আমি সম্পূর্ণ একমত।

ঝিনুক নীরবে সহো, নীরবে সয়ে যাও
ঝিনুক নীরবে সহো, মুখ বুঁজে মুক্তো ফলাও।

সৈয়দ নজরুল ইসলাম দেলগীর এর ছবি

১.
বাংলা সিনেমায় বড় সঙ্কটটা তৈরি হয় যখন ভালো সহকারী পরিচালক পাওয়া যায় না, তখন থেকে।
একটা সময় শিক্ষিত রুচিবান চলচ্চিত্রবোদ্ধারা এফডিসির এসব পরিচালকদেরকে নাক সিটকানো শুরু করেন। আর এফডিসির বাইরে নায়ক হতে প্রত্যাশিতরা প্রোডাকশন বয় থেকে ধাপ বেয়ে বেয়ে একসময় ৪র্থ সহকারী, এভাবে এভাবে সহকারী পরিচালক হয়ে যায়।
এবং একসময় পরিচালক হয়ে যায়। এখন এফডিসি কেন্দ্রীক চলচ্চিত্র পরিচালকদের বড় একটা গ্রুপ এই তরিকায় এসেছে। যারাই মূলত নেতৃত্ব দিচ্ছে কম পয়সায় অশ্লীল চলচ্চিত্র তৈরি করে প্রডিউসারকে খুশি (আর্থিক জৈবিক উভয় ক্ষেত্রেই)। আর এদের প্রভাবেই পুরনো পরিচালকরাও বাধ্য হয়েই অনেকে কিছুটা এপথে এলেন (সোহেল রানার ছবিও সেন্সরে আটকায়)। আর অনেক পুরনো পরিচালক পথ ছেড়ে সরে দাঁড়ান।

এভাবে এভাবে সুস্থ রুচির সিনেমা চিন্তকরা দেখলেন চলচ্চিত্রের মতো একটা বিশাল মাধ্যম পুরোটাই তাদের হাতছাড়া হয়ে গেছে।

২.
দর্শকের দোষ কী? বারোশো হল থাকা না থাকা সমান। শহরের কয়েকটা ভালো হল ছাড়া বাকী সবগুলো হলই আসলে গুদামঘর। গরম ঘাম বাদ দিলাম, সেই স্ক্রিণে তো ছবিই দেখা যায় না। সাদা সাদা ঝাপসা কিছু একটা দেইখা আর অডিও শুইনা দর্শকেরা আন্দাজ কইরা নেয় যে মান্না এখন ভিলেনরে ঘুষি দিতেছে। এই হলগুলার পাশাপাশি অন্তত প্রতিটা জেলা শহরে, নিদেন পক্ষে প্রতিটা বিভাগীয় শহরে ভালো একটা সিনেমা হল বা সিনেপ্লেক্স থাকতে পারতো। সিনেপ্লেক্সে কিন্তু দর্শক যায়। ভালো সিনেমা নাই, তবু যায়, দুইশ টাকা টিকেট কাইট্যা যাইতেছে মধ্যবিত্ত দর্শকরা।
আর আমরা যারা বড় বড় কথা কই তারা ভালো ছবি হইলেও কতবার হলে যাই? চান্স পেলে প্রিমিয়ার শোতে মাগনা দেখে আসি বা ডিভিডি কিনে ঘরে দেখি।
কিন্তু যারা সিনেমার খাঁটি দর্শক, তারা ছবি দেখে। এক ছবি বার বার দেখে। প্রতিটা ডায়লগ তাদের মুখস্ত থাকে। তারা নিবেদিত দর্শক।
প্রযোজক পরিচালক অবশ্যই তাদের জন্যই ছবি বানাবে। আমাদের মতো মৌসুমী দর্শকের জন্য বানাবে না। এইটাই সত্য।

৩.
সার্বিক অবস্থা বিবেচনায় প্রযোজকদের দায় কই?

