ঢাকা শেরাটন হোটেল। মকবুল সাহেব আজ 'বাংলাদেশের খাদ্য সমস্যা ও তার প্রতিকার' শীর্ষক সেমিনারে তার 'পেপার' উপস্থাপন করবেন।
'কি? মকবুল সাহেবকে চেনেননা? তিনি জাতির গৌরব!'
বাংলাদেশের খাদ্য সমস্যা বিমোচনে তার অবদান অনস্বীকার্য। তার খ্যাতি বিশ্বজোড়া। কি করেননি তিনি - বাংলাদেশের খাদ্য সমস্যার উপর 'টপিক' নিয়ে ডক্টরেট ডিগ্রী লাভ করার পর এ পর্যন্ত তার যে ১৭ খানা বই, শ দুয়েক রিসার্চ পেপার আর অসংখ্য আর্টিকেল তার সবই তো বাংলাদেশের খাদ্য সমস্যা ও তার প্রতিকার নিয়ে লেখা!! একটাও পড়েননি?? আজিবতো!!
তিনি মূলত বাংলাদেশে খাদ্য সমস্যা বিষয়ে কি করিলে কি হইবে, কি করা উচিৎ, কোথায় হাত পাতা দরকার, কিভাবে কি ইত্যাদি ইত্যাদি... ...
তো আজ এই সেমিনারে এসে তার একটু সমস্যা হয়ে গেছে। দুপুরের লাঞ্চ সংক্রান্ত। উনার ইচ্ছেতেই প্যাকেট লাঞ্চ এর অর্ডার দেওয়া হয়েছিল। এর সুবিধা জানেনতো নিশ্চয়ই? বাড়িতে নিয়ে যাওয়া যায়।
যাই হোক এখানে হোটেলওলার কোন দোষ নেই। তার অর্ডার মতই প্যাকেট ভরে সবকিছু দেয়া হয়েছে। আড়াই প্যাকেট সাবড়ানোর পরে কোন এক বিচিত্র কারনে তিনি 'এটা কোন মেনু হল।' 'ফকিরনির খাবার দাবার।' 'বিশ্রী রান্না' 'ডাক তোমার ম্যানেজারকে' ইত্যাদি ইত্যাদি হাঁকডাক শুরু করলেন। এরপর আশেপাশে 'ঘুরঘুর' করতে থাকা 'হোটেলব্যাক্তিত্ব' দের কয়েকবার মৌখিক ধোলাইও দিয়ে ফেললেন।
যাই হোক, তার অবস্থার বর্তমান 'আপডেট' হচ্ছে তিনি নড়াচড়া করতে একটু সমস্যা 'ফিল' করছেন। তার সেক্রেটারী মারফত জানা গেল এরই মধ্যে তিনি একবার টয়লেটে গিয়ে কিছুটা পাতলা হবার পায়তাড়া করেছেন - কিন্তু সদ্য খাওয়া খাবার কি আর এত তাড়াতাড়ি হজম হয়?
অসমর্থিত সুত্র মতে আরো জানা গেল যে, গতকাল রাতেও নাকি তার ঠিকমত খাওয়া হয়নি। ঘুমও কিছুটা কম হয়েছে। সেমিনার পেপার রেডি করা তো আছেই তাছাড়া অন্য চিন্তাও ছিল। এই পেপারের উপর ভিত্তি করে একটা প্রকল্প দাঁড় করিয়ে ডোনার থেকে বড়সড় একটা এ্যামাউন্ট খসিয়ে নেবার একটা সুপ্ত ইচ্ছা রয়েছে তার। সকালে আবার ইচ্ছে করে নাস্তাটাও ঠিকমত করেননি তিনি। কেন করেননি এবার বুঝতে পেরেছেন নিশ্চয়ই?
ঠিক ধরেছেন, দুপুরের লাঞ্চ এর লোভে।
দুইশত জনের মত এ্যারেন্জমেন্ট করা হয়েছিল। সেমিনারে উপস্থিত ছিল দেড়শজনেরও কম। কি দাঁড়াল এর মানে? ডোনারের টাকায় শাহী খানাপিনার বিরাট মওকা।
যাই হোক ... অবশেষে... চারটা করে প্যাকেট অধঃস্থনদের দিলেন। নিজে নিলেন মাত্র গোটা দশেক। খুব সম্ভবতঃ রাতে বউ বাচ্চা নিয়ে ডিনার পার্টি করার প্লানটা রয়েছে তার।
গাড়িতে সেক্রেটারীকে তার প্যাকেটগুলো দিয়ে সামনে বসালেন। 'এই সাবধান খাবার যেন কোনভাবে নষ্ট না হয়!' -কয়েকবার তার সাবধানবানী গলধকরণঃ করে ফেলল সেক্রেটারী। এদিকে তার পেট গুরুগম্ভির সাবধানবানী শোনাচ্ছে। তার নিজের পেটের অবস্থা সত্যিই ভাল মনে হচ্ছে না!
