[ড. সিতারা পারভীন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ বিভাগের সাবেক অধ্যাপক; সাবেক রাষ্ট্রপতি বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদের কন্যা।]
আজ ২ সেপ্টেম্বর অধ্যাপক সিতারা পারভীনের জন্মদিন।
যখন 'চারপাশে সব মুখস্থ মানুষ দেখি', ভণ্ডামি আর শঠতায় ভরা সম্পর্ক দেখি, তখনই মনে পড়ে সিতারা আপার কথা। আজকের সমাজে ক্ষমতার মোহ আর ক্ষমতার অপপ্রয়োগ যখন সমাজকে কলুষিত করে চলেছে, তখন সিতারা পারভীন অনুকরণীয় ব্যক্তিত্ব হয়ে দেখা দেন। আয়নার পারদে যেন নিজেকে শুধাই, আমরা- একালের প্রজন্ম কি তাঁর মতো জীবনের কথা বলতে পারব? তাঁর মতো সরল ও সত্য-সাহসে দাঁড়াতে পারব যেকোনো পরিস্থিতির মুখোমুখি?
রবীন্দ্রনাথ তাঁর পুষ্পাঞ্জলি নিবন্ধে লিখেছেন,'আমাদের প্রিয়জন যখন চলিয়া যায়, তখন আমরা জগৎকে চারি দিকে স্পর্শ করিয়া দেখি, ইহারা সব ছায়া কি-না, মায়া কি-না, ইহারাও এখনই চারি দিক হইতে মিলাইয়া যাইবে কি-না! কিন্তু যখন দেখি ইহারা অটল রহিয়াছে, তখন জগৎকে যেন তুলনায় আরও দ্বিগুণ কঠিন বলিয়া মনে হয়।' সিতারা আপাকে হারিয়ে চার বছর পরও আমাদের ঠিক ওই অবস্থা। সিতারা পারভীন ছিলেন চিরতারুণ্যের প্রতীক। জরা তাঁকে কখনোই স্পর্শ করতে পারে না- হাজারো শিক্ষার্থী আর ভক্তের হৃদয়ে স্থায়ী আসন পাতা রয়েছে তাঁর জন্য।
২.
সিতারা পারভীনের জন্ম ১৯৫৩ সালের ২ সেপ্টেম্বর। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে বিএ (সম্মান) ও এমএ, এবং পুনরায় সাংবাদিকতায় এমএ ডিগ্রি লাভ করেন। তিনি পিএইচডি করেন ইংল্যান্ডের ব্রাডফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। ১৯৮২ সাল থেকে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগে আমৃত্যু অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত ছিলেন। ১৯৯৬ থেকে ১৯৯৯ সাল পর্যন্ত তিনি বিভাগের চেয়ারপারসন হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
অধ্যাপক সিতারা পারভীন সাবেক রাষ্ট্রপতি বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদের জ্যেষ্ঠ কন্যা। তাঁর স্বামী তাঁরই সহকর্মী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক আহাদুজ্জামান মোহাম্মদ আলী। তাঁর একমাত্র সন্তান এষা শ্রাবণী।
২০০৫ সালের ২৩ জুন ড. সিতারা পারভীন- আমাদের প্রিয় সিতারা আপা যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো থেকে ক্যানসাসে যাওয়ার পথে মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হন। তিনি আইডব্লিউপিআরের আমন্ত্রণে একটি সম্মেলনে অংশ নিতে ২০০৫ সালের জুনে যুক্তরাষ্ট্র গিয়েছিলেন।
ড. সিতারা পারভীনের গবেষণার প্রধান ক্ষেত্র ছিল গণমাধ্যম, বিজ্ঞাপন, নারী ও আদিবাসী। আদিবাসীবিষয়ক গবেষণায় তিনি বেছে নিয়েছিলেন মাতৃতান্ত্রিক মান্দি (গারো) সম্প্রদায়কে। বৃহত্তর ময়মনসিংহের মান্দি-অধ্যুষিত মধুপুর, দুর্গাপুর, বিরিশিরিসহ বিভিন্ন অঞ্চলে তিনি দীর্ঘদিন গবেষণার কাজ করেছেন।
৩.