৪.
স্যাটেলাইট চ্যানেলগুলার সিনেমা বাণিজ্য নিয়া খুব ভালো কিছু বলার মতো নাই। তারা চায় খুব কম টাকায় একটা সিনেমা বানাইতে। যে ছবি টিভিতে দেখায়া বিজ্ঞাপন বাবদ টাকা কামাবে আর বিদেশে অজানা অখ্যাত সব পুরষ্কার জিতে, সেইটারেই দেশের মিডিয়ায় ছোটদের অস্কার বইলা প্রচার করবে। চ্যানেল আই এখন এই পথেই সিনেমার সমুদ্র বানায়ে ফেলতেছে। টিভি মিডিয়ার পরিচালক, চলচ্চিত্র সংসদ কর্মী শেষ করে এখন তারা এফডিসির পরিচালকদের দিয়েও একই কায়দায় ছবি বানাচ্ছে। এফডিসি এখন চ্যানেল আইয়ের কথায় উঠে বসে।
এনটিভি কয়টা বানাইছিলো। ব্যাবসায় ধরা খেয়ে বসে গেছে। একমাত্র এটিএন বাংলাই (মাল্টিমিডিয়া প্রোডাকশন) পুরোদমে বাণিজ্যিক ছবি বানায়। তবে সংখ্যায় কম।

৫.
এফডিসিওয়ালাদের আর বাণিজ্যিক ছবির দিকে নাক সিটকাইয়া সুস্থ বা বিকল্প ধারার চলচ্চিত্র নির্মাতারা সিনেমা বানানো শুরু কইরা বেশ একটা কাণ্ড করতেছেন। ছবি বানাইতে পারার চেয়ে বড় বড় কথা বলতে ওস্তাদ তারা। প্রতিটা ছবিই বানায় যেন এইটা দিয়াই অস্কার পাইতে হইবো। জীবন পণ করে বানায়। এসব ছবি না পুরষ্কারের যোগ্য হয় না হয় দর্শকযোগ্য। গত কয় বছরে কম ছবি কিন্তু হয় নাই। সংখ্যা বিচারে অনেক। কয়টা বলার মতো সিনেমা হইছে?

৬.
আরো একটা বড় সমস্যা এদেশে ফিল্ম ইন্সটিটিউট নাই কোনো। শেখার কোনো সুযোগ নাই। একদল এফডিসিতে থাকতে থাকতে শেখে। আরেকদল গঁদার ফেলিনি দেখে আর বই পুস্তক পড়ে আর আড্ডা মেরে মেরে শেখে। দুই দলই চরমপন্থী হয়ে যায়।
বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে নাট্যতত্ত্ব পড়ানো হয়, ফিল্ম পড়াইলে ক্ষতি কী?

কয়েকটা বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানো হচ্ছে ইদানীং। কিন্তু এইটা তৈরি করতেছে আরো বড় সমস্যা। এদের শেখানোর মান খুব একটা উন্নত না। এখান থেকে পাশ করে যারা বের হচ্ছে তাদের হাতে কলমে জ্ঞান খুবই সীমিত। এই জ্ঞান নিয়া কাজ করা দুষ্কর। কিন্তু এরাই এখন জোর কণ্ঠে বলতেছে একমাত্র তারাই সিনেমা বুঝে আর কেউ বুঝে না (সেদিন কোন এক টিভিতে তাদের একজনরে বলতে শুনলাম) । বোঝেন এইবার অবস্থা।

৭.
চলচ্চিত্র সংসদগুলো একসময় অনেক ভালো ভালো কিছু তরুণ তৈরি করে দিয়েছিলো। এখন সেগুলোরও করুণ দশা। চলচ্চিত্রম, রেইনবো, জহির রায়হান প্রভৃতি চলচ্চিত্র সংসদগুলো এখন অনেকটা চুপ মেরে গেছে। তারপর সব শূণ্যতা। মোহাম্মদ খসরু অভিমান করে গ্রামে চলে গেছেন বহু বছর হলো। এমনকী সেই ৬২ সাল থেকে সংগ্রহ করা চলচ্চিত্র সম্পর্কিত বই আর সিনেমাগুলোও নিয়ে গেছেন। হায়রে অভিমান...