দ্রুত ছুটে চলেছে গাড়ী। হঠাৎ - 'উহ্ গাড়ী থামাও' চিৎকার করে উঠলেন তিনি। সেক্রেটারী পেছনে তাকিয়ে দেখে বস বুকে হাত দিয়ে - তার ভাষায় 'চ্যাগায়া বইসা রইছে'। 'এই গাড়ি থামাও!' সেক্রেটারী ড্রাইভারকে ধমক দিয়ে গাড়ী থামিয়ে ফেলে। তাড়াহুড়া করে সামনে থেকে নেমে যাবার সময় কিছু একটা পড়েও যায়। অতকিছু কি আর দেখার সময় আছে এখন?
বাসায় যাবার পথেই মকবুল সাহেবের বন্ধুর ক্লিনিক। সব দেখে শুনে ডাক্তার বন্ধু রায় দিলেন - 'ফুড পয়জনিং'।
'মকবুল শোন, চিন্তার কিছু নেই।' - ডাক্তার বন্ধু অভয় দেন।- '১৫/২০ মিনিটেই পেট ওয়াশ হয়ে যাবে।'
রাত পৌনে এগারোটার দিকে মকবুল সাহেবের পেট ওয়াশ করতে শুরু করেন ডাক্তার।
এই ফাঁকে চলেন - আর একজন 'মকবূইল্লার' সম্পর্কে কিছু কথা শোনা যাক --
গত দুদিন ঠিকমত খাওয়া জোটেনি মকবুইল্লার। চলতে ফিরতে খুবই কষ্ট হচ্ছে। ইদানীং হোটেলওলারাও বেঁচে যাওয়া খাবার বিক্রি করে দেয়। খাবার জোগার করা কঠিন হয়ে যাচ্ছে। বয়স হয়ে গেছেতো - খুব বেশী হাটতে চলতে পারে না। না খেয়ে থাকার কি যে কষ্ট!!
যে হোটেলে মোটামুটি রেগুলার রাতের খানা জুটত সে হোটেলে আজ মৌখিক প্যাদানি জুটেছে। হোটেলের সামনে দাঁড়াতেই ম্যানেজার 'আসেন আসেন শ্বশুর সাহেব, আপনের জন্যই সবাই বইসা আছি। ওই কইরে আব্বাজানের খানার ব্যবস্থা কর' বলে ভেংচি কাটল। তাড়াতাড়ি সে সরে পড়ল সেখান থেকে।
কোন রকম টলতে টলতে চলতে লাগল মকবুইল্লা। হঠাৎ ক্লান্তিতে ধপ করে বসে পড়ে সে রাস্তায়। আর চলতে পারছে না সে! 'ইয়া আল্লাহ - আমারে উঠায়ে নেও, আমারে উঠায়ে নেও' - দুহাত তুলে স্রষ্টার কাছে ফরিয়াদ জানায় সে।
কি এই মকবুইল্লার কাহিনী ভাল লাগছে না? ভাল নাও লাগতে পারে। আপনারা বড়লোকের কাহিনী শুনতে ভালবাসেন। নাটকে নভেলে যত বড়লোকের কাহিনী দেখেন তত ভাল লাগে। গরীব লোকের কথা কি শুনতে চান কেউ?