সিতারা পারভীন আমার শিক্ষক ছিলেন, বলা ভালো এখনো আছেন। নিয়মনিষ্ঠ এ মানুষটির কাছে আমি আমার জীবনের অনেক জটিল ধাঁধার সরল সমাধান পেয়েছি। তিনি শুধু বড় মাপের শিকই ছিলেন না, তিনি ছিলেন বড় মনের মানুষও। অল্প পরিচিত কোনো শিক্ষার্থীর ছোট্ট প্রয়োজনেও তিনি এগিয়ে আসতেন। যে-কেউই তাঁর কাছে যেকোনো সমস্যা নিয়ে হাজির হতে পারত। আপা সবার কথা শুনতেন অকাতরে-শিক্ষর্থীরা তাঁর স্বপ্ন ও সম্ভাবনা নিয়ে তাঁর সঙ্গে আলাপ করত। তিনি তাঁর শিক্ষার্থীদের কাছে যেমন প্রিয় ছিলেন, তেমনি প্রিয় ছিলেন তাঁর সহকর্মীদের কাছেও। তাঁর সহকর্মী, এমনকি সাধারণ কর্মচারীরাও তাঁকে আশ্রয়ের ক্ষেত্র মনে করতেন।
সিতারা পারভীন নারী-পুরুষ সাম্যের নীতিতে বিশ্বাসী ছিলেন। তিনি নীরবে নারী-অধিকার বিষয়ে কাজ করে গেছেন। সাংবাদিকতা বিভাগের চেয়ারম্যান থাকাকালে তিনি 'চেয়ারপারসন' শব্দটির প্রয়োগ শুরু করেন, চেষ্টা করেছিলেন নারী-পুরুষ সব শিকের জন্য এ শব্দটির ব্যবহার স্থায়ীভাবে চালু করতে। কিন্তু আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কারণে তিনি শেষ পর্যন্ত এই পরিবর্তন স্থায়ী করতে পারেননি। সাংবাদিকতা বিভাগসহ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন প্রকাশনা বা একাডেমিক কাজে এখনো 'চেয়ারম্যান' শব্দটিই দেখা যায়। এ শব্দটির পরিবর্তন এখন সময়ের দাবি।
আমাদের প্রিয় শিক্ষক, প্রিয় মানুষ সিতারা পারভীনের জন্মদিনে আজ তাঁকে স্মরণ করছি গভীর শ্রদ্ধা, পরম মমতা আর ভালোবাসায়।
মন্তব্য
শ্রদ্ধেয়া সিতারা পারভীনের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা। এষা শ্রাবণী কি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আছেন এখন?
ধন্যবাদ এস এস।
এষা শ্রাবণী নর্থ-সাউথ ইউনিভারসিটি থেকে পাশ করে এখন দেশের বাইরে আছেন।
ঝিনুক নীরবে সহো, নীরবে সয়ে যাও
ঝিনুক নীরবে সহো, মুখ বুঁজে মুক্তো ফলাও।
ইনি মারা গেছেন সেটা জানতামনা। অনেক আগে(ইন্টারে পড়ার সময়) ওনাকে ক্যাম্পাসে দেখেছিলাম। আপা বেশ স্টাইলিশ ছিলেন মনে পড়ে। মামা ডিপার্টমেন্টের আপা বলে পরিচয় করিয়েছিলেন।
ধন্যবাদ প্রকৃতি। আপনার মামা'র পরিচয়টা কি জানতে পারি?
আমার ইমেইলও জানাতে পারেন
ঝিনুক নীরবে সহো, নীরবে সয়ে যাও
ঝিনুক নীরবে সহো, মুখ বুঁজে মুক্তো ফলাও।
সিতারা পারভীনের ছাত্রছাত্রীরা তাঁকে বাঁচিয়ে রাখুন নিজেদের জীবন আর কর্মক্ষেত্রে। গুণীজনের স্মৃতিচারণের মধ্যে দিয়েই যেন দায়িত্ব শেষ না হয়।
ধন্যবাদ হিমু।
ঝিনুক নীরবে সহো, নীরবে সয়ে যাও
ঝিনুক নীরবে সহো, মুখ বুঁজে মুক্তো ফলাও।
যখন 'চারপাশে সব মুখস্থ মানুষ দেখি', ভণ্ডামি আর শঠতায় ভরা সম্পর্ক দেখি, তখনই মনে পড়ে সিতারা আপার কথা। আজকের সমাজে ক্ষমতার মোহ আর ক্ষমতার অপপ্রয়োগ যখন সমাজকে কলুষিত করে চলেছে, তখন সিতারা পারভীন অনুকরণীয় ব্যক্তিত্ব হয়ে দেখা দেন। আয়নার পারদে যেন নিজেকে শুধাই, আমরা- একালের প্রজন্ম কি তাঁর মতো জীবনের কথা বলতে পারব? তাঁর মতো সরল ও সত্য-সাহসে দাঁড়াতে পারব যেকোনো পরিস্থিতির মুখোমুখি?
--সত্যিই ফিরোজ জামান চৌধুরী আমারও একই প্রশ্ন- আমরা তাঁর ছাত্র-ছাত্রীরা কি তাঁর মতো সরল ও সত্য-সাহসে দাঁড়াতে পারব যেকোনো পরিস্থিতির মুখোমুখি?
বিনম্র শ্রদ্ধা তাঁর স্মৃতির প্রতি।
ধন্যবাদ রেনেসাঁ ।
ঝিনুক নীরবে সহো, নীরবে সয়ে যাও
ঝিনুক নীরবে সহো, মুখ বুঁজে মুক্তো ফলাও।
সিতারা পারভানকে আরও বিস্তারিত জানতে পড়তে পারেন
'ভরা থাক স্মৃতিসুধায়'(ড. সিতারা পারভীন স্মারকগ্রন্থ),
সম্পাদনায়: ফিরোজ জামান চৌধুরী, অন্যপ্রকাশ, ফেব্রুয়ারি ২০০৮।
ঝিনুক নীরবে সহো, নীরবে সয়ে যাও
ঝিনুক নীরবে সহো, মুখ বুঁজে মুক্তো ফলাও।
নতুন মন্তব্য করুন