৮.
পুনেতে আগে বাংলাদেশ থেকে ছাত্র নেওয়া হতো। শেষ বোধহয় গেছিলেন নূরুল আলম আতিক... এরপরে আর কাউরে যেতে দেখিনি। সেটা এখন বন্ধ কী না তাও জানি না। খোঁজ নিতে হবে।
তবে যারা এখনো পর্যন্ত পুনেতে গেছেন পড়তে। তাদের অধিকাংশই কোর্স শেষ না করেই ফিরে এসেছেন অথবা বহিষ্কৃত হয়েছেন। যেখানে পুরো ভারত থেকে পুনেতে বছরে চান্স পায় ৮ জন। (এখন বোধহয় বাড়ছে সংখ্যাটা, আমি বেশ কবছর আগের কথা বলতেছি, সঞ্জয় লীলা বানসালীর আমলের কথা)। আর আমরা সেই সুযোগ হেলায় হারাই।
পুনেতে এখনো বাংলাদেশের একজন ছাত্রর নাম নাকি কিংবদন্তীর মতো প্রচারিত। ভারত থেকে পুনে পাশ করা যতোজনই দেশে বেড়াতে আসছে তাদের অনেকের কাছ থেকেই শুনেছি মিলন ভাইয়ের নাম। এই লোকও ৮০'র দশকে কিছু ভালো কাজ করছিলো (তথ্যগুলো মনে নাই)। তারপর ডুব মেরে বসে আছে। পল্টনে একটা স্টুডিও দিছিলো। বছর পাঁচেক আগে একবার গেছিলাম সেই স্টুডিওতে আরেক পুনে ফেরত ভারতীয়র উৎসাহে দেখা করতে। তারপর থেকে আর খোঁজ জানি না।

সর্বশেষ...
আরো কী কী যেন বলতে চাইছিলাম। ভুলে গেছি। টায়ার্ড লাগতেছে...
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

শঙ্খ এর ছবি

পুণে তে নতুন করে বাংলাদেশী ছাত্র নেবার বেপারে চেষ্টা করা হচ্ছে...আশা করা যায়।।এ বছরে নতুন কেঊ সেখানে গেছেন...আপনার মন্তব্য ভালো লেগেছে...

ফিরোজ জামান চৌধুরী এর ছবি

ধন্যবাদ শঙ্খ।

ঝিনুক নীরবে সহো, নীরবে সয়ে যাও
ঝিনুক নীরবে সহো, মুখ বুঁজে মুক্তো ফলাও।

ফিরোজ জামান চৌধুরী এর ছবি

ধন্যবাদ নজরুল।
আমার পরের লেখায় এসব বিষয় ভাববো।

ঝিনুক নীরবে সহো, নীরবে সয়ে যাও
ঝিনুক নীরবে সহো, মুখ বুঁজে মুক্তো ফলাও।

বাঁশের বাঁশি [অতিথি] এর ছবি

নির্মানের বিষয় যায়ই হোক, এই শিল্পটি এখন নানান ছলাকলায় ছয়লাব হয়ে গেছে। যতসব অযোগ্য আর অদক্ষদের আখড়া আমাদের এফডিসি। অথছ তারা নিজেদের মহা পণ্ডিত না ভেবে থাকতে পারেনা।

ফিরোজ জামান চৌধুরী এর ছবি

ধন্যবাদ বাঁশ
অথবা, ধন্যবাদ বাঁশি।

ঝিনুক নীরবে সহো, নীরবে সয়ে যাও
ঝিনুক নীরবে সহো, মুখ বুঁজে মুক্তো ফলাও।

অতিথি লেখক এর ছবি

ফিরোজ ভাই, দ্বিতীয় পর্ব কই?

মহুয়া

ফিরোজ জামান চৌধুরী এর ছবি

কিছুদিন ধরে খুব ব্যস্ত আছি।
খুব তাড়াতাড়িই দ্বিতীয় পর্ব পোস্ট দেবো।

ঝিনুক নীরবে সহো, নীরবে সয়ে যাও
ঝিনুক নীরবে সহো, মুখ বুঁজে মুক্তো ফলাও।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।