আসলে এই মকবুলের অবস্থা কিন্তু একেবারেই খারাপ ছিল না। সিরাজগঞ্জের কাজীপুরে ছিল তার বাড়ী। নদীর পাড়ে অল্প একটু যায়গায় দুই বুড়া বুড়ির বাস করত। খুব বেশী কিছু না থাকলেও অতটা অভাবী সে ছিল না। কিন্তু নদী ভাংগনে ভিটাবাড়ী হারিয়ে ফেলে যখন সে বাঁধের উপর ঠাই নিল তখন অভাব কাকে বলে বুঝতে পারল। অভাবের তাড়নায় বুড়িটাও তাকে একা ফেলে পরপারে চলে গেল।
'খাদ্য নিরাপত্তা' - এই জটিল বাংলা শব্দটা মকবুইল্লার মুখস্থ। কত বার যে কতজনের কাছে শুনছে এই শব্দ। বাপের নাম ভুলে যেতে পারে কিন্তু এই শব্দ সে কোনদিন ভুলবে না। এ শব্দ সে শুনতে শুরু করে যখন তাকে নিয়ে এনজিওর লোকজন টানাটানি শুরু করেছিল। আজ এই মিটিংএ, কাল ঐ অফিসে - তারে নিয়ে সবাই টানাটানি!! একবার একজন বিদেশী তার বিরাট ইন্টারভিউ নিল। কতদিন পরে দেখে কি একটা বইতে তার ছবি!! এরপর তাকে নিয়ে ঢাকায় পর্যন্ত গেল এনজিওর লোকজন। বিরাট মিটিংএ তোতাপাখির মত শিখিয়ে দেওয়া কথা বলেছিল সে। ঐবার দুইদিন ঢাকায় ছিল সে। কি সুন্দর হোটেল - খাওয়া দাওয়া। তবে একটা বিষয়ে সবাই একটু হাসাহাসি করেছিল। ওই এনজিওর বড় সাহেবের নাম আর তার নাম নাকি একই! তার নিজেরও খুব মজা লেগেছিল বিষয়টা শুনে।
ফিরে আসার পর এনজিওর লোকজন আর কোনদিন তার কোন খবর নেয় নাই। শেষ মেষ কোন কুলকিনারা না পেয়ে ভাসতে ভাসতে আবার এই ঢাকা শহরে।
মনে হয় বেশী বক্তৃতা দিয়া ফেলছি তাইনা? যাক এইবার আসল কাজে আসি। আমি আসলে একটা প্যাঁচ লাগাতে চাইছিলাম, এইবার লাগিয়ে দেই---
পরে থাকা প্যাকেটটা দেখে একটু সন্দেহ হল মকবুলের। বোমা টোমা নয়তো? ইদানীং এই সমস্যা শুরু হইছে। দু'একজন এইরকম প্যাকেট হাতড়াতে গিয়ে মরেও গেছে। ভয়ে ভয়ে নাকের কাছে নিতেই খাবারের সুঘ্রান পেল সে। কোন সন্দেহ রইলনা তার। প্যাকেটে খাবারই আছে। তাড়াতাড়ি আশেপাছে তাকিয়ে দেখল কেউ তাকে দেখেছে কিনা। রাস্তা পার হয়ে ওপাশে পার্কে ঢুকল। ল্যামপোস্টের নীচে বসে প্যাকেট খুলল।
পনের বিশ মিনিটের মধ্যেই প্যাকেটের সমস্ত খাবার খেয়ে ফেলল মকবুইল্লা। খাওয়ার পর সে চোখের পানি ধরে রাখতে পারলনা। সাথে সাথে দুহাত তুলে স্রষ্টার দরবারে মোনাজাত করল সে 'হে আল্লাহ্ তুমি সত্যিই রহমানুর রাহিম। তোমার রহমতের কারনে আইজকা পেট ভইরা খাইতে পারলাম।' ঘাড়ের গামছা বিছিয়ে দুরাকাত নফল নামাজও আদায় করে ফেলল সে সাথে সাথে। তারপর আর চোখ মেলে তাকিয়ে থাকতে পারলনা। কাঁধের গামছার জায়নামাজেই ক্লান্তিতে ঢলে পড়ল মকবুইল্লা। মুহুর্তেই গভীর ঘুমে তলিয়ে গেল সে।
তখন ঘড়িতে ঠিক রাত এগারটা।
অবশেষে জোর করেই মকবুইল্যাকে এক প্যাকেট খাইয়ে দিলাম। প্যাকেটটা কোথা থেকে পেল বুঝতে পারলেন কি? ঐ যে গাড়ি থেকে কিছু একটা পড়েছিল খেয়াল আছে? এছাড়া আর কি করতে পারি আমি। মকবুল সাহেবের 'সাগরেদ' হিসেবে আমার আর কিছু করার নেই।
মন্তব্য
প্রথম পাতা পাইল না! বড়ই দুঃখিত হইলাম!!
নতুন মন্তব্য করুন